অমীমাংসিত তৃষ্ণা

বইখাতা এর ছবি
লিখেছেন বইখাতা (তারিখ: শুক্র, ২৪/০৬/২০১১ - ৫:৫৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ভরদুপুরে এই জায়গাটায় একটামাত্র কাক, বিস্তর ডালপালা ছড়ানো একটা আমগাছের ডালে, ছাইরং তার। ওইটাই ডেকে উঠলো। তাতে ঘনবদ্ধ শূন্যতা সামান্য চিরে গেল। এরপর আবার সব চুপ। চড়া হলুদ রোদ। সরিষার তেলে ডুবানো ঝাল আচারের মতো ঝাঁজাল। এ ঘরে ফুল স্পীডে ঘুরছে সিলিং ফ্যান। ঘোলাটে আয়নায় ওর ছবি। আর খোলা জানালা। জানালায় গরম ভাপ। তারও পরে তাপে সিদ্ধ মৃতবৎ তিন চারটে গাছ। তার মাঝে নৃত্যরত তাপতরংগ। এ মূহুর্তে আজকের দুপুর এখানে এই রূপেই প্রকাশিত। নির্জন ও উত্তপ্ত।

একটা পা ভাঙা টুলে বসেছে ও। কিছুটা কুঁজো হয়ে। ব্যালেন্স করে বসতে গেলে খানিকটা কুঁজো তো হতেই হয়, নাকি? ‘এভাবে কখনো বসবে না।‘ বাবা বলেন। এই ব্যাপারে মা’র কোনো বয়ান ছিলো কি? মনে পড়ে না। অবশ্য কোনো ব্যাপারেই তো মা কখনো কোনো বাণী দেন নাই। টুল আর ড্রেসিংটেবিলের মধ্যে জায়গা কম। মৃদু মৃদু পা নাড়ালে স্যান্ডেলের লাত্থি লাগে বাদামী কাঠের গায়ে। সঙ্গত কারণেই নীরস কাঠ বেজায় বিরক্ত হয়। তার একটা ইজ্জত আছে তো। আর আছে চকচকে বার্নিশ। ড্রেসিং টেবিলের ঘাড়ে আয়না । তাকে ঘিরে লতা পাতা খোদাই করা কাঠের ফ্রেম। তাতে পাউডারের গুঁড়ো। ঘাড়ে, পিঠে দেদার পাউডার ঢেলেছে দু মিনিট আগে, এই গরমে কিছুটা স্বস্তি পাওয়া যায়। পাউডারের পাশে একটা লম্বাটে নারকেল তেলের বোতল। একটা দুধসাদা ক্রিমের কৌটা। তাতে পুরু ময়লা জমেছে। হাতলঅলা মোটা দাঁতের সাদারঙ চিরুনি একটা। ঝকঝকে নীল মোহনীয় শেপের সুগন্ধী। মাঝারি ডিম্বাকার পেট্রোলিয়াম জেলীর বুকে রঙ্গিন প্রজাপতি। তার পাশে খয়েরী চামড়ার ডায়েরী। ফ্যানের বাতাসে পাতাগুলো উড়ছে ইচ্ছেমাফিক। পাতা ওড়ার ছবি দেখা যায় আয়নায়। আর দেখা যায় ওর মুখ। সে মুখে পাতলা ঠোঁট আর ঈষৎ কোঁকড়া চুল। এতে মা’কে কিছুটা টের পাওয়া যায়। শুধু এতেই। এছাড়া আর কোথাও মা নেই।

এটা ছিল বাবা ও মা’র ঘর। এ খাটে বাবা ঘুমাতেন। মা ঘুমাতেন চকচকে পানি রঙ টাইলসের মেঝেতে আঁচল কি পাটি পেতে। দিনে অথবা রাতে। সবসময়ে। বাবা এখন বারান্দাঅলা কোনের ঘরটাতে ঘুমান। মা ঘুমান সর্বংদহা শীতল মাটির সাথে মিশে। সেখানে একটা সাদাসিধে গাছ ছায়া দেয়। থেমে থেমে পাতা নড়ে। তার বাতাসে মা আরাম করে ঘুমান। আর এ ঘরে ও অস্থির পায়ে একবার আয়না থেকে জানালায়, তো আবার জানালা থেকে আয়নায়। আয়নায় ডায়েরীর পাতা ওড়ে। বাবার ফাউন্টেন পেনের বাসি নীল কালি লেপটে আছে ময়লা সাদা পাতার গায়ে। তাতে গুটি গুটি অক্ষর হয়েছে। অক্ষর থেকে শব্দ। শব্দ থেকে বাক্য। সেখানেও মা নেই।

এ ঘরের দরজায় লেবুসবুজ পর্দা। পর্দার ওপারে গোল ডাইনিং টেবিল। টেবিলে চায়ের পট আর কাপ থাকতে পারে। কাপে চা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প আর তর্ক বিতর্কে রত ছিল বাবা আর ও। দিনের পর দিন। রাতের পর রাত। অনর্গল কথা বলা। ওর কচি কণ্ঠ। কখনো অভিমানী। কখনো উত্তেজিত। কখনো রাগত। কখনো বিরক্ত। আর বাবার সাধা গলা। খুব ভাল গান গাইতেন। এখন আর গাইতে চান না। ফুসফুস বিট্রে করে। ওর কচি কিশোর মুখে তাকিয়ে বাবার চশমার কাচ প্রশ্রয় ও স্নেহের বাষ্পে ঝাপসা সেসময়। সে ঝাপসা কুয়াশা তার চোখ স্পর্শ করলে সে আর কোথাও ফিরে তাকায় না। আর এতেই বুঝি তার আর মা’র মুখ দেখা হয়নি। কতকাল ও মা’কে দ্যাখে না! কবে থেকে? সেই কিশোরবেলা থেকে? নাকি তারও আগে থেকে? তবু, চায়ের কাপ আর লাল পিরিচে পাতলা সলটেড বিস্কুট হাতে মা টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এখনো সে ছবি বুড়ো টেবিলের আশে পাশে ঝুলে থাকতে পারে। মা’কে দেখার আশায় ও শরীর বাঁকিয়ে উঠতে গিয়েও থেমে গেল। শরীরে মরচে পড়েছে টের পাওয়া যায়। রোমকূপের গোড়ায় গোড়ায় জমেছে তেল চিটচিটে ক্লান্তি। মাংসপেশী জংধরা। শুধু চোখ দুইটা ঝকঝকে পরিষ্কার। সার্ফ এক্সেলে ধোয়া। তৃষ্ণার গনগনে আঁচে শুকানো। সেই তৃষ্ণা এখন লেপটে গেছে আয়নায়। সেখানে ওর মুখ। পাতলা ঠোঁট আর ঈষৎ কোঁকড়া চুল। এটুকু মা'র। জোড়া ভুরু। তার নিচে সরু ও লম্বাটে চোখ। খাড়া নাক। চোয়ালের উঁচু হাড়। এগুলো বাবার। ডায়েরীর খোলা পাতা। ওটাও বাবার। পাতায় প্রায়-মুছে-যাওয়া কালিতে লেখা তারিখ। ১৮ পৌষ। এই রাতটা বড় নির্জন। হঠাৎ করে ঘৃণা জন্মে সবকিছুর উপর। ভালোবাসা নয়। ভালোবাসা নেই। তবুও...অন্য কোনো কারণে...তাকে মনে পড়ে আমার। তার কথা, সর্বাঙ্গে মসৃণ কম্পন তুলে হেঁটে যাওয়া, বাতাসে হালকা সুগন্ধের ঝাপটা লুকোচুরি খেলার মতো উঁকিঝুঁকি দিয়ে যায় মনের ভেতরে। এখানে মা নেই।

এটা বসার ঘর। এদিকে খাটো সোফা। সবজেটে হলুদ। শেওলা সবুজে হালকা কমলা কাজ কুশন কভারে। তাতে সোনালী-লাল বর্ডার। এটাতে ও আছে। বড় সোফাটার পাশে প্রায় সিলিং ছোঁয়া বুকশেলফ। এতে বাবা আছে। ওদিকে টিভি। তার ওপরে বাঁশি হাতে রাখাল বালক পেইন্টিং। এটাতেও বাবা আছে। সাদা লেসের পর্দায় আড়াল করা খাবার ঘর। এটায় ও আছে। সোফা, টিভি, ছোট টেবিলে চীনা ফুলদানি আর লেসের পর্দার জগতে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও মা’কে পাওয়া যায় না। অথচ সেই দিনগুলিতে পাওয়া যেতো। যখন এই সোফা, সোনালী বর্ডারের কুশন কভার, চীনা ফুলদানীর সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ কারুকাজ থাকতো ঝকঝকে, তকতকে ও ধূলিমুক্ত। তখন চেয়ে চেয়ে মা’কে দেখা হয়নি। এখন ওসব ধুলায় ও সময়ের দাগে মলিন। এখন আর ওসবে মা নেই।

এই ভরদুপুরে, ভূতের বাড়ির মতো ছায়া ছায়া অন্ধকার ঘরের শব্দহীন জগতে মাকে খুঁজে বেড়ানো কি বিবেচকের কাজ হচ্ছে? জোড়া ভুরু বাঁকা করে ভাবছে ও। এইটাই আদর্শ সময়। কারণ এইটা মা’র সময়। এভাবে ভাবলে শান্তি পাওয়া যায়। আচ্ছা, মা’কে পাওয়া গেলে কী বলা যায়? মা, আমার জ্বর। ১০৩। মাথায় একটু হাত বুলায় দিবা? ......ধুর, ন্যাকামি হয়ে যায়। সারাজীবনে যেইটা করি নাই। তাহলে? মা, একটু সামনে আইসা বসো না। তোমারে খুব দেখতে ইচ্ছা করে। ......উঁহু, এইটাতে কাজ হবে না। মা বিশ্বাস করলে তো! তাহলে? মাথার ভেতরে আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও বুদ্ধির একটা টুকরাও পাওয়া না গেলে ও নতুন করে নিজের বিদ্যা-বুদ্ধির বিচার করতে বসে। বিচারের রায়স্বরূপ নিজেকে দুয়েকটা হালকা পাতলা গালি দেয়। গাধা। রামছাগল। আমড়া কাঠের ঢেঁকী। শেষের গালিটা তেমন যুতসই লাগে না। তাতে কি! বাবার কাছে ব্যাকরণ শিক্ষার স্মৃতি মনে পড়ে যায়। খুশি খুশি লাগে। এইটাই লাভ। খুশি খুশি মনে ও ভূতের বাড়ির ভেতর ইতস্তত ঘুরে বেড়ায়।

টিভিটা একা একাই কথা বলছে। হাসছে। গাইছে। আগেও তাই করতো। তার সামনের মানুষেরা তার কথা, হাসি, গান শুনতো না। তারা নিজেরা কথা বলতো। হাসতো। গাইতো। এই বড় সোফাটায় আছে পারভীন আন্টি। বাবার ভার্সিটি লাইফের বান্ধবী। সেইরকম ব্যক্তিত্ব। পর্দা ঘেঁষে ছোট গোল সবুজ টুলটায় আছে নীরা আপা। রানু আপা। সুমি আপা। ওরা বাবার ছাত্রী। নীরা আপার চুল অনেক লম্বা। সুমি আপার ফর্সা গালে একটা কালো তিল আছে। সেন্টার টেবিলের কাছাকাছি ছোট সোফায় আছে জামান আঙ্কেল। বাবার বন্ধু। তার পাশের সোফায় আছে লুবনা আন্টি। জামান আঙ্কেলের ওয়াইফ। বাবার ও আঙ্কেলের বান্ধবী। খুব ভাল গান গায়। ও আছে সুমি আপার কোলে। পারভীন আন্টির কোলে। রানু আপার কোলে। অথচ এখানে, বা ওখানে, কোথাও মা নেই। এ অন্যায়। নিতান্ত অন্যায়। কিন্তু অন্যায়টা কার? ওর? মা’র? বাবার? মা’র থেকে পয়দা হওয়ার কয়েকশত বছর পরে মা’কে দেখতে চাওয়ার? নাকি এই মানবজন্মের? ধন্দ লাগে ওর। ঝুলবারান্দার দিকের দরজাটা খোলা। সোফা ও টুলে বসে থাকা মানুষদের মুহুর্মুহু কোরাস হাসির ধাক্কায় কেঁপে কেঁপে ওঠে টবের নাইটকুইনের লম্বা সরু শাখা। সেই কাঁপুনির ধাক্কা লাগে ওর গায়েও। মা’কে খুঁজতে এসে এ কী বিপদ! মৃদু কাঁপুনি আশকারা পেয়ে বেয়াড়াভাবে বাড়তে থাকে। এমনকি সোফার হাতল শক্ত করে চেপে ধরেও হাত পায়ের কাঁপুনি সামাল দেয়া যায় না। তবে এর মধ্যেও চোখ, কান, নাক সমান সজাগ ওর। সমস্ত ইন্দ্রিয় তীক্ষ্ণ, মা'র উপস্থিতি আবিষ্কারের চেষ্টায়।

ছিলো তো! এখানেই মা ছিলো। খুব ঝাপসা একটা ছবি দেখা যায়। সেন্টার টেবিলের ওপর ঝুঁকে আছেন মা। সাদা ফুলতোলা ট্রে হাতে দাঁড়িয়ে আছেন পর্দার পাশে। ঝুলবারান্দার দরজা খুলে দিচ্ছেন। টিভির কাভার সরিয়ে দিচ্ছেন। ফ্যানটা ছেড়ে দিচ্ছেন। একসাথে অনেক জায়গায় খুব অস্পষ্টভাবে মা’কে দেখা যায়। চোখ দুটো সরু করে ও আপ্রাণ চেষ্টা করে যায় - মা'র মুখটা দেখা যায় যদি! একটাবার। তৃষ্ণায় জ্বলে যায় দুচোখ। কতকাল মাকে দ্যাখে না! অথচ ছবিগুলো দেখো, ভেঙে ভেঙে ছড়িয়ে যায় হঠাৎ। ওদের কথা, ওদের আলোচনার নির্যাস ভারী তেলের মত ছড়িয়ে পড়ে মা’র গায়ে। তুলনামূলক সাহিত্য, টি এস এলিয়ট, হাঙরি জেনারেশন, সামরিক শাসন, জাতীয়তাবাদ, ল্যাটিন আমেরিকা, মার্কসবাদ, লেনিন, ক্রুশ্চেভরা ভারি, চাপা ঘ্রাণ ছড়ালে ওর নাইন পাশ মা'র তাঁতের নরম ঘোমটা থেকে চুঁইয়ে পড়া হালকা, ক্ষীণ সুগন্ধ তড়িঘড়ি পালাবার পথ পায় না। আর কী অন্যায়! পালাবার সময়ে ওরা উড়িয়ে নিয়ে যায় মা’কে। রেখে যায় খয়েরী চামড়ায় মোড়া ডায়েরীর কিছু পাতা। ২৪ ফাল্গুন। অভিজ্ঞান। আজ আমি এমন কিছু পেলাম যার জন্যে আমি নিজেও প্রস্তুত ছিলাম না। আমি চোখ তুলে চাইতে পারছি না ওর দিকে। এ কি অপরাধবোধ? তাহলে একই সাথে এক অন্যরকম আনন্দে ভরে যায় কেন মন? ২৪শে ফাল্গুন দুষ্টু মেয়ের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে ছুঁয়ে যায় বড় সোফা, ছোট টুল, ছোট সোফা। স্থির হয় না কোথাও। আর উত্তরোত্তর উৎকণ্ঠা বেড়ে যায় ওর। দুষ্টু মেয়েটা কোথায় বসবে দেখতে চায় ও। অপেক্ষা ক্রমে যন্ত্রণায় পরিণত হলে আবারো গালি বেরিয়ে আসে মুখ থেকে। হারামজাদী, ঠিক হয়ে বস্‌ না নিজের জায়গায়। এতো ছলাকলা কারে দ্যাখাস তুই? তবে এই বকাঝকায় ২৪শে ফাল্গুন আহত হয় বলে মনে হয়না। সে তার লাফিয়ে চলা অব্যাহত রাখে। আর হতাশায়, বিরক্তিতে কান্না পায় ওর। অথচ দেখো, চোখ ফেটে একফোঁটা জলও পড়ে কি? মা'কে দেখার তৃষ্ণায় মরুভূমি হয়ে গেছে দু’চোখ।

এটা এখন বাবার ঘর। ছোটবেলায় ও থাকতো। বাবা ঘুমিয়ে আছেন। বাবার পায়ের আঙ্গুলের দিকে একমনে তাকিয়ে থাকতে ভাল লাগে। ঘুম থেকে কবে উঠবেন বাবা? তাঁর একটা পাশ আগেই মরে গেছে। আরেকটা পাশ বেঁচে আছে নাকি বোঝা যায় না। চোখের পাতা স্থির। বাবা কি স্বপ্ন দেখছেন? গভীর স্বপ্নে কি চোখের পাতা এমন নিস্পন্দ থাকে? বাবার স্বপ্নে কি মা আসেন? ওর অস্থির লাগে। কোনোভাবে একবার যদি বাবার স্বপ্নে ঢুকে পড়া যায় তো মা’কে হয়তো দেখা যায় একবার। আশায় আশায় বাবার বন্ধ চোখদুটোর দিকে তাকালে হলেও-হতে-পারে অযৌক্তিক অথবা যৌক্তিক কারণে হতাশায় নুয়ে পড়ে ও। বাবার ওই চোখ দুটো কি আদৌ কখনো দেখেছে মাকে? এখনো সুদর্শন, সুঠামদেহী তিনি। ঠিক ওর মতো। এই খাটে বসে কত গল্প করেছে ও আর বাবা। কত নতুন ভাবনা ভাবতে শিখেছে। বাবার কাছ থেকে পেয়েছে রবীন্দ্রনাথ। মধুসূদন। কালকূট। পুশকিন। গোর্কি। অরওয়েল। চীনা ও জাপানী সাহিত্য। সত্যজিৎ। ভাষা ও শব্দ। প্রকৃতি ও পাহাড়। এবং কোলরিজ। এই বিছানায় বসেই পেয়েছে। মা’রও কি কিছু দেয়ার ছিলো ওকে? জানা হয়নি। এখন মা’র সাথে একবার দেখা হয় তো জেনে নেয়া যায়। কদাচিৎ বেঢপ এই কাঠের চেয়ারটাতেও বসতেন বাবা। খোলা জানালাপথে বৃষ্টির ছাঁট এসে ভিজিয়ে দিলে বিছানার চাদর, মা এসে জানালা বন্ধ করে দিয়েছেন। গভীর মনোযোগে জানালায় তাকিয়ে থাকলে একটু একটু করে একটা আবছা প্রতিকৃতি স্পষ্ট হয়। উত্তেজনায় ওর শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। সামান্য শ্বাসের শব্দেও পলকা ছবিটা উড়ে যেতে পারে। অথচ এত চেষ্টার পরেও কি কোনো লাভ হয়? হালকা রিনরিনে শব্দ ওঠে। মা'র চুরির শব্দ। একটা সোঁদা গন্ধ পাওয়া যায়। মা’র ভেজা শাড়ির গন্ধ। জোরে দম টেনে সেই গন্ধ নিতে গেলে ওকে ফাঁকি দিয়ে আচানক ছবিটা জানালাপথে উড়ে যায়। আবারো আরেকটা ব্যর্থতার কষ্টে ওর তৃষ্ণা উথলে ওঠে। এই তৃষ্ণা ক্যাম্নে নিবারণ করি জননী আমার? নাকি তুমি চাও আমি এইভাবেই তৃষ্ণায় ছটফট করতে থাকি এই দুনিয়া শেষ হওয়া তক্‌? কয়েকফোঁটা বৃষ্টিও কি হতে নেই?

মুখোমুখি সাদা দেয়ালে বাবা বসে আছেন। কাঁধে ক্রীমরঙা শালটা আলতো করে মেলে রাখা। টেবিলে ফোটোস্ট্যান্ডের ছোট্ট চৌখুপিতে ও দাঁড়িয়ে আছে, একটা নারকেল গাছে হেলান দিয়ে। খাবার ঘরে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালে সাদা নির্ঝঞ্ঝাট দেয়াল চারটা ওকে বিশ্রীভাবে ভেংচি কাটে। এটা মেনে নেয়া যায়। কিন্তু বসার ঘরে টিভির উল্টোদিকের দেয়াল থেকে একটা রুপালি ফোটোফ্রেম, আর ওর ঘরের দেয়ালে ঝোলানো ছোটখাটো কালো ফোটোফ্রেম একসাথে ওর দিকে কটমট করে তাকালে ও বিব্রত বোধ করে। এবং বেয়াদব ফ্রেমগুলোর হাত থেকে রেহাই পেতে তিন পা পিছিয়ে খালি বড় ঘরটায় ঢুকে পড়ে। সেই সাথে ওর পিছু পিছু ঢুকে যায় ডায়েরীর একটা পাতা। ওর রাগ লাগে। কত্তবড় সাহস! খয়েরী চামড়ার পারমিশন না নিয়ে কোন ফাঁকে পালিয়ে এসেছে এই ঘরে। এই পাতাটার গায়ে মাংস নাই। ২৪টা রুলটানা লাইনের দশ নাম্বার লাইনে একটামাত্র বাক্য। ২১ শ্রাবন। তাকে ভুলতে পারিনা কোনোকিছুতে। ফরফর করে উড়তে থাকা পাতা কখন না কখন অবিবেচকের মতো গায়ে এসে বসে এই ভয়ে ও ছিটকে যায় ঘরের আরেক কোনায়। এখানে ওর পাশে এক বিশাল ওয়ার্ড্রোব। আয়েশী চালে শরীর ছড়িয়ে বসে আছে। তার শরীরের ছায়ায় একটা মায়া মায়া স্মৃতিজাগানিয়া গন্ধ। এ গন্ধে আকুল হয়ে ওয়ার্ড্রোবের মুখে চোখে পেটে বিস্তর খোঁজাখুঁজি চালালে পাওয়া যায় কয়েকটা পুরোনো অ্যালবাম। পুরোনো শাড়ি, শার্ট, লেপের ওয়াড়, বিছানার চাদরের ভেতর চুপটি করে শুয়ে ছিল। এদের কারো কারো একটি দুটি পাতায় পাওয়া যায় পাতলা ঠোঁট, ঈষৎ কোঁকড়া চুল আর ঘোমটা। তবে এসবে তার চোখের সীমাহীন তৃষ্ণা মেটে না। কারণ এতে মা’কে পাওয়া যায় না। এই নিস্পন্দ পাথুরে চোখ, এই ঝলমলে চকচকে ঘোমটা, এই আঁটসাঁট বাঁধা জমাট চুলে মা নেই।

মা’কে আর দেখা যাবে কি? এত চেষ্টার পরেও একটুখানি সময়ের জন্যে হলেও মা’কে দেখা গেল না। তাহলে মরে যাবার পরেও মহিলার স্বভাব পালটায়নি! সেই একই লুকিয়ে থাকা। পালিয়ে বেড়ানো। নিশ্চুপ। প্রতিবাদহীন। এই যে এত চেষ্টা করছে ও, মা কি একবারও সামনে আসছে? ঝাপসা ছবির মতো দেখা দিয়েই মিলিয়ে যাচ্ছে। আর মা’কে দেখার তৃষ্ণায় ওর চোখের ভেতরটা শুকিয়ে খটখটে হয়ে যাচ্ছে। এখন এই শুকনো চোখ নিয়ে ও দিন-দুনিয়ার আর কিছু কিভাবে দ্যাখে!

নিজের ঘরে ফিরে সাবধানে মেঝে পেরিয়ে গেল। মা যে জায়গাটায় শুতেন তার পাশ ঘেঁষে অতি সাবধানে হেঁটে বিছানায় বসলো। পেরিয়ে যাবার সময় পায়ের তলা শির শির করে উঠলো ওর। মা’র গায়ে লেগে যায়নি তো! কখন মা’র গায়ে পা লেগে যায় এই ভয়ে পা তুলে বিছানায় বসলো ও। এই বিছানায় মা শুতে চাননি কখনো। গেঁয়ো স্বভাব। খাটে শোয়ার অভ্যেস নেই। একেবারে অজপাড়া গাঁ থেকে মাকে তুলে এনেছিলেন দাদা। তা হোক। মেঝেতে চুল ছড়িয়ে শুয়ে থাকা নেই এখন কোনো অভিযোগ নেই ওর। কিন্তু একথা মা’কে জানানো যায় কি করে? এ সংবাদ মার কাছে পৌঁছুলে তিনি হয়তো একবার দেখা দিতে পারেন। তাতে ওর খাঁ খাঁ মরুভুমির মতো চোখ দুইটাতে এক পশলা বৃষ্টি হয়। তৃষ্ণা মিটে খানিকটা। একটা উপায় খুঁজতে এদিক ওদিক তাকাতেই আবার হতচ্ছাড়া আয়নায় চোখ পড়ে যায়। ওই আয়নায় ওর মুখ দৃশ্যমান, যে মুখে মা নেই বললেই চলে। আর চোখে পড়ে খয়েরী চামড়ার ডায়েরীর পাতা। ২৫ আশ্বিন। ওকে শুধু বলেছি, নিচে শোও। গরম লাগছে। তোমার গায়ে ঘামের গন্ধ। বাজে লাগছে। কোনো কথা না বলে নিচে গিয়ে শুলো ও। আর এটাকেই প্রতি রাতের জন্যে একেবারে নিয়ম বানিয়ে ফেললো সে! আমি তো এমন বলিনি! এ কেমন শাস্তি আমার? ২৫ আশ্বিন থেকে ডায়েরীর বাকি সব পাতা সাদা।

খুব সাবধানে পা নামিয়ে আলতো করে নিচে শুয়ে পড়লো ও। মা যেখানটায় শুতেন, ঠিক তার কোল ঘেঁষে। মা’কে দ্যাখা না যাক, তৃষ্ণায় চোখ জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাক, কয়েকফোঁটা স্পর্শ পাওয়া যাবে হয়তো, কড়া হিমের রাতে প্রবল বৃষ্টির ঠাণ্ডা শীতল স্পর্শ। এই বা কম কি!

২৪/০৬/১১


মন্তব্য

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

অসাধারণ! অসাধারণ!! টুকরো টুকরো কিউবের মতো ছবির অংশগুলি জোড়া লাগিয়ে সবিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

বইখাতা এর ছবি

ধন্যবাদ রোমেল ভাই। হাসি

তিথীডোর এর ছবি

'একটা কী সুর গুনগুনিয়ে কানে আমার বাজে,
মায়ের কথা মিলায় যেন আমার খেলার মাঝে...'

তারাঙ্কিত গল্প। চলুক

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

বইখাতা এর ছবি

ধন্যবাদ তিথী। হাসি

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

আপনার গল্পে ছোট ছোট সুক্ষ্ম বর্ণনা সবসময়ই মুগ্ধ করে।

চলুক গল্প ভালো লেগেছে।

বইখাতা এর ছবি

ধন্যবাদ। হাসি

নীড় সন্ধানী এর ছবি

দৃশ্যবর্ননার দক্ষতা অতুলনীয় আপনার। যেন একটা শর্টফিল্ম দেখার আমেজ পেলাম গল্পটা পড়ে।

'ড্রেসিং টেবিলের ঘাড়ে আয়না'- ছোট্ট এই বাক্যটি যে দৃশ্য চোখের সামনে হাজির করে সেটা বড় বেশী স্পষ্ট।

উজ্জ্বল বিষন্ন একটা গল্প উপহার পেল পাঠক।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

বইখাতা এর ছবি

এই দৃশ্যবর্ণনাই হয়তো একটু আধটু পারি! আর কিছু হয়না। দৃশ্যবর্ণনাও অনেকসময়েই হয়না। ধন্যবাদ। হাসি

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

দারুণ ভালো লাগলো। ডিটেইলগুলো মুগ্ধ করে দেয়... অসাধারণ

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

বইখাতা এর ছবি

ধন্যবাদ। হাসি

অতিথি লেখক(শান্তিপ্রিয়) এর ছবি

ছবির মতন চরিত্রর সাথে বাড়িটা ঘুরে এলাম। অসাধারণ ডিটেল। কিন্তু মাঝামাঝি এসে কেন যেন খেই হারিয়ে ফেলেছিলাম। তবে শেষটা আবার ভাল লেগেছে।

বইখাতা এর ছবি

ধন্যবাদ। হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।