একজন যাজকের 'ডারউইন' হয়ে ওঠা (২)

বন্যা এর ছবি
লিখেছেন বন্যা (তারিখ: বুধ, ১০/১০/২০০৭ - ৮:৩৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পূর্ব্বতী পর্বের পর

auto

ডারউইন এই গ্যালাপ্যাগাসের দ্বীপগুলোতেই সবচেয়ে বিচিত্র ধরনের প্রজাতির নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন, যা তাকে পরবর্তীতে বিবর্তনের পক্ষের প্রমাণগুলো প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করে। গ্যালাপ্যাগাসের বিভিন্ন দ্বীপগুলোতে যে ১৪ ধরনের ফিঞ্চ দেখতে পাওয়া যায় তাদের মধ্যে ডারউইন নিজেই ১৩ টি সংগ্রহ করেছিলেন। এই ফিঞ্চ পাখিগুলো হচ্ছে বিবর্তনীয় অভিযোজন (adaptation) বা বিবর্তনের ফলে এক প্রজাতি থেকে বিচিত্র বহু ধরনের প্রজাতি উৎপত্তি হওয়ার একটি চমৎকার উদাহরণ।

বিস্মিত ডারউইন লক্ষ্য করলেন যে, তাদের সার্বিক দৈহিক গঠনে প্রচুর মিল থাকলেও ঠোটের আকৃতি ও গঠনে বেশ উল্লেখযোগ্য রকমের পার্থক্য রয়েছে। এদের মধ্যে আবার ছয়টি মাটিতে বাস করে এবং বাকিরা থাকে গাছে। যারা মাটিতে থাকে তাদের মধ্যে একটি অংশ বিভিন্ন ধরনের বীজ খেয়ে বেঁচে থাকে আর বাকীদের প্রধাণ খাদ্য হচ্ছে ক্যাকটাস জাতীয় গাছের ফুল। দেখা গেলো যারা বীজ খায় তাদের ঠোঁট বেশ মোটা যা তাদেরকে বীজ ভাঙ্গতে সহায়তা করে, আবার যারা ক্যাকটাসের ফুল খায় তাদের ঠোঁটগুলো হচ্ছে সোজা এবং খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ফুল খাওয়ার উপযোগী। যারা গাছে থাকে এবং পোঁকা মাঁকড় ধরে খায় তাদের ঠোঁটের আকৃতি আবার ঠিক সেরকমই লম্বা যাতে তারা গর্ত থেকে পোঁকা ধরে নিয়ে আসতে পারে। ডারউইন এই পর্যবেক্ষণ থেকে লিখেলেন, সবচেয়ে কৌতুহলোদ্দীপক বিষয় হচ্ছে এই প্রজাতিগুলোর ঠোঁটের নিখুঁত ধাপে ধাপে ঘটা ক্রমবিকাশের ঘটনা ...একটি ছোট ও অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত পাখির দলের মধ্যে বৈশিষ্ট্যের এই ক্রমাগত রূপান্তর ও বৈচিত্র দেখে যে কেউ অবশ্য কল্পনা করতে পারে যে এই দ্বীপগুলোতে পাখির প্রাথমিক অভাব দুর করার জন্য একটি মুল প্রজাতি থেকে নিয়ে বিভিন্ন পরিবেশের জন্য উপযোগী ও পরিবর্তন করে অন্যদের তৈরী করা হয়েছে । তিনি পরবর্তিতে তার বইতে লেখেন, বিভিন্ন জীবের মধ্যে এলাকা এবং সময় বিশেষে এই নিবিড় সম্পর্কের কারণ উত্তরাধিকার ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না, অর্থাৎ এই কাছাকাছি ধরনের প্রজাতিরা সাধারণত খুব কাছাকাছি এলাকায় বাস করে কারণ তারা একসময় একই পুর্বপুরুষ থেকে পরিবর্তিত হতে হতে বিভিন্ন প্রজাতিতে পরিণত হয়েছে


চিত্র : ডারউইনের আঁকা কয়েকটি প্রজাতির ফিঞ্চের ছবি

এতদিনের সৃষ্টিতত্ত্ব আমাদেরকে যা শিখিয়ে এসেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে ধরে নিতে হবে যে, কোন এক সৃষ্টিকর্তা বিভিন্ন পরিবেশের সাথে উপযোগী করে বিভিন্ন জায়গার প্রাণী এবং উদ্ভিদ তৈরী করেছিলেন। কিন্তু এই যুক্তির সাথেই কি বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রমান উদাহরণের কোন মিল পাওয়া যাচ্ছে? তাহলে তো একই ধরনের জলবায়ু এবং ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন জায়গাগুলোতে একই রকমের প্রাণী দেখা যাওয়ার কথা ছিলো! ডারউইন দেখলেন যে, বিভিন্ন মহাদেশের বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে মিল বা অমিল - কোনটাকেই শুধুমাত্র পরিবেশগত পার্থক্য দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। যেমন, অষ্ট্রেলিয়া মহাদেশের প্রাণীগুলোর সাথে অন্য মহাদেশের প্রাণীর তেমন কোন মিল নেই, আবার আমরা দেখেছি যে, দক্ষিণ আমেরিকার প্রাণীগুলোও দেখতে বেশ অন্যরকম। অথচ ইউরোপ, এশিয়া বা আফ্রিকার বিভিন্ন জায়গায় তো অষ্ট্রেলিয়া বা দক্ষিণ আমেরিকার মত পরিবেশ দিব্যি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে! আবার গ্যালাপ্যাগাস বা দক্ষিণ আমেরিকার কাছাকাছি দ্বীপগুলোর প্রাণীদের সাথে তার মুল ভুখন্ডের প্রাণীদের যেরকম মিল পাওয়া যাচ্ছে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের জীবজন্তুর সাথে তা পাওয়া যাচ্ছে না। ডারউইন যদি এই দ্বীপগুলোতে সম্পূর্ন নতুন ধরনের প্রাণী দেখতেন তাহলে সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে তার মনে হয়তো প্রশ্ন উঠতো না, কিন্তু দক্ষিণ আমেরিকার মুল ভুখন্ডের সাথে তাদের এই পরিমাণ সাদৃশ্য তাকে ভাবিয়ে তুলেছিলো। তিনি প্রশ্ন করলেন, সৃষ্টির সময় এইসব দ্বীপে যদি বিভিন্ন জীবদের রেখে দেওয়া হয়ে থাকে তাহলে এদের গায়ে দক্ষিণ আমেরিকার ছাপ কেনো? আবার ঠিক বিপরীতভাবে দেখা যাচ্ছে, কাছাকাছি জায়গার দ্বীপগুলোতে বাস করা বিভিন্ন প্রজাতির জীবজন্তুর মধ্যে রয়েছে অকল্পনীয় রকমের বৈচিত্র! বিস্মিত হয়ে ডারউইন লিখলেন যে তিনি এত কাছাকাছি, মাত্র ৫০-৬০ মাইল দুরে অবস্থিত দ্বীপগুলো, যাদের একটি থেকে অন্যটিকে খালি চোখে দেখা যায়, যারা একই শীলায় তৈরী, একই জলবায়ুর অধীন, এমনকি যাদের উচ্চতাও এক - তাদের মধ্যে এত ভিন্ন ধরনের বাসিন্দা দেখা যাবে তা স্বপ্নেও আশা করেননি

দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া নানা ধরনের প্রাণীর ফসিলও চোখে পড়েছিলো ডারউইনের। বহুদিন আগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া এইসব প্রাণীদের বৈশিষ্ট্যের সাথে আজকের পৃথিবীর প্রাণীদের বৈশিষ্ট্য তুলনা করে তিনি প্রজাতির স্থায়িত্ব নিয়ে আরও সন্দিহান হয়ে পড়লেন। পৃথিবীর বিভিন্ন ভূতাত্ত্বিক স্তরে কেনো বিভিন্ন ধরনের প্রাণীর ফসিল পাওয়া যাচ্ছে? ভুতাত্ত্বিকভাবে যেমন অপেক্ষাকৃত পুরানো স্তরের উপরে থাকে তার চেয়ে কম পুরানো স্তরটি, ঠিক একইভাবে যে জীব যত প্রাচীন তার ফসিলও পাওয়া যায় ততই প্রাচীন স্তরের মধ্যেই। ডারউইন লক্ষ্য করলেন, কাছাকাছি বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন প্রজাতির প্রানী বা উদ্ভিদের ফসিলগুলোকে সময়ের ধারাবাহিকতায় তৈরি একটির উপরে আরেকটি ভুতাত্ত্বিক স্তরের মধ্যেই শুধু খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। তাহলে কি একটি প্রজাতির থেকে কাছকাছি আরেকটি প্রজাতির উদ্ভব হয়েছে নাকি এধরনের মিলগুলোকে কেবলই কাকতালীয় ঘটনা বলে ধরে নিতে হবে? কিন্তু ফসিল রেকর্ডে তো স্পষ্টভাবেই দেখা যাচ্ছে যে একটি প্রাণী হাজার বছর ধরে টিকে থেকে একসময় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, কোন স্তরেই তার আর কোন ফসিল পাওয়া যাচ্ছে না, কিন্তু ঠিক তার উপরের স্তরেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে খুবই সাদৃশ্যপুর্ণ আরেকটা নতুন ধরনের প্রজাতি।

শুধু দেড়শো বছর আগে ডারউইনের সময়ই নয়, একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে এসেও এখন পর্যন্ত এমন একটি ফসিল পাওয়া যায়নি যা কিনা এই নিয়মের বাইরে পড়েছে। কয়েকদিন আগে, ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরের ১ তারিখে বিবর্তনের বিপক্ষ শক্তির প্রচারনাকে খন্ডন করতে গিয়ে আজকের দিনের বিখ্যাত বিবর্তনবাদী প্রফেসর রিচার্ড ডকিনস বলছেন 7,

".. সত্যি কথা বলতে কি, একটি খাঁটি ফসিলও এখন পর্যন্ত কোন 'ভুল' জায়গায় পাওয়া যায়নি - যা বিবর্তনের ধারাবাহিকতাকে ক্ষুন্ন করতে পারে। যদি এমন কোন 'বেমানান' ফসিল কখনও পাওয়া যেত, তাহলে এক নিমেষেই বিবর্তনতত্ত্বের সলিল সমাধি ঘটতো।..‘
.

একটি বহুল আলোচিত উদাহরণ দেওয়া যাক এ প্রসঙ্গে। উত্তর আমেরিকায় এক্কেবারে নীচের দিকের প্রাচীন স্তরে (প্রায় ৫ কোটি বছর আগের) পাওয়া গেছে খানিকটা ঘোড়ার মত দেখতে Hyracotherium নামক একটি প্রাণী, তারপর বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন সময়ে পাওয়া গেছে Orohippus , Epihippus , Mesohippus , Hipparion, Pliohippus এবং আরও অনেক ধরনের মাঝামাঝি ধরনের ঘোড়ার ফসিল। কিন্তু প্রায় ৫০ লক্ষ বছর আগে এদের একটি প্রজাতি ছাড়া বাকি সবাই বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং এরথেকেই পরবর্তীতে উৎপত্তি হয় আজকের যুগের আধুনিক ঘোড়ার বিভিন্ন প্রজাতি। ডারউইনের সময় এতো ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন স্তরের ফসিল পাওয়া না গেলেও তিনি এর পিছনের সম্ভাব্য কারণটি ঠিকই খুঁজে বের করতে পেরেছিলেন।


চিত্র : ঘোড়ার বিবর্তনের বিভিন্ন স্তর

তিনি এ ধরনের উদাহরণগুলো থেকে ক্রমশঃ সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে থাকেন যে, ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কযুক্ত প্রজাতিরা বিবর্তনের মাধ্যমে একে অন্যকে প্রতিস্থাপিত করেছে। তিনি বলেন, 'সমস্ত ফসিলকে দুভাগে ভাগ করা যায়, হয় তারা বর্তমান কোন গোষ্ঠীর মধ্যে পড়বে, নয় তো তাদের জায়গা হবে দুটি গোষ্ঠির মধ্যের কোন জায়গায়'।

চলবে...


মন্তব্য

হিমু এর ছবি

খুব লাগসই দৈর্ঘ্যের আর্টিকেল। জায়গামতো থেমে গেছেন। এবার পাঠকই আপনাকে গুঁতিয়ে অস্থির করবে।


হাঁটুপানির জলদস্যু

কেমিকেল আলী এর ছবি

অনেক গোছালো ও সুন্দর লেখা, ধন্যবাদ

ভাস্কর এর ছবি

চলুক...


স্বপ্নের মতোন মিলেছি সংশয়ে...সংশয় কাটলেই যেনো মৃত্যু আলিঙ্গন...


স্বপ্নের মতোন মিলেছি সংশয়ে...সংশয় কাটলেই যেনো মৃত্যু আলিঙ্গন...

দিগন্ত এর ছবি

এবারের লেখার দৈর্ঘ্য নিয়ে আশাকরি কেউ আপত্তি জানাবেনা ...


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

বিপ্লব রহমান এর ছবি

বাহ! খুব ভালো। তারপর ?...


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

বন্যা এর ছবি

যাক, সচলের অপটিমাম লেভেলটায় আসা গেল ফাইনালি। এইসব ইতিহাস বা ডারউইনের জাহাজে চড়ে ঘুড়ে বেড়ানোর কাহিনী খুব হাল্কা ভাষায় লেখা গেলেও বিবর্তনের মূল তত্ত্বটা কিন্তু এত সহজ ভাষায় লেখা কঠিন হয়ে যাবে। আশা করি, তখনও আপনাদের ধৈর্য বজায় থাকবে।

বিপ্লব রহমান এর ছবি

এইসব ইতিহাস বা ডারউইনের জাহাজে চড়ে ঘুড়ে বেড়ানোর কাহিনী খুব হাল্কা ভাষায় লেখা গেলেও বিবর্তনের মূল তত্ত্বটা কিন্তু এত সহজ ভাষায় লেখা কঠিন হয়ে যাবে।

হোক কঠিন। দিদি, তবু আপনি সহজ ভাষাতেই লিখবেন প্লিজ। কঠিন কঠিন খটোমটি ভাষা একেবারেই চলবে না, বুঝলেন! হাসি


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

হাসান মোরশেদ এর ছবি

পড়ছি ।
-----------------------------------
মানুষ এখনো বালক,এখনো কেবলি সম্ভাবনা
ফুরোয়নি তার আয়ু

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

আরশাদ রহমান এর ছবি

আমিও পড়লাম!

অমিত আহমেদ এর ছবি

পড়তে একটু দেরিই হয়ে গেল।
লেখা ভাল হয়েছে তা বলাই বাহুল্য।
পরের পর্বে যাচ্ছি এখন।


ভালবাসি, ভালবাসি, ভালবাসি তোমায়!
ব্লগস্পট | ফেসবুক | ইমেইল

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।