পড়ার সময় পড়া, খেলার সময় খেলা, পুংটামির সময় পুংটামি - এই নীতি অক্ষরে অক্ষরে পালন করা আমি বিভিন্ন বয়সের কয়েকটি ফ্রেন্ড সার্কেলের রেগুলার মেম্বার ছিলাম। সেকালে বাবামায়েরা সবাই আমার মায়ের মত স্বৈরাচার ছিলেন না, মুখে কথা না ফুটতেই বগলে বই গুঁজে দিতেন না। ফলে আমার ক্লাসমেটদের প্রায় সবার সাথেই আমার বয়সের গ্যাপ এবং সেই সুবাদে আকার-আকৃতিতে বিস্তর ফারাক ছিলো। ফার্স্ট বয় হওয়ার সুবাদে ক্লাসে অন্যরকম মর্যাদা পেলেও ফুটবল টীম সিলেকশনের সময় সেই কেদ্দারি খাটতো না। ক্লাসের অনেকেই ছিলো এলাকার বড়টীমের রেগুলার খেলোয়াড়। প্রাইমারি স্কুলে পড়াকালেই হায়ারে খেলতে যেত তারা। ফলাফল, খেলাধুলা আর পড়াশুনার সার্কেলের মধ্যে কোনো ইন্টারসেক্টিং এলিমেন্ট একেবারেই অনুপস্থিত।
ফুটবল এবং ক্রিকেটে আমি বরাবরই মিডিওকার। কিন্তু হাডুডু ছিলো ব্যতিক্রম। সাহস, রিফ্লেক্স আর ভালো আইসাইট থাকলে ভালো হাডুডু খেলোয়াড় হওয়া আটকায় কে? আমাদের গ্রুপে সবচেয়ে ভালো খেলতো আদর, পান্নু আর লায়েক। আদর মাদ্রাসায় পড়তো, পান্নুর মাথায় কখনো পড়াশুনার বদচিন্তা ঢোকে নি, লায়েক স্কুলে অনেক নিচে পড়লেও মক্তবে ছিলো গ্রুপমেট। প্রচন্ড সুরেলা কণ্ঠ। তিন-চার আলিফ টান দিতে গিয়ে আমার কণ্ঠ যেখানে তিন-চারবার ব্রেক ফেল করতো, সেখানে কত চমৎকার সাবলীলভাবে কেরাত পাঠ করতো সে!
তখন সিক্সে পড়ি। পড়াশুনার চাপ বাড়ছে। কিন্তু চাপের কাছে নতিস্বীকার তখনও শুরু হয় নি। সেদিন বিকেলে ফুটবল খেলি অনেকক্ষণ। যার যার বাড়িতে ফিরি। অনেক রাত্রে খবর পাই, লায়েক বিষ খেয়েছে!
বাড়ি ফেরার পরে খেতে গিয়ে তার বাধে যত বিপত্তি। খাবার পছন্দ হয় না। অভাবের সংসার। ভাত ফেলে দেয় সে। মায়ের ধৈর্যের বাধ ভাঙে। পিটায় তাকে। অভিমান। হাতের কাছে ডাইমেক্রনের বোতল। আগামীকাল মাজরা পোঁকাধরা ধানের জমির পরিবর্তে সেই বিষের ঠাঁই হয় লায়েকের উদরে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বিষক্রিয়া শুরু হয়। অভিমান পরিণত হয় তীব্র আতঙ্কে। ডাক্তার আসে। সাবান গোলা পানি খেয়ে বমি চিকিৎসা ফেল মারে। কিছুতেই কমে না জ্বলুনি। কোরান নিয়ে বসে। আল্লাহ ভালো করে দাও। কান্নাকাটি। তওবা। নির্ঘুম সারাটা গাঁ। সকাল হলেই নিয়ে যাওয়া হবে উপজেলা সদরে বড় ডাক্তারের কাছে।
ভোর রাতের দিকে লায়েক মারা যায়। সকালের সূর্য কখনো কখনো প্রচন্ড উপহাসের!
মন্তব্য
ভাল লাগল।
______ ____________________
suspended animation...
লায়েকের জন্য মনটা কেঁদে উঠলো।
বড় ভালো লিখেছেন।
-----------------------
আমাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে একটা নদী-
সাথে নিয়ে একটা পাহাড় আর একটা নিঃসঙ্গ মেঘ।
সকালের সূর্য কখনো কখনো প্রচন্ড উপহাসের!
...... সত্যিই ।
..হৃদি ভেসে যায় অলকানন্দার জলে...
সময়ভেদে প্রতিটা মূহুর্তই বড় উপহাসের...
লায়েক ছেলেটা এতো বোকা কেন ছিল...ধুর গেল মনডা খারাপ হইয়া।
দৃশা
এই ধরণের ঘটনাগুলি কেন যেন মনের কোণে চাপা দিয়ে রাখি ... কিছুতেই ভাবতে বা লিখতে পারিনা এগুলি নিয়ে ...
লায়েকের ঘটনাটা পড়ে মনে পড়ল আরও কয়েকজনের কথা ... আবার তাদেরকে যথাস্থানে চাপা দিতে হবে ...
খালি মন খারাপ করা লেখা লেখেন। তয় আপনেরে খুইজা পাইছি আবার। আগের মতই বলি, জানিনা, এবারো হয়তো বাস্তবরে ব্লগে তুলে আনছেন, অথবা গল্পরে বাস্তবের মত স্পষ্ট করে আঁকছেন। যেটাই করেন না কেন, হৃদয় স্পর্শ করে গেল লেখাটা।
লায়েক বেচেঁ থাকে হয়তো বন্ধুদের মাঝেই।
মন খারাপ হয়
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
বেশ ভাল লাগল। এই ধরনের ঘটনাগুলো কেন ঘটে? এওয়ারনেসের অভাব, নাকি সোশ্যাল একসেপ্টেন্স না পাওয়া?
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
মানুষ তার পরিবেশ ও পরিস্থিতিদ্বারা সম্ভবত আমরা যা ভাবি, তারচেয়ে অনেক বেশি প্রভাবিত হয়। ১০০ টাকা দেনাপাওনা নিয়ে খুনোখুনির ঘটনা শুনে আমরা ঘটনার বাইরে থেকে ভাবি, কত বোকা লোকগুলো!
উদাহরণটাকে আরেকটু এগিয়ে নিলে দেখা যাবে, দেশের বাইরে থাকা প্রায় প্রত্যেকটা মানুষই ভাববে, কত তুচ্ছ ঘটনার জন্য কত ভাঙচুর চলে দেশে। উচ্চতর পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত মানুষগুলো সামান্য স্বার্থের লোভে বিকিয়ে দেয় দেশের স্বার্থ। খুব অস্বাভাবিক মনে হয়। কিন্তু ওই সময়ে, ওই পরিস্থিতিতে না বাঁচলে ঠিক বোঝা যাবে না,এই বোকা ঘটনাগুলো থেকে চাইলেও বের হওয়া কত শ্রমসাধ্য কাজ।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
কথাটা মানতে পারলাম না। আপনি কখনো বিষ খেয়েছেন? খাননি। তাহলে কেন খাননি? আপনার জীবনে কি দুঃখ, ব্যর্থতা, হতাশা আসেনি? এসেছে। তবু বিষ খাননি। কিন্তু ছেলেটি খেয়েছে। কেন খেয়েছে?
জীবনে কি ছোটখাট বিষয় নিয়ে বড় ঘটনা দানা বাঁধতে দেখেননি? দেখেছেন। তখন আপনার ভুমিকা কি ছিল। কখনো হয়ত সায় দিয়েছেন, কখনো দেননি। যখন দেননি তখন কেন দেননি? কারন আপনার বিবেক আছে। আর যারা সব সময় তুচ্ছ কারনে বড় ঘটনা ঘটায় তারা হয়ত নিজের স্বার্থে বা বোকা বলে ঘটায়।
বোকা ঘটনা থেকে বের হওয়া শ্রমসাধ্য নয়। আপনার ইচ্ছে আর বুদ্ধি তার জন্য যথেষ্ট।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
সুমন, মানুষের জীবন যেকোন ফিকশনের চেয়ে অনেক বেশি বৈচিত্রময় - কথাটা পুরোপুরি বিশ্বাস করি।
আমি বিষ না খেয়ে বেঁচে আছি, ও মরে গেছে - একটা প্রজাপতির পাখা একটু অন্যভাবে ঝাপটালে হয়তো তার উলটোটাও ঘটতে পারতো। মানুষের জীবন এত বেশি ফ্যাক্টর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় যে, হিসেব কষতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলি আমরা - এর নামই হয়তো দেই ভাগ্য। হেমিংওয়ের মত মানুষ কেন আত্মহত্যা করবে?
অন্যদের কথা জানি না; কিন্তু আমি নিজে এত বোকা আচরণ করেছি, এখন ঘটনাগুলো মনে পড়লে অবাক হয়ে ভাবি, এটা অসম্ভব! কিন্তু সেই সময়ে ঘটনাগুলো অসম্ভব ছিলো না কোনভাবেই, অমানানসই তো নয়ই। জীবন বড়ই অদ্ভূত। এজন্যই গোল বাঁধে অন্যকে বিচার করতে গিয়ে। পারফেক্ট স্ট্যান্ডার্ড ঠিক করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
সে ঘটনাগুলো জানার আগ্রহ বোধ করছি। আশা করি আপনার লেখায় উঠে আসবে সেগুলো।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
এখানে একটা বিশাল সীমাবদ্ধতা আছে। নিজেকে পুরোপুরি তুলে আনা কারো পক্ষেই সম্ভবত নয়। প্রধান কারণ হলো, নিজের প্রতি অবচেতনে যে ভালোবাসাটা মানুষের থাকে, সেটা তাকে পুরোপুরি সত্য বলার সদিচ্ছা থেকে আটকে রাখে। আবার পুরোপুরি সত্য বলার ইচ্ছা থাকলেও যেটা বলা হয়, সেটা আসলে একপেশে সত্য। অনুভব-ভাষা-লেখার অক্ষরে প্রকাশ - এই তিন স্তরে ফিলটারড হয়ে তারপর সেটা পাঠকের কাছে পৌঁছায়। বিকৃতি এরপরেও চলতে থাকে। পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারাও লেখকের কথায় রঙরূপ যোগ হয়। প্রকৃত আত্মজীবনী সম্ভবত তাই কারো পক্ষেই লিখা সম্ভব নয়।
আত্মজীবনী নাহলেও ভুলে ভরা আত্মবিশ্লেষণটাইপ লিখা - এটা টেরাই দেওয়া যেতে পারে।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
এই ব্যপারটা আমিও লক্ষ্য করেছি। নিজের ভুলগুলোও ঠিক করে, তার পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে লেখা হয় সব সময়।
তারপরও লিখুন।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
ঠিক । নিরাপদ দুরত্বে থেকে চট করে মুল্যায়ন করে ফেলাটা খুব সহজ ।
-----------------------------------
'আমি ও অনন্তকাল এইখানে পরস্পর বিস্ময়ে বিঁধে আছি'
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
নতুন মন্তব্য করুন