এই সময়টাতে আমি একটু জিরোবার ফুরসত পাই, এই রাত একটায়। জাহিদ ঘুমিয়ে পড়ে, পাশের ঘরে ঘুমান আমার শাশুড়ী। না ঘুমালেও আমাকে আর ডাকাডাকি করেন না, কাশির শব্দে বুঝতে পারি তিনি জেগে আছেন। জাহিদের লতায় পাতায় জড়ানো আত্মীয়সম্পর্কের বোন রিনি কোনো কোনো রাতে জেগে থাকে, টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে বই টই পড়ে। সেই সব রাতে দরজার ফাঁক গলে আলো এসে পড়ে ভেতরের বারান্দায়। আমি কখনো কখনো সেই আলো দেখি ছোট কাঠের টেবিলটার কাছে বসে বসে। এই সাড়ে সাতশো স্কয়ার ফিটের বাসাটা আশ্চর্যরকম নির্জন হয়ে যায় এই রাত একটায়।
সেটা ছিল এক অনিশ্চিত বছর। আমার ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হবে কিছুদিনের মধ্যেই। ভার্সিটির হলে থাকি। সে রাতে হলে তুমুল গোলযোগ। পড়ায় কিছুতেই মন বসাতে পারছি না। ঘুরে একবার বারান্দায় আসি, আরেকবার বাইরের করিডোরে যাই। সবাই উত্তেজিত। দাবি মানতেই হবে। শাস্তি দিতেই হবে আমাদের বেপরোয়া নেত্রী আপাকে। আমি এইসব শুনেও শুনিনা। বারান্দা প্রায় ছুঁয়ে থাকা রেইনট্রিকে বলি, ও রেইনট্রি, আমার মন ভালো করে দাও। আমাকে পড়া শেষ করতেই হবে যে। ক্লাসের পাঁচজনের একজন হতেই হবে আমাকে। এবং অতঃপর একটা ভাল নাহোক চলনসই গোছের চাকরি। জীবনভর একাকী লড়তে লড়তে ক্লান্ত বাবার দিশাহীন চোখে আলোর ফুল ফোটাতেই হবে গো ঋজু বন্ধু আমার। ছোট তিনটা ভাই বোনের জন্যে ঠিক তোমার মতোই হে মহাবৃক্ষ, আমাকে বিশাল তরু হতেই হবে যে।
বিক্ষিপ্ত মন মেরামত করার উদ্দেশ্য নিয়ে হলের ভেতর এলোমেলো হাঁটাহাঁটি করলাম। কমনরুমে উঁকি দিলাম একবার। কেউ নেই। টিভির মানুষগুলো আজ নিঃসঙ্গ। কমনরুম পেরিয়ে হল অফিসের সামনে এসে দেখি মানুষে মানুষে সয়লাব জায়গাটা। হলের সব মেয়ে বুঝি একসাথে হয়েছে ওখানে! উত্তেজনা বারুদের মত। উত্তেজনা ছোঁয়াচেও। মিনিট কয়েক পর আমারও মনে হলো আজ আর ঘুমিয়ে কাজ নেই। একটা হেস্তনেস্ত না হওয়া পর্যন্ত রুমে ফিরবো না।
মিনিট যায়। ঘন্টা যায়। কিছুই হয়না। ক্রমশ নিরাশ হয়ে পড়ি। সিঁড়িতে বসে আবারও নিমেষেই চলে যাই আমার বাবার কাছে, ছোট ভাইটার অবুঝ অভিমানী হাসির কাছে, স্যাঁতসেঁতে গন্ধ ওঠা পুরোনো একতলা বাসাটায়। ঘুরে ঘুরে একবার যাই বাবার কাছে, বাবা চশমা চোখে এঁটে খবরের কাগজ পড়ছেন; ছোট বোনটার কাছে যাই আরেকবার, ওড়নার একপাশ সেলাই করছে খুব সাবধানে; রান্নাঘরে যাই, মা নেই। এভাবে কতক্ষণ কাটলো জানিনা। রুমমেটের ডাকে রুমে ফিরে আসি একসময়। পড়া আর হয় না। মনটা বড়ই উচাটন সেদিন।
হঠাৎ ঘটনাটা ঘটলো। বারান্দা থেকে একটা আর্তচিৎকার। এ চিৎকারে কিছু একটা ছিল – গভীর আতংক জাগানো কিছু। একছুটে বারান্দায় বেরিয়ে পাঁচতলা থেকে নিচে তাকালাম, আর মুহূর্তেই জমে গেলাম তীব্র আতংকে। এ আতংক আদিম। গুহাবাসী যখন হিংস্র পশুর তীক্ষ্ম নখরের নাগালে চলে আসে, এ আতংক সেই সময়কার।
গোটা হলে ছড়িয়ে পড়েছে পুলিশ, ছুটে যাচ্ছে তারা মেয়েদের খোলা রুমগুলিতে। কী করবে ওরা? ধরে নিয়ে যাবে যাকে তাকে? নাকি শিকার করবে আমাদের? দুটোই করবে কি? রাত তুমি তোমার আঁধারে আমাদের মিশিয়ে নাও। দরজা শক্ত করে বন্ধ। আলো নিভিয়ে দেয়া হয়েছে। নিশ্ছিদ্র নিরবতায় অপেক্ষা করছি আমরা, যেকোনো মুহূর্তে বুটের আঘাত পড়বে দরজায়। বহু বছর বয়সী কাঠের দরজা কি যথেষ্ট শক্তি রাখে? রক্ষা করতে পারবে কি আমাদের ওপাশের বিপদ থেকে? মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছি সবকজন, দরজা যদি ভেঙেই যায় তো লাফিয়ে পড়বো পাঁচতলা থেকে। কী হবে? মরে যাবো কি? ঠিক আছে, মরবো নাহয়। কখনো কখনো মৃত্যুতেই মেলে পরম স্বস্তি।
পরদিন সকালে খুলে দেয়া হলো হলের প্রধান ফটক। দুরু দুরু প্রাণটা হাতের মুঠোয় নিয়ে বেরিয়ে এলাম বাইরের খোলা বাতাসে। কোথায় যাই? পরীক্ষা যদি স্থগিত না করে? আমাকে তো পরীক্ষা দিতেই হবে। একটা বছর নষ্ট করার মত বিলাসিতা আমার পোষাবে না।
টের পেলাম, সামনে বিপদ। ক্লাসের কারো সাথে এতটা ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হয়নি যে বিনা অনুমতিতে কারো বাসায় এই জাবদা ব্যাগ হাতে চলে যাবো কয়েকদিনের জন্যে। বিরক্ত না হয়ে বাসায় থাকতে দেবে এমন কারো নাম মনের ভেতর আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও পেলাম না। সামিনাকে ফোন করলাম – ও আমার বাবা-মা, ভাই-বোনগুলির খোঁজখবর নেয় মাঝে মাঝে। ওর বাসায় কি আমাকে থাকতে দেবে কিছুদিন? সামিনা জানায় ওর মা অসুস্থ। এ সময় গেলে আমার নিজেরই নাকি অসুবিধা হবে। বুঝলাম এবং দমে গেলাম। তখনও জাহিদের সাথে আমার পরিচয় হয়নি। কী করি! খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো আমি একে একে আরো কয়েকজনকে ফোন করলাম। কোনো লাভ হলো না। ওই সময়টাতে একসাথে সবারই কেন যে নানান রকম সমস্যা শুরু হয়েছিল তা আমি আজও ভেবে পাইনা। হতাশ হয়ে আমি যখন হলের সামনের গাছতলায় বসে ভাবছি বাড়ি ফিরে যাবো কিনা এইসময় ফোন করলো লামিয়া, আমাদের ক্লাসের সব থেকে অহংকারী, আত্মমগ্ন মেয়েটা। আমি আকাশের চাঁদ হাতে পেলাম। আমার মলিন ব্যাগটা হাতে নিয়ে রওনা দিলাম ওদের বাসায়।
লামিয়াদের বাসাটা বিশাল। এর আগে ক্লাসের সবার সাথে একবার, দুইবার গেছি ওদের বাসায়। এতবড় বাড়িটায় থাকে শুধু লামিয়া, ওর আব্বা আর ওর বড় ভাই। শেষবার যখন গেলাম, লামিয়ার জন্মদিনে, বসে আছি নিরালায় এককোণে সবসময়ের মতো। লামিয়ার বাবা সবার সাথে কথা বললেন, একা বসে আছি দেখে আমার সাথে বসে গল্প করলেন অনেকক্ষণ। আমার বাড়িতে কে কে আছে, আমার বাবা কী করেন, হলে আমি কী খাই না খাই এইসব খোঁজখবর নিলেন পরম আপনজনের মতো। আমি তাতে আপ্লুত। এত আদর করে কেউ তো কখনো খোঁজখবর নেয় না আমার।
লামিয়াদের অ্যাপার্টমেন্টের জমকাল দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আমার ভয় করছিল। ওর পাগল ভাইটা কেমন অবস্থায় আছে কে জানে। মাঝে মাঝেই সে নাকি খুব হিংস্র হয়ে পড়ে শুনেছি। হাতের কাছে যা পায় তাই দিয়ে লামিয়াকে, ওর বাবাকে মারতে যায়। শান্ত থাকে শুধু ওদের পুরোনো মানুষ আজহার চাচার কাছে। এ কষ্টেই হয়তো ওর বাবা অসুস্থ হয়ে পড়বে একদিন – এমনটাই আশংকা লামিয়ার - গল্প করেছে আমাদের সাথে। আজহার চাচাকেও আমি দেখেছি। লোকটাকে অদ্ভুত লেগেছে আমার। আমাদের খাওয়া তদারক করছিলেন তিনি - লামিয়ার জন্মদিনে। একটা পুরোপুরি হাসিবিহীন, ভাবলেশহীন মুখ।
অযথাই দাঁড়িয়ে ছিলাম। দরজার গায়ে কালো সোনালীতে লেখা চকচকে নম্বরপ্লেটের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম এর চেয়ে বাড়িই ফিরে যেতাম নাহয়। দরজার ওপাশের মানুষদের সাথে আমি কি মানিয়ে নিয়ে থাকতে পারবো ক'টা দিন? ওরা কত বড়লোক!
লামিয়া নিজেই দরজা খুলে দিল। এ মেয়েটার সাথে আমার কখনো তেমন কথা হয়নি, সত্যি বলতে কি, লামিয়াকে আমি তেমন পছন্দও করিনা। অথচ বিপদের সময় লামিয়াই আমার পাশে এসে দাঁড়াল। আমি মনে মনে লজ্জিত হই, অনুতপ্ত হই। আপাত অহংকারী চেহারার আড়ালে এক মায়াভরা হৃদয়ের পরিচয় পেয়ে আর্দ্র হই। তারপরও ওর নরম বিছানায় গা এলিয়ে আমি শান্তি পাইনা। পাগল ভাইটা কোন ঘরে থাকে? ঘর কি আটকে রাখে ওরা? আমার চেহারায় অস্বস্তির ছাপ দেখে লামিয়া কিছু অনুমান করে থাকবে, নিজে থেকেই বললো, 'ভাইয়ার ঘর বাইরে থেকে আটকানো থাকে, ভয় পাস না' - গাঢ় বিষণ্ণ স্বর। আমি আবার একদফা লজ্জিত হই। এ দুঃসময়ে ওদের বাসায় থাকতে পাচ্ছি এই কত ভাগ্য আমার!
সারাদিন খানিক পড়াশুনা, খানিক এটা সেটা গল্প – এভাবে দিন কেটে গেল। লামিয়ার বাবা এলেন সন্ধ্যায়। মনের আনাচে কানাচে যা কিছু ছিটে ফোঁটা অস্বস্তি, বিব্রতভাব ছিল, সবটুকু মুছে গেল তাঁর কথায়। 'তুমি আমাদের বাসায় থেকেই পরীক্ষাটা দাও মা, পরিস্থিতি শান্ত হলেও আর হলে যাওয়া লাগবে না।' এক জীবনে কতজনের কাছে যে কৃতজ্ঞ আমি!
লামিয়া বেশি রাত জাগতে পারেনা। ওর অভ্যাস হলো ভোরে উঠে পড়া। আমি আবার রাত জেগে পড়ি। ভোরে ওঠার অভ্যাস নেই আমার। পড়ছি। লামিয়া ঘুমিয়ে পড়েছে। পড়তে পড়তে পানির তৃষ্ণা পেল। ডাইনিং টেবিলে দেখলাম পানির সুদৃশ্য বোতল আর অদ্ভুত সুন্দর কিছু গ্লাস পরিপাটি সাজিয়ে রাখা। কিসের বোতল ওগুলো? পানি খেলাম। ডাইনিং রুম পেরিয়ে বিশাল বসার ঘর, তার একপাশে বাইরে যাবার দরজা, আরেকপাশে অস্বচ্ছ কাচের বাধা, সেটা পেরিয়ে একটুকরো বসার আয়োজন, বাকিটা খোলা শূন্যতা। একটা নিচু টেবিল আর দুইটা চেয়ার। আমি টেবিল ধরে দাঁড়িয়ে হু হু বাতাসের সাথে মিশে যাই। পাগল করা জ্যোৎস্নায় মাখামাখি চরাচর। বিশাল চাঁদের দিকে চোখ মেলে তাকাতেই জ্যোৎস্নারাশি আমূল ঢুকে যায় ঠিক আমার দু চোখের মাঝ দিয়ে। বিবশ আমি আচ্ছন্নের মতো এক পা সামনে এগিয়ে যেতেই চেয়ারের সাথে ধাক্কা লেগে উল্টে পড়ে গেছি প্রায়। ব্যাথা পেয়েছি খুব। অজান্তেই অস্ফুট আওয়াজ বেরিয়ে আসে - 'উহ মা!' আর তখুনি উদবিগ্ন স্বরে - 'আহা! খুব লেগেছে?'
তৎক্ষণাৎ আমি যেন তড়িতাহত। নড়তে পারছি না। কথা বলতে পারছি না। ঘাড় ফিরিয়েই মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে গেছি। লামিয়ার পাগল ভাইটা ওর জানালায়। আগে খেয়াল করিনি, এ অংশটুকুর লাগোয়া একটা জানালা আছে ওপাশের ঘর থেকে। ওটাই তাহলে পাগল ভাইটার ঘর! আমার অবস্থা দেখে ম্লান হাসলো ছেলেটা।
'খুব অবাক হয়েছো না?'
একদম ভালমানুষের মতো কথা বলছে সে! আমি ভাবলাম, আমাকে চাঁদে পেয়েছে বুঝি। আমার জগতের সবকিছু পাল্টে গেছে তাই!
'ভয় পেয়োনা! আমি তো পাগল নই। পাগল সেজে থাকি। বেঁচে থাকতে হবে তো! '
এর মানে কী?! যেন সে কৈফিয়ত দিচ্ছে আমাকে! এমনকি বিব্রত হাসিটাও ঠিক ঠিক মাপমত লেগে আছে ঠোঁটে। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে ছিলাম ছেলেটার না-জানি-কত-শত বছরের জমানো বিষণ্ণ মুখের দিকে। শুকনো হাড্ডিসার চেহারা। কপাল, গালের হাড় বেরিয়ে আছে বেখাপ্পাভাবে। ওরা কি এই পাগল ছেলেকে খেতে টেতে দেয়না নাকি?! ওর ঘরটা অন্ধকার। কালো একটা চাদর জড়ানো গায়ে। মলিন কিন্তু অতি সাধারণ অবয়ব; আর অপ্রাকৃত চোখ। হ্যাঁ, ওই রাতে ছেলেটার চোখ অপ্রাকৃতই লাগছিল আমার কাছে। বুঝি, এ নিছক পরিবেশের প্রভাব। অন্ধকারে চোখ জ্বলে কাদের? হিংস্র শ্বাপদের। আর কাদের? তার চোখ জ্বলছিল! নাকি চাঁদের আলোয় ধুয়ে অমন চকচকে হয়েছিল চোখ! নাকি পাগলদের চোখ ওরকম জ্বলজ্বলেই হয়?
' ভয় পেয়ো না!'
আবারো আমাকে আশ্বস্ত করলো সে।
' তোমাকে কিছু করার ক্ষমতা নাই আমার! দেখো, আমি দেয়ালের এপাশে। দরজা বাইরে থেকে আটকে দিয়েছে ওরা। তুমি ভয় পেয়োনা।'
আমি বিন্দুমাত্র আশ্বস্ত হইনি তার কথায়। বলা যায়না, শক্ত বা ধারাল কিছু যদি ছুঁড়ে দেয়, খুব ব্যাথা পাবো তো! সে যে বহু বছর যাবত উন্মাদ এটা আমরা সবাই জানি। বুঝতে পারছিলাম সময় নষ্ট না করে আমার সরে পড়া উচিত। কখন কী করে বসে কে জানে! কিন্তু আমি যে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চেষ্টা করেও নড়তে পারছিলাম না এক ইঞ্চি! আর কী আশ্চর্য, পাগলটা একেবারে বইয়ের খোলা পাতার মতো আমার মন পড়ে ফেলতে পারছিল কীভাবে যেন!
' ঠিক আছে, ঠিক আছে, তুমি থাক, আমি যাচ্ছি। কী করবো বলো! শোধ নিতে হবে তো। মা-কে কথা দিয়েছিলাম। তাই এভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছি। এছাড়া আমার আর কোনো উপায় নাই বিশ্বাস করো। ওরা আমার মাকে মারলো, বাবাকে মারলো। ওদের অন্তত একটাকে তো আমার মারা উচিত, তাই না?'
পাগলের প্রলাপ! মাকে মেরেছে মানে? লামিয়ার মা তো মারা গেছেন রোড অ্যাক্সিডেন্টে, অনেকবছর আগে। লামিয়ার কাছেই শুনেছি। লামিয়া কি ওর আপন বোন না?! নাকি এই ছেলেটা ওদের কেউ না?! লামিয়া আর ওর বাবার মুখ, ব্যথাভরা চোখ চকিতে মনে পড়ে আমার। ওরা কি জানে এই পাগল ছেলে এইসব উল্টাপাল্টা কথা বলে বেড়ায় অচেনা মানুষের কাছে? একদম সুস্থ মানুষের মতো?! নাকি এই ছেলেটা যা বলছে তার মাঝে সত্যি আছে কিছু? আমার নিজেরই কেমন পাগল পাগল লাগছিল। এত রহস্য সইবার মতন মনের অবস্থা তখন নেই আমার।
'তোমাকে এসব বললাম কেন জানো? কারণ তুমি বিশ্বাস করছো না। তোমার কথাও ওরা কেউ বিশ্বাস করবে না।'
এভাবে কেউ হাসে?! অদ্ভূতভাবে বেঁকে গেছে তার ঠোঁট। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল কিছুক্ষণ, চাঁদের দিকে। অন্যমনস্ক যেন। আমি চাইলেই এক দৌড়ে পালিয়ে আসতে পারতাম ভেতরে, ঐ মুহূর্তে। কিন্তু কি জানি কী হয়েছিল আমার। নড়তে পারছিলাম না একবিন্দু। যেন সম্মোহিত। এবং আতংকিত। ওই অদ্ভূত আলোয় জানালা গলে তার অতি শীর্ণ, ফ্যাকাসে হাত যদি সে একটিবার বাড়িয়ে দিত আমার দিকে, কোনোকিছু চিন্তা না করেই ঝাঁপিয়ে পড়তাম নিচে।
'আমি যাই, তুমিও শুয়ে পড়, অনেক রাত হয়েছে।'
আমি তো যেতেই চাইছি, সেই প্রথম থেকেই। কিন্তু কে যেন আমার পা দুটো গেঁথে দিয়েছে মেঝের সাথে। আমি এমনকি আমার হাতের আঙুলগুলোও নাড়াতে পারছিলাম না। একদম বরফের মতো জমে গেছি। ছেলেটা পেছন ফিরেও আবার ঘুরে দাঁড়ালো হঠাৎ, যেন খুব জরুরী কোনো কথা মনে পড়ে গেছে। আর সাথে সাথেই প্রচণ্ড ভয়ে আমি এমনকি শ্বাস নিতেও ভুলে গেলাম।
'আমার খাবারে বিষ মেশায় ওরা। লামিয়া আর ওর বাবা। যেদিন নিজের হাতে খাওয়াতে আসে, বেশি বেশি ভালবাসা দেখায়, সেদিন মেশায়। আমি জানি। স্লো পয়জনিং মানে কী জানো তুমি? আমি কিন্তু জানি!'
বদ্ধ পাগল একটা!
'শোনো মেয়ে, কেউ যখন খুব আদর করে নিজের হাতে তোমাকে খাওয়াতে আসবে, খাবে না কিন্তু! ককখনো খাবে না!'
একফোঁটা ঘুমাইনি সে রাতে। লামিয়ার বিছানার শিয়রে বিশাল জানালা কাচ আঁটা। কাচ সরিয়ে দিলাম। রাতের দমকা হাওয়ার প্রবল ঝাপটা এলোমেলো করে দিলো আমাকে। আমি সারারাত বসে রইলাম কাচে মাথা ঠেকিয়ে।
জানিনা কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুম ভাঙলো চাপা হুংকার, গর্জনে। পাগল ছেলেটা ক্ষেপেছে নিশ্চয়ই। এক পা এক পা করে এসে দাড়ালাম লামিয়া আর ওর বাবার পেছনে। খুব সন্তর্পণে উঁকি দিলাম দরজার ফাঁক দিয়ে। লাল টকটকে চোখ, ক্ষ্যাপাটে দৃষ্টি, কীসের আক্রোশে যেন চেপে ধরেছে নিজের ঝাঁকড়া লম্বা চুল। খালি গা। ঘরময় ছড়ানো খাবার। এই কি সেই ছেলে যে কথা বলেছিল আমার সাথে এই তো কেটে যাওয়া রাতে?! একটু বেশিই সরে গেছিলাম হয়তো দরজার কাছে। আমাকে দেখেই কেমন বুনো পশুর মতো গোঁ গোঁ করতে করতে হাতের কাছে রাখা পানিভরা গ্লাসটা সজোরে ছুঁড়ে দিল আমার দিকে। আতংকে একটা চিৎকার দিয়ে টলে উঠতেই আমাকে জড়িয়ে সরিয়ে নিয়ে এলো লামিয়া, ওর বাবা দুহাত মেলে দাঁড়ালেন দরজার সামনে, যেন সব আঘাত বুক পেতে নিতে প্রস্তুত তিনি। আমি ছুটে পালালাম লামিয়ার ঘরে, দরজা আঁকড়ে হাঁপাচ্ছি, অথচ কানে বাজছে ছেলেটার সতর্ক কন্ঠ 'শোনো মেয়ে, কেউ যখন খুব আদর করে নিজের হাতে............ '
ছেলেটা বদ্ধ পাগল। পাগলে কী না বলে!
তবে জাহিদ যখন হঠাৎ হঠাৎ নিজে শখ করে রান্না করে, নিজের হাতে থালায় নিয়ে আমাকে আদর করে খাইয়ে দিতে চায়, আদরমাখা কণ্ঠে বলে 'তুমি তো বিয়ের পর একবারও নিজের বাড়িতে গেলেনা, কেমন মনমরা হয়ে থাকো সবসময়, যাও না একবার ঘুরে এসো, তোমাকে রেখে আসি, আমিও থাকবো দু'একদিন'; পাশের ঘরে শাশুড়ীর কাশি থেমে যায়, রিনির নড়াচড়ার শব্দ থেমে যায়, দম বন্ধ অপেক্ষা যেন; আমার চোখে ভাসে বলিরেখা, ঘাম, নিরুপায় চোখ, শুকনো কান্না, বাবা, দুইটা ছোট ঘর, গাদাগাদি ময়লা কাপড়, অন্য সব মৃদু মানুষ, মরচে পড়া চালের টিন, এবং বিশাল বিশ্বস্ত চাঁদ; প্রত্যেকবারই আমি বলি, 'সামনের মাসে যাবো ভাবছি'; আর সতর্ক অবহেলায়, আনমনে খাবারের থালা নিয়ে সরে যাই; খাইনা, ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিই।
লামিয়ার পাগল ভাইটা মারা গেছে আচমকা একদিন। বাথরুমে পা পিছলে পড়ে গেছিল - রক্ত লেগেছিল দেয়ালে - লামিয়া বলেছে।
২১/১০/১০
মন্তব্য
চিত্ররূপময় বর্ণনা। চমৎকার গল্প।
________________________________________________
চতুর্বর্গ
ধন্যবাদ!
খালাম্মা এইবারের গল্পটা ঠিক জমল না, সুন্দর বর্ননা, কিন্তু শেষের দিকে যেন তাড়াহুড়া করে শেষ করার প্রবণতা দেখা গেল, মাঝে খাল কেটে সেখানে কিছু পুটি মাছ ছাড়ায় মন ভরল না
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী
ঠিকাছে, এর পরেরবার আরেকটু ভাল লেখার চেষ্টা করবো। লেখার সময় তাড়াহুড়া না করার কথাও মাথায় রাখবো, যদিও এটা ইচ্ছাকৃত না, হয়ে যায় । ধন্যবাদ!
দৃশ্য রচনা সুন্দর। তবে সাইফ ভাই এর সাথে আমিও একমত। শেষের দিকটায় কেমন তাড়াহুড়ো তাড়াহুড়ো মনে হয়েছে। ভালো থাকবেন বইখাতা।
ধন্যবাদ পড়ার জন্য। আপনিও ভাল থাকবেন।
আহাহা কি অসাধারন বর্ণনা।
রাত একটায় নিঝুম রজনীর চিত্রটা দারুন লেগেছে।
রাত একটার চিত্র ভাল লেগেছে জেনে আমারো ভাল লাগছে । ধন্যবাদ আপনাকে।
আমারতো শেষ সহই গল্পটা অনেক ভালো লাগলো।
ভয় টয় পেয়ে গেলাম রীতিমতো
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
ভয় পেয়েছেন বলছেন! লেখাটা একেবারে খারাপ হয়নি তাহলে । ধন্যবাদ। অনেক ধন্যবাদ।
ভাল্লাগলো গল্পটা।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
জেনে আমারও ভাল্লাগলো । ধন্যবাদ তিথী।
ভাল লাগলো
ধন্যবাদ।
মিসির আলির "নিশিথিনী"র কথা মনে পড়ে গেলো...
চমৎকার গল্প।
_________________________________________
সেরিওজা
তাই!
ধন্যবাদ সুহান।
গল্পটা খুব ভালো লেগেছে। প্রথম জীবনের অনেক কিছুই মানুষ সারা জীবন বয়ে বেড়ায় বা মানুষকে সারাজীবন তাড়া করে বেড়ায়। ইমপ্যাক্ট ইতিবাচক বা নেতিবাচক, যে কোনওটাই হতে পারে। আপনার লেখনী প্রাঞ্জল, পড়তে আনন্দ।
রাতঃস্মরণীয়
ঠিক বলেছেন, কখনো কখনো কোনো ঘটনার প্রভাব এড়ানো সারাজীবনে আর সম্ভব হয় না।
আপনাকে ধন্যবাদ।
শেষটা হয়তো আরেকটু ভালো হতো সময় নিয়ে লিখলে।
তবে একবারেই পড়েছি, ভালো লেগেছে,
আর রাত একটা-কে দেখেছি হারিয়ে ফেলা চোখে! রাতের চেহারা আসলেই বদলায় পুরো রাত জুড়ে।
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
হুম, রাতের যে কতরকম চেহারা! সারারাত জুড়ে চোখ মেলে দেখলেও ক্লান্তি আসেনা।
ধন্যবাদ মর্ম।
গল্পটা পড়েছিলাম, বেশ ভাল লেগেছিল...এখন জানিয়ে গেলাম।
--------------------------------------------
আজি দুঃখের রাতে সুখের স্রোতে ভাসাও ধরণী
তোমার অভয় বাজে হৃদয় মাঝে হৃদয় হরণী।
--------------------------------------------
যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়ি-বাড়ি যায়
তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়।
ধন্যবাদ অদ্রোহ, ভালো লাগা জানিয়ে যাবার জন্য।
আপনার লেখাগুলো আসলেই ভাল। যদিও সবগুলো আজ পড়ে উঠতে পারিনি। কালকের মধ্যেই শেষ করব। চালিয়ে যান।
অমিত্রাক্ষর
অমিত্রাক্ষর@জিমেইল ডট কম
ধন্যবাদ অমিত্রাক্ষর।
আগে চোখে পড়ে নি এই গল্প, এতো দিনে পড়লাম। দারুণ লাগলো, যেমন চমৎকার এগোলো তেমনি অসাধারণ সমাপ্তি! মুগ্ধ হলাম!
পাঠকদা, আপনার দারুণ লেগেছে জেনে সত্যি ভাল লাগছে। অনেক ধন্যবাদ।
চমৎকার লাগলো। আমি মুগ্ধ! অসাধারণ!!!!
রাত একটার বর্ণনা অতিরিক্ত সুন্দর হয়েছে!!!!
--শাহেদ সেলিম
আপনাকে ধন্যবাদ।
আমার না শুরুটা কেমন যেন এলোমেলো লাগছিল, শেষটাই বরং অনেক ইন্টারেস্টিং লাগলো।
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
আপনাকে ধন্যবাদ।
নতুন মন্তব্য করুন