এক.
"এই ফর্মটা পূরণ করে আনেন।"
লারনাকা এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশনে একটি এটাসেটা লিখা দাগ টানা সাদা কাগজ ধরিয়ে দিলেন ইমিগ্রেশন অফিসার।
৩ বছরেরও বেশি হয়ে গেলো, দেশে যাওয়া হয় না। ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে এর মধ্যে ট্রাভেল করলেও ৩ বছর আগে জিয়া বিমানবন্দরে শেষবারের মত পূরণ করা এই কাগজটির অস্তিত্ব প্রায় বিস্মৃত হয়েছিলাম। অনেক দিন পর দেশের হাওয়া টের পাচ্ছি সাইপ্রাসে ল্যান্ড করেই।
কি করেন?
-রিসার্চার।
সাইপ্রাসে কেন এসেছেন?
- একটা ইইউ রিসার্চ প্রজেক্টের মিটিং আছে। ইউনিভার্সিটি অফ সাইপ্রাসও পার্টনার।
কোথায় থাকবেন?
-হোটেল গ্রেশ্যন বে।
বুকিং আছে?
-হ্যা। (বুকিংয়ের কনফার্মেশন দেখালাম)
ইনভাইটেশন লেটার আছে?
- হ্যা। (লেটার দিলাম)
রিটার্ন টিকেট?
- হ্যা। (টিকেট দিলাম)
ইমিগ্রেশন অফিসার আমার সবুজ পাসপোর্টটি হাতে নিয়ে তন্ন তন্ন করে দেখছেন। বিরক্তি ছাপিয়ে আমি একটু একটু মজা ফিল করছি। মিটিমিটি হাসছি।
বারবার ভিসা এক্সটেশন আর ওয়ার্ক পারমিটের ধাক্কায় পাসপোর্টের পেজের পর পেজ ভর্তি। একটা সুদৃশ্য পেজে এসে উনার দৃষ্টি আটকে গেলো।
- ওটা ইংল্যান্ডের ভিসা। (অন্য পেজ উলটিয়ে বললাম) আর জার্মানীতে আমার রেসিড্যান্স পারমিটের পেইজ এটা।
৩ মাসের ভিজিটিং ভিসা ছিলো। ওটা কেটে রিটার্ন ফ্লাইটের ডেট অনুযায়ী ৫ দিনের স্টে পারমিশন দিলেন।
ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এলাম। বাইরে বেরিয়েই ডান পাশে ট্যাক্সিস্ট্যান্ড।
দুই.
"একবার হয়েছে কি, জানেন? এক মহিলা আমাকে বললো, উইল ইউ ফাক মি? আই'ল গিভ ইউ ২০০ পাউন্ডস।"
ট্যাক্সিওয়ালা শুরু থেকেই বকবক করে যাচ্ছে। কয় ছেলে, কয় মেয়ে, কয় বউ এসব কাহিনী অলরেডি শেষ করে ফেলেছে। আমার কাছে ভ্রমণ হলো ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করার সময়।
এতক্ষণ হুহা করে যাচ্ছিলাম। এবার বললাম, কথা না বলে সামনে দেখে কেয়ারফুলি ড্রাইভ করো।
বেচারা মুষড়ে পড়লো।
তিন.
প্রথম দিন মিটিং শেষে সোশ্যল ইভেন্ট। পুরা টীমের একসাথে লারনাকা শহর পরিভ্রমণ, সাথে একজন গাইড। একের পর এক কয়েকটা দর্শনীয় স্থান ঘুরালো, সাথে ইতিহাসের বর্ণনা। আমার এসবে আগ্রহ নেই।
এরপর ডিনার পর্ব। এতক্ষণের অনাগ্রহটা ঝেড়ে ফেলে সজীব হয়ে ওঠলাম। পুরো ডিনার ছিলো মাছের। 'ফিশ ডিনার'। একের পর এক নাম জানা-নাজানা মৎস্য আসতে লাগলো আর আমি বিপুল বিক্রমে খাদক হিসেবে সুনামের প্রতি সুবিচার করে গেলাম।
চার.
৪ দিনের দীর্ঘ মিটিং অবশেষে শেষ হলো। ফিরতি পথে আবারো ইমিগ্রেশন। এক তন্বীতরুণী।
এবার আগেভাগেই ফর্মফিলাপ করে রেখেছিলাম।
তুমি বাংলাদেশি?
- পাসপোর্ট দেখে কি মনে হয়? (মেজাজ মনে হয় একটু খাপ্পা ছিলো।)
কি করো?
- রিসার্চার। ওই ফর্মে লিখা আছে।
কিসের রিসার্চার?
- মিডলওয়্যার।
বুঝলাম না।
- সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং।
বুঝলাম না।
- কম্পিউটার।
কই যাইবা?
- এথেন্স।
এথেন্স থেকে?
- ফ্রাঙ্কফুর্ট।
ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে?
-স্টুটগার্ট।
স্টুটগার্ট থেকে?
-স্টুটগার্ট।
তোমাকে দেখে বাংলাদেশী মনে হয় না।
- কেন?
আমার জানামতে, বাংলাদেশিরা আরো কালো।
- তোমার জানায় ভুল আছে। আমার চেয়ে ফর্সা বাংলাদেশীরও অভাব নেই।
এত কথা জিজ্ঞেস করলাম, মাইন্ড করো নাই তো।
- না।
যাস্ট তোমাকে দেখে আগ্রহ হলো, তাই।
- নো প্রবলেম।
হ্যাভ আ নাইস ফ্লাইট।
- ধন্যবাদ।
কিছু স্যুভেনির কিনলাম। আগুনের দাম। শালাদের এক পাউন্ড প্রায় ২ ইউরোর সমান।
"ওয়েলকাম অন বোর্ড।" পাইলটের ভাষণ শুরু হলো। আরো মিনিট দশেক পরে অলিম্পিক এয়ার লাইন্সের বোয়িং ৩৩২ বিমানটি ভূমি ছেড়ে আকাশে পাড়ি দিলো।
আমি ছুটে চলেছি এথেন্সের দিকে। পেছনে পড়ে রইলো অনেক বছর পরে আমাকে বাংলাদেশের স্বাদ দেওয়া ছোট্ট দ্বীপদেশ সাইপ্রাস।
মন্তব্য
আপনার তো ভাই কোন রসকস নাই, ট্যাক্সিওয়ালা আসল গল্প শুরু করলো আর আপনি থামায়া দিলেন।
আমি গেলে ঐ তরুণীর দিল ঠান্ডা হবে, জানে পানি ফিরে পাবে, বাংলাদেশী বলে চিনে ফেলবে প্রথমেই।
হাঁটুপানির জলদস্যু
অয়ন, ওই বেটার দুই বউ, তারপর পোলাপাইনের গল্পও হজম করেছি। কিন্তু অশ্লীলতা সীমা ছাড়াইয়া যাওয়ার আগেই ব্যান কইরা দিছি।
হিমু, তরুনীর ফিগার-টীগার মাশাল্লাহ ভালো ছিলো। চেহারা-সুরতও চলে। তবে বাংলাদেশী বলে চিনে ফেললে একটু ঝামেলা আছে। একটা সময় পর্যন্ত সাইপ্রাস ছিলো বাংলাদেশীদের ইউরোপে প্রবেশ করার প্রথম মঞ্জিল। সাইপ্রাস-গ্রীস হয়ে ইতালিতে পৌঁছাতে পারাটা ছিলো টার্গেট। এ ব্যাপারে তাই অবৈধ প্রবেশকারী হিসেবে বাংলাদেশীদের প্রভূত বদনাম আছে। সাইপ্রাসের সাথে ইউরোপের অ্যাটিটুড, ভদ্রতাজ্ঞান ইত্যাদিরও অনেক পার্থক্য আছে। এ ব্যাপারে তারা সম্ভবত ইউরোপের চাইতে আরবের অনেক কাছাকাছি।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
হুমম, মজা পেলাম।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
আপনার লেখার ধরনটা বেশ পছন্দ হইছে। 'কথা কম কাজ বেশী' ধরনটা মন্দ না, কম কথায় কাজ হইলে বেশী কথার দরকার কি? অবশ্য কথাসাহিত্যিকরা একমত নাও হইতে পারেন।
==============================
আমিও যদি মরে যেতে পারতাম
তাহলে আমাকে প্রতি মুহূর্তে মরে যেতে হত না।
আরেকটু লিখলেই পারতেন। হাউশ মিটলো না।
-যা দেখি তা-ই বলি...
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
ড্রাইভার কি ২০০ পাউন্ড পাইছিলো? জানা দরকার ব্যাপারটা।
কি মাঝি? ডরাইলা?
চুরদায় খালি ফাঁকি দেয়।
আসল গল্প খাইয়া ফালায়ে একটা ভজঘট ধরনের ট্রেলার দেখায়া কয়, লন।
খেলুম না।
আমি ও আমার স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলি
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
হুমম্ সৌরভদা, খেলুম না !
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
মন্তব্যের জন্য সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ। দেখি, এরপর বেশি শব্দে অন্য কাহিনী লিখে শুধু হাউস না, হাউসের ওপরে ফাউ মিটানো হবে।
এই গল্পে কাটছাঁট না করলে বিশাল বপু দেখে সবাই ভাগতো, এটা কনফার্ম। তবে সৌরভ কাছাকাছি বলেছে। এটা ট্রেলার। ড্রাইভার ২০০ পাউন্ড পেয়েছিলো; কিন্তু তার মেহনতের পুরা কাহিনী শুনতেই আমার আপত্তি ছিলো।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
১৫ বছর আগে যে দেশ ছেড়ে চলে এসেছিলাম ঘৃণা ও বিরক্তি নিয়ে, সে সম্পর্কে একটা নস্টালজিয়া তো কাজ করেই। আপনি বলেছেন বহুদিন পরে বাংলাদেশের স্বাদ পেয়েছেন সাইপ্রাসে। আসলেই ওটা ইউরোপের গ্রাম । ১৯৯১ সালেও আমার তাই মনে হয়েছিলো আজো আপনার তাই মনে হয়। অর্থাত ওরা যত্নের সাথেই ওটাকে গ্রামের আদল দিয়ে রেখেছে। দেবে নাইবা কেন ইউরোপের মানুষ দ্বীপটিতে ভীড় করে তো এজন্যেই। আপনার লেখার হালের সাইপ্রাস সম্পর্কে আরও কিছু পর্যবেক্ষণ আশা করেছিলাম। যা হোক লেখার জন্য ধন্যবাদ।
--------------------------------------------------------
দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে/ লিখি কথা ।
আমি যে বেকার, পেয়েছি লেখার/ স্বাধীনতা ।।
বস, আমি ওখানের জীবনযাত্রার খুব বেশি কিছু জানি না। দুয়েকজন বাংলাদেশী স্টুডেন্টের সাথে ফোনে কথা হয়েছে, নেপালী একজন স্টুডেন্টের সাথে কথা বলেছি, উত্তর ইউরোপ থেকে ওখানে কাজ করতে আসা এক পাবলিকের সাথেও অনেকক্ষণ কথা বলেছি এয়ারপোর্টের ওয়েটিং রুমে - এই পর্যন্তই। তবে কোনো এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন অফিসের কাজকাম থেকেও সেই দেশ সম্পর্কে হয়তো অনেকটাই ধারণা পাওয়া যায়।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
নতুন মন্তব্য করুন