সুজিত আমার বন্ধু। আঁকার হাত দুর্দান্ত, গানের গলা ভালো না, তবে তবলায় ওস্তাদ। ঝাঁকড়া চুল। সিগারেট খায়। আবার পড়াশুনায়ও রেগুলার। কলেজে ঢুকেই প্রথম দর্শনে ফালতু পোলাপান মনে হওয়া লিস্টে এক নাম্বারে থাকা ছেলেটা কিছুদিনের মধ্যেই বেস্ট ফ্রেন্ডে পরিণত হলো।
আমি তখন সদ্য একপক্ষীয় প্রেমে পড়েছি। রাত জাগি। কবিতা লিখি। গ্রহ-নক্ষত্রের সাথে কথা বলি। গ্যালিলিওর সুনামে ভাগ বসাতে আর বেশি দেরি নাই। ঘুমের ওষুধ খাই। পড়াশুনা গোল্লায় যায়। সিগারেট ধরতে চাই। সুজিত কড়া করে ধমক লাগায়। আমার মত এরকম মাগা (= মাইয়া মানুষের স্বভাবী) প্রেমিক সে ইহজনমে দ্বিতীয়টা দেখে নাই। তাকে সেই মুহূর্তে খুব পাষাণটাইপ মনে হয়। আবেগের বালাই নেই। ১৭ বছর বয়সেই ধীরস্থির একটা পরিপূর্ণ মানুষ।
দিন কেটে যায়। সেকেন্ড ইয়ার। তখন মোবাইল ফোন ছিলো না, ইমেইলের কারবার নাই। প্রেমপত্রের বাজার রমরমা, যদিও অনিশ্চিত ভবিষ্যতে কাকে রেখে কাকে ধরতে হয় চিন্তায় মস্তিষ্কের নিউরণগুলো ব্যস্ত হওয়ার যুগ তখন পুরোদমে। একদিন আমার হোস্টেলের ঠিকানায় একটা চিঠি আসে। মেয়েদের মত যত্ন করে ঠিকানা লেখা। প্রেরক - শাহীনুর রহমান। চিনতে পারি না।
চিঠি খুলে অবাক হই। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা -
"ভাইয়া,
আপনাকে আমি আপন ভাই জ্ঞান করে লিখছি। সুজিতের কাছে আপনার কথা অনেক শুনেছি। আপনার ঠিকানায় ওকে চিঠি লিখলে বিরক্ত হবেন না, বোন হিসেবে এ আমার দাবী।
ইতি -
আপনার ছোটবোন পলি"
"ঘটনা কি?" সুজিতকে চেপে ধরি।
পলি তার প্রেমে পাগোল। একই এলাকার একটা হিন্দু ছেলের পক্ষে একটা মুসলমান মেয়ের প্রেম সম্ভব না, কথাটা অনেকবার বুঝিয়েও সে পলিকে নিরস্ত করতে পারে নি। পলির বাবা পোস্টাফিসে বলে রেখেছেন। সুজিতের নাম দেখলেই চিঠি বাজেয়াপ্ত হবে। পলির ঠিকানায় যাওয়া চিঠিও তার হাতে পড়বে। সুতরাং মাধ্যম হিসেবে এইদিকে আমি, ওইদিকে পলির আরেক দোস্ত শাহিন।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি। শালার নিজের প্রেম নিয়াই চালেডালে খিঁচুড়ী অবস্থায় আছি, তারপরে এই মিডিয়াগিরি!
মিডিয়াগিরি তারপরও চালিয়ে যাই। মন্দ লাগে না, রহস্যোপন্যাসের মত। কখনোই দুই নাম্বারি করি না। তবে সবসময়ই ২টা চিঠি থাকে পলির - একটা সুজিতের, একটা আমার। সে ছবিও পাঠায়। নাহ, মেয়েটাকে বোন হিসেবে ভাবতে খারাপ লাগে না।
সেবার এক রচনা প্রতিযোগিতায় চাপাবাজি মেরে কয়েকটা বই পুরস্কার পাই। এর একটা লা নুই বেঙ্গলী। ২ সপ্তাহ পরেই ডাকে একটা প্যাকেট আসে। পলি পাঠিয়েছে। ন হণ্যতে। বই দুইটা একসাথে না পড়লে নাকি মজা নেই।
কলেজ শেষ হয়। ভর্তি পরীক্ষার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ি। প্রেমট্রেম গাছে তুলে কুত্তাফাইট দেই। বন্ধুবান্ধবের সাথে যোগাযোগ কমে যায়। সবাই বিজি। ইচ্ছে ইঞ্জিনিয়ার হবো। বুয়েটে চান্স পাই না। খুলনা বিআইটিতে টিকে যাই। সুজিত ঢাকা ইউনিভার্সিটি। যোগাযোগ থাকে না, যোগাযোগ রাখা যায় না, নতুন সময়কে আঁকড়ে ধরি, নতুন সময়ে ঘর বাঁধি, নতুন স্বপ্নের রেশ কাটতে না কাটতেই আরো নতুন স্বপ্ন আসে, পুরোনোতে ফিরে যাওয়া হয় না আর, যাওয়া যায় নাও হয়তো।
ঢাকায় একটা পূনর্মিলনী হয়। কলেজের পোলাপানের। আমিও যাই। অনেকদিন পরে সুজিতের সাথে দেখা। একটু শুকনা। তবে আগের মতোই হাসে, কথা কয়। এক ফাঁকে পলির কথা জিজ্ঞেস করি। সে উত্তর দেয় না, ফ্যাল ফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। অন্য কথায় চলে যাই।
কলেজ জীবনে ডায়েরী লিখতাম। রেগুলার। ডায়েরীগুলো সযত্নে রেখে দিয়েছি। সাথে বন্ধুদের দেয়া উপহারগুলো। তবে সেই পুরোনো সময়ের ঘ্রাণ নেয়া আর হয়ে ওঠে না। জিনিসগুলো যেন যক্ষের ধন, অমূল্য; কিন্তু কখনোই ভোগ করা যায় না।
ক্যারিয়ার, চাকুরী, পদোন্নতি, সময়কে পিছে ফেলার সংগ্রামটা ভালোই করেছি। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে হয়ে গেছি এক দলছুট রেসের ঘোড়া। যতোক্ষণ সংগ্রাম চলে দলছুট হতে ভয় নেই, কোন এক আজব স্বার্থপরতায় অভিযোজিত হয়ে গেছি। তবে সময়ও মাঝে মাঝে প্রতিশোধ নেয়। আমাকে একা ছেড়ে দিয়ে সে খিল খিল করে হাসে। হাসিতে বিদ্রুপ থাকে। প্রতিযোগিতাহীন হয়ে আমার বাঁচার কষ্টটা কিভাবে যে সে বুঝে গেছে!
গতকাল বিকেলে এমন একা। ২০ বছর আগের ডায়েরীগুলো নেড়েচেড়ে দেখি। তার ফাঁকে চোখে পড়ে ন হণ্যতে। মলাট উলটাই। তেমন কিছুই লেখা নেই, শুধু -
"প্রিয় ভাইয়াকে..."
মন্তব্য
- হ, বিষণ্ণতায় ধর্ছে আপনেরেও!
তবে, অনন্যসাধারণ।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
বিষণ্ণতা হইতে পারে। গতকাল দেখি অনেকক্ষণ কোনো পোস্ট আসছে না। ভাবলাম একটু গোপাল টাইপের পোস্ট দেই। এই ব্যাপারে রঙিলা সিরিজটা চলে। পরে লেখা শেষ করে দেখি একটু দুঃখ দুঃখ হয়ে গেছে। অতীত নিয়ে লিখতে গেলে প্রত্যেকেরই হয়তো একটু বাড়তি মমতা এসে যায়।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
কৈশোর কালের প্রেম পীরিতির কথা তো শুনতে ভালোই লাগে। চালায়া যান। পড়ার অপেক্ষায় থাকলাম।
অলমিতি বিস্তারেণ
অলমিতি বিস্তারেণ
প্রেমের বিবেচনাহীন সময়ই তো কৈশোর। এরপরে পুরাটাই দেহ অথবা বয়স আরেকটু বাড়লে একাকীত্বের সঙ্গী। তবে ব্যতিক্রম অবশ্যই থাকে, ফ্রয়েড কখন কার ওপর ভর করে কে জানে!
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
ভাবছিলাম বন্ধুর প্রেমিকা ছিনতাই টাইপ ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে।
আহ ডায়রী...আমি নিজেও এক কালে লিখতাম। কলেজ থেকে আসার আগে দুই টা ডাইরী আগুন দিয়ে জ্বালাই দিসি...সেই কাহিনী পরে বলা যাবে...
লেখাটা ভাল্লাগছে খুবই।
---------------------------------
জানিনা জানবোনা... কোন স্কেলে গাইছে কোকিল
গুনিনা আমি গুনিনা...কার গালে কটা আছে তিল
হে হে, বন্ধুর প্রেমিকা ছিনতাইয়ের কাহিনীও কালেকশনে আছে। দেখি পরে একসময় ছাড়বো।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
যতদূর মনে পড়ে, অন্য "রঙিলা" গুলোতে, তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে বলা গল্পগুলোয় গল্প বলিয়ের অনুভূতি প্রকাশের সুযোগ ছিল না।
এইটা আলাদা। গল্পকথকের বিষন্নতামাখানো কথন পাঠককে নাড়া দিয়ে যায়।
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
- বিশ বছর আগের কলেজে পড়ুয়া টার্মটা খিয়াল কইরা জনাব। আর যা-ই হোক বলাই ভাই নিশ্চই বিশ বছর আগে কলেজে আছিলো না!
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
গল্পের প্রয়োজনে মানুষ কতো কী করে!
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
ঠিক। চাপা মারা যেহেতু চলিবে .....
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
অতীত নিয়ে লিখতে গেলে একটু বিষণ্ণতা মাখানো মায়া কেন জানি এমনিতেই চলে আসে।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
আপনার লেখা পড়তে খুব "বালা পাই"। সত্যি!
কিন্তুক অ্যাতো কম লেখেন কেন?
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
মৌমাছির জীবন কি মধুর?
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
সন্ন্যাসীদা, পেটের ধান্দায় চিঁড়েচ্যাপটা অবস্থায় আছি। রুটিরুজির বন্দোবস্ত আরেকটু স্থির অবস্থায় আসলে কীবোর্ড আরেকটু বেশি খটখটানির ইচ্ছা আছে।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
বেশ ভালো লাগছে!
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
ধন্যবাদ, মামু।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
বলাই কাকুর গদ্য নেশা ধরিয়ে দেয়। রঙিলায় রঙিন জীবন আরও চলুক..
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
অনেক ধন্যবাদ কাকু। আপনার জায়গীরনামা সিরিজটা পড়ছি আগ্রহের সাথে। সবগুলায় মন্তব্য করি নাই। সিরিজটা শেষ হলে তার ওপরে একটু বড় করে লেখার ইচ্ছে আছে।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
মুগ্ধ হয়ে গেলাম। বলাই ভাই চালিয়ে যান।
---------------------------
সচল আছি, থাকবো সচল!!
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
কীর্তিদাদা, থ্যাংকু।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
দারুণ ভালো লাগলো !
রঙিলা আরো একটু ঘন ঘন ছাড়লে হয় না?
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
ধুর খালি বন্ধুগো কথা কইয়া আমাগো ধোঁকা দ্যান। নিজের কথা ছাড়েন। আর স্মৃতি বড়ো খারাপ জিনিস। খালি মন খারাপ কইরা দ্যায়।
যে রাতে গুঁজেছো চুলে বেগুনি রিবন বাঁধা ভাট,
সে রাতে নরকও ছিলো প্রেমের তল্লাট।
. . . . . . . . . . . . . . . . . . (আবু হাসান শাহরিয়ার)
বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।
নতুন মন্তব্য করুন