সেকালে ব্যারিস্টারি পড়তে বিলেত গমন কেমন সমালোচনার মুখে পড়েছিলো জানা নেই। তবে ইদানিংকালে দেশত্যাগী ছাত্রদের দেশপ্রেম ঘাটতির কথা তুলে কেউ কেউ হাহাকার করে ওঠেন, মেধাপাচারে দেশের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কথা চিন্তা করে মুষড়ে পড়েন; আবার আমার মত কেউ কেউ "ব্যাটা, বৈদেশিক মুদ্রা পাচ্ছো না?" বলে যুক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি। এসব যুক্তি-তর্কের সাধারণত কোনো সর্বজনগ্রাহ্য সমাধান আসে না, সবাই যার যার গোঁ থেকে কিছুটা সরে আসলেও আলোচনা শেষ হয়, দেশে 'ক্ষেত্র' তৈরি হলেই 'মেধা'রা ফিরে আসবে -এরকম একটা অবাস্তব অপ-সিদ্ধান্তের মাধ্যমে।
সিদ্ধান্ত অবাস্তব কেন, তা বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন বোধ হয় নেই, তবে এটাকে অপ বলা হচ্ছে এই অর্থে যে, এতে প্রকৃত সমস্যা তার নিজস্ব স্থানেই থেকে যায়, আবারও চাপা পড়ে যায় সমাধানের পথ, এবং অনেকটা হতাশাগ্রস্তের মতোই চিন্তা করতে হয় "এ সমস্যা থেকে আমাদের নিস্তার নেই।" এই চিন্তাটাকে যতোই নিরীহ মনে হোক না কেন, তার খারাপ প্রভাব সুদূর-প্রসারী। সমস্যা থাকলে তার সমাধান থাকবেই, অন্তত পরিস্থিতিসাপেক্ষে সর্বোত্তম সমাধান থাকতেই হবে। হতাশাগ্রস্ততা সেই সমাধান সন্ধানে উৎসাহী না করে তাকে নিরুৎসাহিত করতেই প্রভাবক হিসেবে বেশি কাজ করে।
প্রাসঙ্গিক আরেকটি বিষয় এখানে বলে রাখা ভালো, বিদেশে প্রতিষ্ঠিত কাউকে দেশে ফিরে না আসার ব্যাপারে কারণ দর্শাতে বললে প্রথমেই আসবে সামাজিক পরিস্থিতির অস্থিতিশীলতার কথা, নিরাপত্তাহীনতার কথা, পদে পদে দুর্ণীতির কথা। অর্থনৈতিক ব্যাপারটা সাধারণত সবাই একটু পরেই টেনে আনেন। তবে অর্থনীতি আসলে সবাই যতোটা দেখাতে চান, তার চেয়ে অনেক বড় একটি প্রভাবশালী নিয়ামক। কারণ, অর্থ আপনাকে অনেকগুলো সুবিধা দিতে পারে - নিরাপত্তা, দুর্ণীতির বাজারে সুবিধা, স্থিতিশীলতা কোনোটাই অর্থের আয়ত্বের বাইরে নয়। আমি মূলত অর্থনৈতিক বিষয়ের ওপরেই ফোকাস করার চেষ্টা করবো। অন্য বিষয়গুলোকে সযতনে পাশ কাটানো হবে; অথবা পাশ কাটাতে গিয়েও কোন না কোনভাবে স্পর্শ করে যেতে হবে। অর্থনৈতিক কিংবা সামজিক বিষয়ে আমার জ্ঞান নিতান্তই অপ্রতুল, তবে জ্ঞানের চেয়ে আমি বুদ্ধির বেশি ভক্ত। অতএব, আলোচনা একপেশে হলো, না দো পেশে; কথাগুলো তীক্ষ্ণ হলো, না বোকা বোকা - তা নিয়ে মাথা খরচ না করেই সাথে থাকুন।
জনগণ সমস্যা, না শক্তি:
আমরা সবাই জানি আমাদের দেশে জনসমস্যা ব্যাপক; আবার অনেক জনবিরল দেশে জনশক্তি আমদানী করা হয়। যেটা জেনেও চোখের আড়ালে থেকে যায়, তা হলো কথাটা শুধু জনবিরল দেশের জন্যই সত্য নয়। জার্মানি ইউরোপের সবচেয়ে ঘনবহুল দেশ। এরাও প্রতিবছর একটা বিরাট সংখ্যক মানুষকে বাইরে থেকে নিয়ে আসে। এর কারণ শুধু জনসংখ্যা হ্রাসের হার সামাল দেয়ার ভবিষ্যত পরিকল্পনা নয়, এর সাথে বর্তমান সমৃদ্ধিও ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করা কেবল বইয়ের কথা নয়, এটা বাস্তব সত্য এবং জনবহুল, জনবিরল দেশ বলে নয় - এটা সব দেশের জন্যই প্রযোজ্য।
জনশক্তি পরিকল্পনা:
কথা হলো, জনসংখ্যা এমনি এমনি জনশক্তি হয়ে ওঠে না। তার জন্য চাই বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা এবং সে অনুযায়ী কাজ করা। পরিকল্পনার শুরু হবে প্রয়োজন এবং সে অনুযায়ী উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখে। একটা অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায় - আমাদের সঠিক স্থানে সঠিক লোক নেই। এরও কারণ সেই পরিকল্পনা দশায়ই ভেজাল করা, মামার জোরে চাকুরীপ্রাপ্তি সেই ভেজালের একটি প্রান্তিক ফসলমাত্র।
পরিকল্পনার শুরুতেই সমস্ত দেশের বিভিন্ন সেক্টরে চাহিদা (বর্তমান এবং সম্ভাব্য) হিসেব করে, সেই অনুযায়ী জনগণকে শিক্ষা দেয়ার বিষয়টা চলে আসে। বিষয়টা বলা যতো সহজ, তার বাস্তবায়ন ততো কঠিন। প্রত্যেকের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার থাকে। যেমন, কেউ যদি ডাক্তার হতে চায়, রাষ্ট্র তাকে বাংলার ভবিষ্যত প্রফেসর হিসেবে গড়ে উঠতে উৎসাহিত করতে ব্যর্থ হতে পারে। তবে পরিসংখ্যান বলে, ব্যক্তির আচরণ ভবিষ্যতবাণী করা কঠিন হলেও সামষ্টিক আচরণের অনুমিতি অপেক্ষাকৃত সহজ। সুতরাং সামষ্টিক অর্থে একটি পরিকল্পনা করা অবশ্যই সম্ভব এবং বাস্তবায়নযোগ্য।
এখন আমাদের মত জনবহুল দেশে যে সমস্যাটা মোকাবেলা করতে হবে, তাহলো দেশের প্রয়োজন মিটেও হয়তো দেখা যাবে জনসংখ্যা উদ্বৃত্ত থেকে যাবে। অতএব, তখন আসবে বিশ্ব বাজার ধরার সমীকরণ। এক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে হবে বর্তমান পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। কোন কোন দেশ বাংলাদেশ থেকে কি কি কাজে 'জনশক্তি' নেয়, তাদের সাথে রাজনৈতিক সম্পর্ক কেমন, সে দেশগুলোর সম্ভাব্য (অনুমিত) অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, জনশক্তি রপ্তানিতে আমাদের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী - এসব প্রভাবককে বিশ্লেষণ করে একটা মোটামুটি ফিগার দাঁড় করানো যায়।
জনসংখ্যা যতো বিশালই হোক, দেশের সমস্ত মানুষকেই এভাবে একটি হিসেবের মধ্যে নিয়ে আসা সম্ভব বলেই মনে হয়।
জনশক্তি - শিক্ষা/ট্রেনিং:
'দক্ষ জনশক্তি' কথাটি বহুল প্রচলিত। সমস্যা হলো, কথাটি আমরা এক কান দিয়ে শুনি এবং এর গুরুত্ব বুঝার আগেই অন্য কান দিয়ে বের করে দেই। ফলে 'ভুল অবস্থানে ভুল লোক' নিয়োগ পায়; কোনো কাজের জন্য এমন লোকের ওপর ভার পড়ে, যার ওই বিষয়ে কোনো দক্ষতাই নেই। পরিকল্পনা স্তর শেষে প্রতিটি কাজের জন্য কি সংখ্যক লোক প্রস্তুত করতে হবে, তার ধারণা পাওয়া যায় এবং সে অনুযায়ী সে সংখ্যক লোকের জন্য সেই বিষয়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রেও ব্যক্তিবিশেষে পছন্দ ভিন্ন হলেও সামষ্টিক অর্থে মোট সংখ্যায় তেমন হেরফের হওয়ার কথা না। প্রয়োজন থেকেই আগ্রহ সৃষ্টি হয় এবং পরিকল্পনা স্তরে এ প্রয়োজনকেই মাথায় রাখা হয়েছিলো।
মেধাপাচার - সমস্যা থেকে সুবিধা:
বর্তমানে যে ধারা চলছে, তাতে মেধাপাচার একইসাথে সমস্যা এবং সুবিধা দুটোই। একদিকে যেমন বৈদেশিক মুদ্রা আসছে, অন্যদিকে তেমন দেশ তাদের এক্সপার্টাইজের সুবিধা নিতে পারছে না। সমাধান হিসেবে আসছে ক্ষেত্র তৈরির কথা, যা আমি শুরুতেই উল্লেখ করেছি। এ ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে না এবং সমাধানও আসছে না। কিন্তু জনশক্তিকে পরিকল্পনামাফিক প্রস্তুত করলে এ সমস্যা 'বহুলাংশে' সমাধান করা সম্ভব। (পরিকল্পনা এবং শিক্ষা 'পারফেক্ট' হলে সমাধানও 'পারফেক্ট' হবে; তবে পৃথিবীতে সর্বাঙ্গসুন্দর জিনিস শুধুই কল্পনা হয়তো; তাই 'বহুলাংশ' শব্দটিই বেশি প্রযোজ্য।)
উদাহরণস্বরূপ, দেশ যদি প্রতিবছর ৫০০০ ইঞ্জিনিয়ার তৈরি করে, যার ২০০০ সে নিজের কাজে লাগাতে পারবে, তাহলে তার ওই ক্ষেত্রসমূহে উন্নয়নের জন্য ওই ২০০০ রেখে বাকি ৩০০০ সে রপ্তানি করতে পারে। এই ২০০০ বা ৩০০০ লোক আবার স্থবির হয়ে যায় না। অর্থাৎ দেশে কর্মসংস্থান থাকলে ওই ৩০০০ এর একটা বড় অংশ দেশের বাইরের অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে আসবে, ২০০০ থেকে একটা অংশ আবার বাইরে যেতে পারবে। এভাবে বিশ্বের সাথে জ্ঞানের আদান-প্রদানেও আপ-টু-ডেট থাকা যাবে। পরিকল্পনা ও শিক্ষাস্তরে ডিমান্ড-সাপলাই সমীকরণ ঠিকমতো সমাধান করতে পারলে দেশে বা দেশের বাইরে অবস্থানরত কাউকেই সামষ্টিক অসন্তুষ্টি নিয়ে জীবনযাপন করতে হবে না। দেশের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে রেখেও বৈদেশিক মুদ্রার জন্য 'পাচার' করতে মেধার সরবরাহে ঘাটতি পড়বে না।
যে জিনিসগুলো খেয়াল রাখা দরকার:
* দেশের প্রতিটি মানুষই সম্পদ। স্কুলে বেশি নম্বর পাওয়ারা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, এ 'ভ্রান্ত' ধারণা থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। প্রত্যেক মানুষেরই কিছু শক্ত এবং কিছু দুর্বল দিক আছে। শক্ত এবং আগ্রহী দিকগুলোকে চিহ্নিত করে, তাকে তার সামর্থ্যবিকাশে সাহায্য করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এক্ষেত্রে উদ্দেশ্য হলো, তাকে 'কাজ' করতে উৎসাহী করে তোলা।
* দেশের অভ্যন্তরীন চাহিদা এবং বিদেশে রপ্তানি করার যোগ্য সম্ভাব্য জনশক্তি হিসেবের সময় প্রতিবেশি দেশসমূহের বিভিন্ন সেক্টর পর্যবেক্ষণ করা অতি জরুরী। নিজেদের দুর্বল দিকগুলো নয়, সবল দিকগুলো নিয়েই প্রতিযোগিতায় নামতে হবে, নাহলে মার খাওয়া ছাড়া উপায় নেই। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের পোশাক বিশ্বে সমাদৃত। অন্যদিকে কম্পিউটার যন্ত্রাংশ প্রস্তুত করতে গেলে বাংলাদেশকে অনেক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। এক্ষেত্রে মূল কথা হবে, নিজেদের শক্তি এবং সীমাবদ্ধতাকে নির্দেশকরণ ও সে অনুযায়ী শক্তিশালী দিকগুলোকে যতদূর সম্ভব ব্যবহার করা।
* তবে সর্বপ্রথমেই থাকতে হবে সদিচ্ছা, যতোটা না জনমানুষের, তারচেয়ে বেশি সিদ্ধান্তগ্রহণে ক্ষমতাধারীদের। ওই স্তরটায় কোন নীতি প্রয়োগ করে জ্বর সারানো যাবে, সে কুইনিন কে বের করবে? আপনার মতো আশাবাদী মানুষেরাই।
মন্তব্য
তবে সর্বপ্রথমেই থাকতে হবে সদিচ্ছা, যতোটা না জনমানুষের, তারচেয়ে বেশি সিদ্ধান্তগ্রহণে ক্ষমতাধারীদের। ...একমত। সুন্দর বিশ্লেষণ।
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
অনেক ধন্যবাদ, কাকু। লেখাটা একেবারেই ইম্যাচিউর। অনেকটা নিজের কাছে যুক্তিগুলোকে উপস্থাপন করার জন্য। পড়ার জন্য কৃতজ্ঞতা।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
শেলফে তুলে রাখলাম, পরে পড়তে হবে। মনে হচ্ছে ভাল বিশ্লেষণ আছে।
বড় লেখা দেখলে সবাই শেলফে তুলে রাখে।![হাসি হাসি](http://www.sachalayatan.com/files/smileys/1.gif)
বিশ্লেষণের মাত্র বিসমিল্লাহটা আছে, বাকিটা ভবিষ্যতের জন্য মুলতবি রাখা হচ্ছে।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
মুলতবি রাখা পর্বটা কবে?
কয়েক বছর লাগবে, বা কোনোদিনও দরকার হবে না। ডিমান্ড বুঝে। তবে এইটার একটা লিলিপুট ভার্সন করবো চিন্তা করছি।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
নতুন মন্তব্য করুন