মাথার ভেতরে গল্পেরা অবিরাম ধাক্কাধাক্কি করে যায়। এ ওকে ধাক্কা দেয় তো ও একে মারে ঠেলা। কার আগে কে বেরিয়ে আসবে এই নিয়ে ঝগড়া, মারামারি, গালিগালাজ, ঠেলাঠেলি। ...কেননা ঘুম এখনও গাঢ় হয়নি। কিছুটা সময় পাওয়া যেতে পারে - এটুকুই আশা। স্বপ্নেরা এখনও হানা দেয়নি একযোগে। মাথার ভেতরটা এ মুহূর্তেও যথেষ্ট পরিষ্কার। তবে কিনা এই সুযোগ চলে যাবে যেকোনো মুহূর্তে। লাল, নীল, বেগুনি, হলুদ, কমলা, কালো, ধূসর স্বপ্নেরা ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে দেবে গল্পেদের। চার রাস্তার মোড়ের গল্পটা এ কারণে অস্থির। উত্তপ্ত রোদে পুড়ছে মোড়ের চতুর্মুখি বাঁক। ওখানে পাক খেয়ে খেয়ে ঘুরে বেড়ায় গল্প, আর প্রলাপ বকে থেমে থেমে। ওঠো মিলু, আমাকে কিন্তু আর পাবেনা আজ রাতের পর। ওদিকে কালো রাতের ভয়ের গল্পটা অধৈর্য, অসহিষ্ণু। গাঢ় জমাট ভয় পাতলা হয়ে আসে ক্রমশ। মিলু, ঘুমায় না মেয়ে, আমি কিন্তু হারিয়ে যাবো রাত পোহালেই। হাজারবার চেষ্টা করলেও আমাকে আর মনে করতে পারবেনা। শতচ্ছিন্ন জামা গায়ে ছেলেটার গল্পের কান্নাকাটির উপক্রম। বিন্দু বিন্দু অশ্রুকণা জমে গল্পের গায়ে। ওঠো মেয়ে, ওঠো। কাগজ কলম নাও। লেখো। আমাকে লিখে ফেলো। ...আর এদেরকে তফাত রেখে মিলু বিজ বিজ করে তলিয়ে যায়। ঘুমের অতলে। আমি পারবো না গল্পেরা। আমাকে রেহাই দাও। ......একে একে স্বপ্নেরা এসে দখল করে নেয় মিলুর অস্তিত্ব। গল্পেরা তোমরা বিদায় হও। তোমাদের পঙ্গু করে ফেলে রাখি কেমন করে! আমার তো আর গল্প আসেনা। এবার আমাকে ছেড়ে দাও। তোমরা বায়বীয়। তোমরা অলীক। তোমাদের অস্তিত্ব নেই।
মিলুর মাইগ্রেনের ব্যথা চড় চড় করে উঠে যাচ্ছে তীব্র থেকে তীব্রতর স্তরে। ঢেউয়ের মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে ব্যথা, মাথার ডানপাশ থেকে ক্রমে পেছনে, ক্রমে তালুর মাঝখানে, ক্রমে......। ......সাইন আউট করতে হবে। ‘ক’ হাসান জ্বালাচ্ছে খুব। এ এইবার ব্লকড হবে......তোমার মতলব আমি বুঝিনা মনে করসো......এস এম এস ......ফোনকল......ফাস্টফুড একদিন দুইদিন......ঘোরাঘুরি আরো তিন দিন চারদিন......তারপর হেন তেন......বিছানায় তুলে দরজা বন্ধ করার তাল......আচ্ছা আপনি কি গ্লাস ইউজ করেন?......গ্লাস পড়লে মেয়েদের সিরিয়াস টাইপ লাগে আবার কিউটও লাগে......ন্যাকা......। আম্মাকে এত বিশাল ঝাড়িটা না দিলেও পারতাম......। নাহ...ন্যাকামি টাইপ কথা শুনলে গা জ্বলে......চোখে পানি দেখলে গা জ্বলে...কিছুই তো করতে পারলা না জীবনে......পারো শুধু হা হুতাশ করতে...।
মিলু ব্লগস্পটে টাইপ করে এলোমেলো......আমি আর দুই দিনের মধ্যে মরতে চাই...। এলোমেলো সময়ে এলোমেলো আঁকিবুকি। এইই জীবন। এটা গল্প নয়। গল্প কি?
এই বাড়িতে মানুষ মোট পাঁচজন। মিলু, বিলু, দীপু, মিলুর বাবা, মা। আর সকালে আসে ছুটা কাজের বুয়া। তাকে গোনাগুণতির মধ্যে ধরলে ছয়জন। বিলুর মাথা খারাপ। মিলুর মা বলেন ‘বুদ্ধি প্রতিবন্ধী’। মানুষে বলে পাগল।
রাত এগারোটার আগে এই বাসার মানুষজন খাবার টেবিলে বসতে চায়না। মিলুর মা ঝিমান টেবিলে বসে। ওরা একটু রেহাই দিতে পারে তো আমাকে! এগারোটায় খাওয়া শুরু করলে...একজন একজন করে মরজিমতন সময়ে খেতে খেতে... সবার শেষ হতে সাড়ে বারোটা। তারপর আমি খাবো। গুছাতে গুছাতে দেড়টা। ঘুমাতে ঘুমাতে দুইটা আড়াইটা। ছয়টায় ঘুম থেকে ওঠা। মিলু, বিলু, দীপু, মিলুর বাবার এসব হিসাবে আগ্রহ নাই। বিলুর হিসাব রাখার ক্ষমতা নাই। তাই মিলুর মা টেবিলে বসে ঝিমান। হাঁটুর ব্যথায় কাতরান। ...ছেলেটা, মেয়েরা কখন খাবে?......চোখে ঘুম নেমে আসে। গাঢ়, ঘন, শান্তিময় ঘুম। কিন্তু এখন তো ঘুম আসার সময় নয়। ঘুমের আসার কথা রাত দুইটায় বা আড়ায়টায়। এই অসময়ে তার জ্বালাতন করা খুবই অসঙ্গত। এখন চুলায় আগুন দেয়ার সময়। দুপুরের তরকারি গরম করার সময়। গ্লাসে গ্লাসে পানি ঢালার সময়। টেবিলে ধোঁয়া ওঠা ভাতের গামলা রাখার সময়।
মিলুর মা ঘরের পর্দা সরিয়ে মিলুকে দেখেন। মেয়েটা বাঁকা হয়ে বসে একগাদা কাগজপত্রের স্তূপে ডুবে আছে। গুটি গুটি পায়ে মেয়ের পাশে এসে দাঁড়ালেন। মেয়ের সাথে কথা বলতে আজকাল তার ভয় লাগে। যা মেজাজ হয়েছে। মেয়ে মুখ তুলে তাকাতে তিনি ভয়ে ভয়ে তার মাথায় হাত রাখলেন। কিছু বললো না মেয়ে। রোজকার মতন ঝনঝন করে বেজে উঠলো না। শুধু আলতো করে একবার হাতটা ছুঁয়ে দিয়ে আবার রাশি রাশি কাগজের স্তূপে ডুবে গেল। ঐ ছোঁয়ায় ভালবাসা ছিল। তাই মিলুর মা দু’ফোঁটা পানি ফেললেন চোখ থেকে। আর এইই হলো গল্প। মিলুর মা পর্দা সামান্য ফাঁক করে গল্পটা দেখে আবার টেনেটুনে পর্দা সমান করে দিলেন। এবং দুই পা হেঁটে রান্নাঘরের লাইট জ্বালালেন। এই হলো গতানুগতিকতা।
মিলু ও দীপু। ওরা ভাইবোন। ওরা পিঠাপিঠি। ......আনাড়ি হাতে দুধ ভর্তি ফিডার মাখন নরম মুখে গুঁজে দিতেই বাচ্চা মেয়েটা যে ঐশ্বরিক হাসি উপহার দেয়, বাচ্চা ছেলেটা তা গ্রহণ করে পরম কৌতূহলে......ভাইয়া আমাকে আচার কিনে দাওনা......কাঁদিস না, তোকে এরোপ্লেন বানানো শিখাবো......অংকে এত কম কেন এইবার.........ঐ মেয়েটার সাথে আর কথা বলিস না, ও ভালোনা......এই জামাটা আমাকে কিনে দিবি?......আমার সময় নাই, তুই একা যা......আম্মা, ওকে কিছু বলোনা কেন তুমি? সংসারে ওরও তো কন্ট্রিবিউশন থাকা উচিত......আমাকে মিথ্যা বলে লাভ নাই আম্মা, আমি জানি ও কী বলসে......আমাকে ও একটুও দেখতে পারেনা আমি জানি......আমি রাস্তায় মরে পড়ে থাকলেও ওর কিছু যাবে আসবে না......বোনটা আমার এত শুকায়ে গেসে কেন? কী হইসে ওর? কেউ দেখেনা?......ভাইয়া আজকাল এতো কম খায় কেন? অসুখ? মা কিছু জিজ্ঞেস করে না কেন?.........অতঃপর জীবন এভাবেই চলবে। কারণ জীবন গতিশীল। দীপু পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে টেবিলের সামনে এখন......ইতিউতি তাকায় পানিভর্তি বোতল বা জগের সন্ধানে......পানির পাত্র রান্নাঘরের হাজারটা এলোমেলো জিনিসের আড়ালে......মিলু বোতলটা ঠক করে কাঠের টেবিলে নামায়...শব্দ হয় ঠক...এই শব্দের গতানুগতিক মানে হলো বিরক্তি......একটা দুটো শব্দ বা বাক্য ওই মুহূর্তে গড়ে দিতে পারে একটা নিটোল গল্প......অথচ মুহূর্তটা থেকে যায় এক শব্দহীন মরুভূমি হয়ে...গল্প গড়ে ওঠে না।
সন্ধ্যা নামে বাতাসে মিশে মিশে। একফোঁটা রঙ ঢালো একপাত্র স্বচ্ছ জলে। দেখো কীভাবে রঙ মিশে যায় বর্ণহীন জলের সাথে। তেমনি মিশে যায় সন্ধ্যা। স্বচ্ছ আলোর সাথে। তার সাথে মিশে ছড়িয়ে পড়ে গল্পেরা। রাস্তায়, বাড়িতে, অলিতে-গলিতে। সচল হয় হাতের আঙ্গুল। তৈরী হয় গল্প। কাগজে। স্ক্রীণে। ......এটুকু লিখে দীপু হাত সরিয়ে নেয় কী-বোর্ড থেকে। কী হবে লিখে? সবকিছু কি অর্থহীন নয়? অন্তত তার নিজের জন্যে? কার অভিশাপে এমন হলো জীবন? তের বছরের কালোকুলো ঝুপড়ি চুলের মেয়েটার অভিশাপে? আমি তো ওকে ভালবাসিনি। ‘এহ.........মা কালী লাল জামা পরসে দেখ’ ... ‘কাঁদলে তোরে পেত্নীর মত দেখায়...’। ...... 'রিকশাঅলা ব্যাথা পায় নায় আমি শিওর। থাপ্পড়টা আস্তেই মারসি... ব্যাটা মফিজ'......'হুম, একটা চুমুতে কী হয়! এখন সতী সাদ্ধী সাজছে'......'তোমার কি ভাল লাগে নাই নাকি...তখন তো খুব ন্যাকামি করসো...হুহ ......বন্ধুর বউ!...যত্তসব'...। ......’না আব্বা, ব্যাংকে তো এই মুহূর্তে এত টাকা নাই, আচ্ছা দেখি কারো কাছ থেকে ম্যানেজ করা যায় কিনা...’ ক্যান দিবো আমি এত টাকা? আমার অ্যাকাউন্ট খালি হইলে আমি বিপদে পড়বো না......আমার একটা সেভিংস কি থাকতে নাই...বিপু বিয়ে করসে, ওর দুই বাচ্চা আসে তো আমার কি? ওরও তো দায়িত্ব আসে সংসারের ওপর, নাকি?... এইসব পাপ না। আমি জানি এইসব পাপ না। এইটা হইলো বাস্তব। ‘দীপু, লেখালেখি চালিয়ে যাও, তোমার লেখার হাত কিন্তু অসাধারণ।’ ‘থ্যাঙ্কস রায়হান ভাই’ ...... ‘বই টই বের করার কথা ভাবসো কিছু?...’ । দীপু আঙ্গুল টান টান করে হাতের আড়মোড়া ভাঙ্গে...কালো কী-বোর্ডে হাত তার এখন...মরুভূমি বানানটা কি ঠিক আসে?...দীপুর আব্বার হালকা ছানি পড়া চোখ, ম্লান বয়স্ক চোখ মায়াভরে তাকিয়ে থাকে স্ক্রীণের ভেতর থেকে...দীপু কান্নার দমকে ঠোঁট চেপে ধরে ঠোঁটে......এবং এক আগ্রাসী কষ্টের ঢেউকে ঠেলে ভেতরে পাঠায়...আঙ্গুল সচল হয় কী-বোর্ডে...তৈরী হয় গল্প। কালো কালো অক্ষরেরা সারি সারি বসে যায় লাইনের পর লাইন ধরে...শব্দ ওঠে খট খট...পিঠ টানটান...স্পীকারে বিদেশি গান, টেবিলে মোটা চিকন বই, খয়েরী পর্দা, পর্দার ওপারে বসার ঘর, বেতের সোফা, দীপুর মা, খবরের কাগজ হাতে ঝিমাচ্ছেন, অজান্তে ঘুমিয়ে পড়েছেন, অথচ এখন ঘুমের সময় নয়।......এটা হলো জীবন।
'বিলু, গায়ে ওড়না দে...ওড়না দে বেহায়া মেয়ে'...। বিলু একটা মোড়ায় বসে পরম যত্নে পায়ে লাল রঙ লাগায়...'মা আমাকে একটা লিপস্টিক কিনে দিবা?'...'ওড়না দিলি না গায়ে...নির্লজ্জ বেহায়া'...'আমার পাউডার শেষ...কবে কিনে দিবা'......'কথা কানে যায় না শয়তান মেয়ে'...। এটা একটা ছোট বারান্দা...পাশে নির্মাণাধীন আরেকটা ছয়তলা...দু একটা ছোকরা মিস্ত্রীর আনাগোনা এদিকটায়...প্রেম যদি আগুন হয় রে এ এ......'বিলু এইদিকে আয়'।...বিলু গভীর মনোযোগে রঙ লাগায় পায়ের নখে।......ও সখি লো ও ও ও......এইবার ঝাঁটা হাতে বিলুর মা ছুটে আসতেই ভয়ে বিলুর হাত কেঁপে যায়...উপড়ে যায় একটা নখ...। এ চিত্র রোজকার। রুটিনবাঁধা। একে খাতায় তুলে দেখাতে গেলে কেমন হবে তার বাক্যবিন্যাস? এ দুঃসহ জীবন কি ফুটে উঠবে কালো অক্ষরে অক্ষরে? উঠবে না। তাই ওটা হবে গল্প। আর এটা জীবন। এ দুইয়ের ফারাক আছে। ......ঠিক এইখানে গল্পটা শেষ করে দেবেন কিনা ভাবেন মিলুর বাবা। স্কুল থেকে চেয়ে আনা অতিরিক্ত পরীক্ষার খাতায় কলমটা রেখে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবেন, আজ এটুকুই থাক।
‘কালকে আর স্কুলে যাওয়ার দরকার নাই, আবার জ্বরটা আসবে তাহলে’। ‘না না, যাওয়া লাগবেই, নাহলে বেতন কাটবে তো’ । ‘তাহলে কালকে আর বাসে যেয়ো না, একটা সিএনজি নিয়ো’, ‘কী যে বলো, কত ভাড়া নেবে জানো তুমি! এই সামর্থ্য আমার আছে? লাইব্রেরিয়ানের সামান্য বেতন!’ ‘বিপু তো এই মাসের টাকা এখনো দিলোনা’ ‘হুম, ছেলেটা একটুও বুঝতে চায় না!’ ‘মিলু আর দীপু তো দিয়ে দিলো, তুমি বিপুকে একটু ফোন করো না’ ‘না দীপুর মা। আমার লজ্জা করে’ ‘এত লজ্জা কীসের তোমার? ছেলেমেয়েদের এত বড় করে দেইনি আমরা!’ ‘থাক থাক দীপুর মা! ওর হয়তো সমস্যা আছে’ ‘টাকাটা পেলে তুমি ডাক্তারের কাছে কিন্তু এইবার অবশ্যই যাবে’ ‘দেখি, বিপু টাকা দিক আগে’......কথাবার্তা থামে অবশেষে। ওরা চুপচাপ বসে বসে এক অপরের দীর্ঘশ্বাস শুনে শুনে সময় কাটায়। সেকেন্ড...মিনিট...ঘন্টা...এভাবেই সময় যায় এবং সেই সাথে বয়স আরও বেড়ে যায় বয়স্ক মানুষ দুজনের। মিলুর আব্বার কাঁধ ঝুলে পড়ে ক্লান্তিতে...মিলুর মার চোখ বুজে আসে অবসাদে......রাতের তারারা উজ্জ্বর থেকে উজ্জ্বলতর হয়। ঝকমকে গল্প, হাসিখুশি মিশুক গল্প, মনমরা মুখগোমড়া গল্প, আশা ভরসার গল্প, নিরাশার গল্প, হরেক রকম গল্প কল্পনার তারার আলোর সাথে, হালকা শীতল হাওয়ার সাথে মিশে ছুটে বেড়ায় এখানে সেখানে......কে কখন খপ করে মুঠোয় ভরে ফেলবে এই আশায় উড়ে বেড়ায় আকাশে বাতাসে...
...'তুই একটা জঘণ্য স্কেপটিক'...'নিহিলিস্ট'...। ...'কী হইলো'!......'কথা বলিস না ক্যান'...?...'রাহাতের সমস্যাটা কোথায়!'......'তোর কাউন্সেলিং দরকার মিলু, কথা বল প্লিজ'..। আমার বিরক্ত লাগে। মিলুকে নিয়ে আমি কী করি! সেই তখন থেকে হাবভাবে চরম একরোখা ভাব নিয়ে ঘাড় গুঁজে পাথরের মতো বসে আছে। আরে বাবা কিছু বলবি তো! আমার অফিসের সময় হয়ে যাচ্ছে সে খেয়াল আছে তোর?
সফিককে চিনিস না?
চিনবোনা কেন? রাহাতের স্কুলের বন্ধু তো?
আমার আর রাহাতের মধ্যে এমন কিছু হয় নাই যেইটা সফিক জানেনা
হুম, তো?
সফিক এখন অস্ট্রেলিয়ায়
তো?
রাহাতের ভার্সিটিতেই
তো?
সফিক আমাকে একবিন্দুও সহ্য করতে পারেনা
তো?
......... ...... ......
তো, কী? চুপ করে থাকবি না মিলু...
তো কিছুনা......
... মিলুর হালকা পাতলা লালচে সেল ফোনটা ঠিক সঞ্চয়িতার মাথার কাছে আছড়ে পড়ে এবং ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়...আর গল্পগুলি টুকরা টুকরা হয়ে ছড়িয়ে যায়...ঢাকায় এবং অস্ট্রেলিয়ায়। গল্প গড়ে ওঠে না। গল্প তৈরি হয়না কারণ মোবাইল ফোনটার টুকরাগুলো কুড়িয়ে নিয়ে মিলু বেরিয়ে যায় আমার ঘর থেকে...আরেকদিন এসে আরেকটা ফোন টুকরা টুকরা করে দেবে এই অনির্ধারিত কিন্তু নিশ্চিত উদ্দেশ্যে। এই গতানুগতিকতা নিয়ে আমি কেমন করে গল্প লিখি! তাই আমি কলমটা ডায়েরির ফাঁকে গুঁজে রেখে, আম্মার প্রশ্নবোধক দৃষ্টি উপেক্ষা করে অফিসের জন্য তৈরি হই...ডায়েরির পাতা খালি থাকাই শ্রেয়...
ভোরের একটা আলাদা ঘ্রাণ আছে। আলাদা রঙ আছে। এই রঙ, এই ঘ্রাণের বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে দীপু মুখ খিস্তি করে একদলা থুতু ফেলে নয়নতারার গোড়ায়। এত ভোরে এখন রিকশা পাই কই! শীত পড়তে শুরু করেছে। বাতাসে ঠান্ডার আমেজ পাওয়া যায়। আর এই আমেজে বোধকরি দীপুর মেজাজও ঠান্ডা হয় কিঞ্চিৎ। সত্যি, রাস্তায় একটা রিকশাও নেই। এখন হাঁটতে হবে অনেকদূর, অনেকক্ষণ। অকস্মাৎ একটা সুদর্শন, সুগঠন যান্ত্রিক যান সাঁৎ করে বেরিয়ে গেলে দীপু একঝলক দেখতে পায় এক কৌতূহলী, টানা সুন্দর চোখ। দীপু থামে খানিক। থমকায় খানিক। কার ডাকে ছুটে যাচ্ছ তুমি মেয়ে? এবং অযথাই লাথি মারে ধুলো ওঠা রাস্তায়...শালার মধ্যবিত্ত! ...ওই গাড়িতেই গল্প আছে...ওই মেয়েটার জীবনে......আর এই রিকশা...লাফ দিয়ে রিকশার সীটে বসা আমি, তিক্ত, বিক্ষিপ্ত মেজাজ...এইটা গতানুগতিক জীবন......এখানে গল্প নাই।...অথবা টানা চোখের মেয়ে কী ভাবে?... গল্প আছে ওই রাস্তায়, ওই ছেলেটার জীবনে, এখানে নয়, আমার জীবনে নয়?
ভোর থেকে সকাল, সকাল থেকে দুপুর, দুপুর থেকে রাত, রাত থেকে আবার ভোর, গল্পেরা আসে অন্য কোনো জগৎ থেকে, কল্পনার সাথে মিশে মিশে, তারার আলোর সিঁড়ি বেয়ে। কেউ কেউ আটকে যায় কাগজে, স্ক্রীণে। বাকিরা মিশে যায় হাওয়ায়। আর মিলু, দীপু, বিপু, মিলুর বাবা, মিলুর মা, গাড়ির মেয়েটা, এবং অন্য মানুষেরা, বিশ্বাস, অবিশ্বাস, ঘৃণা, ভালবাসা, প্রতারণা মিলে এক জগাখিচুড়ী... এইই জীবন। এই জীবনে কোনো গল্প আদতে নেই...অথবা মূলত এই জীবনটাই একটা গল্প...বা গল্প আছে জীবনের অপর জানালায়...আর আমি আছি চোখ রেখে এই জানালায়...যেখানে আমি কোনো গল্প দেখিনা।... ছেলেটা...যাকে আমি নাম দিয়েছি দীপু......মেয়েটা ...যার নাম দিয়েছি মিলু...ওদেরকে নিয়ে গল্প বানানোর আশায় আমি চোখ রাখি ওদের বারান্দায়...পর্দা সরে যাওয়া ঘরের আনাচে কানাচে...দেখি কাঁধে ভারী ব্যাগ নিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে হেঁটে যাওয়া মিলু...প্রতিদিন একই ভাবে...একই সময়ে...দেখি এক লাফে রিকশায় উঠে বসা দীপু...কিছুটা বেপরোয়া যেন...কিছুটা উদাস...কিছুটা হতাশ...আর এলোমেলো জামা গায়ে শিশু চোখের বড় সড় মেয়েটাকে দেখি...যার নাম দিয়েছি বিলু...ওদের অজান্তে ঢুকে পড়তে চাই ওদের জীবনে...মিলুর বন্ধু হয়ে...অথবা দীপুর বন্ধু হয়ে...অথবা দীপুর প্রেমিকা হয়ে। অন্য কোনো বাড়ির, অন্য কোনো ঘরের কোনো জানালা বা দরজা বা খোলা বারান্দায় এমনি করেই বসে কেউ আমাকেই দেখছে কিনা...আমাকে নিয়ে গল্প লেখার কথা ভাবছে কিনা এ অস্বস্তি জোর করে তাড়িয়ে গল্পের খাতা হাতে আগ্রহভরে বসে থাকি......কখন একটি দুটি করে অক্ষর...বা শব্দ...বা বাক্য বসে যাবে আমার খাতায়...একটা গল্প হবে...। অথচ গল্পটা হয়না।...... যা হয় তা হয়তো গল্প, ওদের জীবন নয়।......যা হয় তা নিশ্চিত ওদের জীবন, কিন্তু গল্প নয়।......তাই নিরুপায় উপসংহারে পৌঁছাই......আদতে জীবনে কোনো গল্প নেই।...অথবা এই আমিসহ...পুরো জীবনটাই হয়তো একটা অমীমাংসিত গল্প যার টুকরা টাকরা খামচে নিয়ে তৈরী হয় মসৃণ পাড়ওয়ালা ছেঁড়াখোড়া গল্পাংশ...
১০/০২/২০১১
মন্তব্য
---------------------------------
Sad Songs
হাততালি কেন ভাই?
লেখাটা পড়েছেন, ধন্যবাদ এজন্যে।
গল্প কিংবা ব্লগরব্লগর, যাই হোক, কেন যেনো ভালো লেগেছে। ছেঁড়া সংলাপ, কাটা কথা অথবা দীর্ঘশ্বাষ...
ধন্যবাদ।
প্রতিমন্তব্যগুলো এমন উল্টাপাল্টা জায়গায় গেল কীভাবে!
ভালো লাগলো।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
ভালো লেগেছে খুউব।
------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।
ধন্যবাদ।
যারা লেখালেখি করে তারা সবাই বোধহয় কোন একটা সময় গল্প লেখার গল্প লিখতে চায়। বহুদিন আপনার লেখা পড়া হয় না, কয়েকবার নীড়পাতাতে লেখা দেখবার পরেও পরে পড়ব বলে আর পড়া হয় নি। আজকে ধীরে সুস্থে সিলেবাসে হাত দিলাম ভাল লাগল লেখাটা।
অফটপিকঃ আপনি সচল হয়েছেন আগেই খেয়াল করছিলাম তবে আলসেমির জন্য অভিনন্দনটা দেরিতেই জানিয়ে গেলাম
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
ধন্যবাদ নিবিড়।
ধৈবত
ধন্যবাদ।
নতুন মন্তব্য করুন