আগের পোস্টে বোম্বাই মরিচ দিয়ে মাথামোটা পাকি সৈন্যদের হেনস্তার ঘটনা বর্ণনা করেছি। লীলেন ভাইও অনুরূপ একটা ঘটনার বর্ণনা দিলেন।
এ পোস্টের উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে ঘটা যেসব ঘটনা আপনারা বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছে শুনেছেন (অথবা নিজে দেখেছেন), তার বর্ণনা। সবার বর্ণনা আমি মূল পোস্টে জুড়ে দেবো।
০১.
যুদ্ধের সময়ে আমাদের স্কুলের হেডস্যার ছিলেন প্রচন্ড ব্যক্তিত্ববান এবং দেশপ্রেমিক মানুষ। আমাদের এলাকায় যখন পাকি বাহিনী আসে, তখন তাদের টার্গেট লিস্টে এক নাম্বারে ছিলেন তিনি। দুই নাম্বারে ছিলেন চেয়্যারম্যান সাহেব। সেই হেডস্যার ১৯৮০ সালে মারা যান, আমি তখন পিচ্চি। তাকে দেখার স্মৃতি মনে নেই। তবে চেয়ারম্যান সাহেবকে মনে আছে। চুল-দাঁড়ি পাঁকা মানুষটা যতদিন বেঁচে ছিলেন, প্রতিবারই প্রায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতেন।
উনাদেরকে খুন করতে পাকি সৈন্যরা যখন বেরোলো, তখন তাদেরকে যে রাজাকার গাইড করছিলো, সেও হেডস্যারকে পছন্দ করতো। পাকিরা স্যারের বাড়ি চিনতো না। স্যারের বাড়ির পাশে এসেও তারা বুঝে নাই, এটা কার বাড়ি। রাজাকারকে জিজ্ঞেস করতে সে শুধু বললো, "আগাড়ে হ্যায়।" হেড স্যার রক্ষা পেলেন।
আরেকটু এগিয়ে চেয়্যারম্যান সাহেবের বাড়ি। চেয়ারম্যান সাহেবকে বাড়িতে পাওয়া গেলো না। অবস্থা ঠাহর করে তারা আগে থেকেই গা ঢাকা দিয়েছিলেন। বাড়িতে ছিলো শুধুমাত্র উনার এক ভাতিজা এবং একটি কাজের ছেলে। পাকি সৈন্যরা বাড়ির উঠানেই তাদেরকে গুলি করে হত্যা করে।
০২. (কৃতজ্ঞতা: নায়েফ)
ঘটনাস্থল: বাদামতলী বাজার । চট্রগ্রাম ।
শুনেছি - আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে যে মুল সড়কটা গেছে -তার পাশে ১লা বৈশাখে মেলা বসেছিল-কেউ চা দোকানে চা খাচ্ছিল- তখনও আশেপাশের এলাকায় মিলিটারি আসেনি-আসার লক্ষণও নেই- সেদিন আচমকা মিলিটারির গাড়ি সাঁই সাঁই করে আসল, আর অবিরাম গুলি - মারা গেল শত শত লোক-
এলাকার মানুষ এখনও বলে - যা পাইছে সাফ করে দিয়ে গেছে -
০৩. (কৃতজ্ঞতা: পরিবর্তনশীল)
মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের এক ভাইয়ার কাছ থেকে শোনা। উনার ভাষায় লিখলাম...
যুদ্ধ যখন শুরু হল- তখন আমি ক্লাস ইলেভেনে। তখন আমাদের ক্যাডেট কলেজের প্রিন্সিপাল আর অ্যাডজুটেন্ট দুইজনেই ছিলেন পাকিস্তানি। আর ভিপি ছিলেন বাঙ্গালি কিন্তু সুবিধাবাদী। যুদ্ধের পরপরই রাস্তাঘাট সব বন্ধ করে দেওয়ায় আমাদের কলেজে বন্দী হয়ে যেতে হল, সব ছুটি বাতিল করা হল।
একদিন ক্যাডেট কলেজ থেকে আমি পালিয়ে গেলাম যুদ্ধ করব বলে। ক্যাডেট কলেজ থেকে কেউ এভাবে পালিয়ে গেলে তার শাস্তি হল জরিমানা এবং কলেজ থেকে বহিস্কার।
যাই হোক, আমি ট্রেনিং নিলাম এবং একদিন কলেজে ফিরে আসলাম; আমার জিনিস্পত্র কিছু নিয়ে যাওয়ার জন্য। মনে করেছিলাম, একজন মুক্তিযোদ্ধাকে কলেজ বহিস্কার করা হবে না। তাছাড়া আমার যুদ্ধে যাওয়ার ব্যাপারটা প্রিন্সিপাল ও এডজুটেন্ট জানত না। ভিপি স্যার জানতেন এবং তিনি আমাকে বাঁচিয়ে দেবেন।
কিন্তু কলেজ থেকে আমাকে বহিস্কার করে দেওয়া হল। আমি যখন বেরিয়ে আসছিলাম, তখন যে দৃশ্য দেখেছিলাম এখনো তা আমার চোখে জল আনে।
বিভিন্ন হল থেকে ক্যাডেটরা আমার দিকে হাত নাড়াল, একজন মুক্তিযোদ্ধাকে স্যালুট করল।
আমার সেক্টর ছিল ঢাকায়। ডিসেম্বরের ফার্স্ট সপ্তাহে ঢাকায় ভিপি স্যারের সাথে আমার দেখা হল। আসন্ন যুদ্ধ জয়ের কথা মাথায় রেখে তিনি আমাকে আবার কলেজে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা দিলেন। এরপর যে কথাটা বললেন, তা একজন সত্যিকারের বাংগালি বলতে পারে না...
- তোমার তো এখন অনেক আর্মি অফিসারের সাথে চেনাজানা, বলে দেইখ তো, আমি যেন প্রিন্সিপাল হতে পারি।
মুক্তিযুদ্ধের পর আবার আমি ক্যাডেট কলেজে ফিরে গিয়েছিলাম।
০৪. (কৃতজ্ঞতা: তীরুদা)
আমার এক বন্ধু পাগল হয়ে গিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকারের দল নিশৃংসভাবে হত্যা করেছিল তার বাবাকে তার সামনে। হাত পা থেকে শুরু করে একটি একটি করে অঙ্গ কেটে তাঁকে মারে শুয়োরের পাল!
০৫. (কৃতজ্ঞতা: সুমন চৌধুরী)
০৫, ০৬ ও ০৭-এর ঘটনাস্থল: নবাবগঞ্জ, জয়পাড়া, মুন্সীগঞ্জ
এপ্রিল মাসের শেষ দিকে জয়পাড়ায় ব্যপকভাবে হিন্দুদের বিষয় সম্পত্তি লুঠ করা শুরু হয়। সেখানে এক বৃদ্ধা গোবিন্দ'র পিসী নামে সকলের কাছে পরিচিত ছিলেন। তাঁর পরিবার অতীতে কোন এক সময় এলাকায় খুব প্রভাবশালী জোতদার ছিলেন। শত্রু সম্পত্তি আইনে প্রায় সর্বস্ব খোয়া গেলেও গোবিন্দর পিসী বেশ কিছু সোনাদানা আর ইংরেজ আমলের সোনার মোহর ইত্যাদি একটা কাঁসার ঘটিতে ভরে কোথাও লুকিয়ে রেখেছিলেন বলে জনশ্রুতি ছিল। রাজাকাররা ঐ বাড়ি লুঠ করার সময় কিছু পুরনো আসবাব পত্র, কাঁসার থালাবাসন আর কিছু পরিত্যাক্ত কাপড়চোপড় ছাড়া কিছুই পায় না। কিন্তু তাঁদের দৃঢ় বিশ্বাস গোবিন্দর পিসীর সেই ঘটি ঐ বাড়িতেই কোথাও না কোথাও লুকানো আছে। ভিটেমাটি খুঁড়েও যখন কিছু পাওয়া গেলো না তখন কেউ একটা রিউমার ছড়িয়ে দিলো, কেউ যাতে তুলতে না পারে সেই জন্যে ভদ্রমহিলা ঘটিটা কাঁচা পায়খানায় বিষ্ঠার মধ্যে ডুবিয়ে রেখে গেছেন। সোনার লোভে তখন রাজাকাররা নেমে পড়লেন বুকসমান গু এর মধ্যে...........
০৬. (কৃতজ্ঞতা: সুমন চৌধুরী)
জুন মাসে ধলেশ্বরী নদীতে দুইদিক থেকে গ্রেনেড হামলা করে পুরো এক লঞ্চ বোঝাই সৈন্য আর রাজাকার হালাকের ঘটনাটি অনেকেই জানেন। সেইসময় জনাচারেক রাজাকার কোনরকমে সাঁতরে কূলে এসে প্রাণরক্ষা করেন। গ্রামে ঢুকে একটি ঝুপড়ি দেখে সেখানে কড়া নাড়তে এক বৃদ্ধা বেরিয়ে এলেন। রাজাকাররা তাঁকে সকরুণ মিনতি করে বললেন, নানী, মুক্তিরা আমাগো দেখলে মাইরা ফালাইবো ...আমাগো বাঁচান। নানী পরিস্থিতিটা বুঝলেন। তিনি বললেন, তগো কোন ভয় নাই...তগো বন্দুকগুলা দে আমি পলাইয়া রাখি আর তরা গোয়াল ঘরে গিয়া নাড়ার মইধ্যে ঢুইকা থাক। এইখানে কেউ আইবো না। আইলে আমি কমু কেউ নাই। কিন্তু আমি না ডাকলে গোয়ালঘর থিকা বাইর হবি না। আমি ঘাটে যাই পানি আনতে। ঐ বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার দূরেই তখন মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেঞ্চ। নানী রীতিমতো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাঁর প্রকৃত নাতিদের কাছে বার্তা পৌছে দিলেন। সেদিন সন্ধ্যার মধ্যেই দোজখে আরো চারজন বাড়লো.....
০৭. (কৃতজ্ঞতা: সুমন চৌধুরী)
এটাও জুনের মাঝামাঝি সময়কার ঘটনা। ঝুম বুষ্টির মধ্যে নৌকায় করে জনাছয়েক পাকিস্তানী সৈন্য ধলেশ্বরী নদী পার হচ্ছিল। মাঝির কাজ ছিল কলা-ডাব ইত্যাদি পার করা। সৈন্যরা নৌকায় উঠলে তিনি ওদের কলা খেতে দিলেন। নিরিহ মাঝির মনে কি ছিল সেটা পাকিদের উর্বর মস্তিস্কে আসেনি। মাঝি একফাঁকে পাটতন তুলে নিচে সামান্য মেরামত করে নিলেন। ওয়াহা কেয়া কর্তা প্রশ্নের জবাবে বললেন, ফুডা জোড়া দেই। পরবর্তী আধাঘন্টা তিনি পাকা মাঝির মতো নৌকা মাঝনদীতে রেখে দিলেন। খানসাহেবরা সাঁতার জানতেন না..........
০৮. (কৃতজ্ঞতা: আনোয়ার সাদাত শিমুল)
ঘটনাস্থল: চট্টগ্রাম
আহমেদুর সোবাহান রাজাকার ছিল। তার ভাগ্নে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিংয়ে গিয়েছিলো। সেটা আহমেদুর সোবাহান মেনে নেয়নি। দাওয়াত দিয়ে ভাগ্নেকে প্রথমে বাড়ী নিয়ে যায়, সেখান থেকে রাজাকার ক্যাম্প।
তারপর জনসমক্ষে জবাই।
ভাগ্নে চিৎকার করে বলেছিলো - 'মামা আমি তোমার ভাগিনা, আমাকে মেরো না।'
মামা বলেছিলো - "আমার চোখ অন্ধ, আমি কিছু দেখিনা - আমি কানে শুনি না, আমার ভাগ্নে বলে কেউ নাই, নারায়ে তকবির - - -"
এই কথা বলে তাকে জবাই করা হয়।
যুদ্ধের মাস গুলোয় সবাই এই আহমেদুর সোবাহানের আতঙ্কে থাকতো। তার নাম হয়েছিলো - আজরাইলেস-সোবাহান।
এলাকা (চট্টগ্রাম-১) শত্রুমুক্ত হয় ৮ ডিসেম্বর।
এর পরদিন আহমেদুর সোবাহানকে ধরে পাইলট স্কুল ভবনে আনা হয়। গণমানুষ তাকে স্কুলের দো'তলার বারান্দায় বেঁধে রাখে। আর নিচ থেকে শিশু-কিশোর-যুবা-বৃদ্ধ পাথর-ইট মারতে থাকে সারাদিন। পিপাসায় চিৎকার করলে যুদ্ধে নিহত একজনের খুলি (পাওয়া গিয়েছিলো কোনো ডোবায়) এনে তার গলায় ঝুলিয়ে দেয়া হয়। খুলির মধ্যে পানি। সমবেত জনতা চিৎকার করে বলে - 'ঐ পানি খা'। এভাবে ২/৩ দিন পরে আজরাইলেস-সোবাহান মারা যায়।
কারো কোনো দু:খ ছিলো না।
ঘাতক যুদ্ধাপরাধীর জন্য মানুষ কখনো দু:খ করে না।
০৯. (কৃতজ্ঞতা: নুরুজ্জামান মানিক)
ঘটনার উৎস: মোঃ রহমতুল্লাহ
কোম্পানী কমান্ডার, ১১ নং সেক্টর ,১৯৭১।
১৭ ই নভেম্বর ১৯৭১। ৩ জন সহযুদ্ধাসহ ছদ্ধবেশে রেকি প্যাট্রলে নালিতাবাড়ি (বর্তমান শেরপুর জেলার অন্যতম থানা ) পৌছলাম । নালিতাবাড়ি সদর ও তার আশপাশ ঘুরলাম। বিকেল হল। সারাদিন ছিলাম উপোষ । পেটে কোন দানাপানি পরে নি । আমাদের হাতে শুধু ধান কাটার কাচি। পাক বাহিনীর টহল লক্ষ্য করলাম। সন্ধা ঘনিয়ে এল । এরই মাঝে লক্ষ্য করলাম একটি জীপ গাড়ি থেকে কয়েকজন পাক সেনা অস্ত্রসমেত নেমে কাচা সরু পথে একটি বাড়িতে যাচ্ছে। এমন সময় আমার সহকর্মী শাহজাহান হঠাৎ বলে বসল স্যার তাড়াতাড়ি জীপে (পাকবাহিনীর জীপটি ) উঠুন । এই গাড়ি নিয়ে যাব। আমি পুলিশের গাড়ির ড্রাইভার ছিলাম , ড্রাইভিং জানি সুতরাং কোন চিন্তা নাই । যেই কথা সেই কাজ । শাহজাহান দৌড়ে গাড়িতে বসেই ষ্ট্রার্ট দিয়ে দ্রুত ক্যাম্পের দিকে যাত্রা শুরু করলো । পাক বাহিনী যখন বুঝতে পারলো তখন আমরা রাইফেলের রেঞ্জের বাইরে । তবুও তারা অনবরত গুলি ছুড়তে লাগল । আল্লাহ’র অশেষ রহমতে গাড়িসহ আমরা মেঘালয় রাজ্যের চিচিং পাড়া ক্যাম্পে পৌছলাম । পরদিন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের "স্বাধিন বাংলা বেতার কেন্দ্র" থেকে এই বীরোত্বপুর্ন ঘটনা প্রচার করা হয়।
১০. (কৃতজ্ঞতা: নুরুজ্জামান মানিক)
ঘটনার উৎস: মোঃ রহমতুল্লাহ
কোম্পানী কমান্ডার, ১১ নং সেক্টর ,১৯৭১
মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার নেতৃত্বে কিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট এলাকায়অপারেশনে আসিলাম। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে নিজেদের ক্যাম্পে ফেরত যাইতে পারিলাম না। সকাল হইয়া গেল। সারারাত ছিলাম জঙ্গলে, কাদাযুক্ত ধানক্ষেতে এবং কচুক্ষেতে পাক হানাদার বাহিনীর আনাগোনার চাইতেও দুর্ধষ্য আলবদর বাহিনীর ভয়ে সারা রাত মৃত মানুষের মত প্রচন্ড ঠান্ডা পানিতে কচুরী পানা মাথায় দিয়া পঁচা ডুবায় অবস্থান করিয়াছি। খাওয়ার কোন ব্যবস্থা ছিলনা বলিয়া সারারাত কিছুই খাওয়া হয় নাই। তবে জীবনের ভয়ে এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের সৈনিক হিসাবে ুধা ছিল না। এইভাবে রাত শেষ হইল। দিনেতো যাওয়া সম্ভব নয়। সেই অবস্থায় আবার সারাদিন কাটিল শুধু কুচুরী পানার পঁচা পানি পান করিয়া। ইহাতে আমার কোন দুঃখ নাই। দুঃখ হয় তখন, যখন দেখি বা শুনি আলবদর বাহিনী নেতা নিজামী বা মোজাহেদীর হাত দিয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা গ্রহণ করিতে হয়েছিল গত সরকারের আমলে।
১১. (কৃতজ্ঞতা: নুরুজ্জামান মানিক)
ঘটনার উৎস: মোঃ রহমতুল্লাহ
কোম্পানী কমান্ডার, ১১ নং সেক্টর ,১৯৭১
অপারেশন পানিহাতা টু জামালপুর :
৫ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সকাল ৯ টায় মিত্রবাহিনীর অধিনায়ক কর্নেল রাও আমাদের ক্যম্পে এসে নির্দেশ দিলেন সন্ধা ৭টায় পাক বাহিনীর শক্তিশালী ঘাটি পানিহাতা আক্রমন করতে হবে। তার নির্দেশ শুনে আমার কোম্পানির যুদ্ধারা কিছুটা ভড়ঁকে গেল । কারণ, কিছুদিন আগে উক্ত ঘাটি আক্রমন করতে গিয়ে মুক্তিবাহিনীর একজন কোম্পানি কমান্ডার সহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছে । যা হোক, দেশ স্বাধিন করতেই হবে যে কোন মুল্যে, পিছঁপা হলে চলবে না । আমি সকলকে একত্র হতে আদেশ দিয়ে ব্রিফিং দিলাম । সবাই "জয় বাংলা " বলে অপারেশনে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করল ।সন্ধায় কর্নেল রাও এসে আমাদের প্রস্তত দেখে খুশি হলেন ।
শুরু হল আমাদের যাত্রা । ঘুটঘুটে অন্ধকার ,সামনে ছোট নদী পার হয়ে পানিহাতার দিকে নিরবে চললাম । আনুমানিক রাত ১১টায় পাকবাহিনীর ক্যম্পের অতি নিকটে পৌছলাম । আন্ধাররাতে কিছুই দেখা যাচিছল না । কিন্তু ক্যাম্পটি দেখা যাচেছ হারিকেন এর প্রজ্জ্বলিত আলোয় ।বেশ কিছুক্ষন কাদাযুক্ত ধানক্ষেতে চুপটি মেরে থাকার পর আদেশ দিলাম ফায়ারিং এর । মিত্রবাহিনী সেল মারা শুরু করল । আর আমরা এল এম জি, এস এল আর ও রাইফেল দিয়ে গুলি ছুড়তে থাকলাম । প্রায় ৩ ঘন্টা ধরে যুদ্ধ চলল । পাকবাহিনী ক্যাম্প ছেড়ে সাজোঁয়া গাড়ি করে পালিয়ে গেল । ভোর ৪টায় পানিহাতা ক্যাম্পে রেড করলাম। বিজয় নিশান উড়ানো হল ময়মনশিংহ জেলার সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাটি পানিহাতায়। শত্রুমুক্ত ঘাটিতে শুরু হল আনন্দ উল্লাশ।
সকালে বাংকারের ভিতরে দেখলাম সম্পুর্ন নগ্ন মা -বোনাদের । তাদের দেহে শক্তিবল কিছুই নেই , রক্তশুন্য ফ্যাকাঁসে ,একেকজন যেন জিন্দা লাশ । প্রশ্ন জাগে মনে "পাকিস্তানি সেনারা কি মুসলমান ", "তারা কি মানুষ নাকি নরপশু ", "তারা কুকুরের চেয়ে নিকৃষ্ট জীব " । ১৭/১৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করলাম । আমাদের সাথে যে গামছা ছিল তা' দিয়ে তাদের লজ্জাঁ ঢাকার ব্যবস্থা হল । আশপাশের লোকজন এলে বীরঙ্গনাদের নিজ নিজ বাড়িতে পৌছানোর জন্য তাদের হেফাজতে দিয়ে ক্যাম্পে চলে এলাম । সঙ্গে ছিল দুই সহযোদ্ধার লাশ ।
সারারাত ঘুম জাগা তাই দুপুরের খানা খেয়ে সকলকেই বিশ্রাম করতে আদেশ দিয়েছি। যারা রান্নার কাজে দায়িত্বে আছে তারা রান্না করছে। হঠাত্ বাঁশীর হুইসেলে ,সকলেই হতবাক। অফিসার জানাল ,সমস্ত মুক্তিযোদ্ধাকে প্রস্তুত করতে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সকলেই সসস্ত্র প্রস্তুত হলাম। তিনি আমাদেরকে ডালো বারাঙ্গা পাড়া মিত্র বাহিনীর ঘাটিতে যেতে বললেন। রাতের জন্য রান্না বান্না প্রায় শেষ। অনেকে খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু সবকিছু ফেলে সকল মুক্তিযোদ্ধা রওয়ানা হলাম। মনে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া নেই; পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা , তবুও আনন্দ, সম্মূখযুদ্ধে যাচ্ছি। দেশ স্বাধীন হবে। সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালী মুক্ত দেশে শান্তিতে থাকবে। এই বুক ভরা আশা নিয়ে স্বদেশের মাটির দিকে দ্রুত যেতে থাকলাম। ডালো বারাঙ্গা পাড়ায় কিছু আনুষ্ঠানিকতার পর বাউরামারী হয়ে নন্নী পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যা। আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বাউরামারী নন্নী হয়ে প্রথমে ঝিনাইগাতীর আহম্মদ নগর পাক বাহিনীর ঘাটি আক্রমন করার ।শেরপুরের পথে নন্নীতে আমার ছোট বোন রৌশন আরার বাড়ী। বোনসহ এলাকার মুক্তিপাগল মানুষের কি আনন্দ-মুক্তিবাহিনী এসেছে। রৌশন আরা আমাকে সমস্ত যোদ্ধার সামনে দেখে চিনে ফেললো, অশ্র“ সজল নয়নে শুধু বল্লো-সকলেই একটু দাঁড়াও। ২/৩ মিনিটের মধ্যেই বস্তায় বস্তায় চিড়ামুড়ি-গুর নিয়ে আমাদের কে বিতরণ করলো। খাবার এর পর আবার চলতে শুরু করলাম। আমাদের যেতে হবে ঝিনাইগাতী হয়ে শেরপুর। রাত ৮ ঘটিকায় ঝিনাইগাতী পৌছলাম। হঠাত্ মোবারক ও প্লাটুন কমান্ডার বকর নামে দু'জন সহযোদ্ধা আমাকে অনুরোধ করে বলল-স্যার এখান থেকে অতি নিকটে আমাদের বাড়ী। আপনার নিকট অনুরোধ, মাত্র ১০ মিনিটের জন্য সকলকেই নিয়ে আমাদের বাড়ীতে চলুন ,সময়মত শেরপুর পৌছতে কোন অসুবিধে হবে না। আমরা মোবারকের বাড়ী কালিনগর গেলাম। মোবারকের পিতামাতা আত্মীয় স্বজনসহ গ্রামের লোকদের কি আনন্দ। আমাকে না জানিয়ে না বুঝতে দিয়ে বিরাট বড় একটা ষাড় গরু জবাই করে ফেললো।
চারিদিকে রান্না শুরু হলো। রাত ২ টার মধ্যেই খানা-পিনা শেষ করে আবার রওয়ানা হলাম শেরপুর সদরের দিকে। পথে আহাম্মদ নগর পাক বাহিনীর শক্ত ঘাটি। আমরা পৌঁছার আগেই হানাদার পাক বাহিনী ঘাটি ছেড়ে চলে গেছে। এই ঘাটিতেই শত শত স্বাধীনতাকামী লোকদেরকে এনে ক্রস ফায়ারে হত্যা করেছে।ভোর বেলায় আহম্মদনগর ক্যাম্প রেড করে শেরপুর সদরে আসার পথে আল বদর কমান্ডার কামারুজ্জামান (ভারতে থাকতেই শুনেছি , জামাতে ইসলামীর শেরপুরের নায়েবে আমির ফজলুর রহমান কামারুজামানকে দিয়ে অসংখ্য মানুষ হত্যা করেছেন এবং শেরপুর পাক হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে আওয়ামী লীগের নেতা সমর্থকদের হত্যার পরামর্শ দিয়ে লিখিত তালিকা পেশ করেছিলেন ) এর বাড়ী ঘেরাও করলাম কিন্তু তাকে পেলাম না। জানতে পারলাম আগের রাতে আহম্মদনগর ক্যাম্পের পাক বাহিনীদের সাথে জামালপুরে চলে গেছে । সকাল ৭ঘটিকায় শেরপুর শহরে পৌঁছালাম। শেরপুর শহরেই আমাদের বাড়ী। খবর পেয়ে শ্রদ্ধেয় বাবাজান দারগ আলী পার্কে আসলেন। একে একে সকলের সাথে দেখা হলো। মা আমাকে দেখে আবেগে বিহব্বল হয়ে প্রায় বাকশূন্য হলেন। শুধু দেখা হলো না স্ত্রী নূরজাহানের সাথে। সে তখন তাদের গ্রামের বাড়ীতে ছিল।হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষের আনন্দ দেখে আমি আবেগের কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। কিছুণের মধ্যেই হেলিকপ্টার আসলো। পদার্পণ করলেন মিত্র বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেঃ জেঃ আরোরা। আমার বাহিনীসহ হাজার হাজার মুক্তি বাহিনী ও মুক্তি পাগল মানুষ তাকে অভ্যর্থনা জানালাম। মুহুর্তেই আদেশ হলো আজ বিকাল ৫ ঘটিকায় জামালপুর আক্রমণ করতে হবে। জামালপুর এম্বোসের জন্য আমার বাহিনীকে নান্দিনায় ডিফেন্স দেওয়া হলো-যাতে হানাদার বাহিনী রেলওয়ে যুগে পালাতে না পারে।
জামালপুর মুক্ত করে কামাল খান মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা আলবদর বাহিনীর প্রধান বহু মানুষ হত্যাকারী, ধনসম্পদ লুটকারী আব্দুল্লাহ ইবনে ফজলের (ফজল মুন্সী ,বর্তমানে বোমাবাজ কথিত শায়খ আবদুর রহমানের পিতা) বাড়ী ও মাদ্রাসা ঘেরাও করলাম। তিনি পলাতক। লুটের মাল উদ্ধার করে জামালপুরের এস ডি ও এর হেফাজতে দিলাম। আমাকে এস ডি ও সাহেব প্রশংসা করলেন এবং মাল্য দান করলেন।
এভাবে ৪ঠা ডিসেম্বর পানিহাতা, নালিতাবাড়ী, ৫ই ডিসেম্বর বাওরামারী, ঝিনাইগাতী, ৬ই ডিসেম্বর শেরপুর, ৭ই ডিসেম্বর জামালপুর, ময়মনসিংহ, মধুপুর শত্র“ মুক্ত হলো। ইতিপূর্বেই কাদের সিদ্দিকি টাঙ্গাইল মুক্ত করেছে। ১৬ই ডিসেম্বর ৯০,০০০ হাজার হানাদার বাহিনীর আত্মসর্মনের মধ্য দিয়ে বাংলার মাটিতে উড়ল বিজিয়ের নিশান ।জয় বাংলা ।
১২. (কৃতজ্ঞতা: বিপ্লব রহমান)
১৯৭১ সালে ঘটে যাওয়া আমার নানু বাড়ির টুকরো কাহিনী নীচে বলছি। এসব আমাকে বলেছেন আমার মা, সৈয়দা আসগারী সিরাজী। আর ঘটনার বর্ণনায় সৈয়দ মোহাম্মদ ইসাহাক আমার নানু। তার মেয়ে সৈয়দা এলিজা সিরাজী (মঞ্জু) ও ছেলে মুস্তাফিজুর রহমান (মন্টু) আমার খালা ও মামা।
---
সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর ছোট ভাই সৈয়দ মোহাম্মদ ইসাহাক ছিলেন সিরাজগঞ্জের নামকরা স্কুল শিক্ষক। সিরাজগঞ্জের এই নামকরা পরিবারটি মুক্তিযুদ্ধের সময় স্পষ্টত: দুটি ভাগে বিভক্ত হয়। সিরাজীরা বরাবরই ছিলেন মুসলিম লীগের সমর্থক। তবে ওই যৌথ পরিবারের কোনো কোনো সদস্য জড়িয়ে পড়েছিলো '৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে।
যুদ্ধের সময় পাকিস্তানপন্থী সিরাজীরা মুসলিম লীগের ব্যানারে গঠন করেন শান্তিকমিটি। তবে স্কুল শিক্ষক ইসাহাকের ছোট মেয়ে সৈয়দা এলিজা সিরাজী (মঞ্জু) কলেজে পড়ার সময়েই জড়িয়ে পড়েন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে।
১৯৬৯ এর গণঅভ্যূত্থানে সিরাজগঞ্জের বড় বড় হরতাল, অবরোধে মঞ্জু নামের তরুণীটি সরাসরি অংশ নেন। তার ভাই মন্টুও গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন।
সিরাজী বাড়ির শান্তি কমিটির অনেক গোপন তথ্য এই দুই ভাইবোন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাচার করে দিতেন। ১৯৭১ সালে মুক্তি বাহিনী সিরাজগঞ্জে বড় বড় অভিযান চালালেও তাই মুসলিম লীগার এই পরিবারটির ওপর কোনো হামলা হয়নি।
এমন কি পাকিস্তানী বিমান বাহিনী যখন বোমা হামলা শুরু করে, তার আগে মুক্তি বাহিনীর সদস্যরা সিরাজী বাড়িতে এসে কী ভাবে ট্রেঞ্চ খুঁড়তে হয়, তা তাদের দেখিয়ে দিয়েছিলো!
সিরাজী বাড়ির শান্তি কমিটির পাণ্ডারা বাড়ির ছোট ছেলে ও তাদের ম্যাসেঞ্জার মন্টুকে সন্দেহ করতো। সে বোধহয় তাদের গোপন চিঠিপত্রর একটা কপি টুকে রেখে তবেই তা পৌঁছে দিতো অন্য রাজাকারদের কাছে। আর টুকলিফাই কপি চলে যেতো মুক্তি বাহিনীর কাছে।...এ রকমই তথ্য ছিলো তাদের কাছে।
একদিন বিকালে মন্টু শান্তিকমিটির চিঠি নিয়ে রওনা দেয় নির্দিষ্ট কোনো রাজাকার বাহিনীর কাছে পৌঁছে দিতে। একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা মতে, পথেই অন্য রাজাকারদের একটি গ্রুপ তাকে প্রথমে অপহরণ, পরে খুন করে লাশ গুম করে। ১৯৭১ এর নিখোঁজদের তালিকায় যুক্ত হয় মুস্তাফিজুর রহমান মন্টুর নাম।
সিরাজী বাড়িতে অনেক আঁতিপাতি করেও নিখোঁজ মন্টুর কোনো ছবি পাওয়া যায়নি। তবে তার স্মৃতি হিসেবে একটি তিন ব্যান্ডের চীনা রেডিও অনেকদিন পরিবারটির সংগ্রহে ছিলো। অনাদরে সেই রেডিওটিও অবশেষে খোয়া গেছে। ...
১৩. ...
মন্তব্য
ভালো উদ্যোগ।
চলুক।
ওয়েবসাইট | ফেসবুক | ইমেইল
০২...কই?
তাড়াতাড়ি...তাড়াতাড়ি...
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
হুম, ফাঁকি বাজি! ০৩টা আপনি দেন। কুইক!
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের এক ভাইয়ার কাছ থেকে শোনা। উনার ভাষায় লিখলাম...
যুদ্ধ যখন শুরু হল- তখন আমি ক্লাস ইলেভেনে। তখন আমাদের ক্যাডেট কলেজের প্রিন্সিপাল দুইজনেই ছিলেন...পাকিস্তানি। আর ভিপি ছিলেন বাঙ্গালি কিন্তু সুবিধাবাদী। যুদ্ধের পরপরই রাস্তাঘাট সব বন্ধ করে দেওয়ায়...আমাদের কলেজে বন্দী হয়ে যেতে হল...সব ছুটি বাতিল করা হল।
একদিন ক্যাডেট কলেজ থেকে আমি পালিয়ে গেলাম...যুদ্ধ করব বলে। ক্যাডেট কলেজ থেকে কেউ এভাবে পালিয়ে গেলে...তার শাস্তি হল জরিমানা এবং কলেজ থেকে বহিস্কার।
যাই হোক, আমি ট্রেনিং নিলাম এবং একদিন কলেজে ফিরে আসলাম...আমার জিনিস্পত্র কিছু নিয়ে যাওয়ার জন্য। মনে করেছিলাম...একজন মুক্তিযোদ্ধাকে কলেজ বহিস্কার করা হবে না। তাছাড়া...আমার যুদ্ধে যাওয়ার ব্যাপারটা প্রিন্সিপাল...এডজুটেন্ট জানত না। ভিপি স্যার জানতেন এবং তিনি আমাকে বাঁচিয়ে দেবেন।
কিন্তু কলেজ থেকে আমাকে বহিস্কার করে দেওয়া হল। আমি যখন বেরিয়ে আসছিলাম...তখন যে দৃশ্য দেখেছিলাম...এখনো তা আমার চোখে জল আনে।
বিভিন্ন হল থেকে ক্যাডেটরা আমার দিকে হাত নাড়াল...একজন মুক্তিযোদ্ধাকে স্যালুট করল।
আমার সেক্টর ছিল ঢাকায়। ডিসেম্বরের ফার্স্ট সপ্তাহে ঢাকায় ভিপি স্যারের সাথে আমার দেখা হল। আসন্ন যুদ্ধ জয়ের কথা মাথায় রেখে তিনি আমাকে আবার কলেজে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা দিলেন। এরপর যে কথাটা বললেন... তা একজন সত্যিকারের বাংগালি বলতে পারে না...
- তোমার তো এখন অনেক আর্মি অফিসারের সাথে চেনাজানা...বলে দেইখ তো... আমি যেন প্রিন্সিপাল হতে পারি।
মুক্তিযুদ্ধের পর আবার আমি ক্যাডেট কলেজে ফিরে গিয়েছিলাম।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
গ্রেট। যোগ করে দিলাম। সাথে স্যালুট সেই ক্লাস ইলেভেনের টগবগ তরুণ মুক্তিযোদ্ধাকে।
রাজাকারদের মৌলিক চরিত্র সুবিধাবাদিতা। সব সুবিধাবাদীই রাজাকার নয়, তবে সব রাজাকারই সুবিধাবাদী। ভিপি মিয়া চামেচিকনে প্রিন্সিপাল হওয়ার ধান্দা তো করবেই। লাভের গুড় সবসময়ই এই সুবিধাবাদীরা খায়।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
ভাইয়া দুইটা ভুল হয়ে গেছে। একটু ঠিক করে দ্যান।
দ্বিতীয় লাইনে ''প্রিন্সিপাল আর এডজুটেন্ট দুইজনই...''হবে
আর তৃতীয় লাইনে ''দেওয়াই''না হয়ে ''দেওয়ায়'' হবে
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
শুনেছি - আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে যে মুল সড়কটা গেছে -তার পাশে ১লা বৈশাখে মেলা বসেছিল-কেউ চা দোকানে চা খাচ্ছিল- তখনও আশেপাশের এলাকায় মিলিটারি আসেনি-আসার লক্ষণও নেই- সেদিন আচমকা মিলিটারির গাড়ি সাঁই সাঁই করে আসল, আর অবিরাম গুলি - মারা গেল শত শত লোক-
এলাকার মানুষ এখনও বলে - যা পাইছে সাফ করে দিয়ে গেছে -
----
নায়েফ
অনেক ধন্যবাদ। ঘটনাটি পোস্টে যোগ করে দিয়েছি। কোন এলাকার ঘটনা জানতে পারলে ভালো হতো।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
বাদামতলী বাজার । চট্রগ্রাম ।
উদ্যোগঃ নিঃসন্দেহে জটিল।
আমার এক বন্ধু পাগল হয়ে গিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকারের দল নিশৃংসভাবে হত্যা করেছিল তার বাবাকে তার সামনে। হাত পা থেকে শুরু করে একটি একটি করে অঙ্গ কেটে তাঁকে মারে শুয়োরের পাল!
**********************************
যাহা বলিব সত্য বলিব
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
অনেক ধন্যবাদ। স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস জানতে আপনাদের মত প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে বেশি বেশি তথ্য প্রয়োজন।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
এইমাত্র বাবার সাথে কথা হলো। একটানা বেশ কয়েকটা ঘটনার বর্ননা দিলেন। বাবা একটা কথার উপরে খুব জোর দিলেন যে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিটারণে শোকাবহ ঘটনার উল্লেখ খুব বেশী থাকে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের আসল স্পিরিট হচ্ছে আমাদের বিজয়ের ঘটনা। মুক্তিবাহিনি আর জনগণ সেখানে বিচ্ছিন্ন কিছু ছিলো না। জনগণের সক্রিয় সহায়তায় মুক্তিবাহিনি পাকিস্তানী সেনাবাহিনি আর তাদের চামচা রাজাকার-আলবদরদের পরাজিত করেছিল এই ইতিহাসকে সমানে নিয়ে আসতে হবে।
বাবার বর্ননা করা ঘটনাগুলির সবই নবাবগঞ্জ, জয়পাড়া, মুন্সীগঞ্জ এলাকার।
ঘটনা এক.
এপ্রিল মাসের শেষ দিকে জয়পাড়ায় ব্যপকভাবে হিন্দুদের বিষয় সম্পত্তি লুঠ করা শুরু হয়। সেখানে এক বৃদ্ধা গোবিন্দ'র পিসী নামে সকলের কাছে পরিচিত ছিলেন। তাঁর পরিবার অতীতে কোন এক সময় এলাকায় খুব প্রভাবশালী জোতদার ছিলেন। শত্রু সম্পত্তি আইনে প্রায় সর্বস্ব খোয়া গেলেও গোবিন্দর পিসী বেশ কিছু সোনাদানা আর ইংরেজ আমলের সোনার মোহর ইত্যাদি একটা কাঁসার ঘটিতে ভরে কোথাও লুকিয়ে রেখেছিলেন বলে জনশ্রুতি ছিল। রাজাকাররা ঐ বাড়ি লুঠ করার সময় কিছু পুরনো আসবাব পত্র, কাঁসার থালাবাসন আর কিছু পরিত্যাক্ত কাপড়চোপড় ছাড়া কিছুই পায় না। কিন্তু তাঁদের দৃঢ় বিশ্বাস গোবিন্দর পিসীর সেই ঘটি ঐ বাড়িতেই কোথাও না কোথাও লুকানো আছে। ভিটেমাটি খুঁড়েও যখন কিছু পাওয়া গেলো না তখন কেউ একটা রিউমার ছড়িয়ে দিলো, কেউ যাতে তুলতে না পারে সেই জন্যে ভদ্রমহিলা ঘটিটা কাঁচা পায়খানায় বিষ্ঠার মধ্যে ডুবিয়ে রেখে গেছেন। সোনার লোভে তখন রাজাকাররা নেমে পড়লেন বুকসমান গু এর মধ্যে...........
ঘটনা দুই.
জুন মাসে ধলেশ্বরী নদীতে দুইদিক থেকে গ্রেনেড হামলা করে পুরো এক লঞ্চ বোঝাই সৈন্য আর রাজাকার হালাকের ঘটনাটি অনেকেই জানেন। সেইসময় জনাচারেক রাজাকার কোনরকমে সাঁতরে কূলে এসে প্রাণরক্ষা করেন। গ্রামে ঢুকে একটি ঝুপড়ি দেখে সেখানে কড়া নাড়তে এক বৃদ্ধা বেরিয়ে এলেন। রাজাকাররা তাঁকে সকরুণ মিনতি করে বললেন, নানী, মুক্তিরা আমাগো দেখলে মাইরা ফালাইবো ...আমাগো বাঁচান। নানী পরিস্থিতিটা বুঝলেন। তিনি বললেন, তগো কোন ভয় নাই...তগো বন্দুকগুলা দে আমি পলাইয়া রাখি আর তরা গোয়াল ঘরে গিয়া নাড়ার মইধ্যে ঢুইকা থাক। এইখানে কেউ আইবো না। আইলে আমি কমু কেউ নাই। কিন্তু আমি না ডাকলে গোয়ালঘর থিকা বাইর হবি না। আমি ঘাটে যাই পানি আনতে। ঐ বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার দূরেই তখন মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেঞ্চ। নানী রীতিমতো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাঁর প্রকৃত নাতিদের কাছে বার্তা পৌছে দিলেন। সেদিন সন্ধ্যার মধ্যেই দোজখে আরো চারজন বাড়লো.....
ঘটনা তিন.
এটাও জুনের মাঝামাঝি সময়কার ঘটনা। ঝুম বুষ্টির মধ্যে নৌকায় করে জনাছয়েক পাকিস্তানী সৈন্য ধলেশ্বরী নদী পার হচ্ছিল। মাঝির কাজ ছিল কলা-ডাব ইত্যাদি পার করা। সৈন্যরা নৌকায় উঠলে তিনি ওদের কলা খেতে দিলেন। নিরিহ মাঝির মনে কি ছিল সেটা পাকিদের উর্বর মস্তিস্কে আসেনি। মাঝি একফাঁকে পাটতন তুলে নিচে সামান্য মেরামত করে নিলেন। ওয়াহা কেয়া কর্তা প্রশ্নের জবাবে বললেন, ফুডা জোড়া দেই। পরবর্তী আধাঘন্টা তিনি পাকা মাঝির মতো নৌকা মাঝনদীতে রেখে দিলেন। খানসাহেবরা সাঁতার জানতেন না..........
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ
অজ্ঞাতবাস
রাজাকার কী বস্তু !
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
বিশাল ধন্যবাদ, আঙ্কেলকে।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
চোখ রাখছি এ পাতায়
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
এইটা জমতেসে
আহমেদুর সোবাহান রাজাকার ছিল। তার ভাগ্নে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিংয়ে গিয়েছিলো। সেটা আহমেদুর সোবাহান মেনে নেয়নি। দাওয়াত দিয়ে ভাগ্নেকে প্রথমে বাড়ী নিয়ে যায়, সেখান থেকে রাজাকার ক্যাম্প।
তারপর জনসমক্ষে জবাই।
ভাগ্নে চিৎকার করে বলেছিলো - 'মামা আমি তোমার ভাগিনা, আমাকে মেরো না।'
মামা বলেছিলো - "আমার চোখ অন্ধ, আমি কিছু দেখিনা - আমি কানে শুনি না, আমার ভাগ্নে বলে কেউ নাই, নারায়ে তকবির - - -"
এই কথা বলে তাকে জবাই করা হয়।
যুদ্ধের মাস গুলোয় সবাই এই আহমেদুর সোবাহানের আতঙ্কে থাকতো। তার নাম হয়েছিলো - আজরাইলেস-সোবাহান।
এলাকা (চট্টগ্রাম-১) শত্রুমুক্ত হয় ৮ ডিসেম্বর।
এর পরদিন আহমেদুর সোবাহানকে ধরে পাইলট স্কুল ভবনে আনা হয়। গণমানুষ তাকে স্কুলের দো'তলার বারান্দায় বেঁধে রাখে। আর নিচ থেকে শিশু-কিশোর-যুবা-বৃদ্ধ পাথর-ইট মারতে থাকে সারাদিন। পিপাসায় চিৎকার করলে যুদ্ধে নিহত একজনের খুলি (পাওয়া গিয়েছিলো কোনো ডোবায়) এনে তার গলায় ঝুলিয়ে দেয়া হয়। খুলির মধ্যে পানি। সমবেত জনতা চিৎকার করে বলে - 'ঐ পানি খা'। এভাবে ২/৩ দিন পরে আজরাইলেস-সোবাহান মারা যায়।
কারো কোনো দু:খ ছিলো না।
ঘাতক যুদ্ধাপরাধীর জন্য মানুষ কখনো দু:খ করে না।
অনেক ধন্যবাদ। এই ধরণের একটা ঘটনা আমার কালেকশনেও আছে। নামটা নিশ্চিত হয়ে ওটাও এই পোস্টে অ্যাড করে দেবো।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
ভালো আইডিয়া!
হাঁটুপানির জলদস্যু
অসামান্য!!
ব-e কইরা ফেলেন
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
হিমু, ইশতিয়াক রউফ এবং জ্বিনের বাদশা ভাই, আপনাদের শোনা ঘটনা অ্যাড করেন। ফাঁকিবাজি চলবে না!
বই করতে গেলে আরেকটু গোছানো লেখা দরকার। দেখি, আরো কিছু ঘটনা পাওয়া গেলে পুরোটা গুছিয়ে কিছু একটা করা যায় নাকি।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
মোঃ রহমতুল্লাহ
কোম্পানী কমান্ডার, ১১ নং সেক্টর ,১৯৭১।
এক ) ১৭ ই নভেম্বর ১৯৭১। ৩ জন সহযুদ্ধাসহ ছদ্ধবেশে রেকি প্যাট্রলে নালিতাবাড়ি (বর্তমান শেরপুর জেলার অন্যতম থানা ) পৌছলাম । নালিতাবাড়ি সদর ও তার আশপাশ ঘুরলাম। বিকেল হল। সারাদিন ছিলাম উপোষ । পেটে কোন দানাপানি পরে নি । আমাদের হাতে শুধু ধান কাটার কাচি। পাক বাহিনীর টহল লক্ষ্য করলাম। সন্ধা ঘনিয়ে এল । এরই মাঝে লক্ষ্য করলাম একটি জীপ গাড়ি থেকে কয়েকজন পাক সেনা অস্ত্রসমেত নেমে কাচা সরু পথে একটি বাড়িতে যাচ্ছে। এমন সময় আমার সহকর্মী শাহজাহান হঠাৎ বলে বসল স্যার তাড়াতাড়ি জীপে (পাকবাহিনীর জীপটি ) উঠুন । এই গাড়ি নিয়ে যাব। আমি পুলিশের গাড়ির ড্রাইভার ছিলাম , ড্রাইভিং জানি সুতরাং কোন চিন্তা নাই । যেই কথা সেই কাজ । শাহজাহান দৌড়ে গাড়িতে বসেই ষ্ট্রার্ট দিয়ে দ্রুত ক্যাম্পের দিকে যাত্রা শুরু করলো । পাক বাহিনী যখন বুঝতে পারলো তখন আমরা রাইফেলের রেঞ্জের বাইরে । তবুও তারা অনবরত গুলি ছুড়তে লাগল । আল্লাহ’র অশেষ রহমতে গাড়িসহ আমরা মেঘালয় রাজ্যের চিচিং পাড়া ক্যাম্পে পৌছলাম । পরদিন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ‘স্বাধিন বাংলা বেতার কেন্দ্র’’ থেকে এই বীরোত্বপুর্ন ঘটনা প্রচার করা হয়।
দুই) মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার নেতৃত্বে কিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট এলাকায়অপারেশনে আসিলাম। কিন্তু নিদৃষ্ট সময়ে নিজেদের ক্যাম্পে ফেরত যাইতে পারিলাম না। সকাল হইয়া গেল। সারারাত ছিলাম জঙ্গলে, কাদাযুক্ত ধানক্ষেতে এবং কচুক্ষেতে পাক হানাদার বাহিনীর আনাগোনার চাইতেও দুর্ধষ্য আলবদর বাহিনীর ভয়ে সারা রাত মৃত মানুষের মত প্রচন্ড ঠান্ডা পানিতে কচুরী পানা মাথায় দিয়া পঁচা ডুবায় অবস্থান করিয়াছি। খাওয়ার কোন ব্যবস্থা ছিলনা বলিয়া সারারাত কিছুই খাওয়া হয় নাই। তবে জীবনের ভয়ে এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের সৈনিক হিসাবে ুধা ছিল না। এইভাবে রাত শেষ হইল। দিনেতো যাওয়া সম্ভব নয়। সেই অবস্থায় আবার সারাদিন কাটিল শুধু কুচুরী পানার পঁচা পানি পান করিয়া। ইহাতে আমার কোন দুঃখ নাই। দুঃখ হয় তখন, যখন দেখি বা শুনি আলবদর বাহিনী নেতা নিজামী বা মোজাহেদীর হাত দিয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা গ্রহণ করিতে হয়েছিল গত সরকারের আমলে।
নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)
অনেক ধন্যবাদ, মানিক ভাই।
মূল পোস্টে যোগ করে দিলাম।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
আরে! আপনার এই উদ্যোগটা তো দারুন! ১৯৭১ এর টুকরো ঘটনা একেবারে সিনেমা স্লাইডের মতো একে একে চোখের সামনে ভাসছে।...
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। ধারাবাহিকটি চলুক।।
---
আমিও আমার মা'র কাছে শোনা নানু বাড়ির একটি সত্যি ঘটনার কথা আপনাকে মেসেজ দিয়ে জানিয়েছি। দেখুন তো এটি আপনার কোনো কাজে লাগে কী না।
আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
গ্রেট জব!!
যোগ করে দিলাম।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
মোঃ রহমতুল্লাহ
কোম্পানী কমান্ডার, ১১ নং সেক্টর ,১৯৭১।
অপারেশন পানিহাতা টু জামালপুর ঃ
৫ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সকাল ৯ টায় মিত্রবাহিনীর অধিনায়ক কর্নেল রাও আমাদের ক্যম্পে এসে নির্দেশ দিলেন সন্ধা ৭টায় পাক বাহিনীর শক্তিশালী ঘাটি পানিহাতা আক্রমন করতে হবে। তার নির্দেশ শুনে আমার কোম্পানির যুদ্ধারা কিছুটা ভড়ঁকে গেল । কারণ, কিছুদিন আগে উক্ত ঘাটি আক্রমন করতে গিয়ে মুক্তিবাহিনীর একজন কোম্পানি কমান্ডার সহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছে । যা হোক, দেশ স্বাধিন করতেই হবে যে কোন মুল্যে, পিছঁপা হলে চলবে না । আমি সকলকে একত্র হতে আদেশ দিয়ে ব্রিফিং দিলাম । সবাই "জয় বাংলা " বলে অপারেশনে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করল ।সন্ধায় কর্নেল রাও এসে আমাদের প্রস্তত দেখে খুশি হলেন ।
শুরু হল আমাদের যাত্রা । ঘুটঘুটে অন্ধকার ,সামনে ছোট নদী পার হয়ে পানিহাতার দিকে নিরবে চললাম । আনুমানিক রাত ১১টায় পাকবাহিনীর ক্যম্পের অতি নিকটে পৌছলাম । আন্ধাররাতে কিছুই দেখা যাচিছল না । কিন্তু ক্যাম্পটি দেখা যাচেছ হারিকেন এর প্রজ্জ্বলিত আলোয় ।বেশ কিছুক্ষন কাদাযুক্ত ধানক্ষেতে চুপটি মেরে থাকার পর আদেশ দিলাম ফায়ারিং এর । মিত্রবাহিনী সেল মারা শুরু করল । আর আমরা এল এম জি, এস এল আর ও রাইফেল দিয়ে গুলি ছুড়তে থাকলাম । প্রায় ৩ ঘন্টা ধরে যুদ্ধ চলল । পাকবাহিনী ক্যাম্প ছেড়ে সাজোঁয়া গাড়ি করে পালিয়ে গেল । ভোর ৪টায় পানিহাতা ক্যাম্পে রেড করলাম। বিজয় নিশান উড়ানো হল ময়মনশিংহ জেলার সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাটি পানিহাতায়। শত্রুমুক্ত ঘাটিতে শুরু হল আনন্দ উল্লাশ।
সকালে বাংকারের ভিতরে দেখলাম সম্পুর্ন নগ্ন মা -বোনাদের । তাদের দেহে শক্তিবল কিছুই নেই , রক্তশুন্য ফ্যাকাঁসে ,একেকজন যেন জিন্দা লাশ । প্রশ্ন জাগে মনে "পাকিস্তানি সেনারা কি মুসলমান ", "তারা কি মানুষ নাকি নরপশু ", "তাদেরকে কুকুর এর চেয়ে নিকৃষ্ট জীব " । ১৭/১৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করলাম । আমাদের সাথে যে গামছা ছিল তা' দিয়ে তাদের লজ্জাঁ ঢাকার ব্যবস্থা হল । আশপাশের লোকজন এলে বীরঙ্গনাদের নিজ নিজ বাড়িতে পৌছানোর জন্য তাদের হেফাজতে দিয়ে ক্যাম্পে চলে এলাম । সঙ্গে ছিল দুই সহযোদ্ধার লাশ ।
সারারাত ঘুম জাগা তাই দুপুরের খানা খেয়ে সকলকেই বিশ্রাম করতে আদেশ দিয়েছি। যারা রান্নার কাজে দায়িত্বে আছে তারা রান্না করছে। হঠাত্ বাঁশীর হুইসেলে ,সকলেই হতবাক। অফিসার জানাল ,সমস্ত মুক্তিযোদ্ধাকে প্রস্তুত করতে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সকলেই সসস্ত্র প্রস্তুত হলাম। তিনি আমাদেরকে ডালো বারাঙ্গা পাড়া মিত্র বাহিনীর ঘাটিতে যেতে বললেন। রাতের জন্য রান্না বান্না প্রায় শেষ। অনেকে খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু সবকিছু ফেলে সকল মুক্তিযোদ্ধা রওয়ানা হলাম। মনে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া নেই; পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা , তবুও আনন্দ, সম্মূখযুদ্ধে যাচ্ছি। দেশ স্বাধীন হবে। সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালী মুক্ত দেশে শান্তিতে থাকবে। এই বুক ভরা আশা নিয়ে স্বদেশের মাটির দিকে দ্রুত যেতে থাকলাম। ডালো বারাঙ্গা পাড়ায় কিছু আনুষ্ঠানিকতার পর বাউরামারী হয়ে নন্নী পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যা। আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বাউরামারী নন্নী হয়ে প্রথমে ঝিনাইগাতীর আহম্মদ নগর পাক বাহিনীর ঘাটি আক্রমন করার ।শেরপুরের পথে নন্নীতে আমার ছোট বোন রৌশন আরার বাড়ী। বোনসহ এলাকার মুক্তিপাগল মানুষের কি আনন্দ-মুক্তিবাহিনী এসেছে। রৌশন আরা আমাকে সমস্ত যোদ্ধার সামনে দেখে চিনে ফেললো, অশ্র“ সজল নয়নে শুধু বল্লো-সকলেই একটু দাঁড়াও। ২/৩ মিনিটের মধ্যেই বস্তায় বস্তায় চিড়ামুড়ি-গুর নিয়ে আমাদের কে বিতরণ করলো। খাবার এর পর আবার চলতে শুরু করলাম। আমাদের যেতে হবে ঝিনাইগাতী হয়ে শেরপুর। রাত ৮ ঘটিকায় ঝিনাইগাতী পৌছলাম। হঠাত্ মোবারক ও প্লাটুন কমান্ডার বকর নামে দু'জন সহযোদ্ধা আমাকে অনুরোধ করে বলল-স্যার এখান থেকে অতি নিকটে আমাদের বাড়ী। আপনার নিকট অনুরোধ, মাত্র ১০ মিনিটের জন্য সকলকেই নিয়ে আমাদের বাড়ীতে চলুন ,সময়মত শেরপুর পৌছতে কোন অসুবিধে হবে না। আমরা মোবারকের বাড়ী কালিনগর গেলাম। মোবারকের পিতামাতা আত্মীয় স্বজনসহ গ্রামের লোকদের কি আনন্দ। আমাকে না জানিয়ে না বুঝতে দিয়ে বিরাট বড় একটা ষাড় গরু জবাই করে ফেললো। চারিদিকে রান্না শুরু হলো। রাত ২ টার মধ্যেই খানা-পিনা শেষ করে আবার রওয়ানা হলাম শেরপুর সদরের দিকে। পথে আহাম্মদ নগর পাক বাহিনীর শক্ত ঘাটি। আমরা পৌঁছার আগেই হানাদার পাক বাহিনী ঘাটি ছেড়ে চলে গেছে। এই ঘাটিতেই শত শত স্বাধীনতাকামী লোকদেরকে এনে ক্রস ফায়ারে হত্যা করেছে।ভোর বেলায় আহম্মদনগর ক্যাম্প রেড করে শেরপুর সদরে আসার পথে আল বদর কমান্ডার কামরুজ্জামান (ভারতে থাকতেই শুনেছি , জামাতে ইসলামীর শেরপুরের নায়েবে আমির ফজলুর রহমান কামরুজামানকে দিয়ে অসংখ্য মানুষ হত্যা করেছেন এবং শেরপুর পাক হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে আওয়ামী লীগের নেতা সমর্থকদের হত্যার পরামর্শ দিয়ে লিখিত তালিকা পেশ করেছিলেন ) এর বাড়ী ঘেরাও করলাম কিন্তু তাকে পেলাম না। জানতে পারলাম আগের রাতে আহম্মদনগর ক্যাম্পের পাক বাহিনীদের সাথে জামালপুরে চলে গেছে । সকাল ৭ঘটিকায় শেরপুর শহরে পৌঁছালাম। শেরপুর শহরেই আমাদের বাড়ী। খবর পেয়ে শ্রদ্ধেয় বাবাজান দারগ আলী পার্কে আসলেন। একে একে সকলের সাথে দেখা হলো। মা আমাকে দেখে আবেগে বিহব্বল হয়ে প্রায় বাকশূন্য হলেন। শুধু দেখা হলো না স্ত্রী নূরজাহানের সাথে। সে তখন তাদের গ্রামের বাড়ীতে ছিল।হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষের আনন্দ দেখে আমি আবেগের কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। কিছুণের মধ্যেই হেলিকপ্টার আসলো। পদার্পণ করলেন মিত্র বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেঃ জেঃ আরোরা। আমার বাহিনীসহ হাজার হাজার মুক্তি বাহিনী ও মুক্তি পাগল মানুষ তাকে অভ্যর্থনা জানালাম। মুহুর্তেই আদেশ হলো আজ বিকাল ৫ ঘটিকায় জামালপুর আক্রমণ করতে হবে। জামালপুর এম্বোসের জন্য আমার বাহিনীকে নান্দিনায় ডিফেন্স দেওয়া হলো-যাতে হানাদার বাহিনী রেলওয়ে যুগে পালাতে না পারে।
জামালপুর মুক্ত করে কামাল খান মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা আলবদর বাহিনীর প্রধান বহু মানুষ হত্যাকারী, ধনসম্পদ লুটকারী আব্দুল্লাহ ইবনে ফজলের (ফজল মুন্সী ,বর্তমানে বোমাবাজ কথিত শায়খ আবদুর রহমানের পিতা) বাড়ী ও মাদ্রাসা ঘেরাও করলাম। তিনি পলাতক। লুটের মাল উদ্ধার করে জামালপুরের এস ডি ও এর হেফাজতে দিলাম। আমাকে এস ডি ও সাহেব প্রশংসা করলেন এবং মাল্য দান করলেন।
এভাবে ৪ঠা ডিসেম্বর পানিহাতা, নালিতাবাড়ী, ৫ই ডিসেম্বর বাওরামারী, ঝিনাইগাতী, ৬ই ডিসেম্বর শেরপুর, ৭ই ডিসেম্বর জামালপুর, ময়মনসিংহ, মধুপুর শত্র“ মুক্ত হলো। ইতিপূর্বেই কাদের সিদ্দিকি টাঙ্গাইল মুক্ত করেছে। ১৬ই ডিসেম্বর ৯০,০০০ হাজার হানাদার বাহিনীর আত্মসর্মনের মধ্য দিয়ে বাংলার মাটিতে উড়ল বিজিয়ের নিশান ।জয় বাংলা ।
নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)
অসংখ্য ধন্যবাদ।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
নতুন মন্তব্য করুন