সেইবার নির্মল চন্দ্র রায় মহাশয়ের প্রথমা কন্যা চপলা চম্পা রায় যখন পূর্ব পাড়ার গোলক বিশ্বাসের পাণি জাপটিয়া ধরিয়া নিশীথে মিলাইয়া গেলো, এই গ্রাম ওই গ্রাম ছাড়াইয়া সেই কেলেঙ্কারির খবর পুরা মহকুমার কোথাও আর পৌঁছাইতে বাকি রহিলো না। মাস তিনেক অতিবাহিত করিয়া উহারা যখন আবার গাঁয়ে প্রত্যাবর্তন করিলো, তখন চম্পার কপালে টিপ, সিঁথিতে সিঁদুর আর সে আড়াই মাসের সন্তান-সম্ভবা।
মানসম্মান সব ধুলায় মিশাইয়া যাওয়া নির্মল চন্দ্র রায় মহাশয়ের গলার স্বর রকেট বেগে বাঁজখাই হইতে কুঁই কুঁই-এ বিবর্তিত হইলো। শেষমেশ পুরোহিতের ফতোয়া মোতাবেক গোবর খাওয়াইয়া প্রায়শ্চিত্ত করিয়া নমঃশুদ্র গোলক বিশ্বাস টাইটেল পালটাইয়া ব্রাহ্মণ গোলক চন্দ্র রায়ে রূপান্তরিত হইলেন। নির্মল চন্দ্র রায় মহাশয় জনসমক্ষে হাফ ছাড়িয়া মুচকি হাসি হাসিলেও তাহার হৃদয়ের কোনো গোপন কুঠুরিতে গোপন কষ্টের বীণা সুযোগ পাইলেই অদ্যাবধি টুং টাং করিয়া থাকে।
গোলক চন্দ্র রায় ও তাহার সহধর্মিনী মায় সহবর্ণিনী চম্পা রায় যথাসময়ে এক কন্যাসন্তানপ্রাপ্ত হইলেন। উহারা আদর করিয়া সদ্যপ্রসূতা স্বপ্নের ন্যায় সৌন্দর্যধারিণী কন্যার নাম রাখিলেন স্বপ্না। পদ্মামেঘনাযমুনার স্রোতের বেগ কমিয়া গেলেও দ্রব্যমূল্য আর মুদ্রাস্ফীতির সম-সুতীব্রবেগে স্বপ্না দিনকে দিন গায়েগতরে বাড়িয়া উঠিতে লাগিলো। গোলক চন্দ্র ধীমান ছিলেন। শ্বশুরের সম্পত্তি এবং প্রভাব প্রতিপত্তি নিজ ধীশক্তির গুণে বহুগুণে শক্তিশালী করিয়াছেন। মহকুমা ভাঙিয়া জেলা হইয়াছে এবং জেলার সুশীল হইতে চামার কামার সকলের নিকটেই গোলক চন্দ্র রায় অতি পরিচিত কুলীন এবং ভদ্রলোক।
দুর্ভাগ্যক্রমে রূপবতী স্বপ্না রায় দিনেদুপুরেই এক উড়নচন্ডী মুসলিম যুবার ছলনায় ভুলিয়া তাহার হস্ত ধরিয়া মাতৃ আদর্শ বুকে ধারণ করিয়া অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাইলো। অবাক হইলেও ইহা নিশ্চিত করিয়া বলা যায়, গোলক চন্দ্র রায় মহাশয় উক্ত সংবাদে মোটেই বিচলিত হইলেন না। তিনি বরঞ্চ তাহার ল্যাপটপ অন করিয়া এমএসএন-এ লগ-ইন করিলেন। লগইন করিয়াই গ্রামের আইটি সেন্টারের হেড জোতিশ ছোকড়াটাকে আনব্লক করিলেন। ছোকড়াকে ব্লক করিয়াছিলেন একবার ঘন্টাখানেক বিরক্তিকর চ্যাটের পর। ছোকড়াটা অতিদ্রুত টাইপ করিতে পারে এবং তাহাকে অনেক বেফাঁস প্রশ্ন করিয়া ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিয়াছিলো।
তবে অদ্য তিনি উহার সমস্ত অপরাধ মার্জনা করিয়া দিলেন। তাহাকে মেসেজ দিয়া কহিলেন, একটা সার্চ মারিয়া দেখো তো বাপু, আমার স্বপ্না স্কুল হইতে ফিরিবার পথে নিশানা ভুল করিয়া অন্য কোথাও ধাবিত হইতেছে। উহাকে লোকেট করিয়া পর্যাপ্ত তথ্যাদি 'আসাপ' আমাকে ইমেইল করিয়া দাও। জোতিশ ছোকড়া কথা বেশি কহিলেও করিৎকর্মা আছে। আর শত হইলেও স্বপ্নার কেস। দ্বিগুণ উৎসাহে সার্চ মারিয়া সে স্বপ্নার কারেন্ট লোকেশনের অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশসহ সমস্ত তথ্য গোলক চন্দ্র রায় মহাশয়কে ইমেইল করিয়া দিলো। বলিতে ভুলিয়া গিয়াছি, গুগল ম্যাপ এখন আর ৩ বছরের অ্যান্টিক স্ট্যাটিক পিকচার ব্যবহার করে না, তাহাদের সমস্ত কম্যুনিকেশন হয় রিয়েলটাইমে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে। ইউজার এন্ডে আউটপুট হিসেবে এখন আর সেই পিকাচারের দিন নাই, এখন সবকিছুই লাইভ ভিডিও।
যাহা হউক, রায় মহাশয় অতিস্বত্তর লোক পাঠাইয়া কপোত-কপোতীকে পাকড়াও করিলেন। উহারা তখনো পালাইতেই ব্যতিব্যস্ত ছিলো; ভাব-ভালোবাসা বলিতে দুয়েকবার ঠোঁট চোষাচুষি করিয়াছে এবং তাহা ঠিক উত্তেজনাকে বর্ধিত করিতে সক্ষম হয় নাই। ধরা পড়িলেই মরিবে, এহেন শর্ত পিছন হইতে ধাওয়া করিয়া ফিরিলে তাহা সম্ভবও নহে। পরিণামে দশমাস পরের একটি আসন্ন সঙ্কট হইতে রায় পরিবার রক্ষা পাইলেন। গোলক চন্দ্র রায় মহাশয় জীবনে প্রথমবারের ন্যায় ঈশ্বরবিসৃত হইয়া গুগল ম্যাপের প্রতি সমস্ত কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করিলেন।
লোকের মুখে মুখে এই ঘটনা চাউর হইতেই দিকে দিকে ইন্টারনেট ও গুগল ম্যাপের জয় জয়কার পড়িয়া গেলো। মানীজ্ঞানী লোকের দৃষ্টান্ত অনুকরণই ঈশ্বরের পথ অনুসরণ - এই আপ্তবাক্যে বিশ্বাসী দরিদ্র গ্রামবাসীগণ এতদিনে কলাটা মুলাটা নারিকেল সুপারিটা বিক্রিবাট্টা করিয়া যাহা জমাইয়াছিলেন, উহা খরচ করিয়া ইন্টারনেট কানেকশন নিতে লাগিলেন। অবশ্য কোন কর্মে যে উহা ব্যবহৃত হইবে, তাহা উহাদের নিকট ঝাপসাই রহিয়া গেলো। শেষমেশ উহারা ভাবিলো, ইহা নিশ্চয়ই কোনো স্ট্যাটাসের ব্যাপার হইবে; ইন্টারনেট না থাকিলে সমাজে মুখ দেখানোর মত বুকের পাটাওয়ালা কাহাকেও খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই। যাহাদের ঘরপালানোযোগ্যা কন্যাসন্তান নাই, তাহারাও স্ট্যাটাস রক্ষা করিতে হাসিমুখে ঝাঁকের কই হইতে তেমন দ্বিধা করিলেন না।
গোলক চন্দ্র রায় মহাশয় সেবার 'মোস্ট ভ্যালুয়েবল বেঙ্গালী'পদক প্রাপ্ত হইলেন। উক্ত অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথী 'পাই-টু-পাই' কম্যুনিকেশন কোম্পানির সম্মানিত এমডি চিরঞ্জীব মেহতা (ভারতীয়) তাহাকে পুরস্কারের সাথে তাঁহার কোম্পানীর তরফ হইতে একটি বিশেষ ক্রেস্ট তুলিয়া দিয়া সম্মানিত করিলেন। তুমুল হাততালির নড়াচড়া ভাঙ্গিয়া পিছনের সারিতে কতিপয় গামছা কাঁধে লোকের চকচকে চক্ষুও দৃষ্টিগোচর হইলো।
মন্তব্য
সেরম হইসে।
হাসতে হাসতে পেট ব্যথা করতেছে।
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
কৃতজ্ঞতা।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
কিন্তু জ্যোতিষীর ভালে কী ঘটিলো?
হাঁটুপানির জলদস্যু
সে আরেক কাহিনী।
তবে স্বপ্না এখনও কুমারী। জোতিশ (জ্যোতিষের বলাইয়ীয় ভার্সন আশায় বুক বাঁধতেই পারে।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
বুক বাঁধবে?
.......................................
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ
অজ্ঞাতবাস
এই বুক বুক নয়, আরো বুক আছে।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
৫ এ ৫।
-----------------------------------
কিস্তিমাতের যুদ্ধ শেষে,সাদাকালো ঘুটিগুলো এক বাক্সেই ফেরত যাবে...
মজা পাইলাম ।
একটু হাড্ডি দেই।
১. গোবর খেয়ে শুদ্র ব্রাহ্মণ হইতে পারে?
২. যেই সময়ের কথা বললেন আশা করি ততদিনে কাফের ব্রাহ্মণ এদেশে একটাও থাকবে না। সব খেদান শেষ। আর থাকলেও স্বপ্লাকে মোচলমান ছেলের কাছ থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসার মত হ্যাডম কোন কাফেরের থাকবে না।
-------------------------------------------------
আমি ভালবাসি বিজ্ঞান
আমি ঘৃণা করি জামাত॥
হুম মজা হইছে। তবে আমার জানামতে, বঙ্গদেশীয় বিশ্বাস পদবীধারীরা নম:শুদ্র নয়, তারা কায়স্থ। কোলকাতাতে আবার প্রচুর জেলে আছে যারা বিশ্বাস পদবীধারী।
রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।
বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।
জেবতিক আরিফ ভাই, কৃতজ্ঞতা।
অচেনা ভাই, গল্পে পারে। আসলে মনে হয় পারে না। গোবর খেয়ে প্রায়শ্চিত্ত করে আগের সমাজে ফিরে যাওয়া যায়; কিন্তু শুদ্রের ব্রাহ্মণ হওয়ার কাহিনী এই গল্পেই আমি প্রথম পাইলাম।
সব অধর্মের মূলেই এক।
ঝরু,
আমার এক মুসলমান বন্ধু আছে বিশ্বাস। এটা কি ইউনিভার্সাল পদবী নাকি? তবে কোনো ব্রাহ্মণকে পাই নাই।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”
নতুন মন্তব্য করুন