মেরীকে আমার মনে পড়ে। হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে। নিরুত্তাপ সকালে সদ্য-জেগে-ওঠা রাস্তায় পা রাখার পর, অথবা অফিসে এক সেকেন্ডও বিশ্রাম না নিয়ে একটানা ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করে যাওয়ার সময়গুলিতে, অথবা সন্ধ্যায় চায়ের পানি যখন টগবগ করে ফুটতে থাকে গ্যাসের চুলায় আর আমি চা-পাতা হাতে প্রস্তুত যখন - সেই সময়ে, অথবা রাতে ঘুমানোর আগে যখন লাইট নিবিয়ে দেবো ঠিক সেই মুহূর্তে কোনও পূর্বাপর কারণ ছাড়াই মেরীকে আমার মনে পড়ে।
মেরী ছিলো পাতলা ছিপছিপে। লম্বাটে মুখের গড়ন। শ্যামলা। লম্বা একঢাল চুল। ব্যাস, এটুকুই। যতই চেষ্টা করিনা কেন, আর কিছুই মনে করতে পারিনা। সে কি সুন্দর ছিল দেখতে? নাকি চলনসই চেহারা ছিল তার? তার গলার স্বর কেমন ছিল? কর্কশ? মিষ্টি? খসখসে? চিকন? মোটা? নাহ। মনে করতে পারিনা। তবে এটুকু মনে আছে, মেরী ছিলো খুব ছিমছাম। পরিষ্কার, গোছানো সাজের। আর দশটা কাজের মানুষের মতো ছিল না সে। হ্যাঁ! মেরী ছিল জাফর স্যার আর অণিমা ম্যাডামের কাজের মানুষ! সে রান্না করতো, ঘর ঝাঁট দিতো, ঘর মুছতো, কাপড়চোপড় ধুতো, ইস্ত্রি করতো এবং করতো আর সব আনুষঙ্গিক কাজ। এবং এত কিছু করেও মেরী আমাদের সাথে খেলার সময় পেতো। কারণ ও বাড়িতে মানুষ ছিলো মোটে দুজন। মেরীকে নিয়ে তিনজন।
জাফর স্যার আর অণিমা ম্যাডামকে প্রথম প্রথম আমি বলতাম জাফর চাচা আর অণিমা চাচী। টুনি, বটু আর তিয়াসাও তাই বলতো। কারণ যে স্কুলটাতে জাফর স্যার আর অণিমা ম্যাডাম পড়াতেন সেখানে আমরা ভর্তি হই বেশ পরে। তাঁরা ছিলেন ঐ এলাকার সবচেয়ে জনপ্রিয় জুটি। দুজনকে মানাতোও চমৎকার। এখনকার ভাষায় বললে বলতে হয় ‘মেড ফর ইচ আদার’। তারা নাকি ‘ইলোপ’ করে বিয়ে করেছেন! এই গল্প পদার্থবিজ্ঞানের ক্লাসে শুনিয়েছেন জাফর স্যারের বন্ধু মকবুল স্যার। গল্প শুনে আমরা সবাই ‘ইলোপ’ মানে কী, কীভাবে ইলোপ করে বিয়ে করে এসব নিয়ে জোর আলোচনা করেছিলাম কয়েকদিন। ক্লাসে বা স্কুলের যেকোনো অনুষ্ঠানে এই জুটিকে একসঙ্গে দেখা গেলে মুগ্ধ চোখে তাকাতাম। জাফর স্যাররা ছিলেন আমাদেরই প্রতিবেশী। তাই ঘরোয়া আড্ডাতে বা অনুষ্ঠানগুলিতে যখন অণিমা ম্যাডাম গাইতেন রবীন্দ্রসংগীত বা আধুনিক গান, আর জাফর স্যার বাজাতেন তবলা, আমরা অনিমেষ নয়নে তাঁদের দেখতাম আর ভাবতাম, ইস আমারও কি এমন হতে পারেনা? এইরকম ইলোপ করে বিয়ে! সেটা ছিল লাগামছাড়া স্বপ্ন দেখার বয়স। তো সেই তাক লাগানো কাহিনীর নায়ক নায়িকা জনপ্রিয় জুটি জাফর স্যার আর অণিমা ম্যাডামের বাড়িতে কাজ করতো মেরী। আর আমরা মেরীর সাথে খেলতে যেতাম দুপুরবেলায়।
জাফর স্যারদের বাড়িটা ছিল খুব সুন্দর করে সাজানো। এলোমেলো কইরা রাখলে অণিমা আপায় রাগ করবো। মেরী বলতো আমাদের। তাই খেলা শেষ হলে আমরা চারজনে মিলে, আবার কখনো কখনো যখন আমরা চারজন ছাড়াও তুলি, সজলরাও থাকতো, তখন সবাই মিলে ঘরগুলো গুছিয়ে রাখতাম। এই কাজটা করতে আমাদের কখনো খারাপ লাগতো না। মূলত আমাদের ভাল লাগার জিনিসপত্র দিয়ে বোঝাই ছিল বাড়িটা। দেখো, খেলো আর সবশেষে গুছিয়ে রাখো। নানান রঙের কাপড় দিয়ে বানানো নানা ধরনের পুতুল; রঙিন কাচ, পুঁতি, প্লাস্টিক, চকচকে শক্ত কাগজ, কাঠ দিয়ে বানানো খেলনা ঘণ্টা, অদ্ভুতদর্শন বাক্স, কিম্ভূত পোকামাকড়, ঝলমলে প্রজাপতি, খেলনা নৌকা, ঘরবাড়ি, রঙিন পিরামিড, লম্বা কালো মসৃণ টাওয়ার; রংবেরঙের মুখোশ, উজ্জ্বল সবুজ, হলুদ, কমলা নরম কুশন - এসব হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে আবার গুছিয়ে রাখতে কী যে ভাল লাগতো! এই এখন, যখন আমার নিজের একটা ঘর আছে, সেই ঘরের সাজসজ্জা দেখে আমি ভাবি, ছোটবেলায় দেখা আমাদের খেলার ঘরটার সাথে একটুও কি মিল নেই আমার ঘরটার! আছে তো! একটু নয়, অনেকখানিই আছে! মেলায় কিংবা পথচলতি রাস্তায় নানা রঙের মুখোশ, পুতুল দেখলে এখনও যে হামলে পড়ি, কোনটা কোন ঘরের কোনখানটায় রাখবো আনমনে ভাবি, এর মাঝে কি সেই দোতলার ডানদিকের সবুজ দরজার ওপাশের রঙিন জগতটার প্রভাব নেই!
কোনও কোনও দুপুরে আমাদেরকে দোতলায় যেতে দেওয়া হতো না। সেই সব দুপুরে মেরী গাঢ় ধূসর, শীতল মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে খুন খুন করে কাঁদতো। ঘোলাটে চোখে অপরিচিতের মতো এদিক সেদিক মাথা ঘুরিয়ে সবার মুখের দিকে তাকাতো। কিন্তু কাউকে চিনতে পারতো না। নিম্নগ্রামে একঘেয়ে সুরে প্রলাপ বকতে বকতে একটা সময়ে বিকট চিৎকারে ভয় পাইয়ে দিতো সবাইকে। ওকে গোল হয়ে ঘিরে থাকা মানুষেরা বৃত্তটা এতে আরেকটু বড় হয়ে যেতো। আর তার মাঝে বসে অবিস্রস্ত মেরী ক্রমাগত খিচুনিতে অস্বাভাবিকভাবে বেঁকে যাওয়া শরীরে আহাজারি করে যেতো অনেকক্ষণ ধরে। অবশেষে মুখে ফেনা তুলে সমাপ্তি দিতো সবকিছুর। তার চারধারে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের বাবা, মা, চাচা, চাচীরা ফিস ফিস করে এর ওর কানে আউড়ে যেতেন জ্বীনে ধরা মানুষদের কাহিনী। আর তাদের থেকে সামান্য দূরে অসহায় অনাত্মীয়ের মতন দাঁড়িয়ে থাকতেন জাফর স্যার আর অণিমা ম্যাডাম। এই সব দুপুরে আমরা দোতলায় যেতাম না। তাই আমরা কখনো মেরীকে ওই অবস্থায় দেখিনি। না, ভুল হলো। একদিন দেখেছি। আর সেদিনের পর মেরী হারিয়ে গেছে আমাদের জীবন থেকে। এমনকি চলে যাবার সময় স্মৃতিটুকুও মুছে নিয়ে গেছে আমাদের মন থেকে।
মেরীর সাথে খেলতে যাওয়াটা আমাদের বাবা, মা’রা একেবারেই পছন্দ করতেন না। অথচ মেরীর সাথে খেলতে না পারলে আমাদের দিনটাই মাটি হয়ে যেতো। মেরী আমাদের জন্য আটআনার লেবু স্বাদের লজেন্স কিনে রাখতো। কখনো কখনো পেতাম সাদা কাগজে মোড়ানো এক টাকার টফি অথবা দুই টাকা দামের চকচকে হলুদ, পিচ্ছিল কাগজে মোড়ানো বরইয়ের বা তেঁতুলের আচার। তবে এসবের লোভেই আমরা বাবা, মা’র নিষেধ না মেনে মেরীর কাছে যেতাম ভাবলে খুব ভুল হবে। মেরী আমাদের সাথে নতুন নতুন মজার সব খেলা খেলতো। বিশাল ড্রইংরু্মের সবুজ গদির সোফাগুলো দেয়ালের সাথে লাগিয়ে ঘরের মাঝখানটায় আমরা খেলতাম। ধূসর, কিছুটা কালচে, পরিষ্কার শীতল মেঝে হয়ে যেতো এক বিশাল সমুদ্র, আমরা সেই সমুদ্রের অতিকায় ঢেউয়ের রাশিকে বাগ মানানো বিশালকায় জাহাজে বসে থাকতাম। কখনো কখনো সেই মেঝেতে গড়ে উঠতো লাল, নীল রত্নখচিত প্রাসাদ। আবার কখনো সেখানে ঝড়ো বাতাস বইয়ে দেয়া কালো মেঘের মাঝে উড়ে বেড়াতাম। কখনো ঘন গহন জঙ্গলে হারিয়ে যেতাম সিংহ শিকারের নেশায়। আবার কখনো শুধুই গল্প বলতো মেরী। ব্যালকনিতে সারি সারি টবের পাশে মোড়া পেতে বসে আমরা গল্প শুনতাম। রাজা-রানীর গল্প, রাক্ষস-খোক্কসের গল্প, সমুদ্রবাসী বিরাটকায় মাছের গল্প, ছোট্ট গাঁয়ের ছোট্ট কোনও বালকের গল্প। আমরা মেরীকে প্রশ্ন করতাম, 'মেরী, তোমার বাড়ি কোথায়?' মেরী ম্লান মুখে উত্তর দিতো, 'আমার কোনও বাড়ি নাই গো। এটাই আমার বাড়ি।'
মেরীর সাথে শেষ দেখার গল্পটা এবার বলি। সেটাও ছিল এমনি এক দুপুর। গাঢ় হলুদ, ঝাঁঝাল, তীব্র, পিচ গলা দুপুর। স্কুল থেকে ফিরে আমি, টুনি, বটু আর তিয়াসা গেছি দোতলায়। ঘরের ভেতর দাগ কেটে আমরা ‘মাংস-চোর’ খেলছি। আমি আর তিয়াসা এক দলে। মেরী, টুনি আর বটু আরেক দলে। বটুটা কিছু পারতো না। তাই ও ছিল দুধভাত। একটা দলে ঢুকিয়ে ওকে খুশী রাখতাম আমরা। তো সেদিন আমি আর তিয়াসা দাঁড়িয়ে আছি দাগের একপাশে। সতর্ক। মেরী দৌড়ে আসছে দম বন্ধ রেখে। আমাদের এ দিকে। আমাদের দুজনের চারজোড়া চোখ দাগের এপাশ থেকে, আর দাগের ওপাশ থেকে আরো চারজোড়া চোখ মেরীর ওপর নিবদ্ধ। ঠিক মধ্যবিন্দুতে, ঘরের মাঝখানটায় পৌঁছে মেরীর কী হলো জানিনা, খিল খিল হেসে লুটিয়ে পড়লো মেঝেতে। মেঝেতে পড়েও বেদম হাসছিল মেরী। যেন খুব হাসির কিছু একটা মনে পড়ে যাওয়ায় হাসি সামলাতে পারছে না। আমরা ভীষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে। তবে ভয় পাইনি মোটেও। মেরী এত হাসছে কেন, এটাই ছিল আমাদের কৌতূহল। তবে কি আমরাই হাস্যকর কিছু করেছি! আমাদের মধ্যে বটুই সবার আগে মেরীর গা ঘেঁষে বসে ওর গায়ে হাত রাখলো। আর সাথে সাথেই আচমকা হাসি বন্ধ করে বড় বড় চোখে বটুর দিকে তাকিয়ে মেরী এক অদ্ভুত প্রশ্ন করলো ওকে। নিবি? তুই নিবি? আমরা কী ভেবেছিলাম এখন আর মনে করতে পারিনা। তবে সেই মুহূর্তেই আমরা কয়েকজন, মানে আমি, তিয়াসা, আর টুনি এক পা এক পা করে পিছিয়ে দেয়ালের সাথে মিশে যেতে চাইছিলাম। কেমন ভয় ভয় করছিল। কী কারণে পরিষ্কার বুঝিনি। তবে এটুকু বুঝেছি, ঘরের পরিবেশ আর আগের মতো নেই। আমাদের অবোধ্য কিছু একটা ঘটছে এখন। শুধু বটুরই কোনও ভাবান্তর হয়নি। বোকাসোকা ছেলেটা মেরীর পাশে আরও ভাল করে বসে জানতে চাইল, 'কী নিবো মেরী?' আমরা স্পষ্ট দেখলাম, এই প্রশ্নে মেরীর চোখের গোল কালো বলটা যেন ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। সাদা অংশটা হয়ে যাচ্ছে ঘোলাটে। বটুকে দুই হাতে তুলে ধরে ভীষণ জোরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে মেরী চিৎকার করে উঠলো। তুইও নিবি! শয়তানের বাচ্চা! তুইও নিবি! দেরী না করে এই চীৎকারের সাথে একযোগে আমরা চারজন জুড়ে দিলাম তীক্ষ্ণ চীৎকার। তীব্র ভয়ে। আমাদের বাবা মা’রা যখন চলে এসেছে, ততক্ষণে বটুকে মেরী আছড়ে ফেলে দিয়েছে মেঝেতে। আর নিজের শরীরের এখানে সেখানে নিজেই খামচি দিতে দিতে তারস্বরে কেঁদে যাচ্ছে অবিরাম। কখন ঘর থেকে বের হয়ে এসেছি মনে করতে পারিনা। ঘর থেকে বের হয়ে যাবার মুহূর্তে মেরী ঠিক কী করছিলো এখন আর চেষ্টা করেও মনে করতে পারিনা। সেটাই ছিল মেরীকে আমাদের শেষ দেখা।
জাফর স্যার আর অণিমা ম্যাডাম মেরীকে তাদের বাসায় আর রাখতে পারেননি। জ্বীনে ধরা একটা মেয়ে যত ভাল কাজই করুক না কেন, যত ভাল হয়েই চলুক না কেন, কলোনির বাচ্চাদের জন্য সে বিপদজনক। তাই একদিন মেরীকে তারা কোথায় যেন রেখে এলেন। আমাদের বাবা মা’রা আমাদের জানিয়েছে যে মেরীকে নাকি তার বাড়িতে রেখে আসা হয়েছে। আমরা প্রত্যুত্তরে কিছু বলিনি, তবে তাদের কথা বিশ্বাসও করিনি। কারণ মেরীই আমাদের জানিয়েছে তার কোনও বাড়ি নেই।
আমরা খুব দ্রুত মেরীকে ভুলে গেলাম। মেরীর ঘটনাটার পর কয়েকদিন 'জ্বীনে ধরা' 'জ্বীনে ধরা' খেলেছি। ‘জ্বীনে ধরা’ বলতে কী বোঝায় সেটা অবশ্য ঠিকমত বুঝতাম না। তবে এটুকু আন্দাজ করেছিলাম যে জ্বীনে ধরা মানুষে অদ্ভুত, ভয়-ধরানো কাজকর্ম করে বা এইরকম আচরণ যারা করে তারাই ‘জ্বীনে ধরা’। আমাদের বাবা-মা’রা আমাদের এইসব খেলা টের পেয়ে যাবার পরপর একদিন টুনিকে গোটাকয় চড়-থাপ্পড় খেতে হলো, তিয়াসাকে শাস্তিস্বরূপ ক’দিন খেলতে যেতে দেয়া হলো না আর আমি কোনও এক বিকেলে আব্বার তুমুল বকা শুনলাম।
সময় তো আর থেমে থাকে না! বড় ক্লাসের পড়ার চাপ, নাচ গান ছবি আঁকা শেখার চাপ, নতুন নতুন গল্পের বইয়ের অচেনা জগতে হারিয়ে যাবার উত্তেজনায় আমরা মেরীকে একসময় পুরোপুরিই ভুলে গেলাম। ইতোমধ্যে জাফর স্যারদের স্কুলে ভর্তি হয়েছি। স্কুলটা ছিল সেই এলাকার মধ্যে সবচেয়ে ভাল, বেশ নামকরাও। অণিমা ম্যাডাম কিছুটা রাশভারী হওয়ায় আমরা তার কাছে বেশি ঘেঁষতাম না। তবে হাসিখুশি, প্রাণচঞ্চল জাফর স্যার ছিলেন স্কুলের সব অনুষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যমণি। স্কুলের মাঠে ছাত্রদের সাথে ফুটবল খেলায় কিংবা নেট টানিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে ব্যাডমিন্টন খেলায় তার কোনও অনীহা দেখিনি কখনো। দাবা বা টেবিল টেনিসেও স্যারকে সাথে পাবার জন্য আমরা ছিলাম উদগ্রীব। স্যারকে আমরা ভীষণ ভালবাসতাম। এমনকি সেই সময়ে জনপ্রিয় নায়ক-নায়িকাদের নয়, আমরা অনুকরণ করতাম জাফর স্যারের কথা বলার ভঙ্গি, চশমার ফ্রেম, অণিমা ম্যাডামের চুল বাঁধার রীতি, শাড়ি পরার ধরন এবং এমন আরও অনেক কিছু। তাদের জন্য শুধু একটাই দুঃখবোধ ছিল আমাদের সবার। এই চমৎকার জুটি ছিলো নিঃসন্তান। তবে একটা মেয়েকে দত্তক নিয়েছেন তারা, একথা শুনেছি স্কুল ছেড়ে চলে আসার পর।
আমাদের স্কুলের গ্রুপটার সবাই এখন দেশে, দেশের বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে। ঢাকায় আছে কেউ কেউ। যোগাযোগ হয়েছে তাদের কারো কারো সাথে। সবাই বিয়ে করে, বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে সংসারী এখন। বহুদিন পর এইতো ক’মাস আগে জানলাম রিইউনিয়ন হবে আমাদের স্কুলে। ঢাকায় যারা আছি, সবাই মিলে ঠিক করলাম রিইউনিয়নে যাবোই যাবো। আগাম ছুটি নিলাম সবাই অফিস থেকে। বন্ধু থেকে বন্ধুর বন্ধু, তার থেকে আবার তারও বন্ধু, এইভাবে খবর ছড়িয়ে দিয়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম স্কুলের গ্রুপটার সবার সাথে। এতে লাভও হলো। অনেকেরই খোঁজ পাওয়া গেল নতুন করে। সবাই মিলে প্রস্তুতি নিলাম। হারিয়ে যাবো আমাদের শৈশবে কৈশোরে কিছুদিনের জন্যে।
রিইউনয়নে পৌঁছেই আমরা দুঃসংবাদটা পেলাম। জাফর স্যার আর অণিমা ম্যাডামের নাকি ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে! খবরটা শুনে আমরা প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারিনি! এ কীভাবে সম্ভব! জাফর স্যার আর অণিমা ম্যাডাম! সেই যুগে ‘ইলোপ’ করে বিয়ে করেছেন যারা! বছরের পর বছর পাশাপাশি থেকেছেন যারা ভালবেসে! নানা রঙের পুতুলে সাজানো সুন্দর ঘর ছিল যাদের! আমরা রীতিমত মর্মাহত হলাম। এমনটা তো হওয়ার কথা নয়! শুধু তাই নয়, এমনটা হওয়া একদম অনুচিত! এতে যে আমাদের কিছু মধুর স্মৃতিও টুকরো টুকরো হয়ে যায়! সত্যি বলতে কি, রিইউনিয়নে আসার আনন্দটাই ম্লান হয়ে গেল। তবে কী কারণে এই অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে গেলো সে খবরটা কেউ দিতে পারলো না। জাফর স্যার বা অণিমা ম্যাডাম, কেউ এ ব্যাপারে মুখ খোলেননি। মেয়েটাকে দত্তক নেবার বছর তিনেক পর একদিন সকালে জাফর স্যার স্কুলে রেজিগনেশন লেটার জমা দিলেন। তারপর কাউকে কিছু না বলে চলে গেলেন এলাকা ছেড়ে। ঘটনা এতটুকুই।
রিইউনিয়ন হয়েছিল তিনদিন ধরে। আমরা যে কলোনিতে থাকতাম সেখানেও গেছি একবার। পুরনো জায়গাটা অনেকটা আগের মতই আছে। সেই মাঠ, পুকুর, পেয়ারা বাগান, বাড়িগুলোর সামনে ছোট্ট একটুকরো করে ফুলের বাগান, সবজি ক্ষেত। শুধু মানুষগুলোই নতুন এখন। পুরনোরা চলে গেছে। তিয়াসা আর টুনিকে অভাব বুকে বাজলো খুব। দুজনেই দেশের বাইরে এখন। অণিমা ম্যাডামকে বহুদিন পর আবার দেখে কী যে ভাল লাগলো! রাশভারী মুখোশটা খুলে আমাদের জড়িয়ে ধরলেন তিনি। আমরা অনেক গল্প করলাম। তবে ভুলেও কেউ জাফর স্যারের নাম উচ্চারণ করিনি। দ্বিতীয় দিনে দেখা পেলাম মায়া মায়া চেহারার বালিকাটির। অণিমা ম্যাডাম এবং অবশই জাফর স্যারেরও মেয়ে। দত্তক নেয়ার সিদ্ধান্ত ছিল দুজনেরই। ওকে কাছে ডাকলাম আমরা। হাতে একমুঠো চকলেট গুঁজে দিতে মিষ্টি হাসলো মেয়েটা। তার হাসিটা যেন ধক করে বুকে গিয়ে লাগলো আমাদের। এই মিষ্টি হাসির মায়া কেমন করে ভুলে আছেন জাফর স্যার? তাঁর কি কষ্ট হয়না মেয়ের জন্য! ওর কাছে জানতে চাইলাম, 'নাম কি তোমার মামণি?' মিষ্টি হেসে বালিকা জবাব দিল, 'মেরী।'
গালে যেন সপাটে চড় বসিয়েছে কেউ, ঠিক এমন এক অনুভূতি হলো আমার। এমন নয় যে মেরী নামটা খুব দুর্লভ। এ নামের কারো সাথে আমার খুব যে শত্রুতা আছে এমনও নয়। তারপরেও আচমকা আঘাতের মতো তীক্ষ্ণ বোধের চাপে আমি চারদিক বিস্মৃত হলাম। গুন গুন গুঞ্জন ধ্বনি ক্রমশ জোরদার হলে বালিকার হাত ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়ালাম এককোণে। দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতেই হলো আমার। কেননা হাবিজাবি রাশি রাশি স্মৃতির চাপে ধ্বসে যাওয়া বহু পুরনো রঙ জ্বলে যাওয়া এক স্মৃতি ফিরে পেলাম আমি। একেবারে অপ্রস্তুত অবস্থায়। আর সেই থেকে হঠাৎ হঠাৎ মেরীকে মনে পড়ে আমার। তার সাথে চোখে ভেসে ওঠে পুরনো ছবির মতো ক্ষয়ে যাওয়া কিছু মানুষের হলদে মুখ। অমীমাংসিত কিছু সূত্র মেলানোর চেষ্টা করি। কাজটা একেবারেই অসম্ভব মনে হয়। নিজেকে এক শুরু-নাই-শেষ-নাই গোলকধাঁধার মাঝে আবিষ্কার করি। সন্দেহ, বিস্ময়, বিশ্বাস, অবিশ্বাস, লজ্জা, ঘৃণা, মায়া, রাগ, অসহায়তা, আফসোস এইসব যাবতীয় অনুভূতির গোলপাকানো জটলায় বড়ই ত্যক্ত বোধ করি। নিজেকে গালি দেই মন খুলে। জটিল, কুটিল, নীচ, সন্দেহবাতিকগ্রস্ত! লাভ হয় না এতটুকুও। তাই হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিই। কিন্তু মেরীর স্মৃতি আমাকে ছাড়েনা। সময়ে অসময়ে মেরীকে মনে পড়ে আমার।
২৩/০২/১০১১
মন্তব্য
যা আন্দাজ করছিলাম
গপ ভালো লাগছে
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
ধন্যবাদ নজরুল ভাই
আপনার লেখা মোটামুটি নিয়মিতই পড়ি।
এটা পড়ে মনে হলো, গল্পটার মাঝের অংশটা এসেই শেষটাকে বলে দিয়ে গ্যাছে।...
ঠিক, কিছুদূর পড়লেই শেষটা আন্দাজ করা যায়। গল্পের শেষে এসে মূল ঘটনা টের পাওয়া যাবে এমন উদ্দেশ্য ছিলও না অবশ্য। ধন্যবাদ পড়বার জন্য।
গল্পটা ভালো লেগেছে। সত্য ঘটনা মনে হয়েছে যদিও।
তবে সুহানের সাথে একমত।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
ধন্যবাদ তাসনীম ভাই। সত্য ঘটনা নয় এটা, পুরো লেখার অল্প কয়েক লাইনের সাথে আমার ছোটবেলার সময়ের মিল আছে। বাদবাকি পুরোটাই বানানো।
ভালো লেগেছে।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
ধন্যবাদ তিথী।
আহা কি হৃদয়হরা বর্ণনা। কি চমৎকার। আপনাকে সেলাম, কুর্ণিশ আপনার লেখনীকে!
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
ধন্যবাদ রোমেল ভাই। এই লাইনগুলো আপনার ভাল লেগেছে জেনে খুশী হয়েছি।
আমার বন্ধু তাজুল ইসলামকে নিয়ে একটা লেখা লিখছি। অদ্ভুতভাবে তার প্রথম অংশটুকু আপনার এ গল্পের ১ম অংশের সাথে মিলে গেল!
লেখার বাইরে অন্য প্রসঙ্গে -
ইলোপ কী তা শিখিয়েছিল মিস্টার রেহমানের 'প্রেমলীলা' কলাম ঃ)
তাই নাকি!!
অন্য প্রসঙ্গে -
আচ্ছা! যাযাদি তেমন পড়া হতো না, তবে 'প্রেমলীলা' কলামের 'সুখ্যাতি' শুনেছি। পড়াও হয়েছে কয়েকবার।
ভালো লাগলো।
ধন্যবাদ আপনাকে।
ভালই লাগল।
মাঝে মধ্যে গল্পের গতিতে কিছুটা ছন্দপতন রোধ করা গেলে আরো ভাল লাগত। নিতান্তই আমার ব্যাক্তিগত অভিমত।
- নুর নবী দুলাল
আপনার মতামত জানানোর জন্য ধন্যবাদ।
গল্পের গতির ছন্দপতন ও আরও হাজার রকমের দোষত্রুটি কিছুটা হলেও কাটিয়ে উঠতে পারবো হয়তো একসময়, এটাই প্রত্যাশা।
ধন্যবাদ অতীত।
চমৎকার বর্ণনা। অনেক অনেক ভালো লাগলো।
-অতীত
নতুন মন্তব্য করুন