সময়টা প্রায় দুপুর। অর্পিতা হাফ ইয়ার্লির খাতা নিয়ে বসেছে। হাতে একটা হলুদ কলম যার কালি লাল। ডান গালে একটা লাল রেখা। তর্জনীতে লেপটানো লাল কালি। ছুটির আর মাত্র দিন তিনেক আছে অবশিষ্ট। এর মধ্যে শেষ করতে হবে এত এত খাতা। কাগজের খস খস গা শিউরানো কর্কশ শব্দ ছাড়া এ ঘরে আর কোনো শব্দ নেই।
এটা ছোট্ট গোল কাচের টেবিল, নিচু, গাঢ় রঙের। খাতাগুলো ছড়ানো টেবিলে। অর্পিতার বাদামী-খয়েরী মগ এক পেট চা নিয়ে একধারে দাঁড়িয়ে। আরেকধারে ছোট্ট সুদর্শন মুঠোফোন। টেবিলে খাতা রাশি রাশি। খাতার ভাঁজে ভাঁজে দেবশিশুদের হাসি আর কলতান। অর্পিতাও হাসে আনমনে। হঠাৎ, হঠাৎ। বাচ্চাগুলো মায়ায় জড়ায়। বিনা প্রচেষ্টায়। মুখোমুখি দেয়ালে ঝোলানো একটা লাল-কালো মুখোশ। নড়ে ওঠে বাতাসে।
আজ দুপুরে বড় আপার বাসায় দাওয়াত। ছোট আপা আসবে। ভাইয়া আসবে। সাথে ভাবী, তাদের বাচ্চারা। প্রথম প্রথম এইরকম দাওয়াতে যেতে অর্পিতার খারাপ লাগতো। তানভীর অস্বস্তিবোধ করবে কিনা, তানভীরকেই বা ওরা কীভাবে নেবে এইসব ভেবেই খারাপটা লাগতো। তবে সে সংশয় এখন আর নেই। তানভীর সবার সাথে এমনভাবে মিশে গেছে যেন আর কেউ কখনো ছিল না ওর জায়গায়। কেউ কখনো জামানের নামটা পর্যন্ত উচ্চারণ করেনা অর্পিতার সামনে। তানভীরের সামনে তো নয়ই। এক দুঃস্বপ্নের কাল গেছে ওর জামানের সাথে। সে দুঃস্বপ্ন, তার রেশ, আশংকা, সংশয় সব কাটিয়ে আজ অর্পিতা সুখি, পরিতৃপ্ত। ধোঁয়া ওঠা চায়ের তিক্ত, মিষ্টি, উষ্ণ স্বাদ; কোলে সবুজ কুশনের আরাম; গাঢ় হলুদ রঙা কলম হাতে অর্পিতা দৃষ্টি ছড়িয়ে দেয় ঘরের আনাচে-কানাচে। এ তার নিজ হাতে গড়া নিটোল সংসার।
তনু পড়ছে ওর ঘরে। পড়াশোনায় খুব ভালো হয়েছে অর্পিতার মেয়ে। ক্লাস ফোরের ফাইনাল পরীক্ষায় প্রথম হতে পারেনি। তাই নিয়ে কী কান্না মেয়ের। এ বছর পড়ছে অনেক বেশী করে, নিজের গরজেই। এ দিকটা নিয়ে সে নিশ্চিন্ত। চেয়ারে পা দুটো তুলে, কুঁজো হয়ে বসে গভীর নিমগ্ন বইয়ের পাতায় তার মেয়ে। একটু একটু দুলছে। একরাশ চুলে ঢাকা মুখ। দরজায় দাঁড়িয়ে মেয়েকে দেখলো কিছুক্ষণ অর্পিতা। মেয়ের চুল, মুখের গড়নে জামানকে টের পাওয়া যায়। এটা কষ্ট দেয় অর্পিতাকে। ও চেয়েছিল জামানকে পুরোপুরি মুছে ফেলতে ওর দৃষ্টিসীমা থেকে। মনের ভেতরে ও বাইরে থেকে। অথচ প্রতিনিয়ত তনু মনে করিয়ে দেয় এ সম্ভব না। জামান আছে তনুর সাথে। থাকবে সবসময়। তনু বা অর্পিতা, এমনকি জামানের চাওয়া বা না চাওয়াতেও কিছু আসে যায় না। তনুর কি কখনো মনে পড়ে তার বাবাকে? এ এক বিরাট সংশয় অর্পিতার। মেয়ের মন থেকে কি মুছে গেছে জামান? নাকি ফিরে ফিরে আসে কখনো?
বেলা বারোটা বেজে গেছে। তেরছা করে রোদ এসে দখল নিয়েছে ঘরের দেয়াল, মেঝের। বারান্দা ভেসে গেছে ঝাঁঝাল রোদে। মেয়েকে গোসলের তাড়া দেয় অর্পিতা। সারাটা সকাল পড়েছে তনু। মেয়ের মাথায়, গায়ে হাত বুলিয়ে দেয় খানিক আদর করে দেয় অর্পিতা পরম মমতায়। এই মেয়েটার জন্যই সে নিজেকে শেষ করে দিতে গিয়েও পারেনি। মেয়েকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন। অনেক পরিকল্পনা। এখনো মা'কে দরকার তার রাতে ঘুমানোর সময়। অর্পিতা এসে কপালে একটা চুমু দেবে, কিছুক্ষণ বসে থাকবে মেয়ের পাশটিতে, তবেই তনু ঘুমাবে। খুব ভয় পেয়েছিল অর্পিতা; তানভীরের সাথে যখন বিয়েটা হয়। সে ভয় ছিল অমূলক। তনু ওদের সাথেই ঘুমিয়েছে বছর দুয়েক। ওর গায়ের সাথে লেপটে। চিকন লতার মত হাত দুটো ওর গায়ে ছড়িয়ে। নিশ্চিন্ত নির্ভরতায়। যেমনটা ঘুমাতো জামান চলে যাবার পর। জামান চলে যাবার আগে। ঘর আলাদা হলো তারপর। মেয়ে তার বুঝদার। একটা আস্ত ঘরের মালিক বনে যাওয়া রীতিমত গর্বের ব্যাপার নয় কি? পুতুল, রকমারি খেলনা আর রঙিন সব ছবি দিয়ে তানভীর সাজিয়ে দিয়েছে মেয়ের ঘর। হালকা গোলাপী, গাঢ় বেগুনি, টকটকে লাল, লেবু সবুজ, লালাভ কমলা.........কত রং! তনু রীতিমত গর্ব করে ওর ঘরটাকে নিয়ে। স্কুলের বন্ধুদের ডেকে ডেকে দেখিয়েছে। আর অর্পিতা দেখেছে মেয়েকে। সুখ নিয়ে। দেখেছে তানভীরকে। ভালবাসা নিয়ে। তানভীরকে না পেলে ওর কখনো জানাই হতোনা এতটা সুখ, এতটা ভালবাসা থাকতে পারে একটা জীবনে।
মেয়ের ঘরটা গুছিয়ে দেয় অর্পিতা। টেবিলে বই, খাতা, কলম সাজিয়ে রাখে এবং দমচাপা উৎকণ্ঠায় ত্বরিৎ উল্টায় খাতাগুলোর পৃষ্ঠা। তনু গোসল সেরে ফেরার আগে যতটুকু সম্ভব অর্পিতা দেখে নিতে চায়। কোথাও কি আছে জামানের নাম? কিংবা জামানকে নিয়ে কোনো কথা? আনমনে কখনো জামানকে নিয়ে কিছু লিখেছে কি মেয়ে পুরোনো খাতার পাতায়? বা অন্য কোথাও? বাবার কথা মেয়ে কি মনে করে অর্পিতাকে এড়িয়ে? তেমন হলে ভীষণ মুষড়ে পড়বে অর্পিতা। ডিভোর্সের পর জামান তার মেয়েকে কখনো এমনকি দেখতেও চায়নি যে! বাথরুমের দরজা খোলার শব্দ পেয়ে তড়িঘড়ি আবার খাতাগুলো গুছিয়ে রাখে অর্পিতা। এবং লম্বা করে ছেড়ে দেয় চেপে রাখা শ্বাস। নাহ, কোত্থাও নেই। জামান মুছে গেছে তনুর মন থেকে। সেখানে এখন রাজত্ব করে তানভীর। তনুর বাবা তানভীর। বাবাকে ভীষণ ভালবাসে মেয়ে। যত আব্দার সব বাবার কাছে। ফুরফুরে মন নিয়ে প্রজাপতির হালকা পাখায় করে নিজের ঘরে পা রাখে অর্পিতা।
এ ঘরটা নীল রঙে মোড়া। তানভীরের প্রিয় রং নীল। অর্পিতারও। এমনি কত কিছুতেই যে মিল অর্পিতা আর তানভীরের। শুধু ওদের পরিচয়টাই হলো এত দেরীতে। কেন যে ঠিক মানুষটার সাথে দেখা হতে দেরী হয়ে যায়। কারো হয়তো সারা জীবনে দেখাই হয়না। ভুল মানুষের সাথে কেটে যায় পুরো জীবন। টিভির পাশে ইয়া বড় এক নীল রঙা ভালুক। আদুরে, নরম। ওটার পেটে ঠেস দিয়ে ছোট্ট নোটবুক, বই খাতা, কলম কোলে কাজ করে অর্পিতা প্রায়ই। ফোন কানে নিয়েও হেলান দেয় কখনো কখনো নীল ভালুকটার তুলতুলে পেটে। আর এ নিয়ে কী অভিমান তানভীরের। একদম ছেলেমানুষ! অর্পিতা হেসে ফেলে একা একাই, এই দুপুরবেলায়, নিজের ঘরের মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে, ভালবাসা মেশানো স্নেহে! নিজের প্রিয় পুরুষের কথা ভেবে। এই ঘর, এই বাসা তুমুল ভালবাসাবাসিতে ভরে যায় কোনো কোনো একলা দুপুরে, কিংবা বিকেলে বা রাতে। এ ঘর, ও ঘর, বিছানায়, সোফায়, মেঝেতে লেখা হয় ভালবাসার কবিতা, গদ্য। তনু থাকেনা সেসব রাতে। বিকেলে। দুপুরে। এ ছোট্ট উষ্ণ বাড়িতে থাকে শুধু ওরা দু'জন। শুধু ওরা দু'জন। আর কেউ নয়। নিজেদের একলা পাওয়ার এ অনুভূতি অন্যরকম। তানভীরের কাছে। অর্পিতার কাছেও। তনু হয়তো খেলতে যায় পাশের বাসায়, পড়তে যায় নিচের বাসার ভাইয়ার কাছে, জন্মদিনের পার্টিতে যায় কাছাকাছি কোনো বন্ধুর বাসায়। ফিরতে ফিরতে বেশ দেরী হয়। সেইসব দুর্লভ রাত, দুপুর, বিকেলের জন্য অপেক্ষায় থাকে তানভীর। অর্পিতাও। এখন, এ মুহূর্তে সেই ভালবাসার তীব্র স্বাদ চারিয়ে যায় নিজঘরে একলা অর্পিতার মনে ও শরীরে। গুণ গুণ গুঞ্জন তুলে অর্পিতাকে ঘিরে ঘুরপাক খায় একটা একলা মৌমাছি।
তানভীর এতো দেরী করছে কেন? ফোনটাও সাথে নিতে ভুলে গেছে। কী যে করে তানভীর! এখন বসে বসে টেনশন করো! গোসল সেরে, তানভীরের দেয়া মরচে রঙা শাড়িটা পরে আয়নার সামনে কালো টিপ হাতে এখন অর্পিতা। তনু ওদের বিছানায় একটা বই হাতে মগ্ন। চীনদেশের উপকথা। তানভীর এনে দিয়েছে। অসহ্য গরম পড়েছে আজ। তানভীর ফিরছে না কেন এখনো?
অবশেষে কালো টিপটার স্থান হলো আয়নার এক কোণায়। একরাশ বিষণ্ণতা মেখে অর্পিতা তেমনি বসে আছে। মাথায় হানা দেয় রাশি রাশি দুর্ভাবনা। নিস্তব্ধ দুপুর। শুনশান নিরবতা। হঠাৎ বইয়ের পাতা থেকে মুখ তোলে তনু। 'বাবা এখনো আসছেনা কেন মা?' মেয়ের স্বরে উৎকণ্ঠা। অর্পিতা মেয়ের দিকে তাকাতেই দেখতে পায় এখনো বইয়ের প্রথম পাতাই খোলা। মেয়ে একটা পাতাও পড়েনি। বাবার জন্য দুশ্চিন্তায়। এত টেনশনেও একটা ভাললাগা ছুঁয়ে যায় অর্পিতাকে। একটা কাক ডেকে ওঠে বারান্দায়। একঝলক গরম হাওয়া ঢুকে পড়ে খোলা জানালা দিয়ে। নিশ্চুপ অপেক্ষায় মা ও মেয়ে। হঠাৎ এই টানটান দুপুরকে একটানে ছিঁড়ে ফেলে বেজে ওঠে চেনা সুর। একলাফে দরজার সামনে তনু। তানভীর এসেছে। মেয়ের মাথায় হাত রেখে হাসছে, চোখ অর্পিতায়। শোবার ঘরের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ অপেক্ষায় অবসন্ন অর্পিতা। দেখে নিচ্ছে প্রাণভরে একটা সুন্দর ছবি। বাবা ও মেয়ে। মেয়ে বাবার দুহাত জড়িয়ে। বাবার স্নেহময় হাত মেয়ের অগোছালো চুলে। ওখানে কোথাও জামান নেই।
আপা অনেককিছুর আয়োজন করলেও অল্পই খেল অর্পিতা। মোটা হওয়া চলবে না। এখনই তানভীরকে ওর চেয়ে ছোট দেখায়! দেখাক, তাতে কী? উঁহু! 'তাতে কী' বলে চিন্তাটাকে উড়িয়ে দিতে চাইলেও হতচ্ছাড়া চিন্তা তো উড়ে যেতে চায় না। অবশ্য অর্পিতাকেও ওর বয়সের তুলনায় অনেক ছোট দেখায় বলে বয়সের ফারাকটা চোখে পড়ে না কারো। তবুও! বুকের ভেতর সময়ে সময়ে কুটকুট করে কামড়ায় কী যেন!
বিকেল পর্যন্ত আড্ডা দিলো ওরা সবাই মিলে। বসার ঘরে, খাবার ঘরে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে সবাই। ছেলেমেয়েরা আপার মেয়ে তুলির ঘরে। তুলির ঘরটা বেশ বড়। নানা সাইজের বাচ্চা ঐখানে এখন। ছোটগুলি খেলনা হাড়িপাতিল, পুতুল, খেলনা গাড়ি এসব নিয়ে খেলছে। তারচে বড়গুলি ব্যস্ত কম্পিউটারে। তনু ভিড়ে গেছে এই দলে। তারচেয়েও বড়রা নিজেদের গোপন কথার ঝাঁপি খুলে দিয়েছে বুঝি! কাছাকাছি গোল হয়ে বসে নিচু স্বরে চলছে গল্প। তুলি আছে এই দলে। সবাই যার যার মতো ব্যস্ত এখানে।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। ফিরতে হয় এখন। মেয়েকে বারকয়েক ডেকে এখন বিরক্ত অর্পিতা। তনু কিছুতেই যেতে চাইছে না। কীসব খেলছে কম্পিউটারে। এখন বাসায় ফিরবে না। বাসা তো কাছেই, খেলা শেষ হয়ে গেলে ভাইয়া রেখে আসবে। মা'র আপত্তি প্রবল বিরক্তিতে ঝেড়ে ফেলছে সে। এইসব সময়ে অর্পিতার রাগ হয়। মেয়ে এইসব হাবিজাবি খেলার সুযোগ পেলে একদম কথা শুনতে চায় না।
মেয়েকে একটা বকা দিতে প্রস্তুত যখন সে, চোখের কোণায় তানভীরকে দেখতে পেল। তার দিকেই তাকিয়ে আছে। থমকে গেল অর্পিতা। দুচোখের সংযোগে একটা আলোর রশ্মি। এ দৃষ্টি তো তার চেনা! তাইতো! বহুদিন পর! আবারো একলা বাসায় দুজন। 'ঠিক আছে খেলো, বেশি রাত কোরো না কিন্তু, তোমার হোমওয়ার্ক শেষ হয়নি এখনো।' বেরিয়ে আসে ওরা। হেঁটেই ফিরছে। বাসা কাছেই। তানভীরের হাত ধরতে গিয়েও সামলে নিল শেষ মুহূর্তে। কীভাবে যে টের পেয়ে যায় তানভীর! ঠোঁটে তার হালকা হাসি। আলতো ছুঁয়ে দিল আঙুল। একটুকু এই ছোঁয়ায় পৃথিবী রঙিন হয়ে গেল অর্পিতার।
কী বিপদ। বাসার দরজার সামনে পৌঁছে টের পাওয়া গেল ব্যাপারটা। চাবি ছিল অর্পিতার হাতব্যাগে। ফেলে এসেছে আপার বাসায়। তানভীরকে দাঁড়াতে বলে একছুটে অর্পিতা আবার বড়পার বাসায়। বাসা কাছেই। এক সারিতে কয়েকটা অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিঙ। তারই একটায় অর্পিতার বাসা, আরেকটায় থাকে ওর বড়আপা।
সদ্য কিশোরীর মতো কয়েক লাফে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল অর্পিতা। সিঁড়িটা এখন ফাঁকা। অর্পিতা নেমে গেছে। ওদিকে একবার তাকিয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো তানভীর। একটা পা ভাঁজ করে দেয়ালে ঠেকানো। সাদা, শীতল দেয়ালের স্পর্শ। তানভীর কেঁপে উঠলো অল্প। একটা বাচ্চা নিতে এত আপত্তি কীসের? তালাটা থেমে গেছে প্রায়। একটা বাচ্চা। ছেলে অথবা মেয়ে। তানভীর থেকে যার জন্ম। তার নিজের বাচ্চা। তালাটা দুলছে না আর। সোনালী গা, চকচকে তালা। পিচ্ছিল। এবং শীতল। তানভীর নড়েচড়ে দাঁড়ায়। তনু। অর্পিতা ও জামানের মেয়ে। এবং তানভীরের মেয়ে। তানভীর ওকে অবহেলা করতে পারেনা কখনও। অর্পিতা দেরী করছে কেন? পোকায় কাটা গোপন ক্ষত থেকে চুঁইয়ে পড়ে তিক্ত রস। বিয়ের আগে কি এ নিয়ে কথা হয়নি? হয়েছে তো। তবুও! গোপন খোপগুলো তৈরী হচ্ছে ধীরে ধীরে। অর্পিতা কিছু গোপন করেছে কি? দেয়ালটা এত শীতল! অর্পিতা ফিরবে যে কোনো মুহূর্তে। গোপন ক্ষত আপাতত বুজিয়ে দিতে তৎপর তানভীর। দরজার ওপাশে তাদের সংসার। ওখানে এখন একটা ভালবাসার গান রচনা হবে। যেই গানে কোনো ক্ষতের আভাস থাকতে পারে না। পারে কি!
ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে আসতে গিয়েও অর্পিতা মত পাল্টালো। কী করছে তনু? আজেবাজে ওয়েবসাইটে ঘুরে বেড়াচ্ছে নাতো ওরা! মেয়েকে নিয়ে বড় ভয় অর্পিতার। মেয়ের কোমল কৈশোরে কোনো রিপুর তীক্ষ্ণ আঁচড় না লাগুক। কিন্তু কোথায় তনু?
ঘরটার একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা। মেঝেতে দুইটা বালিশ, বই, রং পেনসিল, খাতা, অ্যালবাম, কম্পিউটার ঘিরে তিনটা চেয়ারে পাঁচজন আর তাদের চিল চিৎকার, বিছানায় আদৌ কোনো চাদর বিছানো ছিলো কিনা বোঝা যাচ্ছেনা, বালিশে পেট চেপে তিন চারজন। অর্পিতার মেয়ে নেই কোথাও। পায়ে পায়ে বাইরের বারান্দার পর্দাটা একটু সরাতেই একটা জলরঙে আঁকা ছবি। এপাশে সূর্য অস্ত যায়। আকাশ এখন ম্লান। কিছুটা লাল। কিছুটা বেগুনি। কিছুটা নীল। বারান্দা ছুঁয়ে আমগাছটার ডাল। গাঢ় সবুজ নিটোল পাতা। দুহাত ছড়িয়ে বারান্দা ঘেরা গ্রীল আঁকড়ে, মুখটা গ্রীলে চেপে বিষণ্ণ যেনবা দুই বালিকা। তনু। তুলি। ডেকে উঠতে গিয়েও কেন জানি এই প্রথমবারের মতো থেমে গেল অর্পিতা। মাত্র দুহাত দূরে দাঁড়িয়ে তার মেয়ে যেন দু শতাধিক মাইল দূরে চলে গেছে কেমন করে! অর্পিতার ডাক কি তার কানে পৌঁছুবে?
আলতো করে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে নিলো তনুকে ওর বোন। পরম মমতায়। অর্পিতার বুকের ভেতর একটা ঘর আছে। সে ঘরে বাস করে তার মেয়ে। ঘরটা কি পড়ো পড়ো হয়ে গেলো অজানা কোনো আঘাতে! মেয়েকে এমন বিষণ্ণ দেখেনি তো সে কখনো। কবে থেকে তনুর আলাদা জগৎ তৈরী হলো?
'বাসায় যাবি তনু? ভাইয়াকে বলবো রেখে আসতে? '
'যাবো তো। এখন না! সময় হয়নি! আর একটু পর যাবো। আর একটু সময় যাক।'
বহুদূর থেকে ভেসে আসা কণ্ঠ অর্পিতাকে এক ধাক্কায় নিয়ে আসে রাস্তায়। সিঁড়ির বাইরে টুকরা ইটের স্তুপ। অর্পিতার পায়ের তলায় ইটের কুচি। মগজ কেটে কেটে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন ক'রে সরব সগর্জন জেনারেটর। রাস্তার পাশের চায়ের দোকান থেকে ছলকে পড়লো ময়লা পানি। ধুলামেশানো বাতাসে অর্পিতার আঁচল উড়ছে বেপরোয়া। কেননা অর্পিতা ছুটছে সজোরে। আর কয়েক পা সামনেই অর্পিতার বাসা। তার দরজায় অপেক্ষায় তানভীর। অর্পিতার মেয়ে পেছনে কোথাও। মাঝে অর্পিতা। রাস্তার মানুষের চোখ অর্পিতার শরীরে। টুকরো টাকরা কথা, গানের কলি ভেসে আসে বাতাসে। এসব কিছুকে পাত্তা না দিয়ে হঠাৎ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে অর্পিতা। থেমে গেছে ছুটতে ছুটতে। নিশ্চুপ। আত্মমগ্ন। এবং অপেক্ষমাণ। কীসের জন্য? জানেনা।
এক মিনিট। দুই মিনিট। আরও কয়েক মিনিট। অর্পিতা বাসায় ফিরবে। ফিরতেই হবে। তারওপরে ফিরবে অর্পিতার মেয়ে। তানভীর দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। হয়তো বা অসহিষ্ণু এতটা দেরীতে। দরজার ওপাশে মানিপ্ল্যান্টের টব, লাল-কালো মুখোশ, নীল রঙা ভালুক, দুটো উষ্ণ আরামদায়ক ঘর। ওরা অপেক্ষায় একটা গদ্য কি কবিতার জন্যে। একটা ভালবাসার গদ্য। ভালবাসার কবিতা। ওটা অর্পিতার সংসার।
২৪/১২/২০১০
মন্তব্য
চমৎকার লিখেছেন বইখাতা। খুব ভালো লাগলো। বাচ্চাগুলো যতো বড়ো হতে থাকে ততোই কেমন যেনো মা'র থেকে দুরত্বে যেতে থাকে, নিজের জগত গড়তে থাকে।
======================================
অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো, সেইতো তোমার আলো।
সকল দ্বন্ধ বিরোধ মাঝে জাগ্রত যে ভালো, সেইতো তোমার ভালো।।
------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।
ঠিক। আপনাকে ধন্যবাদ।
ভালো লেগেছে বইখাতা। চলুক।
ধন্যবাদ আপনাকে।
সব মিলিয়ে অসাধারণ।
---আশফাক আহমেদ
আপনাকে ধন্যবাদ।
কাল রাতে ঘুমঘুম চোখে একবার পড়েছিলাম। সকালে উঠে আরেকবার পড়লাম।
নারীর মনোজগতের বাইরের কিছু নিয়ে আপনার কাছ থেকে লেখা চাই। আপনার পড়া প্রতিটা গল্পের বুনোট ভালো লেগেছে- তাই আপনার কাছেই আশাটা জানিয়ে গেলাম।
_________________________________________
সেরিওজা
আমি বোধহয় একটা লুপের মধ্যে পড়ে আছি। অথবা এরচে বেশি কিছু লেখার ক্ষমতাই আসলে আমার নাই।
ছোটরা বোঝে অনেক বেশি। খালি নিষ্কলুষ মনের কারণে তখন সিদ্ধান্ত নিতে এত দেরি হয় না। খালি ছোটরা কেন যে বড় হয়ে যায়!
আর লেখা নিয়ে আবার বলি, আশেপাশের ছোট ছোট বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করে তা লেখার বর্ণনায় ফুটিয়ে তোলার আপনার ক্ষমতাটা ঈর্ষণীয়।
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
ধন্যবাদ আপনাকে।
আসলেই, ছোটরা কীভাবে যেন বড়দের অনেক জটিল ব্যাপারও ঠিকঠাক বুঝে ফেলে, অবাক হয়ে যেতে হয়। আবার এই বুঝে ফেলাটাই কখনো কখনো তাদের জন্য অনেক কষ্ট নিয়ে আসে।
ভালো লেগেছে আপু।
তোমার গল্পের ধাঁচ আর ঠাস-বুনোট ভঙ্গি বরাবরই ভালো লাগে...
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
ধন্যবাদ তিথী।
ভালো লেগেছে
নাম:মুনতাসীম মুনিম মিশু
আপনাকে ধন্যবাদ।
কী যে অসাধারণ লেখা---বলে বোঝাতে পারব না!
মুগ্ধ হয়ে পড়ছিলাম, ধীরে ধীরে পড়ছিলাম।
মনে হচ্ছিল যত দেরীতে শেষ হয় তত ভাল। পাঠককে গল্প শেষ হতে না দেবার আকুতিতে ডুবিয়ে দেয়াটা এক অসামান্য ক্ষমতার লক্ষণ!!
তোমার লেখার হাত অসাধারণ---তারচেয়েও অসাধারণ হল, মনের ভেতরের অলিগলিগুলোর সুলুক সন্ধান তোমার হাতের তালুতে লেখা।
আবারও মুগ্ধতা জানিয়ে গেলাম
জয় হোক---!!
অনিকেতদা! কী বলি! কিছুটা লজ্জা পেয়েছি বললে ভুল হবেনা! এই লেখা ভাল খারাপ যাই হোক না কেন, আপনার যে বেশ ভাল লেগেছে এটা জেনে আমারও সত্যি খুব ভাল লাগছে। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। ভাল থাকবেন।
নিখুত।
দুর্দান্ত।
অসাধারন।।
আপনাকে ধন্যবাদ।
নতুন মন্তব্য করুন