'না, আফসোস করবো কেন! ভাল মন্দ যাই হোক না কেন সিদ্ধান্তটা আমারই হওয়া উচিত। জীবনটা তো আমার, তাই না?' কাল সন্ধ্যায় বলছিল নীরা। তন্ময়দা তার নতুন বান্ধবী সোমাকে নিয়ে বসেছিল অমাদের উল্টোদিকের বেঞ্চে। নরম সরম পুতুলের মতো মেয়েটা। বার বার ফোনে খবর নিচ্ছিল বাচ্চা খেয়েছে কিনা। টু'তে পড়ে ওর ছেলে। আমাদের সবার হাতে ছিলো চায়ের কাপ। আমি তাকিয়ে ছিলাম নীরার হাতের তালুর দিকে। ঘামছিল। হলুদ আলোয় ওর চোখ পড়া যাচ্ছিল না। অথচ ওর চোখের ভাষাই পড়তে চাইছিলাম তখন।
হাইরাইজ বিল্ডিংগুলোর ছাদ ঢাকা জ্যামিতিক আকাশ, আকাশ থেকে মসৃণ সিল্কের মত গলে পড়া তরল সোনা আলো, ডানে একটা ছয়তলা, সামনে একটা নয়তলা, কোনাকুণি একটা পনেরোতলার ব্যালকনির গ্রিল পেঁচিয়ে সবুজ লতা, বামে একটা খোলা ছাদ, ছাদে সারি সারে টব, দূরে দূরে দশ, বারো, পনেরো তলারা ভীড় করে দাঁড়িয়ে, তারই ফাঁক গলে হালকা শ্বাস ফেলা বাতাস, বাতাসে উড়ছে হালকা নীল ওড়না, পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে নীরা। একটা মন খারাপ করা ছবি, নিঃসঙ্গ, একাকী।
এখানে এসেছি ঘন্টাখানেক হলো। বিকালে বেরিয়েছি দোকান থেকে। তখন পাঁচটা হবে। মনমেজাজ ভাল যাচ্ছে না একদম। বিক্রিবাট্টা খারাপ। নিজের ডিজাইন করা কাপড়গুলা অভিমান নিয়ে তাকায়। আমি পাত্তা দেই না। সবুজকে দোকানে রেখে যখন রাস্তায় নামলাম, সারি সারি গাড়িতে অচল শাহবাগের রাস্তা। হাঁটতে শুরু করলাম। হাঁটতে হাঁটতেই সায়েন্স ল্যাব। রাস্তা পেরিয়ে রিকশা নিলাম। মিনিট বিশেক পর নীরার বাসার সিঁড়ি ভেঙে উঠতে উঠতে ভাবছিলাম এই সাততলা বাড়িতে লিফট দেয়া উচিত ছিল বাড়িওয়ালার।
দরজা খোলাই ছিল। এক কামরার বাসাটা বেশ বড়ই বলতে হবে। নীরা ছিল না। দরজা খোলা রেখে কোথায় গেল ভাবতে ভাবতে বেতের নিচু মোড়াটায় বসলাম। বুকশেলফের সামনে জানালা ঘেঁষে সিঙ্গেল খাট। প্রতিবার এই খাটটার দিকে তাকালেই আমার লালমাটিয়ার বাসার সেই ডাবল খাটটার ছবি চোখে ভেসে ওঠে। ফোর বি, চারতলা, গোলাপী রঙ বিল্ডিঙ। লালমাটিয়ার ওই একবছরের কথা আমি কখনো ভুলেও তুলিনা। যেন স্রেফ হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে ওই একবছর। সেই একটা বছর শুধু আমার সাথেই বোধহয় যোগাযোগ ছিল নীরার। আর সবাই দূরে সরে গেছিল। এমনকি সেঁজুতিও।
আধাঘন্টা হয়ে গেল নীরার কোনো খবর নাই। এভাবে দরজা খোলা রেখে কেউ বাইরে যায়! মেয়েটার হলো কী! পিঠটা টনটন করছে ব্যথায়। দেয়ালে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসলাম। নীরার কালো আলমিরাটা অনেক বড়। প্রায় দেয়ালছোঁয়া। ' আমাদের সব ফার্ণিচার হবে কালো রঙের ', সেঁজুতি বলেছিল। সেঁজুতির বাসার ফার্ণিচার কী রঙের? আসিফ ভায়ের কালোতে সমস্যা নাই তো? হাসি পাচ্ছে আমার। নীরা যদি সেঁজুতির বান্ধবী না হতো তো ওর সাথে আমার পরিচয়ই হতো না।
মিনিট কয়েক নীরার পেছনে দাঁড়িয়ে সূর্যের অস্ত যাওয়া দেখলাম।
'আরে তুই! কতক্ষণ?'
'ঘন্টাখানেক। তোর ঘর পাহারা দিচ্ছিলাম!'
নীরার হাসিটা সুন্দর।
'কফি?'
'হুম! চলবে!'
বিস্কিটের টিনটা আমার সামনে নামিয়ে কফি বানাল নীরা। দুই মগ কফি হাতে নীরাকে দেখে কেমন শান্তি শন্তি লাগছিল। এমন শান্তির একটা ছবির স্বপ্ন আমার ছিল একসময়। সব ছবি ধুয়ে মুছে ক্যানভাস পরিষ্কার করে দিয়ে গেছে সেঁজুতি। এখন আমি নিশ্ছিদ্র ঘুমে রাত পাড়ি দিই, নিশ্চিন্তে।
' মা'র সাথে কথা হয়না অনেকদিন।' নীরার দুই হাতের তালুতে চেপে ধরা কফির মগ, একটা চুমুকও পড়েনি।
' ফোন করে না?!'
'করে তো। কাল রাতেও করলো।'
'তাহলে?!'
'ফোন ধরিনি।'
লালমাটিয়ার ফোর বি। ডাবল খাট। তখন ফোন করতো নীরা, বারে বারে, অস্থির হয়ে, ওর বাসার কেউ ফোন ধরতো না। সময় বদলে যায়।
আরো আধাঘন্টা বসে থাকলাম চুপচাপ। যার যার নিজের ভাবনায় মগ্ন। কথা ফুরিয়ে গেছে।
'এভাবে আর কতদিন নীরা?'
'কি করতে বলিস?'
'বিয়ে করছিস না কেন?'
'বিয়ে......! কাকে! আমার ভয় করে তানিম। খুব ভয় করে!'
এবার যেতে হয়। রাত নেমে গেছে শহরে। নতুন রাতের রাস্তায় হাঁটতে আমার ভাল লাগে। দরজার কাছে দেয়ালে টানানো ছবিটায় চোখ পড়তে কেন জানিনা আজ আমার ভীষণ রাগ লাগলো। তন্ময় বসুর আঁকা।
'তন্ময়দা ফোন করে?'
'হু! কাল রাতে করলো।'
একটু অবাক হলাম। এটা আশা করিনি।
নীরা ওর খালি কফির মগে কী খুঁজছে ওই জানে।
'তাই!'
'ও বিয়ে করছে এই সামনের শুক্রবার।'
বিয়ে করছে তন্ময়দা! কোনো কারণ ছাড়া এই সাততলা বাড়ি ভেঙে পড়লেও বোধহয় এতটা অবাক হতাম না।
'কাকে?' প্রশ্নটা করেই বুঝলাম ভুল হয়ে গেছে।
তনুদির মৃত্যুর পর তার জায়গায় কাউকে বসাতে পারছে না বলে লোকটা একটার পর একটা বান্ধবী বদল করলো আটটা বছর। সোমার সাথে তনুদির একবিন্দু মিল নাই! এই নিয়ে তৃতীয়বার লালমাটিয়া বাসা আর ডাবল খাটের ছবি আমার করোটিতে হানা দিল। আর তখুনি চোখ তুলে আমার চোখে চোখ রাখলো নীরা।
'সোমা ইমিগ্র্যান্ট, কানাডায়, জানিস তো?!'
আমি ব্যগটা তুলে নিই।
'যাচ্ছিস?'
'হুম! যাই।'
দরজা পেরিয়ে পেছন ফিরে নীরাকে দেখলাম একবার। চুপচাপ তাকিয়ে আছে টিভি স্ক্রীণের দিকে। টিভি বন্ধ। চুল এলোমেলো। ছোট কপাল। গভীর কালো চোখ। বিষণ্ণ, জলভরা। ছোট্ট চিবুক, মায়াভরা। একেই বোধহয় রাজহংসী গ্রীবা বলে। ঠিক মাঝখানটায় একটা কালো তিল। আহ্বান জাগানিয়া। তবুও, নাহ্! কোনো উত্তেজনা জাগায় না তো। বরং তেত্রিশ বছরের ক্লান্তি চেপে বসে দুই কাঁধে। নীরা কখনো আমার স্বপ্নে আসেনি। আমি কি নীরার স্বপ্নে আসি? কখনো?
'আজকে আর বের হবি না?'
'নাহ্।'
সাততলা, ছয়তলা..... নামতে নামতে রাস্তায় পৌছে দেখি বয়স বেড়েছে রাতের। রিকশা, মানুষ, চায়ের টংঘর, চায়ের ঘ্রাণ, বাস, সিএনজির কর্কশ চিৎকার মেখে হাঁটতে হাঁটতে মনে একটা প্রশ্ন জাগলো হঠাৎ। কেন আমি নীরার কাছে আসি?
২০/০৮/১০
মন্তব্য
গল্প ভাল লাগল!
একটু অন্যরকম, বর্ণনা আর কিছু কিছু উপমা চমৎকার হয়েছে।
ধন্যবাদ মর্ম।
প্রিয় বইখাতা, চমৎকার বর্ণনা। গল্প ভালো লেগেছে। শেষের প্রশ্নটা কি যে অদ্ভুত !!!!। ভালো থাকবেন।
ভাবলাম এই প্যারাটাই কোট করব। গল্পকারকে ধন্যবাদ।
___________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
আপনাকেও ধন্যবাদ।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আপনিও ভাল থাকবেন।
ভাল্লেগেছে!
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
ধন্যবাদ আপু!
একটু ছাড়া ছাড়া লাগলো...
_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না
_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না
হুম, ঠিকই বলেছেন। গল্পটা একটু ছাড়া ছাড়াই হয়ে গেছে...গল্পের চরিত্র দুইটার মতো।
করোটি শব্দটা পড়ে ইলিয়াসের কথা মনে পড়ে গেল
অদ্রোহ।
তাই!
গল্পটা পড়ার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।
আপনার সবশেষ ১১টা গল্প প্রিন্ট আউট নিয়ে ২বার করে পড়লাম লম্বা সময় নিয়ে, একটা রিভিউ দেয়ার আশায়... সময়ের টানেই হলো না।
এ গল্পটাও পড়লাম।
একটা ব্যাপারে আগ্রহ রাখি, নারী জীবনের নিঃসঙ্গতা কি আপনার লেখার প্রিয় বিষয়। বেশ কিছু গল্পে এ ব্যাপারটা এলো বলে জিজ্ঞেস করলাম। ঃ)
আমি ঠিক এই মন্তব্যটাই করতে যাচ্ছিলাম। ... শিমুল ভাই একটা রিভিউ দিতেও পারেন, আশায় রইনু তবে।
বইখাতাপু, আপনার অন্যান্য গল্পের চেয়ে এই গল্পের বুনোটটা কেন যেনো আলগা মনে হলো। কেন, তা বলতে পারবো না।পরের গল্পে নিশ্চয় আরো সূক্ষ্ণতর হবে বুনন...
_________________________________________
সেরিওজা
গল্পের ফাঁক ফোকরগুলো বন্ধ করা যেতো কিন্তু কেন জানি ইচ্ছা করলো না।
ধন্যবাদ সুহান।
রিভিউ! কিন্তু আমার গল্পগুলি কি রিভিউ বা এতখানি মনোযোগ পাবার যোগ্যতা রাখে! আমার গল্পগুলি সম্মানিত বোধ করছে, সেই সাথে আমিও। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে শিমুল।
নারী জীবনের নিঃসঙ্গতা আমার লেখার প্রিয় বিষয়, এমনটা না কিন্তু। এমনকি আমি নিজেও সচেতন ছিলাম না যে এই ব্যাপারটা বার বার গল্পে চলে আসছে। ব্যাপারটা ধরিয়ে দেওয়ার জন্য আবারও ধন্যবাদ আপনাকে।
ধরিয়ে দিইনি তো!
স্রেফ পর্যবেক্ষণ বলতে পারেন...
নিজের মতো করে লিখুন, সেটাই পাঠক হিসেবে চাইবো।
ঠিক আছে। কিন্তু আমি যে একই বিষয় নিয়ে বারবার লিখছি এই ব্যাপারে আমার সচেতন হওয়া দরকার ছিলো বলে মনে হয়েছে। আপনার পর্যবেক্ষণের ফলাফল এই কাজটাই করেছে, এটাই...
সচলায়তনে আমার সাধ্য নেই তারা দেয়ার । কিন্তু অসম্ভব ভাল লাগা এই গল্পটিতে আমি আমার ভাল লাগাটুকু জানিয়ে গেলাম…
মানুষের নিঃসঙ্গতা, নাগরিক বিচ্ছিন্নতার এমন বিষন্নতার গল্পটির সবটুকু ভাল লাগল ।
আপনার জন্য এক আকাশ শুভেচ্ছা । এমন আরো লিখুন ।
……………………………………
বলছি এক জ্যোতির্ময়ীর কথা
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
গল্পটা যেমনই হোক না কেন, আপনার এতখানি ভাল লেগেছে জেনে আমারও খুব ভাল লাগছে। ধন্যবাদ আপনাকে।
গল্প ভালো লাগলো।
কিন্তু চরিত্র কি একটু বেশি?
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
ধন্যবাদ আপনাকে। লিখতে বসলে চরিত্র বেশি হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা আর বেশি বর্ণনা দিয়ে ফেলার ব্যাপারটা কিছুতেই সামলাতে পারিনা।
অনেক ভাল লাগলো।
ধন্যবাদ আপনাকে।
খুব ভাল লাগল।
অনেক ধন্যবাদ।
ভালো লাগলো।
ধন্যবাদ আপনাকে।
আপাতত শুধুই বৃদ্ধাঙ্গুল
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
ধন্যবাদ নিবিড়।
হা হা হা
আমি শিরোনাম পড়ছিলাম, নারীর সাথে... মাফ করবেন।
গল্প ভালো লেগেছে।
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
তাই!
গল্প ভাল লেগেছে জেনে ভাল লাগল।
নতুন মন্তব্য করুন