‘পিতৃপরিচয় মুছবো বলে শেযাবধি মুছি নিজেকে।’
সমস্ত মৃত্যুই স্বাভাবিক। বিশেষত আমাদের এই পোড়া দেশে, এমন অকল্পনীয় বিতিকিচ্ছিরি আর্থ সামাজিক পরিবেশে, যেখানে বেঁচে থাকাই অস্বাভাবিক, বলা যায় প্রায় অসম্ভব, সেখানে মৃত্যুই একমাত্র নি...‘পিতৃপরিচয় মুছবো বলে শেযাবধি মুছি নিজেকে।’
সমস্ত মৃত্যুই স্বাভাবিক। বিশেষত আমাদের এই পোড়া দেশে, এমন অকল্পনীয় বিতিকিচ্ছিরি আর্থ সামাজিক পরিবেশে, যেখানে বেঁচে থাকাই অস্বাভাবিক, বলা যায় প্রায় অসম্ভব, সেখানে মৃত্যুই একমাত্র নিদারুণ নিয়তি। মৃত্যু দ্রুত এসে পড়ে; কিন্তু বেচেঁ থাকার জন্য প্রয়োজন প্রায় অসাধ্য সাধনের মত, বিদ্রোহের অন্তঃশীল আবেগ। তাই মৃত্যুইচ্ছা যেমন অপ্রয়োজনীয় বিলাস-বাহুল্য, ঠিক তেমনি বাঁচার ইচ্ছা সৃষ্টির অদম্য অনুপ্রেরণা যা অবশেষে কুরে খায় সৃষ্টিকর্তাকে।
আর সৃষ্টির জন্যে এমনি অদম্য অনুপ্রেরণা ছিল সুনীল সাইফুল্লাহর অন্তর্গত রক্তধারায় নিরন্তর সক্রিয়। তার এই জেগে ওঠার প্রক্রিয়া, জীবন, জগৎ ও কর্মের সঙ্গে সংযোগ সেতু ছিল তার কবিতা। যে বয়সে সে মৃত্যুকে বেছে নিল, বলা যায় মৃত্যু তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো, সে বয়সের তুলনায় তার কবিতার সংখ্যা খুব বেশী নয়, তবে একদম কমও নয়; নয় এড়িয়ে যাবার মতো সাধারণ, সাদামাটা শুকনো ঘাসের স্তূপ। তার কবিতা সম্পর্কে যে গূণবাচক শব্দটি অবশ্যই অনিবার্যভাবে ব্যবহার করতে হবে, তা হলো, তার কবিতা একান্ত তার নিজস্ব, তার আপন রক্তগন্ধমাখা। কবিতা, তার সংগ্রামের অঙ্গীকার, বল্লমের ফলা যা তার নিজের দিকেই তাক করা।
তার কবিতা ছিল তার নিজস্ব একদম নিজস্ব, তার একান্ত নিজের বৃত্তে বেঁচে থাকা। এইসব কবিতা কর্মের মধ্যে অন্য কারো, অন্য অগ্রজ কোনো কবির বা কোনো সতীর্থের প্রভাব খুঁজে পাওয়া অসম্ভব যেমন অন্য কোন ব্যক্তিত্বের প্রভাব তার জীবন রচনায় ছিল অকল্পনীয়। এর একটি জঠিল কিন্তু সাধারণ কারণ হয়তো এই যে সে কোন আশ্রয় খুঁজে পায় নি, না কাব্যে না জীবনে। এবং এই কারণেই তার দূর যাত্রা হয়ে পড়েছিল এতো বন্ধুর, বিপদ সংকুল।
পাহাড়ের সরু ধার বেয়ে চলতে গিয়ে, খাদে গড়িয়ে পড়ার ঘটনা, প্রায় অবধারিত। আলো-হাওয়া, আকাশ সুর্যস্তি রক্তে মাংস-মস্তিষ্কে ভাঙনের টানে তোলপাড় ঘটাবেই। তারপরও রয়েছে কতো কানাগলি, রূপকথা, রাজারপুর, হারিয়ে যাওয়া সকাল, অন্তহীন দুপুর-রাত্রি; এমনি মায়াবী ধ্বংসের গহ্বর খুঁড়ে যাত্রাপথ তৈরী এতোই কী সহজ? সে জীবনেই হোক আর কাব্যেই হোক। সাইফুল্লাহ সেই যাত্রার খাদ কেটেছে ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র বুনোট গদ্যধর্মী কাব্যরচনায় যা তার নিজের চলার ও চলার সংগ্রামের মতো নিজস্ব।
‘চুমু নাও ক্ষমাশীল মৃত্তিকা মহাদেশ-/ সামনে ক্রন্দনশীলা পথ’’।
ভালবাসায় যেমন সামান্যতম ফাঁকির আশ্রয় নিয়ে পার পাওয়া যায় না, ঠিক তেমনি ঘটে সৃষ্টি কর্মের ক্ষেত্রে ।সাইফুল্লাহ কখনো ফাঁকির দ্বারস্থ হয় নি যেমন কাব্যের, তেমনি জীবনে। আর কে না জানে, এই ধরনের সততা কতোটা হননকারী। আর্শিতে নিজের মুখোমুখি দাঁড়াবার শক্তি প্রতিনিয়ত কী পরিমান রক্তস্রাব ঘটায়। সাইফুল্লাহ, স্বাভাবিক আত্মশক্তির কারণেই, সততাকে বরণ করে নিয়েছিল অজানা পথের সঙ্গী, বন্ধু ও পথদর্শক হিসেবে; এবং সে জন্যেই তাকে বিনিময়ে দিয়ে যেতে হয়েছেও প্রচুর, শেষ পর্যন্ত নিজেকেই। সে একজন সচেতন কৃষক যে ভাঙনের বিরুদ্ধে লড়তে-লড়তে ভাঙনের জলেই ভেসে যায়, আর তার ফলনকে ঘরে তোলে বা ফলনের স্বাদ উপভোগ করে আমাদের মতোই অন্যেরা।
‘স্বপ্নশরীর, ছোঁবো না কণামাত্র নপুংসক মাটি/ছোঁবো না পরাধীন সুষমা, নগ্ন হয়ে দেখাই রূপান্তরিত জন্মরূপ-/পরান্ন প্রবাসে এই অধিকার’।
মাথার ওপরে চাঁদ বা মেঘ, পায়ের নীচে অনুর্বর তাবু, কর্ষিত ক্ষেত, শরীরে খরার সংবাদবাহী হাওয়া; এইসব স্বদেশের, স্বজাতির, স্বজনের নিজস্ব ইতিহাস নিয়ে
দীর্ঘ পথ পরিক্রমা কখনো আনে ক্লান্তি, পরাজয়ের বোধ বা গ্লানি; তবু চলার দুঃসাহস কিছুতে থামে না। কখনো নিজের চুল ছেঁড়ে নিজে, মাথা ঠোকে পাথরে, নিজের বিরুদ্ধে নিজে চীৎকার করে ওঠে ক্রোধে, আত্ম-উন্মোচনের অসহ্য ক্রন্দনে। সুনীল সাইফুল্লাহর কবিতা ধারণ করেছে, এমনি বিস্ময়কর, কখনো কখনো অনিবার্যভাবে পরস্পর বিরোধী জগৎ, শারীরিক পঙ্গুতায়, অসামর্থও লালিত্যে। সার্থকতা বড়ো কথা নয়; কতোটা সততা ধারণ করতে পেরেছে তার কবিতা, সেটাই বিচার্য, ভেবে দেখার। তার অকাল মৃত্যুর জন্যে দুঃখ নেই, কর্মের অপূর্ণতার কারণে।
‘শ্রেষ্ঠতম উন্মোচন হবে আজ’।
এই উন্মোচন, বেঁচে থাকার জন্যে যে সংগ্রামের প্রয়োজন, তার। আমাদের জন্যে রয়ে গেল, সাইফুল্লাহর কবিতা, মৃত্যুর বিরুদ্ধে তার রুখে দাঁড়াবার অদম্য অনুপ্রেরণা ও প্রয়াস। অনিবার্য কিন্তু স্বাভাবিক ও সাধারণ বলা যায় প্রায় গতানুগতিক ক্ষয় ও মৃত্যুর বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম যতো দীর্ঘজীবী হয় ততোই প্রসারিত হয় আমাদের উত্তরাধিকার। সাইফুল্লাহর মধ্যে এমন একটি সুদীর্ঘ সংগ্রাম ও জাগরণের প্রত্যাশা ও প্রত্যাশার উদ্গম পেয়েও হারালাম। সেখানেই আমাদের দুঃখ ও দুঃখবিনাশী অনুরনণ।
‘ফুটপাতে গলিত সংসার অন্ততঃ স্থিতিহোক সামান্য চলায়/সঞ্চিত হোক কমলাগন্ধ, কচি লেবু পাতায় প্রভাতী সুর্যের সৌরভ।’
দীর্ঘায়ু হোক তারঁ বেঁচে থাকার আত্মধ্বংসী প্রয়াস, তার কবিতা। তার কর্মই বহন করুক তার পিতৃপরিচয়, শোধ করুক তার জন্মঋণ।
মোহাম্মদ রফিক
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন