সোনালি আলো আলো গায়ের রং। ছোট কপালের ঢালে, দু ভুরুর মাঝে একটা ছোট্ট সবুজ টিপ। চিবুকের মাঝখানটায় হালকা ভাঁজ। পাতলা ঠোঁটজোড়া চেপে বিরক্তি প্রকাশ শেষ করতে পারেনি সে, থেমে গেছে প্রবল বিস্ময়ে। কেউ তাকে ডেকেছে, তার ডাকনামটি ধরে।
আরে! রুমি!
রিকশা থেকে একরকম লাফ দিয়েই নামলো ছেলেটা। মোটা কাচের চশমা চোখে তার।
রুমি তুই! কতদিন পর! এখানেই থাকিস নাকি? নাকি কারো কাছে এসেছিস?
মেয়েটা কয়েক মুহূর্ত স্থির চোখে তাকিয়ে রইলো ছেলেটার মুখে। বিশ্বাস করতে পারছে না পুরনো বন্ধুর সাথে এক জীবন পর এই দেখা হয়ে যাওয়া। মেয়েটার পাশে ছিলো হালকা পাতলা গড়নের মায়াময় চোখ এক ছেলে। তার প্রতিক্রিয়াও একই রকমের। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ওদের দুজনের দিকে।
রাশেদ! তুই!
জমাট যানজটের গ্রন্থিগুলোতে জড়িয়ে থাকা দু'চাকা, তিন চাকা, চার চাকার বাহনগুলি থেকে ছেলে, মেয়ে, বুড়ো, বুড়ি, বাচ্চা-কাচ্চা সবাই কৌতূহলভরে দেখছে ওদের। রিকশা থেকে নেমে যাওয়া ছেলেটা। রিকশায় বসে থাকা কোঁকড়া চুলের মেয়েটা। কালো গাড়িতে বসে থাকা অনিন্দ্যসুন্দর সবুজ টিপ মেয়ে। আর তার পাশে বসে থাকা মায়াবী চোখের ছেলেটাকে দেখছে ওরা। গাড়িতে বসে থাকা ছেলেটা আর মেয়েটাই নজর কাড়ছে বেশি। একটা পার্ফেক্ট ম্যাচ।
সাময়িক জট ছেড়ে গেছে এখন। যান চলাচল শুরু হয়েছে আবার । রিকশা ছেড়ে তিন পা হেঁটে ফিকে কমলা জমিনে সবুজ বুটিদার শাড়ি পরা কোঁকড়া চুলের মেয়েটা এসে দাঁড়াল চশমা পরা ছেলেটার পাশে। মুখে তার লাজুক হাসি। চোখে বিস্ময়। মুগ্ধতা। এবং কিছুটা যেনবা ঈর্ষাও।
আমার বউ। সাথী।
সবুজ টিপ অস্ফুট হেসে অভিবাদন জানাল। ফিরে চাইলো মায়াময় চোখে। চোখে চোখে খানিক কথা। অনুরোধ। অসন্তুষ্টি। নিষেধ। হার মেনে নেওয়া। নামলো ছেলেটা গাড়ি থেকে। মিষ্টি সারল্যমাখা মুখ তার। যে মুখে তাকালে সাধ হয় থেমে দুটি কথা বলে আসি, ঠিক তেমন একটা মুখ। সবুজ টিপও নামলো।
আমার বর। তানিম।
মৃদু হেসে জানাল সবুজ টিপ। মায়াবী চোখের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে হাতটা ধরলো আলগোছে। মায়াবী চোখ সে হাতে মৃদু চাপ দিয়ে জানালো তার ভালবাসা। ভালবাসার সৌরভ এই প্রবল গ্রীষ্মের সোনালী সকালের বাতাসে ভেসে ছড়িয়ে গেল ফটকের দারোয়ান অবধি।
যুবক দারোয়ান তার হাতের মোটা লাঠি নামিয়ে বসেছে ছোট টুলে। স্বপ্নিল চোখে ভাবছে বুঝিবা ফেলে আসা রাতের ভালবাসাবাসির কথা। বউটা কী করছে এখন!
স্নিকার পায়ে প্রৌঢ় মানুষটা ওদের পেরিয়ে গেলো। মুখে তার বিষণ্ণ হাসি। তার দিন তো কবেই গেছে ফুরিয়ে। তার সময়েও ছিল এমন ছায়া ছায়া নরম দিন। ছিলো এমন রঙিন শাড়ি আর টিপেরা। এমন বাতাসে ভেসে আসা ভালবাসার মৌ মৌ ঘ্রাণ।
সামান্য দূরে রাস্তার ধারে বাদাম বুটঅলা দেয়ালে হেলান দিয়েছে। ওহ, এরকম একটা মেয়েকে যদি বউ করে পাওয়া যেত! কী যে সুন্দর লাগছে ওদের।
ছুটির এমন এক সকালে এ এক অতি চমৎকার ছবি।
দিনটা বড় সুন্দর। যদিও এখন গ্রীষ্মের শুরু, রোদের আঁচ নেই তেমন। থোকা থোকা মেঘ ঝুলে আছে। গুমোট ভাবটা কাটছে ধীরে ধীরে। বাতাস বইছে মৃদু মৃদু। সে বাতাসে মেঘগুলো ছুটোছুটি করে চলেছে দুষ্টু ছেলেদের মতো। বড় বড় গাছগুলোর শাখায় শাখায় ঘন সবুজ পাতারা দুলছে। চলে গেছে বসন্ত। তার রেশ রয়ে গেছে। মেঘে ছাওয়া রোদ নিরুত্তেজ আলোয় ধুয়ে দিয়েছে নতুন গ্রীষ্মের সকালটাকে। সর সর শব্দ তুলে কাগজ, কুটো, চকলেটের লাল নীল মোড়ক সরে গেল প্রশস্ত রাস্তার এপাশ থেকে ওপাশে। ফুটপাত ধরে হেঁটে যাওয়া পনিটেল কিশোরী ফিক করে হেসে ফেললো কেন জানি। অমন মায়াবী চোখ আর নিষ্পাপ হাসিমুখ কেউ তাকে একটা রক্তগোলাপ দিয়েছিল বুঝি কোনো নির্জন সুগন্ধি সন্ধ্যায়।
সবুজ টিপ ও তার সঙ্গীর তাড়া আছে। কেমন আছিস? ভাল আছি। এটুকু সেরে ওরা গন্তব্যে চলে যেতে চায়। নাকি দিনটা শুধু নিজেদের করে নিতে চায় বুঝি! ফিকে কমলা শাড়ি এত অল্পে খুশি নয়।
তোমার কথা ওর কাছে অনেক শুনেছি।
সবুজ টিপের চোখে ছায়া ঘনাল। তার এক সেকেন্ড পরেই ঝলমলে রোদ এসে জায়গা করে নিলো পুরো চোখ ও মুখ জুড়ে।
তাই!
হুম। ছবিও দেখেছি। তুমি কিন্তু ছবির চেয়েও অনেক সুন্দর!
এক ঝলক মিষ্টি হাওয়ার সাথে মিশে গেল সবুজ টিপের রিনিঝিনি হাসি।
তুমিও তো খুব মিষ্টি দেখতে।
ফিকে কমলা শাড়ি খুশি হলো এই প্রশংসায়। সবুজ টিপের টোল পড়া চিবুক আর রিনিঝিনি হাসিতে কিছু একটা আছে। মন কেড়ে নেয়। আনমনে রাশেদ দৃষ্টি ফেরালো দূরের কফিশপটার রঙ্গিন নকশাদার কাচের দরজায়। ভুল করে ফেলেছে কি?
ওরা হেঁটে চললো। গন্তব্য সামনের কফিশপ। মেয়ে দুটো আগে আগে। তাদের পিছে ছেলেরা। কী মনে করে সবুজ টিপ একবার ফিরে তাকালো মায়ামায়া চোখের দিকে। কথা বলছিলো ছেলেটা তার পাশের সদ্য পরিচয় হওয়া তরুণটির সাথে। এরই ফাঁকে একটুকরো হাসি ছুঁড়ে দিলো সে সবুজ টিপকে।
এইই হলো ভালবাসা! বারে বারে মুখটা দেখতে ইচ্ছে হয়। এমনটাই ভাবলো বিস্কুট-চিপস সফট ড্রিঙ্কসের দোকানী লোকটা। তামাকের কড়া দাগ পড়া মোটা ঠোঁট মুচড়ে হাসলোও একটু।
সারল্যমাখা মুখ রাস্তা পেরিয়ে দোকানটাতে ঢুকে গেল। বেরিয়ে এলো চারটা চিজবলের হলদে প্যাকেট হাতে। হুম, প্রথম প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিলো সে সবুজ টিপকেই।
আমাকে তো রাশেদ এমন করে ভালবাসেনা। বাসে কি?
ফিকে কমলা শাড়ি বিষণ্ণ মনে ভেবে নিলো এক ফাঁকে।
ওরা হেঁটে চলেছে রাস্তার ধার ঘেঁষে। গতি বেড়েছে বাতাসের। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে সবুজ টিপের পাতলা নরম চারকোল গ্রে ওড়না। এলোমেলো উড়ছে ফিকে কমলা আঁচল। ওদের সুগন্ধিমাখা শরীরের মৃদু সৌরভ মিশে যাচ্ছে বাতাসে। কফিশপের উল্টোপাশে গাছতলায় বসে থাকা বলিরেখা-মুখ হাত বাড়িয়ে দিলো সবুজ টিপ আর ফিকে কমলা শাড়ির সামনে।
কিছু দিয়া যান মায়েরা। আল্লায় আপনাগো আরো অনেক দিবো।
ছোট্ট সবুজ হাতব্যাগ থেকে খুচরো টাকা বের করে দিলো সবুজ টিপ। খুশি হলো থালা হাতে বৃদ্ধ। দিনটা সত্যি সুন্দর। আর ফলবতী।
ওরা কফিশপের তৃতীয় খদ্দের। জানালার পাশে একটা বড় টেবিল নিয়ে বসলো চারজনে।
মেয়ে বটে একখানা। ভাবলো কাউন্টারের ওপাশে বসে থাকা লোকটা।
ছেলেটা কী দারুণ দেখতে। কী মায়ামায়া চোখ! কোনাকুনি বসে থাকা টেবিল থেকে নিচু স্বরে বলে উঠলো তরুণী।
মেয়েটাকে দারুণ মানাচ্ছে কিন্তু ছেলেটার সাথে। বললো তার সাথের তরুণ।
ওরা শুধু কফি নিলো। একটা দুটো ছেঁড়া বাক্য বিনিময়। তারপরই জমে উঠলো গল্প। জমালো মূলত সবুজ টিপ। মুহূর্তে মুহূর্তে তার রিনিঝিনি হাসিতে কেঁপে কেঁপে উঠলো শীতল হাওয়া। প্রশ্রয়ের ও স্নেহের হাসি হেসে প্রতিবারই মায়াবী চোখ কান পেতে শুনলো সে হাসি। প্রশংসার দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো কফিশপের অন্য খদ্দেররা। এই হলো যৌবন। আর ভালবাসা। ওরা ভাবলো।
ওদের গল্প এতটাই জমে গেল যে কফিশপ থেকে বেরিয়েও ওরা আলাদা হয়ে গেলো না। এলোমেলো হাঁটলো। গল্প করলো। হাসলো। তর্ক করলো। মেয়েরা ছেলেদের, ছেলেরা মেয়েদের হাত ছুঁলো গোপনে। প্রগলভ এক তরুণ হঠাৎ গর্জে ওঠা বাইক সামলে হাসি ছুঁড়ে দিলো মেয়েদের দিকে।
স্যরি!
মেয়েরা কোনোমতে বাইক থেকে দূরে সরে গিয়ে হাসিতে প্রত্যুত্তর জানালো।
মেঘ সরে গিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে দিনটা। বাতাসের কমতি নেই। ছুটির দিনের এই আঁকাবাঁকা গলিপথ অপেক্ষাকৃত নির্জন আজ। রাস্তার প্রায় গা ঘেঁষে দোতলা পুরনো বাড়ির ব্যালকনিতে এক বেণী দোলানো বালিকা। চোখ তার রাস্তায়। ব্যাট হাতে বাঁকা হয়ে দাঁড়ানো বালকটির মুখে। প্রস্তুত বল হাতে অপর বালক। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আর দু তিনজন। নিশ্চুপ অপেক্ষা। আচমকা ধুলো উড়লো বাতাসে। ওরা হেঁটে গেল ধুলো গায়ে মেখে। ওরা চারজন।
ডিয়ার লিসেনার্স, এই রোদ ঝলমলে ঢাকার রাস্তায় ও গাড়িতে অথবা বাড়িতে বসে যারা শুনছেন তাদেরকে জানাই এক আকাশ রোদমাখা শুভেচ্ছা। এইরকম একটা সুন্দর দিনেই হয়তো এলোমেলো হাঁটতে হাঁটতে অনেকদূর চলে যেতে ইচ্ছে হয়। চলে যেতে ইচ্ছে হয় এমন কোথাও, যেখানে কোনো দুঃখ নেই, কষ্ট নেই। ডিয়ার ফ্রেন্ডস, শুনুন উইনিঙের "ইচ্ছে করে", আমার খুবই ফেইভরিট একটা গান,... আর ...সাথেই থাকুন। ইনজয়!
নতুন গ্রীষ্মের প্রথম বৃষ্টির ছোঁয়া লাগা একগুচ্ছ দোলনচাঁপার মতোই তরতাজা এই দিনটা। আর আনন্দময়।
ওরা দুপুরে খেলো একসাথে। সবুজ টিপ চাইলো ফ্রাইড রাইস। ফিকে কমলা শাড়ি নিলো চাউমিন। লো ভল্যুমে বাজছেন ক্রিস ডি বার্গ। খেতে খেতে ওরা গান শুনলো আনমনে। গান শোনার ফাঁকে ফাঁকে কথা বললো নিচুস্বরে। কথার সাথে গান যেন জড়িয়ে মরে না যায়।
বিকাল হয়ে এলো। বাড়ি ফেরার ইচ্ছা জানালো না কেউ। এমন সুন্দর একটা দিনে কে চায় ঘরের ভেতর সেঁধোতে! তিন চাকা, চার চাকাতে চাপার সাধও জাগলো না ওদের। কাটুক না দিনটা এমন পরিকল্পনাবিহীন! জানাশোনার, মিলিয়ে নেবার, মনে মনে হিসেব মেলাবার এমন সুযোগ কি আর পাওয়া যাবে! দিনটা অন্যরকমই থাকুক নাহয়।
বিকেল গড়িয়ে এলে ওরা পার্কে বসলো। সবুজ ঘাস স্বাগত জানালো ওদের। এলোমেলো গাছের সারি শন শন শব্দ তুলে গান শোনালো। স্বাস্থ্যসচেতন পুরুষ ও নারীরা ওদের পেরিয়ে গেল একে একে।
এইই তো বেঁচে থাকার আনন্দ। ভাবলো ওরা।
পাখিদের কলকাকলি যখন স্তিমিত হয়ে এলো, ওরা বুঝলো সন্ধ্যার আর দেরী নেই। রং বদলাচ্ছে আকাশ। বেগুনিতে, গোলাপিতে। সময় হলো ঘরে ফেরার।
তারপর?
রুমিকে চুপচাপ দেখে আমি প্রশ্ন করলাম। আমাদের পাশে বসেছে এক পরিবার। বাবা, মা আর তিন ছেলেমেয়ে। ছেলেমেয়েগুলো কথা বলছে খুব জোরে জোরে। নিজেদের কথা শুনতে তাই আমাদের জোরে জোরে কথা বলতে হচ্ছে। অথচ এটা আমরা চাইছি না।
তারপর আর কী! নাভিদ আমাকে একটা টাকাও দিলো না।
কেন? কেন টাকা দেবেনা? টাকা তো তোমার পাওনা ছিলো।
রাগ হলো আমার।
হুম। পাওনা ছিলো। তবে নাভিদের দিনটা আমি মাটি করেছি। বুঝতেই পারছো। জানালার কাচ না নামালে হয়তো এসব কিছুই হতোনা।
কিন্তু, এমন তো না যে তুমি জানালার কাচ নামাতে পারবে না। তোমার কী দোষ! রাশেদ যে ওখানে থাকবে তুমি কীভাবে বুঝবে!
অসহিষ্ণু বোধ করি আমি। এটা রুমির প্রতি অবিচার। কিছু টাকা অন্তত দেয়া উচিত ছিলো ওকে। ও ওর কাজ করে উপার্জন করেছে এই টাকা। উদাসীন ভঙ্গিতে হাত উল্টালো রুমি।
নাহ। বুঝতে পারছো না তুমি। রিস্ক ছিলো ব্যাপারটায়। সারাদিন এভাবে আমার সাথে কাটানো! এটা কিন্তু ইয়ে...কী বলা যায়...খুবি এক্সট্রাওর্ডিনারি। নাভিদ ছেলেটা আসলে ভাল। নাহলে আমাকে এভাবে সাপোর্ট দিতো না। সকালে আমাকে এগিয়ে দেয়ার দরকারও ছিলো না কিন্তু! ছেলেটার মন মরে যায় নায় এখনো।
আমি সন্তুষ্ট হতে পারিনা।
চাইলেই রাশেদকে এড়াতে পারতে।
ভ্রু উল্টালো রুমি।
পারতাম। আবার পারতাম না। কারণ ওটা ছিলো রাশেদ। বুঝতে পারছো না কেন? ওটা ছিলো রাশেদ!
রুমির আঙুল ওর রোদচশমায় চেপে বসেছে। এখুনি ভাঙবে ওটা।
হ্যাঁ বুঝতে পারছি।
তড়িঘড়ি জবাব দিয়ে পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটে চলা হার্টবিটের রাশ টেনে ধরতে চেষ্টা করলাম।
আমাদের পেছনে তিন তরুণ এসে বসেছে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম আমি। ওরা ভাজা চিকেন নিয়েছে। খাচ্ছে। আর রুমিকে দেখছে। আমাদের ঘিরে তিন বাচ্চার উঁচু গলার কথা। এছাড়া রেস্তোরা নীরব।
নাভিদ তো তোমার সত্যিকারের নাম জেনে গেলো!
রুমির চিবুকের ভাঁজে ছড়িয়ে গেল হাসি। তিন তরুণ এত চুপচাপ কেন? ওরা আমাদের কথা শুনতে চাইছে।
এটা আমার ডাক নাম! কোথাও ইউজ করিনা। নাভিদের সাথেও আর কোনো বিজনেস নাই আমার। ঝামেলা শেষ।
তিন তরুণের পাশের টেবিলটায় দুটো অল্পবয়স্ক ছেলেমেয়ে এসে বসলো। চোখের কোণ দিয়ে দেখতে পেলাম।
তোমার তাহলে লস হয়ে গেল।
কিশোর কিশোরী দুজন টেবিলের ওপর দিয়ে ঝুঁকে বসলো একে অপরের দিকে। ওরা নিজেদের কথা কাউকে শুনতে দিতে চায়না। রেস্তোরাটা আরও বড় হওয়া দরকার ছিলো।
নাহ। লস হয়নি। আরও দুইজন ক্লায়েন্ট দিলো নাভিদ। ও আমার রুচি বোঝে।
আমার ক্লান্ত লাগে। অথচ রুমিকে ছেড়ে উঠে যেতেও ইচ্ছা করছে না। এই রেস্তোরা, পেছনের টেবিলের তিন তরুণ, তাদের পাশের দুই কিশোর কিশোরী, পাশের টেবিলের পরিবারটা, আর আমার মুখোমুখি বসে থাকা রুমি - এই সবকিছু কেমন যেন অবাস্তব লাগছে আমার। উদ্ভট লাগছে। এটা তো একটা উপন্যাসের পাতা হতে পারে। কয়েক মিনিট পরে কেউ উলটে দেবে। অথবা এটা নাটক কিংবা সিনেমার একটা দৃশ্যও তো হতে পারে। কিছুক্ষণ পরে অন্য দৃশ্যে পালটে যাবে। এমন কিছুই হলো না।
এই বিজনেস না করলে হয় না রুমি? তোমার একটা ভাল চাকরি আছে।
না। এখন আর হয়না। ...ব্যবসাটা শুরু না করেও উপায় ছিলো না।
ওর এই উত্তরে আমি সন্তুষ্ট হতে পারিনা। টেবিলের কোনা আঁকড়ে ধরি অকারণে।
কিন্তু...
কোনো কিন্তু নাই। রুমির দৃঢ় জবাব।
ঠিক আছে, তাহলে কিন্তু নাই।
আমার খারাপ লাগে। কিন্তু কেন খারাপ লাগে বুঝতে পারিনা। বুঝতে পারিনা বলে আরও খারাপ লাগে।
আব্বা মারা যাওয়ার আগে আমাদের টিনের ঘর ছিলো লীনা।
এই কথাগুলো বলছে রুমি ফিসফিস করে। যেন কী লজ্জার এক কথা। জোরে বলতে নেই।
আব্বা যখন মারা যায়...মারা যাবে জানতাম...তারপরও হাল ছাড়া তো যায় না। যায় বলো?
দুপুর হয়ে আসছে। অত্যন্ত অপ্রাসঙ্গিকভাবে আমার মনে হলো ভারি কিছু খাওয়া দরকার।
তাই হাল ছাড়লাম না। ছুটাছুটি করলাম এদিক সেদিক। একা একাই। ...না, রাশেদ সাথে ছিলো না...কথা বলো না...আমাকে বলতে দাও। ...ম্যানেজ হলো সবকিছু। দুলাভাই ব্যবস্থা করলো। সব ঠিকঠাক হওয়ার পর দুলাভাই বুঝালো কিছু পেলে কিছু দিতেও হয়। তো ব্যবসায় ঢুকতে বাধ্য হলাম। ভাবলাম ব্যবসাটা নিজের ঘরে না থাকুক। তাই বাইরে বাইরে...তোমাকে কি আরো ডিটেইলে বলবো লীনা? তুমি বুঝতে পারছো তো? নিজের মতো করে লিখতে পারবে না? ডায়ালগ গুলো তোমার ইচ্ছামতো দিয়ো...
কফি শেষ করে ফেলেছি বেশ আগেই। এরা সুন্দর মগে করে কফি দেয়। আমাকে দিয়েছে মাটি রং কাপ। নিচের দিকে সামান্য সরু। হাতলটা বেশি লম্বা। রুমিকে দিয়েছে ভায়োলেট মগ। ছোট ছোট ফুল। ওপরে নিচে সমান প্রশস্ততা। ওরটা বেশি সুন্দর। এটাই স্বাভাবিক। ভাবছিলাম এরকম মগ কিনতে পাবো কোথায়।
আমাকে কেন এসব বলছো রুমি?
ভাবছি, ওর নাম কি আসলেও রুমি? নাভিদ কিংবা তানিম, কোনটা আসল নাম? একটাও না হয়তো। আর রাশেদ? এটাও না বোধহয়। রুমিকে দোষ দেয়ার কিছু নেই।
বলেছি তো প্রথমে। একটা গল্প লিখবে আমাকে নিয়ে। তুমি গল্প লিখো, তোমার বরের কাছে শুনেছি।
সেই রাতের কথা মনে পড়ে গেল আমার। বিয়েবাড়ি থেকে বেরোচ্ছিলাম আমি আর শাহেদ। হঠাৎ হুড়মুড় করে বাইরে থেকে একদম গায়ের ওপর এসে পড়লো মেয়েটা। সামলে নিয়ে তাকাতেই আমি হতবাক। লাল নীল মরিচবাতি ঘেরা জায়গাটুকুতে হঠাৎ পরী নেমে এলো নাকি আকাশ থেকে! বেবি পিঙ্ক সিল্ক পড়া মেয়েটা পরীর মতো সুন্দর। ওর পাশে এক কিশোরী। চেহারায় খানিকটা মিল আছে। থমকে দাঁড়ালাম। আমার হতভম্ব হয়ে যাওয়া ভাব না কাটতেই শুনতে পেলাম শাহেদের সাথে আলাপ জুড়ে দিয়েছে মেয়েটা।
আরে তুমি!
আরেহ! কী খবর!
ওরা একসময় কলিগ ছিলো। আমাদের বাসায় ফেরার তাড়া ছিলো তাই আলাপ এগোয়নি খুব একটা। তার ঠিক এক সপ্তাহ পর পরীর মত মেয়েটার ফোন পেয়ে তড়িঘড়ি অফিস থেকে বেরিয়ে এসে বসেছি এই রেস্তোরায়।
ওইটুকু দেখায় আমাকে তোমার এত বিশ্বাস হলো কেন বলোতো?
অনাবিল হাসলো রুমি।
তুমি খুব মিষ্টি মেয়ে লীনা। আমি তোমাকে একবার দেখেই বুঝে নিয়েছি। ...আমার কথা বিশ্বাস না হলে ধরে নাও জুয়া খেললাম। ...তুমি তোমার বরকে এসব কিছুই বলবে না কিন্তু। ...আমি জানি তুমি আমার অনুরোধ রাখবে...কী ঠিক?
অদ্ভুত। মেয়েটা বুঝলো কীভাবে!
আমাদের পাশের পরিবারটা চলে গেছে। টেবিলটা খালি এখন। পেছনের তিন তরুণ এখনো আছে। তবে গল্প করছে ওরা এখন।
গল্পটা তুমি কোথায় লিখবে লীনা?
আমি জবাব দেই না। কী বলবো!
প্লট খুঁজে বেড়াও না তুমি? এত ভাল একটা গল্পের প্লট দিলাম! গল্পটা তোমাকে লিখতেই হবে লীনা।
আমি তো নিজের নামে লিখিনা। তুমি বুঝতে পারবে না।
আমাকে সেই নামটা বলো, যে নামে তুমি লিখো। আমি কাউকে বলবো না। প্রমিস।
কৌতুক ভরা কণ্ঠে আমাকে আশ্বস্ত করে রুমি। চোখে চিক চিক করছে হাসি।
আমি ওকে আমার ছদ্মনাম বললাম। কোথায় লিখি সেটাও বললাম। আর সাথে সাথে সাদা হাতব্যাগটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো মেয়েটা। আমি যাই লীনা। অপেক্ষায় থাকবো কিন্তু। আমাকে হতাশ কোরোনা।
রুমি চলে গেলে কেন জানিনা একাকী বোধ করি আমি। অথচ ওর সাথে পরিচয় মাত্র কয়েক ঘণ্টার। পেছনের তিন তরুণ বেরিয়ে গেছে। কিশোর কিশোরী জোড়া এখনো আছে। নিজেতে নিমগ্ন। আমি বেরিয়ে এলাম। রঙ্গিন কাচ ঘেরা রেস্তোরা থেকে বেরিয়ে চোখ ঝলসে গেল আমার। বাইরে ঝক ঝক করছে রোদ। কেমন অস্বস্তি বোধ করছি। কোনো কিছুর অপেক্ষায় ছিলাম আমি। কীসের? এখনো জানিনা। কিছু একটা মিলছে না। অথবা আমিই হয়তো মিলতে দিচ্ছিনা। ভাবছি, সেটা কী হতে পারে।
রেস্তোরা থেকে সিঁড়ি নেমে গেছে চার ধাপ। গাড়ী পার্কিং এর জায়গা। কিছু ছেলেমেয়ের জটলা ওখানে। এক ছেলের কাঁধে ঝোলানো গিটার। একটা মেয়ে বসে আছে সিঁড়িতে ঠেস দিয়ে। চমৎকার মেরুন সুতার কাজ করা একটা জামা গায়ে। মেয়েটা হাসছে। আমাদের পেছনের টেবিলের তিন তরুণের একজন দাঁড়িয়ে আছে সিঁড়ির দ্বিতীয় ধাপে। একটা রিকশা থামলো সিঁড়ি ঘেঁষে। আমি সেই কিছু একটার খোঁজ পেলাম।
তোমার বর! আচ্ছা! আমার কলিগ! ঠিক আছে! তোমার কলিগের নাম কি শাহেদ? রুমি কি শাহেদের নামটা জানে? শাহেদ রুমির নাম?
আমি রুমির মুখ থেকে আমার বরের নামটা শুনতে চাইছিলাম। শুনতে পাইনি। না আজ। না সেই রাতে। অপেক্ষা নিষ্ফল গেছে।
তো? কী এসে যায়?
মাথাটা ভার ভার লাগে। মাইগ্রেনের ব্যথা শুরু হলো। রোদের আঁচ সইতে পারছি না। এজন্যেই হয়তো ব্যথাটা বাড়ছে। একটা টাফনিল খাওয়া দরকার। ব্যাগে আছে। সাথে পানি নেই। রেস্তোরাতে ফিরে যাবো? ইচ্ছা করছে না! শুধু ইচ্ছা হয় এক বিশাল বৃক্ষের মতো শিকড় গেঁড়ে এইখানে অনন্তকাল দাঁড়িয়ে থাকি। মাথার ভেতরে পোকার কামড় টের পাই। অসহ্য লাগে। কামড়ের হাত থাকে বাঁচতে মাথাটা এদিক ওদিক ঝাঁকাই! কোনো লাভ হয় না। পোকাগুলো আটকে আছে খুলি কামড়ে। মাথাব্যথা বাড়লো ঝাঁকিতে।
তিন তরুণের তৃতীয়জন এখনো দাঁড়িয়ে আছে। এখন সিঁড়ির প্রথম ধাপে। ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালে কেমন হয়?
কী রোদ!
হুম! ভীষণ গরম পড়েছে।
ছাতা আনতে ভুলে গেছি আজকে। এই রোদে মাইগ্রেনের ব্যথা বাড়ছে আমার। কী যে যন্ত্রণা!
আমার সাথে গাড়ী আছে। কোথায় যাবেন? পৌঁছে দেবো আপনাকে?
না না সেকি! আপনি কষ্ট করবেন! আপনার কাজের দেরী হয়ে যাবে না!
নাহ। দেরী কীসের। ইন ফ্যাক্ট আমার হাতে কোনো কাজ নেই এখন।
এরকম কথা হতে পারে আমাদের। তারপর আমরা একসাথে যেতে পারি। কোথায়?
ব্যথায় মাথাটা গেছে আমার। যাক। কী এসে যায়!
প্রচণ্ড রোদে কাঁপছে বাতাস। সবকিছু অপার্থিব লাগছে হঠাৎ করে। এইই কি আমার পরিচিত পৃথিবী? রেস্তোরার দরজা খুলে অন্য কোথাও চলে আসিনি তো? তাইই হবে! চোখজোড়া কুঁচকে দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে চারদিকে তাকালাম। সবকিছু একইরকম আছে। ধূসর কালো রাস্তা। রাস্তার ওপরে মানুষেরা। রিকশা, বাসের দঙ্গল। রাস্তার পাশে পাশে দোকানপাট। হাসপাতাল। স্কুলের গেইট। আইল্যান্ডে বেঁটে গাছের সারি। সবুজায়নে ক্রিডেন্স ব্যাঙ্ক। এই ব্যাঙ্কে আমার অ্যাকাউন্ট আছে। ...সবই ঠিকঠাক দেখা যায়। তবুও! খুব সম্ভবত সূক্ষ্ণ একটা পরিবর্তন ঘটেছে কোথাও। স্বস্তি পাই না আমি।
দূরে দেখতে পেলাম এক জোড়া তরুণ তরুণী রাস্তায় দাঁড়িয়ে। মেয়েটা এক ওষুধের দোকানে ঢুকলো। এক লহমায় পালটে গেল ছেলেটার মুখ। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো আমার। মেয়েটা ফিরে এসে হাসলো ছেলেটার মুখে চেয়ে। মেয়েটার জন্য ভয় হলো।
আমার ডানে বসে থাকা জটলা থেকে হাসির শব্দে মুখ ফেরালাম। মেয়েটা তুমুল হাসছে। তার পাশে বসে হাসছে গীটার হাতে ছেলেটা। মেয়েটার মুখ অন্যরকম এখন। ছেলেটা বুঝতে পারছে না কেন? আমার চোখেই সব এমন দেখাচ্ছে কেন?
এ সবই মাথার ভেতরের পোকাদের কাজ। আমি নিশ্চিত। পোকাগুলো একটা একটা করে ধীরে ধীরে আমার চোখের ভেতরেও ঢুকে গেছে। এতটা অধিকার নেই কীটগুলোর! ওদের শেষ করে দিতে হবে। দাঁতে দাঁত চেপে ভাবলাম।
আপাতত আমার একটা আয়না দরকার। ব্যাগে আজ আয়না নেই।
প্রবল মাথাব্যথা নিয়ে তীরের ফলার মতো রোদের আঘাত গায়ে মাথায় গেঁথে আমি রাস্তায় নামলাম। একবার...অন্তত আর একটাবার রুমির সাথে আমার আবার দেখা হওয়া দরকার। সেলফোন হাতে নিয়ে লাভ নেই। জানি ওপাশে দরজা বন্ধ হয়ে গেছে।
আমার ডানদিক থেকে একটা সিটিবাস এগিয়ে আসছে দ্রুত। আমি রাস্তা পার হচ্ছি। আমার বামে একইসাথে রাস্তা পার হচ্ছে রেস্তোরার সেই ছেলেটা। ওর দিকে তাকালাম। সেও আমার দিকে তাকালো। হুম! চেহারা বদলে গেছে। আমাকে কেমন দেখাচ্ছে?
সিটিবাস একটু ধীরে আসতে পারে। কারণ আমার একটা কাজ আছে। গল্পটা লিখে ফেলতে হবে। ছেলেটা কি আমার সাথেই রাস্তার ওপাশের ব্লু বার্ডস সাইবার ক্যাফেতে ঢুকবে? সেও অপেক্ষা করতে পারে। কারণ আমাকে কাজটা শেষ করতে হবে। মাথার খুলি কামড়ে থাকা পোকাগুলো মেরে ফেলবার আগেই গল্পটা লিখে ফেলতে হবে। তাই শুধুমাত্র একটি চিন্তা রেখে মাথা থেকে সব ভাবনা ঝেড়ে ফেলে দিলাম। যাই ঘটে থাকুক না কেন গল্পটা লিখতে হবে আজই! লিখতেই হবে। কেননা আমি রুমিকে কথা দিয়েছি। কথা দিয়েছি গল্প লিখে দেবো।
০৭/০৫/২০১১
মন্তব্য
চমৎকার
ধন্যবাদ আপনাকে।
'দেখছিও তো কবো না....
লম্বা ঘুষি মারেগা!
হা রে মনোপাগলা।'
পড়লাম, এখন ভাবছি..
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
আরে এত ভাবনা-চিন্তার কিছু নাই...
গল্পের কথক কে কখন এটা নিজের দোষে বুঝতে না পারায় একটু প্যাচ লেগেছিলো। কিন্তু পড়া শেষে সবটা বুঝে গেছি পরিষ্কার আবারও বলি, আপনি চারপাশের পরিবেশের বর্ণনায় এতটাই নিখুঁত মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না! " বিশ্বাস করতে পারছে(না) পুরনো বন্ধুর সাথে এক জীবন পর এই দেখা হয়ে যাওয়া" এই লাইনটা একটু দেখবেন প্লিজ। শুভেচ্ছা।
ঠিক করলাম। ধন্যবাদ।
শেষটা ঠিক মতো বুঝি নাই। কিন্তু পড়তে ভালো লাগছিল। বর্ণনাগুলো চমৎকার। আচ্ছা, দোলনচাঁপা কি গ্রীষ্মে হয়? আমি তো জানতাম এটা বর্ষার ফুল। দোলনচাঁপা আর কৃষ্ণচূড়া, এই দুইটা ফুল আমার মাথা আউলা দেয়।
ধন্যবাদ। দোলনচাঁপা বোধহয় বর্ষারই ফুল। কৃষ্ণচূড়া আমার মাথাও খানিকটা আউলা করে দেয়।
নতুন মন্তব্য করুন