আমার মানুষের নুন আনতে পান্তা ফুরায়, আমার মানুষ ২০ টাকার জন্য চুলোচুলি করে, শ’টাকার জন্য খুনোখুনি করে, আমার মানুষের অক্ষরজ্ঞান নেই, আমার মানুষ চোর, আমার মানুষ পরশ্রীকাতর, আমার মানুষ অলস, আমার মানুষ উন্নয়ন বুঝে না, সূক্ষ্ণ বিশ্লেষণ বুঝে না, আমার মানুষ চুন থেকে পান খসলে শব্দের অভিধান অপবিত্র করে গালি দেয়, আমার মানুষ সুশীলতা বুঝে না। আমরা গরীব থেকে আরো গরীব হই, শোষিত থেকে নিষ্পেষিত হই, মুদ্রাস্ফীতি বাড়ে, বাড়ে দুর্যোগ; ঘুর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের পাশাপাশি বাড়ে সন্দেহ আর অবিশ্বাস। আর্মির ডান্ডাকেই যখন আমার মানুষকে ঠান্ডা করার একমাত্র উপায় ভাবেন সুশীল সমাজ, তখনও আমি প্রচন্ড বিশ্বাসে এই মানুষগুলোর ওপর আস্থা রাখি, এই মানুষগুলোর অস্বপ্নাভ্যস্ত অনিশ্চিত চোখে আমি মুক্তির বিশ্বাস খুঁজি, আমি সর্বান্তকরণে এই মানুষগুলোর ওপরে ছেড়ে দেই তাদের ভাগ্যের রশি।
কারণ, কারো সুন্দর ভাগ্য অন্য কেউ গড়ে দিয়ে যাবে, এ ফতোয়ার বাস্তবতা আমার কাছে শূন্য মনে হয়। অপরপক্ষে এই অলস মানুষগুলো ব্যক্তিগত স্বার্থপরতার উর্ধে উঠে কী চমক দিতে পারে, সেই ইতিহাস বারবার জ্বলজ্বল করে। এই মানুষগুলো হয়তো ব্যথায় কাতর হয়, হতাশার অন্ধকারে তলিয়ে যেতে চায়, তবে তলিয়ে যেতে যেতে এরাই আবার গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। তখন আর তারা ব্যক্তি থাকে না, একটা সমগ্র জাতি তখন এক সূরে মুর্ছনা তোলে। নিথর হতে হতে তখন জীবনে বসন্তের বাতাস ফিরে আসে। ফিরে আসে বারবার।
বিএনপি-রাজাকার জোটের অরাজকতার ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ রেখে অবৈধভাবে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে ফেলে তত্ত্বাবধানের নামে উড়ে এসে জুড়ে বসা সরকার। মাঝে এক প্রস্থ চেষ্টা চলে অর্থনীতির ফর্মূলা লিখে শান্তির জন্য নোবেল বিজয়ী ডঃ ইউনুসকে দেবতার আসনে বসানোর। পাড়ায় মহল্লায় গড়ে ওঠে সুশীল সমাজ, দেশে-বিদেশে ব্যাঙের ছাতার মত গঁজিয়ে ওঠে ডঃ ইউনুস ফ্যানক্লাব। ব্যবসায়ী ইউনুস তার রিস্কটা বুঝতে পারেন, জনগণের ওপর আস্থাহীন ব্যবসায়ীটি তাই পিছন দরজা দিয়ে ভাগেন।
বিএনপি-রাজাকার জোটের শাসনামলে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহ দলীয় সমর্থকদের দ্বারা কুক্ষিগত করার আত্মবিশ্বাসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিরাপদ ছত্রছায়ায় দেশবিরোধী, স্বাধীনতাবিরোধী অশুভ শক্তির ঔদ্ধত্য চরমে পৌঁছে যায়। তারা সদম্ভে ঘোষণা করে দেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই, ভন্ডামির চূড়ান্ত নিদর্শনস্বরূপ তারাই মুক্তিযোদ্ধা পরিষদ গঠন করে, যেখানে টিভি ক্যামেরার সামনেই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা আলী আমানকে লাথি মারা হয়। এর বিরুদ্ধে কিছুই করে নি তত্ত্বাবধায়ক সরকার। বরং কয়েকদিনের ছুটি কাটিয়ে জেল থেকে ফুলের মালা গলায় পরে বেরিয়ে আসে যুদ্ধাপরাধীরা। ফুটপাতের দুটাকার হকারের পেটে লাথি মারা হয়; কিন্তু দুর্ণীতি মামলায় খালাস হয়ে বেরিয়ে আসে অপরাধীরা। স্বাধীনতাবিরোধী সাবেক মন্ত্রীকে রাষ্ট্রীয়কার্যে বিশেষ অবদানের জন্য (আল্লাহই মালুম বিশেষ অবদানটি কি) স্বাধীন বাংলাদেশের একখন্ড জমি লিখে দেয়া হয়।
এইসব অনিয়মের প্রতিবাদ করে নি কোনো দল। না স্বাধীনতার সপক্ষ বলে দাবী করা দলটি, না স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রতিষ্ঠা দেয়া দলটি। জরুরী অবস্থার জলপাই বুট সাধারণ মানুষের মুখের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। তবুও সাধারণ মানুষের ভিতরে জন্ম নেয়া ক্ষোভের প্রশমন হয় নি কিছুতেই। আজ চালের কেজি ১০ টাকা থেকে বেড়ে ৪৫ টাকা হলে একজন রিক্সাচালকের পেটে লাথি পড়ে, আজ রাজাকার মন্ত্রীর গাড়িতে লাল-সবুজ পতাকা উড়লে একজন অবহেলিত মুক্তিযোদ্ধার বুকে শেল হয়ে আঘাত করে। জলপাই বুট দিয়ে মুখ চেপে রাখা যায়; কিন্তু বুকের আগুন যে দাউ দাউ করে জ্বলতেই থাকে।
গতবছর দেশে গিয়ে প্রচন্ড ব্যস্ততার মধ্যেও চেষ্টা করি কিছু মানুষের সাথে কথা বলার। যে মানুষগুলো একাত্তরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। বুঝতে চেষ্টা করি কোন পরিস্থিতিতে একজন মানুষ হাসিমুখে জীবনকে তুচ্ছ করে বুকে মাইন বেঁধে ট্যাঙ্কের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। আমি ভীতু মানুষ, আমি মৃত্যুকে ভয় পাই। এই মানুষগুলোও হয়তো আমার মতোই, অন্তত তাদের অনেকেই আমার মতই ভীতু ছিলেন হয়তো। তারপরেও কোন সে পরিস্থিতি যা তাদেরকে সাহসী করে তোলে! জানার চেষ্টা করি জামাত মুক্তিযোদ্ধা পরিষদ বানালে তাদের কেমন অনুভূতি হয়, দেশে যুদ্ধাপরাধী নেই - এরকম উদ্ধত উক্তি শুনে তাদের মধ্যে এখনও কি আগুন জ্বলে! আগুনটা ঠিকই জ্বলে। সফল রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে নরসুন্দরের কাজ করা মানুষগুলোর চোখে আমি আগুন দেখি। জলপাইয়ের বুটের নিচে চাপা থাকলেও সে আগুন পোঁড়াবেই, পুঁড়িয়ে ছারখার করবেই দেশবিরোধীদের ঔদ্ধত্য, আমি নিশ্চিত জানি। আমার বিশ্বাস আরো বাড়ে সেই অলস, দরিদ্র, ২০ টাকার জন্য চুলোচুলি করা, চুন থেকে পান খসলেই অসুশীল গালি দেয়া মানুষগুলোর প্রতি।
শেষ হলো ২০০৮এর সংসদ নির্বাচন। আশঙ্কা, আতঙ্ক, জরিপ আর যত হিসাব নিকাশ উলটে দিয়ে মহাজোট বিজয়ী। শুধু কি বিজয়ী? ৩০০ আসনের সংসদে ২৫০+ আসনের নিরঙ্কুশ আধিপত্য ৭৩ সালের নির্বাচনের পর আর কখনো কেউ দেখে নি বাংলাদেশে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এখন মহাজোট কনফিডেন্ট হতেই পারে। তবে স্বৈরাচারকে সাথে নিয়ে নির্বাচন করা আত্মবিশ্বাসহীন আওয়ামী লীগও জানে এই বিশাল জয়ে তাদের নিজস্ব অবদান খুবই নগণ্য। ৯৬-০১ টার্মে মানুষের জন্য তারা এমন কিছুই করেন নি, যাতে মানুষ তাদেরকে এভাবে ভোট দিয়ে বিপুল ব্যবধানে জয়ী করবে। সেরকম কাজ করলে ২০০১ এর নির্বাচনে তাদের ভরাডুবি ঘটতো না। একইভাবে বিএনপি-রাজাকারের টার্মেও আওয়ামী লীগ কিছু হরতাল-ধর্মঘট দেয়া ছাড়া মানুষের জন্য এমন কিছুই করে নি, যার জন্য তাদের ভোট বাড়বে। এখানে কারণটি অত্যন্ত সুষ্পষ্ট। বিএনপির রাজনীতির মূলধন মানুষের আওয়ামী বিদ্বেষ, একইভাবে এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় মানুষের রাজাকারবিদ্বেষ এবং তারেক-ফালু-কোকো গংয়ের নজিরবিহীন দুর্ণীতি।
মানুষের বিশ্বাস পোক্ত হওয়ার জন্য যা করেছে, তার চেয়ে বিশ্বাস হালকা হওয়ার পক্ষে অনেক বেশিই করেছে স্বাধীনতার নেতৃত্ব দেয়া দলটি। তারপরেও মানুষ এই দলটিকে বিশ্বাস করতে চায়। স্বৈরাচার ছাড়াও খুব সহজেই জিততে পারতো তারা। তারপরেও আত্মবিশ্বাস তলানীতে থাকা দলটি স্বৈরাচারকে সাথে নিয়ে নির্বাচন করে। এরপরেও মানুষ তাদের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করতে চায়। মানুষ এখনও ভাবে আওয়ামী লীগই তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন ঘটাবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ কি জানে, মানুষ তাদের কাছে কি চায়? যুদ্ধাপরাধীদের মুক্ত বাতাসে চলতে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের নামে অশলীলতা কি এবারও চলবে? বাংলাদেশের জন্মের পরেও বহু বছর তার বিরুদ্ধে ক্যাম্পেন করা গোলাম আযম কি এখনও সবুজ পাসপোর্টটির মালিক থাকবে? স্বাধীন বাংলাদেশের একখন্ড জমির মাটিতে লেগে থাকা শহীদের রক্তের ওপর নিযামী কি এখনও তুলবে সুরম্য প্রাসাদ? এখনও কি ধর্মকে বেঁচে খাওয়া রাজনীতি চলতে থাকবে? ৭২এর সংবিধানকে রেইপ করে যোগ করা ধারাগুলো কি এখনও সিন্দাবাদের ভূতের মত চেপে রবে আমাদের কাঁধে? শেখ হাসিনা কি এবারও বুঝবেন না, বাংলার মানুষ কি চায়? বাংলার মানুষ কেন তাকে এখনও ভোট দেয়?
আমি আশাবাদী, প্রচন্ড আশাবাদী মানুষ। এই আশা নিয়েই উচ্চারণ করি, আপনাকে নির্বাচিত করে জনগণ তাদের দায়িত্বটি পালন করেছেন; এবার আপনার দায়িত্বটি পালন করুন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন