পূর্ববর্তী পর্বের পর ...
১৮৩৭ থেকে ১৮৫৮ - দীর্ঘ ২০ বছর! ডারউইন মনোনিবেশ করলেন তার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষায়। লোকজনের সাথে বেশী মেশেন না, নিজের মনে গাছপালা, পোকা মাকড় নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। এমনকি লন্ডন থেকে ১৬ মাইল দুরে বাড়ি কিনে পরিবার নিয়ে উঠে আসেন নিরিবিলিতে সময় কাটানোর জন্য। কিন্তু বারবারই অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকলেন তিনি, সে এক অদ্ভুত অসুস্থতা, প্রায়ই শরীরটা খারাপ থাকে, মাথা ব্যথা, পেটের অসুখ কখনই নাকি পিছ ছাড়ে না! কোন ডাক্তারই অসুখটা কি তা ধরতে পারেন না। অনেকেই এখন মনে করেন যে তার অসুখটা হয়তো ছিলো নিতান্তই মানসিক, এত বড় একটি আবিষ্কারকে নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখার অসহ্য ভার আর বইতে করতে পারছিলেন না তিনি। খুব সাবধানে এবং গোপনে কাজ চালিয়ে যেতে থাকলেন তিনি। ভূতত্ত্ব এবং জীববিজ্ঞানের অন্যান্য বিষয়ের উপর বই প্রকাশ করতে থাকলেও তার এই বিবর্তনের উপর কাজ সম্পর্কে লায়েল, হুকার, বা হাক্সলির মত দুই চারজন বিজ্ঞানী বন্ধু ছাড়া আর কাউকে কিছু জানাতেন না তিনি। বিবর্তন যে ঘটছে তা সম্পর্কে নিশ্চিত হলেও কি প্রক্রিয়ায় তা ঘটছে বা এর চালিকাশক্তি কি হতে পারে তা সম্পর্কে তখনও কোন নির্দিষ্ট ধারণায় পৌঁছাতে পারেননি। সিদ্ধান্ত নিলেন, বিবর্তনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট এবং বিস্তারিত তথ্য প্রমাণসহ একটি তত্ত্ব আবিষ্কার করতে না পারা পর্যন্ত কোনভাবেই এই আবিষ্কারের কথা জনসমক্ষে প্রচার করবেন না। তাই পরবর্তী বিশ বছর ধরে তিনি অত্যন্ত গভীর অধ্যাবসায়ের সাথে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষাগুলো চালিয়ে যেতে থাকলেন।
১৮৫৮ সালে অপ্রত্যাশিত একটি চিঠি এসে পৌঁছায় ডারউইনের হাতে। তার ভিতরে ছিলো আলফ্রেড ওয়ালেসের (১৮২৩-১৯১৩) বিবর্তন নিয়ে লেখার একটি পান্ডুলিপি। ডারউইন বিস্ময়ের সাথে দেখলেন যে আজকে ২০ বছর ধরে যে তত্ত্ব নিয়ে তিনি গোপনে কাজ করে আসছেন তা মাত্র তিন বছরেই ওয়ালেস আবিষ্কার করে ফেলেছেন। তিনি অত্যন্ত আশাহত মনে সিদ্ধান্ত নিলেন যে এখন পর্যন্ত করা সব কাজ ধ্বংস করে ফেলবেন। কিন্তু এরপর বন্ধুদের অনুরোধে শেষ পর্যন্ত "On the origin of species by means of Natural Selection'' বা প্রজাতির উৎপত্তি বইটি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রকাশ করে ফেলতে রাজী হলেন। তখনই ঠিক করা হয় যে, ১৮৫৮ সালে লন্ডনের লিনিয়ান সোসাইটির এক অধিবেশনে ডারউইনের এবং অ্যলফ্রেড ওয়ালেস (১৮২৩-১৯১৩) এর বিবর্তন তত্ত্ব আলাদা আলাদাভাবে প্রস্তাব করা হবে। অনেকে মনে করেন প্রজাতির উৎপত্তি বইটিতে ডারউইন যেভাবে অগুনতি উদাহরণ, পর্যবেক্ষণ এবং সাক্ষ্য প্রমাণের মাধ্যমে তার তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করেছেন ওয়ালেস তার ধারে কাছেও যেতে পারেন নি। ডারউইন এত বিস্তারিতভাবে বইটি না লিখলে শুধুমাত্র ওয়ালেসের লেখা দিয়ে যুগান্তকারী এই বিবর্তনবাদ পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা পেতে পারতো না। ওয়ালেস নিজেই পরবর্তীতে 'ডারউইনবাদ' নামক একটি বই লেখেন এবং তাতে বিবর্তন তত্ত্বের মূল কৃতিত্ব যে ডারউইনেরই, তা স্বীকার করে নেন ।
এখন তাহলে দেখা যাক ডারউইন এমন কি সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন বিবর্তনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে, যার ফলে জীববিজ্ঞানের ইতিহাসের মোড় ঘুরে গেলো চিরতরে। তিনি তার সময়ের থেকে এতখানিই অগ্রগামী ছিলেন যে, তার এই আবিষ্কারের প্রমাণ পেতে বিজ্ঞানীদের আরও প্রায় এক শতক সময় লেগে গেলো! ডারউইন দেখলেন, হাজার হাজার বছর ধরে কৃষকেরা এবং পশু পালকেরা কৃত্রিম নির্বাচনের (ারতঠিচিািল সলেচেতৈিন) মাধ্যমে বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন বাড়িয়েছে, গৃহপালিত পশুর মধ্যে প্রয়োজন মত বিভিন্ন জাতের প্রাণীর সৃষ্টি করেছে। সে সময়ে জীববিজ্ঞান কিংবা এর শাখা জেনেটিক্স সম্পর্কে কিছুই না জেনেও, তারা শুধুমাত্র বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে সঠিকভাবেই বুঝেছিলো যে, অনেক বৈশিষ্ট্য বংশগতভাবে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে প্রবাহিত হয়। যেমন, যে ধানের গাছের জাত থেকে অনেক বেশী বা উন্নত মানের ধান উৎপন্ন হয়, ক্রমাগতভাবে শুধু সে ধরনের ধানের বীজই যদি চাষের জন্য নির্বাচন করা হয় তাহলে এক সময় দেখা যাবে শুধু উন্নত মানেরই ধান উৎপন্ন হচ্ছে। যে গরু বেশী দুধ দেয়, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে যদি শুধু সেই ধরনের গরুকেই বংশবৃদ্ধি করতে দেওয়া হয় তাহলে এক সময় দেখা যাবে যে পুরো গরুর পালের মধ্যেই গড়পড়তা দুধ দেওয়ার পরিমান বেড়ে গেছে। তার মানে কয়েক প্রজন্মের প্রচেষ্টায় ক্রমাগতভাবে সতর্ক, কৃত্রিম নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এমন জাতের পশু বা উদ্ভিদ তৈরি করা সম্ভব যাদের মধ্যে শুধু কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্যগুলোই দেখা যাবে। এক সময় তাদের মধ্যে বৈশিষ্ট্যের পার্থক্যগুলো এত বেশী হয়ে যায় যে তারা সম্পুর্নভাবে এক নতুন প্রজাতির প্রাণী বা উদ্ভিদে পরিণত হয়ে যেতে পারে, যার সাথে তাদের পূর্বপুরুষের প্রজনন অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এভাবেই মানুষ হাজার বছর ধরে বুনো নেকড়েকে পোষ মানিয়ে কৃত্রিম নির্বাচনের মাধ্যমে বিভিন্ন জাতের কুকুরের বিবর্তন ঘটিয়েছে ৪। এখন যদি অন্য কোন গ্রহ থেকে কেউ আমাদের এই পৃথিবীতে এসে প্রথমবারের মত বিভিন্ন রকমের কুকুরগুলোকে দেখে, তাহলে তাদের পক্ষে কোনভাবেই অনুমান করা সম্ভব হবে না যে এরা এক সময় সবাই নেঁকড়ে প্রজাতির বংশধর ছিলো ৪। ফার্মের মোটা মোটা মুরগী বা বিশাল বিশাল মাংসওয়ালা অষ্ট্রেলিয়ান গরুগুলোকে দেখে আমাদের যে ভিমরি খাওয়ার জোগাড় হয় তাদেরকে
চিত্র : নেকড়ে থেকে কুকুরের বিবর্তন।
এভাবেই কৃত্রিম নির্বাচনের মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে (এখন অবশ্য অনেক ধরনের কৃত্রিম পদ্ধতি এবং ওষুধ ব্যবহার করা হয়ে থাকে)। তার মানে মানুষ কৃত্রিমভাবে নির্বাচন করে নতুন নতুন প্রজাতি তৈরি করে আসছে সেই অনাদি কাল থেকেই! ডারউইন দেখলেন, এরকম কৃত্রিমভাবে নির্বাচিত প্রজননের মাধ্যমে তার আশে পাশে মানুষ প্রায় ১০ রকমের কবুতর তৈরি করেছে। এদের মধ্যে পার্থক্য এতখানিই যে, প্রকৃতিতে আগে থেকে দেখতে পেলে এদেরকে খুব সহজেই ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতি বলে ধরে নেওয়া হত ৩। তাহলে কি প্রকৃতিতেও এমনই কোন প্রক্রিয়ায় নির্বাচন ঘটছে?
চিত্র : কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে উৎপন্ন বিভিন্ন ধরণের কবুতর।
ডারউইন আরও লক্ষ্য করলেন, আমাদের চারপাশের উদ্ভিদ এবং প্রাণীরা যে পরিমাণে বংশবৃদ্ধি করে তার
বেশীরভাগই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে না। একটা পুরোপুরি বড় হওয়া কড মাছ বছরে প্রায় ২০ থেকে ৫০ লাখ ডিম পাড়ে, একটি মেপল বা আম বা জাম গাছে হাজার হাজার ফুল এবং ফল ধরে, কিন্তু এর বেশীরভাগই পূর্ণাঙ্গ রূপ ধারণ করার আগেই মৃত্যুবরণ করে, আমাদের দেশের ইলিশ মাছের কথাই চিন্তা করে দেখুন না। সমুদ্র থেকে নদীগুলোতে এসে তারা কি হারে ডিম পারে আর তাদের মধ্যে ক’টাই বা শেষ পর্যন্ত পুর্ণাঙ্গ মাছে পরিণত হয়ে টিকে থাকতে পারে! বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখিয়েছেন যে একটা কড মাছের ডিমের ৯৯% ই প্রথম মাসেই কোন না কোন ভাবে ধ্বংস হয়ে যায়, বাকি যা বেঁচে থাকে তার প্রায় ৯০% জীবনের প্রথম বছরেই কোন না কোনভাবে মৃত্যুবরণ করে ৮। ডারউইনও এই একই জিনিস দেখিয়েছেন হাতীর বংশবৃদ্ধির উদাহরণ দিয়ে। অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় হাতীর বংশবৃদ্ধির হার তুলনামুলকভাবে খুবই কম, কিন্তু তারপরও একটা হাতী তার জীবনে যে ক’টা বাচ্চার জন্ম দেয় তার মধ্যেও সবগুলি শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকে না। ডারউইন হিসেব করে দেখিয়েছেন যে, হাতী অন্য সব প্রাণীর তুলনায় সবচেয়ে কম বংশবৃদ্ধি করেও তার ৯০-১০০ বছরের জীবনে প্রায় ৬ টি বাচ্চার জন্ম দিতে পারে। অর্থাৎ যদি সবগুলো বাচ্চা বেঁচে থাকে তাহলে এক জোড়া হাতী থেকে ৭০০-৭৫০ বছরে প্রায় ১৯০ লক্ষ হাতীর জন্ম হবে ৮।
প্রকৃতিতে প্রায় সব জীবই এরকম বাড়তি শিশুর জন্ম দিয়ে থাকে, একটা ব্যকটেরিয়া প্রতি ২০ মিনিটে বিভক্ত হয়ে দুটো ব্যকটেরিয়ায় পরিণত হয়, হিসেব করে দেখা গেছে যে এরা সবাই বেঁচে থাকলে এক বছরে তারা বংশ বৃদ্ধি করে সারা পৃথিবী আড়াই ফুট উচু করে ঢেকে দিতে পারতো। একটা ঝিনুক কিংবা কাছিম একবারে লাখ লাখ ডিম ছাড়ে, একটা অর্কিড প্রায় ১০ লাখ বীজ তৈরী করতে পারে ৩। মানুষের জনসংখ্যার কথাই চিন্তা করা যাক, চিকিৎসাবিজ্ঞানের এতখানি উন্নতি ঘটার আগে অর্থাৎ মাত্র এক-দেড়শো বছর আগেও শিশু মৃত্যর হার ছিল অপেক্ষাকৃতভাবে অনেক বেশী। (আধুনিক বিজ্ঞানের সাহায্যে, কৃত্রিমভাবে আমরা এখন একদিকে জন্ম নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা করছি, অন্যদিকে শিশু আধুনিক চিকিৎসার কল্যানে মৃত্যুর হারও কমিয়ে আনতে পেরেছি)। তাহলে দেখা যাচ্ছে, এভাবেই সব জীব যদি বংশবৃদ্ধি করতে থাকতো, অর্থাৎ একেকটা জীব তার সারা জীবনে যতগুলো ডিম বা বাচ্চার জন্ম দিতে সক্ষম তার সব গুলো যদি টিকে থাকতো তাহলে এতদিনে পৃথিবীতে আর কারোরই থাকার ঠাঁই হতো না। আসলে খেয়াল করলে দেখা যায় যে, প্রকৃতিতে ঠিক এর উলটোটা ঘটছে - সংখ্যার দিক থেকে যত উদ্ভিদ বা প্রাণীর জন্ম হয় বা বেঁচে থাকে, তার তুলনায় তাদের বংশবৃদ্ধি করার ক্ষমতা বহু গুণ বেশী। শেষ পর্যন্ত এর মধ্যের ছোটটো একটা অংশই শুধু বড় হওয়া পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে। যে কোন প্রজাতি হঠাৎ করে অনেক বেশী হারে বংশবৃদ্ধি করে ফেলতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের বিস্তৃতি প্রাকৃতিক নিয়মেই বন্ধ হতে হবে। কারণ, তাদের সবার বেঁচে থাকার জন্য যে পরিমান খাদ্যের বা অন্যান্য সম্পদের প্রয়োজন তা আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। ডারউইন ভাবলেন, তাহলে প্রকৃতিতে প্রাণের এই বিশাল অপচয় এবং বাড়তি বংশবৃদ্ধির (Prodigality of Reproduction ba Over Production) ব্যাপারটার অবশ্যই কোন ব্যাখ্যা থাকতে হবে!
শুধু যে আমাদের চারপাশে অনেক বাড়তি প্রাণের জন্ম হয় তাই তো নয়, প্রত্যেক প্রজাতির জীবের নিজেদের মধ্যেই আবার অসংখ্য ছোট বড় পার্থক্য দেখা যায়। মানুষের কথাই ধরুন না, আমাদের একজনের সাথে আরেক জনের তো কোন মিল নেই। গায়ের রং এ পার্থক্য, চোখের রং এ, আকারে পার্থক্য, দেখতে একেক জন একেররকম, কেউ বা বেশী দিন বাঁচে, কেউ বা কম, কাউকে বেশী রোগে ধরে, কাউকে কম, কারও গায়ে বেশী শক্তি আবার কারও কম - এমন হাজারোতর পার্থক্য। দ্বিতীয় অধ্যায়ে আমরা এর বিভিন্নরকম উদাহরণ দেখেছিলাম। বংশ পরম্পরায় বিভিন্ন প্রজাতির শিশুরা তাদের বাবা-মার থেকে বিভিন্ন রকমের বৈশিষ্ট্য পেয়ে থাকে, যৌন পদ্ধতি থেকে জন্মানো এই প্রতিটি প্রাণী বা উদ্ভিদ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়। এর ফলে যে কোন প্রজাতির জনসংখ্যার বৈশিষ্ট্যের মধ্যে প্রচুর পরিমানে পার্থক্য বা প্রকারণ দেখা যায় । সে সময় জেনেটিক্স বা বংশগতিবিদ্যার আবিষ্কার না হওয়ায় ডারউইন প্রকারণ সম্পর্কে সঠিক ধারণায় পৌঁছুতে পারেন নি, কিন্তু তিনি এই সব পর্যবেক্ষণ থেকে সঠিকভাবেই সিধান্েত আসেন যে, প্রকৃতিতে সবসময় খাদ্য, বেঁচে থাকা, জায়গা, সঙ্গী নির্ধারণ, আশ্রয়, এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে একধরনের প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। এই বেঁচে থাকার সংগ্রাম চলতে থাকে একই ধরনের প্রজাতির ভিতরের প্রতিটি জীবের মধ্যে এবং এক প্রজাতির সাথে আরেক প্রজাতির মধ্যে। আবার প্রতিটি জীবের বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য বা প্রকারণের কারণে এই অনন্ত প্রাকৃতিক সংগ্রামে কেউ বা সহজেই খাপ খাইয়ে নিয়ে বেশীদিন টিকে থাকতে সক্ষম হয়, আর অন্যরা আগেই শেষ হয়ে যায়। অর্থাৎ প্রতিটি জীবের মধ্যে প্রকৃতি তুলনামুলকভাবে বেশী উপযুক্ত বৈশিষ্ট্যের অধিকারীদের টিকিয়ে রাখে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে যে,
একটা নির্দিষ্ট পরিবেশে সংগ্রাম করে যারা টিকে থাকতে সক্ষম হয়, তারাই শুধু পরবর্তী প্রজন্মে বংশধর রেখে যেতে পারে, এবং তার ফলে তাদের বৈশিষ্ট্যগুলোরই পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে অনেক বেশী প্রকটভাবে দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অর্থাৎ, যে প্রকারণগুলো তাদের পরিবেশের সাথে অপেক্ষাকৃত বেশি অভিযোজনের ক্ষমতা রাখে, তাদের বাহক জীবরাই বেশীদিন টিকে থাকে এবং বেশী পরিমানে বংশবৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়। এভাবে প্রকৃতি প্রতিটা জীবের মধ্যে পরিবেশগতভাবে অনুকুল বৈশিষ্ট্যের অধিকারীদের নির্বাচন করতে থাকে এবং ডারউইন প্রকৃতির এই বিশেষ নির্বাচন প্রক্রিয়ারই নাম দেন প্রাকৃতিক নির্বাচন (Natural Selection)
ডারউইনের সময় বিজ্ঞানীদের বংশগতিবিদ্যা (Genetics) সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না। জীবাশ্মবিদ্যা বা ফসিল রেকর্ডও তখন তেমন জোড়দারভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ভাবতেও অবাক লাগে ডারউইন কিভাবে এই সব জ্ঞান ছাড়াই বিবর্তনবাদ সম্পর্কে এত সঠিক সিদ্ধান্েত পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিলেন! তার এই বিবর্তন তত্ত্ব ইউরোপের সেই সময়ের খ্রিষ্ট ধর্মসহ অন্যান্য সব ধর্মের ভিতকেই টলিয়ে দিলো, আদম হাওয়া থেকে শুরু করে আলাদা আলাদাভাবে প্রজাতির সৃষ্টির সব গল্পই হল পরিণত হল রূপকথায়, নুহের মহাপ্লাবনের সময় প্রজাতির নতুন করে টিকে যাওয়ার কেচ্ছা গেলো বানের জলে ভেসে। আগেই বলেছি, জীববিজ্ঞানে ডারউইনের মূল অবদান দু’টি, প্রথমত যুক্তি প্রমাণ উদাহরণ দিয়ে প্রমাণ করা যে, প্রাণের বিবর্তন ঘটছে এর উৎপত্তির পর থেকে (দ্বিতীয় অধ্যায়ে দ্রষ্টব্য) আর দ্বিতীয়তঃ এই বিবর্তন ঘটছে প্রাকৃতিক নির্বাচন নামের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। হইচই পরে গেলো সারা দুনিয়া জুড়ে ১৯৫৮ সালে ডারউইন এবং ওয়ালেস এই তত্ত্বটা প্রস্তাব করার পর। যুগে যুগে বিভিন্ন প্রজাতি বদলাচ্ছে- তা বিশ্বাস করা এক কথা, আর প্রকৃতিতে হাজারো রকমের নতুন নতুন প্রজাতি তৈরি হচ্ছে এবং এই পরিবর্তন বা বিবর্তন ঘটছে সম্পুর্ণভাবে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় - কোন সৃষ্টিকর্তার হস্তক্ষেপ ছাড়াই, তা মেনে নেওয়া আরেক কথা!
সে সময়ের ইউরোপে প্রাণের উৎপত্তি সংক্রান্ত দর্শনের পুরোটাই ছিলো বিখ্যাত ঈশ্বরতত্ত্ববাদী উইলিয়াম প্যালের ( ১৭৪৩-১৮০৫) সৃষ্টিতত্ত্ববাদ দিয়ে প্রভাবিত।
তিনিই বলেছিলেন যে প্রত্যেকটা ঘড়ির যেমন একজন কারিগর থাকে তেমনি প্রত্যেকটা প্রাণেরও পিছনে একজন স্রষ্টা থাকতেই হবে। ঘড়ির মত একটা জটিল জিনিস যেমন কারিগর ছাড়া সৃষ্টি হতে পারে না তেমনি এত জটিল অংগ প্রত্যংগ সম্পন্ন জীবগুলোও সৃষ্টিকর্তা ছাড়া পৃথিবীতে জন্মাতে পারে না। তাই ডারউইন এবং ওয়ালেস যখন দেখালেন যে, প্রাকৃতিক নির্বাচনের মত অন্ধ, অচেতন কিন্তু অনাকস্মিক এবং নিতান্তই একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শুধু জীবের বিবর্তনই ঘটছে না, নতুন নতুন প্রজাতিরও উদ্ভব ঘটছে এবং ধাপে ধাপে জটিল থেকে জটিলতর প্রাণেরও উন্মেষ ও বিলুপ্তি ঘটছে তখন স্বভাবতই ইউরোপের রক্ষণশীল এবং ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মাথায় যেনো বাজ পড়লো।
তারা ঝাঁপিয়ে পড়লেন বিবর্তনবাদ তত্ত্বের বিরুদ্ধে। রেঁনেসা, পুঁজিবাদের বিকাশ, শিল্প বিপ্লব ইত্যাদির কারণে তখন মহা প্রতাপশালী চার্চ্চের ক্ষমতা বেশ নড়বড়ে হয়ে উঠেছে ইওরোপে, ইচ্ছা করলেই তারা আর ডাইনী বানিয়ে কিংবা বাইবেলের বিরোধিতার অজুহাতে একে ওকে পুড়িয়ে মারতে পারছে না। তাই ডারউইন এ যাত্রায় প্রাণে বেঁচে গেলেও কম অপমান এবং সমালোচনার স্বীকার হতে হয়নি তাকে, ক্যারিক্যাচারি কার্টুন থেকে শুরু করে, গালিগালাজের ঝড় বয়ে যেতে থাকলো তার উপর। যেমন, নীচের ছবিটি (চিত্র ৩.৩) প্রকাশিত হয়েছিল হর্নেট ম্যাগাজিনে, ১৮৭১ সালে। এ ছবিটি দেখলে বোঝা যায় ডারউইনের তত্ত্ব সে সময় ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের কি পরিমান গাত্রদাহের কারণ ঘটিয়েছিল; তারা বানরের দেহের সাথে ডারউইনের মুখমন্ডল জুড়ে দিয়ে এ ধরণের নানা বিদ্রুপাত্মক ছবি এঁকে ডারউইনকে তাঁর বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের প্রচার থেকে বিরত রাখতে চেয়েছিল।
চিত্র ৩.৩ : হর্নেট ম্যাগাজিনে (১৮৭১) প্রকাশিত একটি বিদ্রূপাত্মক ছবি
ডারউইন নিজে খুব বেশী উত্তর না দিলেও তার বন্ধুরা, টি এইচ হাক্সলি, জোসেফ ডাল্টন হুকার, অ্যাশা গ্রে প্রমুখ তার হয়ে লড়ে যেতে থাকেন। বিশেষ করে হাক্সলিকে তো তখন ‘ডারউইনের বুল ডগ’ বলেই ডাকা হত।
এ প্রসঙ্গে একটা মজার ঘটনা না বললেই নয় - একবার অক্সফোর্ডে ব্রিটিশ এসোসিয়েশনের সম্মেলনে বিবর্তনের তীব্র বিরোধিতাকারী খ্রিষ্টান ধর্ম বিশপ স্যামুয়েল উইলবারফোর্স ডারউইনের তত্ত্বকে ঈশ্বরবিরোধী ব্যক্তিগত মতামত বলে আক্রমণ করেন। তখনই তিনি হঠাৎ করে সভায় উপস্থিত বিজ্ঞানী হাক্সলিকে উদ্দেশ্য করে জানতে চান তার দাদা এবং দাদীর মধ্যে কে আসলে বানর ছিলেন। তারই উত্তরে হাক্সলি বিবর্তনবাদের পক্ষে বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে বিশপকে তুলাধুণা তো করে ছাড়েনই বক্তৃতার শেষে এসে তিনি এও বলেন যে,
যে ব্যক্তি তার মেধা, বুদ্ধিবৃত্তিক অর্জন ও বাগ্মিতাকে কুসংস্কার ও মিথ্যার পদতলে বলি দিয়ে বৌদ্ধিক বেশ্যাবৃত্তি করে, তার উত্তরসুরী না হয়ে আমি বরং সেইসব নিরীহ প্রাণীদের উত্তরসুরী হতে চাইবো যারা গাছে গাছে বাস করে, যারা কিচিরমিচির করে ডাল থেকে ডালে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ায়
এদিকে আবার বিগেল জাহাজের ক্যাপ্টেন ফিটজরয়ও আরেক কান্ড করে বসলেন সেই সভায়। তিনি বাইবেল হাতে চারদিকে দৌড়াদৌড়ি করে বলতে থাকলেন যে, সব দোষ আসলে তারই, তিনি যদি ডারউইনকে তার জাহাজে করে বিশ্ব ভ্রমণে নিয়ে না যেতেন তাহলে ডারউইন এভাবে ধর্মের ক্ষতি করার সুযোাগ পেতেন না। তবে অনেকেই মনে করেন যে, ফিটজরয়ের মানসিক সমস্যা ছিল এবং তিনি এর কিছুদিন পরে আত্মহত্যাও করেছিলেন। কিন্ত আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যে, বিবর্তন এবং প্রাকৃতিক নির্বাচন নিয়ে আজও অবধি বিতর্কের ও বিরোধিতার কোন শেষ নেই। যদিও মাইক্রো-বায়োলোজী, জেনেটিক্স, জিনোমিক্স ইত্যাদি আধুনিক জীববিজ্ঞানের শাখা যত এগিয়েছে, ততই অভ্রান্তভাবে প্রমাণ হয়েছে বিবর্তনবাদের সঠিকতা! কিন্তু তার ফলে ধর্মীয় অংশ থেমে যায়নি, বরং আমেরিকার মত জায়গায় তারা সরকার এবং প্রভাবশালী লোকদের সমর্থন পেয়ে ইদানীং মহাশক্তিশালী হয়ে উঠতে শুরু করেছে। প্রাচীন সৃষ্টিতত্ত্ব দিয়ে আর কুলাচ্ছে না দেখে এখন ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন বা আই.ডি নামের মোড়কে পুরে নতুন করে সৃষ্টিতত্ত্বকে প্রচার করার আপ্রাণ চেষ্টায় নেমেছে, এ নিয়ে পরে বিস্তারিত আলোচনার ইচ্ছা রইলো।
চলবে ...
মন্তব্য
অসাধারণ।
এক টানে পড়ে গেলাম এবং যথারীতি পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায়।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
চমৎকার এবং চমৎকার !
সাধু, সাধু!
হাঁটুপানির জলদস্যু
খুব ভালো লাগল।
ধর্মীয় মৌলবাদীদের চেহারা সর্বত্র একই রকম। সব কালেও একই রকম।
--------------------------------------------------------
দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে/ লিখি কথা ।
আমি যে বেকার, পেয়েছি লেখার/ স্বাধীনতা ।।
অসাধারণ!!
বন্যাদি, বিবর্তনের সব জটিল তত্ত্ব কথা আপনি কি সুন্দরভাবে সহজ কথায় গুছিয়ে লেখেন!
আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
ধন্যবাদ সবাইকে, কষ্ট করে এই লম্বা লম্বা লেখাগুলো পড়ার জন্য।
বন্যা
সুহৃদ সুলেখক: আমার একটা ছোট্ট কৌতূহল আছে। selective evolution এর মাধ্যমে যদি সত্যিই আমার কাঙ্খিত বৈশিষ্ট্যের জন্ম দেওয়া যায়, তাহলে যে মানুষগুলো ইতিমধ্যেই জন্মে গেছে তাদের কে কি কোনো অপারেশন এর মাধ্যমে "ভালো" বৈশিষ্ট্যের ক্লোন সেল ঢুকিয়ে ভালো বা "সুন্দর" ক্লোন সেল ঢুকিয়ে সুন্দর করা সম্ভব? যেমনটা ক্যান্সার রিসার্চ এর বেলায় বলা হচ্ছে, যে বিষাক্ত কোষকে আর বাড়তে না দিয়ে ওই জায়গার সুস্থ কোষের ইনপুট করা, যেটা আবার ক্লোন বিজ্ঞানীদের ক্লোনিং এর পক্ষে বড় যুক্তি। এটা evolution এ কিরকম প্রভাব ফেলবে? আমি কি চাইলেই আমার গায়ের রঙ বা আমার পরবর্তী প্রজন্মের উচ্চতা বদলে ফেলতে পারবো?
কৌতূহলী
ss
নতুন মন্তব্য করুন