১
কানের ভেতরটা পুড়ে গেল তাহমিনার। বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে হাসান। সে এই তিক্ত কণ্ঠ শুনতে পায়নি। হাসানের বাবার পায়ের থেকে হাত গুটিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় তাহমিনা। চাপদাড়িঅলা বিশাল শরীরের প্রৌঢ় মানুষটার চোখ তীব্র লাল। রক্ত ছুটে বেরিয়ে আসবে যেন। ক্রোধ, হতাশা আর তিক্ত ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে হাসানের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি।
আমার কবরে তোমার মাটি দিতে আসার প্রয়োজন নাই।
প্রৌঢ়ের ভরাট কণ্ঠের তীব্র বিষাদ আর নিদারুণ তিক্ততা উঠানের জমাট বাতাসকে বিষাক্ত করে তোলে। ডুকরে কেঁদে ওঠে কেউ। হাসানের মা। চোখে আঁচল চাপা তার।
ওরা আঙিনা ছেড়ে বেরিয়ে আসে। বিরাট বাড়িটার ছায়া সন্ধ্যার অন্ধকারে চুপিসারে ভূতের মতো ওদের পিছু নেয়।
২।
একফালি সরু রাস্তা। সামনে হাঁটছে হাসান। তার পেছনে তাহমিনা। স্কুলঘর, মুদিদোকান, বাজারের পেছনটা, সবজি ক্ষেত পার হয়ে বড় রাস্তা আর অল্প কিছুদূর।
বুবু...
থমকে পেছন ফিরে দাঁড়ায় তাহমিনা। তাকে কেউ কখনো বুবু বলে ডাকেনি।
বকুল। চাচার মেয়ে।
এই ছোট বোনটিকে স্নেহ করে হাসান। তার কণ্ঠে প্রকাশ পায়। ভাল লাগে তাহমিনার। শুকনো মুখে এই প্রথম হাসি ফুটিয়ে সে মেয়েটার হাত জড়িয়ে ধরে। মেয়েটা একগাছা লাল চুড়ি পরিয়ে দেয় তাহমিনার কবজি দুহাতে চেপে ধরে।
আমার যে আর কিছু নাই বুবু।
লাল চুড়ি আমার খুব পছন্দ বকুল।
মেয়েটা হাসে।
আমাদের ঘরে একটু বসবে বুবু? এই একটু! তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছা হয়।
দেরী হয়ে যাচ্ছে মিনা। বকুল, ঘরে যা। মিনা চলো।
বড় বড় পা ফেলে হাঁটতে শুরু করে হাসান। আকাশ লাল হতে শুরু করেছে। নীল ক্যানভাসের এখানে সেখানে কেউ বালতি বালতি গোলাপী, কমলা রঙ ঢেলে দিয়েছে। রাতের বাস না ধরলেই নয়। হাসানের বিরক্তি তাহমিনাকে সন্ত্রস্ত করে।
আজকে যাই বকুল। এরপর এলে তোমার সাথে অনেক গল্প করবো।
তুমি কি আর আসবে বুবু!
তাহমিনা এ কথার জবাব দিতে পারেনা। বকুলের দৃষ্টি এড়াতে এদিক ওদিক তাকায়। সূর্যের শেষ আলোর রাশিকে ঠেলে সরিয়ে ঝোপঝাড়ে জায়গা করে নিচ্ছে কালো কালো অন্ধকারের পিণ্ড। এর মাঝেই বাচ্চাটাকে চোখে পড়ে। কপালে কালো ফোঁটা। গাছগাছালির আড়ালে এক প্রৌঢ়ার কোলে ঘুমিয়ে আছে। প্রস্তুতিহীন কান্নার এক প্রবল ঢেউয়ের ধাক্কায় টালমাটাল তাহমিনা ঠোঁট কামড়ে ধরে, তবু কান্না রোধ করতে পারেনা। দু ফোঁটা গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে।
আমার টুনি।
তাহমিনা মাথা ঝাঁকায়। বুঝতে পেরেছে।
তুমি ওকে নিতে চাও বুবু?
৩।
বাসে ওঠা অবধি হাসান একটা কথাও বলেনি। চোখ বন্ধ করে এলিয়ে আছে সীটে। যেন রণক্লান্ত এক সৈনিক। ঢাকার কাছে আসতেই ওদের ট্রাফিক জ্যামে পড়তে হয়। শহরটা ধীরে ধীরে স্থবির হয়ে পড়ছে বুড়ো মানুষের মতো। এর মৃত্যু আসন্ন। হাসানকে ধীরে ধীরে চোখ মেলতে দেখে তাহমিনা পাশ ফিরে তাকায়।
তোমার চাচা কি -
মারা গেছে।
কী বলবে বুঝতে পারেনা তাহমিনা। হাসানদের বিশাল বাড়ি আর গ্রাম ছাড়িয়ে একটা একলা মাটির ঘরে বকুলদের বাসা ওকে ভাবায়, কষ্ট দেয়। তবু হাসানকে ঘিরে থাকা এক অচেনা দুর্ভেদ্য বলয় তাহমিনাকে কোনো প্রশ্ন করতে বারণ করে।
চাচার সাথে তোমাদের সম্পর্ক -
জটিল সব বৈষয়িক ব্যাপার, তুমি বুঝবে না।
হাতের ঝাপটায় প্রসংগটা উড়িয়ে দেয় হাসান। তার এই নির্লিপ্ততায় ভয় পায় তাহমিনা। হাসান কেমন বদলে গেছে, বিয়ের ক’দিনের মাথাতেই। এই হাসানকে চিনতে কষ্ট হয় তাহমিনার। অফিসের নম্র ভদ্র গোছানো, হাসিখুশি, অমায়িক হাসানের সাথে এই হাসানের মিল নেই।
বকুলের স্বামী -
ওকে তালাক দিয়ে গেছে।
ওহ...
তাহমিনা আর কথা খুঁজে পায়না। আবারো ভুল করে ফেললাম কি? - এমন এক ভাবনা তার চেতনায় মৃদু টোকা দিয়ে যায়। সন্তর্পণে গুড়ি মেরে এগিয়ে আসা এক অশুভ ঘন কুয়াশা তাহমিনাকে বুনো জন্তুর মতো গিলে ফেলতে চাইলে সে ভয় পায়। দু'হাতে ঠেলে সরিয়ে দিতে চায় দলা দলা চাপা হলুদ কুয়াশা। অথচ অসাড় হয়ে পড়ে থাকে দু’ হাত।
৪।
ওরা যদি কখনো রিনিকে দাবী করে?
করবে না।
আত্মবিশ্বাসে অথবা রিনিকে হারানোর ভয়ে হাসানের গলা কর্কশ শোনায়। তাহমিনা তবু স্বস্তি পায়না। একটা চাপা টেনশন টিপটিপে মাথাব্যাথার মতো কপালে লেপটে থাকে।
হাসান...
উমম...
হাসানের শার্টের কুঁচকানো জায়গাটা টেনে টেনে সমান করছে তাহমিনা।
আমার না মাঝে মাঝে বিশ্বাস হয়না!
কী বিশ্বাস হয়না?
শার্টের বোতাম থেকে চোখ সরিয়ে ঘর-বারান্দা-জানালায় তাকায় তাহমিনা। একটা ছোট ঘর। পরিপাটি করে সাজানো। একটা ছোট বারান্দা। দুটো বেতের চেয়ার। একটা ছোট কাঠের টেবিল। তিন চারটা টব। বাহারী পাতা আর ফুলেরা। জানালায় ঝকঝকে কাচ। জানালা গলে ঘরটাতে ঢুকে পড়েছে এক টুকরো আকাশ। ঘর বারান্দার একোনা ওকোনা থেকে নিরন্তর উঁকি দেয় শান্তি আর ভালবাসারা।
তুমি আমাকে অ্যাতখানি –
ভালোবাসি মিনা!
তাহমিনা হাসানের বুকে মাথা রাখে। হাসান আলতো হাত রাখে তাহমিনার চুলে।
৫।
কী এটা?
দেখতেই পাচ্ছো! চিঠি।
তাহমিনার মুখে আষাঢ়ের কালো মেঘ। হাসান বুঝলো গুরুতর কিছু হয়েছে। তার ওপর আবার এই চিঠি! এতবছর পর এই ইমেইলের যুগে চিঠি লিখলো কে? হাতের ব্যাগটা বিছানায় ফেলে খামটা হাতে নিলো হাসান। খামের মুখ ছেঁড়া। চিঠিটা পড়েছে তাহমিনা। কী আছে চিঠিতে জিজ্ঞেস করার আর সুযোগ দিলোনা সে। ঘর ছেড়ে চলে গেছে।
রুলটানা কাগজে বড় বড় হরফে লেখা চিঠি।
বাবা হাসান,
তোমাকে এ চিঠি না লিখে পারলাম না। বকুলের একান্ত ইচ্ছা ছিল তুমি ওর মাথার পাশে কয়েকটা মিনিটের জন্যে হলেও এসে দাঁড়াবে। মা আমার বিগত দুই বছর যাবত ভুগে ভুগে অবশেষে মুক্তি পেয়ে গেল। এ কথা লিখতে আমার কলম সরে না, এ বরং ভালই হলো। আমি আর দেখতে পারছিলাম না। যাওয়ার আগে তোমাদের স্মরণ করেছে। আমি আর সইতে পারিনা বাবা। ঈশ্বর কবে আমাকে তুলে নেবেন সে অপেক্ষায় আছি। আর বিশদ কী। তুমি কি একবার আসবে বাবা? না আসলেও ক্ষতি নেই, আমি ওর মাথার পাশে বসে রোজ ওর সাথে গল্প করি। ও শান্তি পায় ।
তাহমিনা মা কেমন আছে? সোনামানিক রিনি কেমন আছে বাবা? ভাল থাকিও।
রান্নাঘর থেকে ভাত পোড়ার কটু গন্ধ ভেসে আসে। নাক কুঁচকায় হাসান।
৬।
এটা কিন্তু বাড়াবাড়ি হচ্ছে হাসান!
তাহমিনা, একটু বোঝার চেষ্টা করো...
তুমিও একটু বোঝার চেষ্টা করো। মেয়েটা যেতে চাইছে না, কাল রাত থেকে গোঁজ হয়ে বসে আছে। রাতে একটা দানাও মুখে দিলো না...
হাসান জবাব না দিয়ে ব্যাগ গোছায়। বিছানায় থম মেরে বসে আছে তাহমিনা।
বাবা...
মেয়ের কাঁদো কাঁদো স্বরে চোখ ফেরায় দুজনেই।
আমি যাবো না বাবা। আমার ক্লাস পার্টি বছরে একবারই হয় তুমি জানো...
রিনি...মামণি...তোমার এক দাদু তোমাকে খুব করে দেখতে চেয়েছেন...
দরজার হাতল শক্ত করে চেপে ধরে রিনি গা মোচড়ায়...
অন্য কোনো সময় যাই না বাবা...প্লিজ...
আর হয়ত সময় মেলাতে পারবো না মামণি, তোমারও তো ক্লাস থাকবে, পরীক্ষা থাকবে...
এসব কথায় কান না দিয়ে রিনি মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে পড়েছে...চোখ বিপদজনকভাবে ছল ছল করছে। এখুনি গড়িয়ে নামবে কয়েক ফোঁটা।
মাআআআ...তুমি বলো না বাবাকে ...প্লিইইজ...
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালার দিকে মুখ ফেরায় তাহমিনা। আকাশে ঘন মেঘ জমেছে। আষাঢ় মাস। এখুনি নামবে বৃষ্টি। বৃষ্টিদিনের কত প্ল্যান ছিল তার। এমন দিনে হঠাৎ হঠাৎ নিয়মছাড়া কাজে গা ভাসাতে হাসানও খুব পছন্দ করে । কিন্তু সব ভেস্তে গেল। বোতলবন্দি স্মৃতি আর ভাবনারা, দুরন্ত ঝড় আর লবণাক্ত স্বাদেরা বোতলের মুখ উপচে পড়তোই তো একদিন।
রিকশায় উঠে হাসান একবার পেছনে ফিরে তাকায়। জোর হাতে কাঠের রেলিং চেপে ধরে তাহমিনা। একটা শালিক চমকে উড়ে পালায়।
হাসান...
অনুচ্চ এই ডাক হাসান অবধি যেতে পারেনা। বরং তা দোতলার বারান্দা থেকে একটা শুকনো পাতার মতো বেখেয়ালী ভঙ্গিতে ঝরে পড়ে জমে থাকা আগাছার ওপরে।
৭।
থেকে থেকে বৃষ্টির ঝাপটা এসে পড়ছে হাসানের গায়ে। বাসের জানালা বন্ধ। তারপরও চিপা চাপা দিয়ে ছিটকে এসে পড়ছে বৃষ্টির পানি। হাসানের অবশ্য ভালই লাগছে। তবে মেয়েটা মুখ ভার করে বসে আছে।
মামণি, ওখানে গিয়ে তোমাকে অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গা দেখাব...
আমি দেখতে চাইনা।
বেগুনি কচুরীপানা ভরা পুকুর দেখাবো তোমাকে, লাল শাপলা ভরা পুকুর ...
এসব টিভিতে দেখেছি আমি।
নৌকায় চড়তে পারবে তুমি...বৃষ্টির মধ্যে নৌকাভ্রমণ কেমন মজার ব্যাপার হবে...মাকে বলবে না কিন্তু।
আমি এসব চাইনা...আমার ক্লাস পার্টি মিস করতে চাই না...
চুপ করে যায় হাসান।
৮।
সন্ধ্যায় পৌঁছুলো হাসানরা। সেই নিকানো উঠান। উঠানের কোনে একটা কাঠের বেঞ্চি। দালানটা এখন আধপাকা। তার পিছনে আম জাম লিচুর গাছ।
বাড়ির পাশ দিয়ে একটা পায়ে চলা সুড়কির রাস্তা। রাস্তায় এক এলোচুল কিশোরী। কে ও? বুক দুরুদুরু করে ওঠে হাসানের। এক লাফে পেরিয়ে যায় বহু বহু বছর। কে ঐ কিশোরী?
বাবা......আমি ঘুমাবো কোথায়?
রাস্তা থেকে কয়েকটা ছোট লাফে হাসানের কোলের কাছে গিয়ে পড়ে তার মেয়ে।
তুমি আমার কাছে শোবে সোনামানিক আমার। আমি অনেক গল্প জানি। তোমাকে গল্প শুনাব ঘুমানোর আগে। কী গল্প ভালো লাগে তোমার...রাজা রানীর নাকি ভূত পেত্নীর?
পরিষ্কার সাদা শাড়ি পড়া বৃদ্ধা তার কুঁচকানো চামড়ায় ঢাকা হাত দুটি দিয়ে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরেন মেয়েটাকে। হাসান বিব্রত বোধ করে। রিনি বেফাঁস কিছু বলে ফেললেই বিপদ। রাজা রানীর গল্পে আগ্রহ নাই রিনির। অচেনা মানুষের সাথে এক ঘরে ঘুমাতেও পছন্দ করেনা।
রিনি, যাও দিদিমার সাথে ঘুমাতে যাও মামণি।
ঠোঁট দুটো শক্ত করে চেপে বৃদ্ধার হাত ধরে ঘরের ভেতরে চলে যায় রিনি। এই এতটা সময় পরে প্রথমবারের মতো ক্লান্তি অনুভব করে হাসান।
৯।
বাথরুমে টপ টপ করে পানি পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। এই শব্দটা এত বিরক্তিকর। কিন্তু একটুও নড়তে ইচ্ছা করে না তাহমিনার। সারা শরীর জুড়ে আলস্য, অবসাদ। এত অবসাদ বছরের পর বছর যাবত জমা হয়ে ছিল বুঝি। রাত মাত্র এগারোটা। এই সময়টা তার আর হাসানের একেবারে একান্ত নিজস্ব। রিনি ঘুমিয়ে পড়ে সাড়ে দশটাতেই। বাকি সময়টা ওদের। সারাদিনের ক্লান্তি অগ্রাহ্য করে প্রায় রাতেই তাহমিনা জেগে থাকে হাসানের সাথে। হাসানের রাত জাগার অভ্যাস আছে। তাহমিনা হাসানকে একদম সময় দেয় না, ভালবাসায় কমতি পড়েছে তাহমিনার, হাসানের এই অভিযোগ সুখ আর তৃপ্তির সাথে মেটায় তাহমিনা রাতের এই সময়ে। গল্প করে মুখোমুখি বারান্দায় বসে। গান শোনে বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে, দুজনের পছন্দের কোনো সিনেমা দ্যাখে। দু কাপ চা নিয়ে খাবার টেবিলে বসে উপভোগ করে দুজনার সঙ্গ। হাসান জানে বছরের পর বছর গড়িয়ে গেলেও কীভাবে ভালোবাসা নতুন করে গড়তে হয় দৈনন্দিন যান্ত্রিকতার মাঝে। এই বিছানা, খাবার টেবিল, বারান্দার মুখোমুখি বেতের চেয়ার আজ অসহ্য লাগছে তাহমিনার। সবকটা লাইট নিভিয়ে দিয়েছে। সারাদিনের অবিরাম বর্ষণে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার এখন আকাশ। বিরাট চাঁদ উঠেছে। তার আলো এসে পড়েছে তাহমিনার অন্ধকার ঘরে। হালকা রুপালি তরল আলোয় ভিজে গেছে ঘরের সবকিছু। আলস্য ভেঙে উঠে দাঁড়ায় তাহমিনা। পুরোনো সবুজ শাড়ি ন্যাপথলিনের গন্ধ ছড়ায়। টুনটুন বেজে ওঠে ধুলোপড়া পুরোনো লাল চুড়ি। লম্বা একরাশ চুল ছড়িয়ে অশরীরির মতো ছায়া কেটে কেটে হেঁটে বেড়ায় তাহমিনা। হাসানের ড্রয়ারের তালা খোলে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে। বহু পুরোনো কাগজ। পুরোনো মাসিক পত্রিকা। পেপার কাটিং। পুরোনো ফাইলে দাগ পড়া ফিতার গিঁট। আলতো হাতে ফাইল খোলে তাহমিনা। স্কুলের রেজিস্ট্রেশনের কাগজ, পুরোনো প্রশংসাপত্র, পুরোনো প্রশ্নপত্রের ভাঁজে একটা ছোট সাদা খাম। খামের ভেতরে একটা পাসপোর্ট সাইজ ছবি। এক সদ্য তরুণীর মুখ তাতে। অ্যা...ত সাদামাটা মুখ। দেখে করুণা জাগে। ছবিটা মুঠোয় নিয়ে মেঝেতে বসে পড়ে তাহমিনা। চাঁদের আলোয় তরুণীর মুখ ভিজে যায়। তাহমিনার চোখ ভিজে যায়। বুকের ভেতরটা ভিজে যায়। ফ্যাকাসে হাতের চামড়ায় টকটকে বৃত্তাকার লাল কাচ ধোঁয়া ধোঁয়া আলোয় অপার্থিব দেখায়। এক আশ্চর্য শূন্যতায় আপাদমস্তক ডুবে গিয়ে ফাঁকা দৃষ্টিতে ঐ ছবির মুখে তাকিয়ে থাকে তাহমিনা। ঠোঁট নড়ে থেমে থেমে। নির্বোধ বাঁজা মেয়েলোক...
১০।
টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে ভোর থেকে। আর অপেক্ষা করা যায় না এই অজুহাতে বৃদ্ধ হাতের বাধা অগ্রাহ্য করে মেঠো পথে বেরিয়ে পড়েছে হাসান। তার পেছনে পেছনে রাজ্যের বিরক্তি আর অসন্তোষ মুখে মেখে নিয়ে হাঁটছে রিনি। বৃদ্ধার প্রবল আপত্তিতে কান না দিয়ে জোর করে ওকে সাথে নিয়েছে হাসান।
সাবধানে পা ফ্যালো রিনি। পিছলে পড়ে যেতে পারো।
আমি সাবধানেই হাঁটছি। তুমি তাড়াতাড়ি করো।
রিনির ক্ষুব্ধ জবাব।
বেশি দূরে নয়। মিনিট বিশেকের মধ্যেই ওরা পৌঁছে যায় চৌকোনা জায়গাটিতে। মেয়ের হাত চেপে ধরে হাসান। দৃষ্টি সামনের দিকে। একবারও মেয়ের মুখের দিকে তাকায় না সে।
সামান্য উঁচু ঢিবির মতো জায়গাটা। এখানেই আছে সে। থর থর করে পা কাঁপে হাসানের। বহুবছরের পুরোনো, অমানুষিক শক্তিতে চেপে রাখা সাইক্লোন উথাল পাথাল ঢেউ তুলে আছড়ে পড়ে বুকের ভেতর। সে ঢেউ সামলে নিতে গিয়ে এলোমেলো হয়ে পড়ে হাসান।
...বাবা......
দু হাত পেছনে থেমে আছে রিনি। ওর চোখে অস্বস্তি, ভয়।
হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়ে হাসান। মেয়েকে কাছে ডাকে। সাবধানী পায়ে হেঁটে বাবার কাছে এসে দাঁড়ায় রিনি। মেয়ের চোখে চোখ রাখে হাসান।
বসো রিনি।
মেয়ের হাত ধরে পাশে বসিয়ে দিতে চায় সে। রিনি হাত ছাড়িয়ে নেয়। ঠোঁট কাঁপে তির তির করে। হাত দুটিতে শক্ত করে চেপে রাখা নীল ফুল ফুল ফ্রকের দুই কোনা। এক পা এক পা করে কয়েক পা পিছিয়ে যায় রিনি।
সামান্য শংকা বোধ করে হাসান। রিনি কি এখানে বসবে না একটু? তবে কি সে বলে দেবে কথাটা? তবে কি বসবে রিনি ওর পাশে? কয়েকটা মিনিটের জন্যে? এই ঢালু ঘাসজমির ওপরে? এখনই সময় – হাসান ভাবে। মেয়েকে বলতে হবে কথাটা। এখন না বললে সারাজীবনেও আর বলতে পারবে না হয়তো। কারণ এই মুহূর্তটা ফুরিয়ে যাবে। তালাচাবি পড়ে যাবে কুয়োর ঢাকনায়। কাজটা ভালো হবে কি মন্দ ওর জানা নেই। বলার পর মেয়েকে শুদ্ধ সে নিজে কোনো অকূল সমুদ্রে ডুবে যাবে কিনা জানা নেই। শুধু জানে বলতে হবে মেয়েকে। এতে হয়তো রিনিকে বকুলের পাশে নিয়ে আসা যাবে। অন্তত এটুকু বকুলের প্রাপ্য।
বাবা আমাকে এক্ষুনি এই ন্যাস্টি জায়গা থেকে নিয়ে চলো.....কী বিশ্রী জায়গা...
রিনি...মা...কয়েকটা কথা একটু মন দিয়ে শোনো লক্ষ্ণী মামণি...
নাআআ বাবা...... প্লীইজ...কী জঘণ্য এই জায়গার সবকিছু...
কেন? দিদিমা ভালো না?
না ভালো না...ভালো না...সারাদিন পান খায়...পানের গন্ধে আমি ঘুমাতে পারিনি বাবা...অসহ্য... চলো...চলো না...
বাবার হাত ধরে টানে রিনি...ওর চোখে ভয়, অস্বস্তি।
মার কাছে যাবো বাবা, মার কাছে নিয়ে চলো...প্লিইজ বাবা...
কয়েক মুহূর্ত মেয়ের চোখে স্থির চোখ রাখে হাসান। ওর চোখ এখন এক অচেনা ক্যানভাস। সেখানে এক হালকা রেখায় আঁকা কোনো দূরের পাখি অধৈর্য ডানা ঝাপটায়। কয়েকটা সেকেন্ড, তারপর সে ধীরে চোখ সরায়।
তুমি ওই গাছটার নিচে গিয়ে একটু বসো রিনি...আমি এখুনি আসছি।
হাসানের ভারি কণ্ঠে একটু ইতস্তত করে রিনি। কিন্তু প্রতিবাদ করে না আর। উলটো ঘুরে হাঁটতে শুরু করে।
দুহাতে দুমুঠো ঘাস তুলে নেয় হাসান। মাটির ঢিবিটার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। কাঁপা হাতে ঘাস ছড়িয়ে দেয় ঢিবির বুকে। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করে কয়েক পংক্তি.....অল্প সময়ের জন্যে ফিরে আসে বহু বছরের পুরোনো, রোদমাখা এক কোমল বিকাল...
একটা মিনিট। উলটো ঘুরে ফিরে যায় হাসান একবারও পেছন না ফিরে। রিনি ফিরে চলে হাসানের সাথে। ওর চোখ এই ঘাসজমি পেরিয়ে সামনের লাল সুড়কির রাস্তায়। যে রাস্তা তাকে নিয়ে যাবে তার মা’র কাছে। চেনা গন্ধ, চেনা স্পর্শ, চেনা ওম, চেনা হাসির কাছে।
টিপ টিপ বৃষ্টিতে সবুজ ঘাস নেতিয়ে পড়ে ভেজা মাটিতে। প্রবল বাতাসের তোড়ে হাহাকার ধ্বনি তোলে অদূরের বাঁশঝাড়।
১১।
গোল সাদা টেবিলে এক কাপ চা। তাহমিনা নখ দিয়ে আঁচড় কাটে কাপের গায়ে। আজ রোববার। হাসান আর রিনি ফিরে আসবে। যেকোনো মুহূর্তে বেজে উঠবে ডোরবেল। শুনশান ঘরটা রিনির হাসি, কথায়, গানে ভরে উঠবে। একটা স্বল্পবিরতির পরে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে ওদের এই ছোট বাসা। সে অপেক্ষায় হাসিরা, উচ্ছ্বাসেরা, আনন্দ-কলতানেরা, নির্ভার গল্প-গুজবেরা দরজার আড়ালে, টেবিলের নিচে, ফোটোফ্রেমের পেছনে, পর্দার ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে। দরজায় সতর্ক কান রেখে চেয়ারে গা ছেড়ে দেয় তাহমিনা। সমস্ত শরীর ও মন জুড়ে এক বিচিত্র ও অদম্য অনীহার স্বাদ নিতে নিতে সুস্বাদু উষ্ণ চায়ের স্বাদ নিতে ভুলে যায় সে। নির্ণিমেষ তাকিয়ে থাকে চায়ের কাপ থেকে পাক খেয়ে খেয়ে উড়ে যাওয়া বিলীয়মান বাষ্পরাশির দিকে। সাদা দেয়ালে এক কর্কশ গায়ের বাদামী বড়সড় টিকটিকি কথা বলে ওঠে। টিক টিক টিক। দমকা বাতাসে তাহমিনার চুল ওড়ে। সুস্বাদু উষ্ণ চা নিরবে শীতল হয়।
২৯/০৭/১১
মন্তব্য
অ-সা-ধা-র-ণ!!
তুখোড় কাহিনী বিন্যাস, গল্পের গাঁথুনী আর প্রকাশভঙ্গী----আপনাকে সেলাম!
অনিকেতদা, আমাকে আপনি করে বলার দরকার নাই তো!
গল্পটা আপনার ভালো লেগেছে জেনে আমারও ভালো লাগছে।
অপূর্ব! অসাধারণ।
বারে বারে মনে হচ্ছিলো একটা নাম, খুব কোমল অথচ খুব ব্যপ্ত একটা নাম হওয়া উচিত এই গল্পের।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
ধন্যবাদ তুলিরেখাদি। বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করেও এটার নাম ঠিক করতে পারিনি। তাই অনামা গল্প...
ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ।
অসাধারণ!
ধন্যবাদ।
আজকে আমার মন খারাপের সাথে এ গল্প মিলে গেল.......ব্যাপক মন খারাপ লাগছে...........
তাই! আহা!
ধন্যবাদ।
কেন যেন তাহমিনার মত মেয়েদের জন্য খুব কষ্ট লাগলো।এত সুন্দর করে লিখেন আপনি।
ধন্যবাদ বন্দনা।
খুব ভালো লাগলো গল্প
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
আপনাকে ধন্যবাদ।
নাম নাই থাক, এ গল্পের নাম না হলেও কোনকিছু আসবে যাবেনা। এ গল্প নামহীন মুগ্ধতা!
ধন্যবাদ আপনাকে।
ভালো লাগা গল্প
ধন্যবাদ।
ভুল জায়গায় প্রতিমন্তব্য মুছে দিলাম।
গল্প ভালো লাগলো খুব।
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
ধন্যবাদ আশালতা।
আগেও বেশ কয়বার বলেছি মনে হয়, আপনার উপমাগুলো আমাকে মুগ্ধ করে... মানুষের অভ্যাসের, আচরণের অবজারভেশন আর তা ফুটিয়ে তোলার ক্ষমতাটাও...
অনেকদিন পরে লিখলেন... আরও ঘন ঘন অনামা গল্পেরা এলে আমি আগ্রহ নিয়ে পড়তাম...
অট: আপনার অ্যাকাউন্টে ঢুকে মেইল পাঠাবার অপশনটা অন করে দিয়েন তো বইখাতাদি। কয়দিন আগেও একবার যোগাযোগ করতে গিয়ে দেখি সম্ভব হচ্ছে না...!
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
ধন্যবাদ যাযাবর। একটানা অনেকটা সময় হাতে না পেলে লেখা হয়না...তারপরও একমাসে দেড়মাসে হাবিজাবি যাই হোক কিছু একটা লেখার চেষ্টা করি...
অট: ঠিক আছে, অন করে দিলাম আপাতত।
খুব ভালো একটা গল্প পড়তে দেবার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ! আপনি বইখাতা বগলে করে কোথায় থাকেন বলেন দেখি? এত কম লেখলে চলে নাকি? অনেকদিন পর আপনার লেখা পেয়ে ভালো লাগলো। অনেক শুভকামনা আপু
ধন্যবাদ আয়নামতি। আরে এত বিশাল বিশাল লেখা কম দেয়াই তো ভালো! আসলে সময়ের অভাব আর অন্যান্য ঝামেলার জন্য লেখা হয়না। অনেক শুভকামনা।
এত ভাল লেখা! আর লেখেন না কেন?
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
নতুন মন্তব্য করুন