রেড ইন্ডিয়ান বলে আমরা যাদের চিনি তাদের নেটিভ আমেরিকান বলাই শ্রেয়। ইওরোপিয়দের দখলদারির পূর্বে নেটিভ আমেরিকানদের ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠী উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা জুড়ে বসবাস করত। তাদের বেশিরভাগ জাতিগোষ্ঠী এখন প্রায় বিলুপ্ত এবং ইতিহাসের আড়ালে চলে গেলেও দুটি শক্তিশালী ও মেধাবী জাতি তাদের শৌর্য বীর্যের কথা আজও আমাদের মনে করিয়ে দেয়। তারা হল প্রাচীন ইনকা ও মায়া সভ্যতার রূপকার।
ইনকা সাম্রাজ্য নেটিভ আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে ক্ষমতাশালী সাম্রাজ্য ছিল। মায়া জাতি অপেক্ষাকৃত ছোট্ট পরিসরে বসবাস করলেও তাদের গাণিতিক ও বৈজ্ঞানিক প্রভাব তাদেরকে তখনকার সবচেয়ে উঁচুদরের জাতিগোষ্ঠী হিসেবে আমাদের আজও স্মরণ করিয়ে দেয়। মায়াদের সংস্কৃতি এতটাই সমৃদ্ধ ছিল যে তারা প্রাচীন মিশরীয়দের মত পিরামিড ও দেবমুর্তি নির্মাণ করতে জানত, তারা হায়ারোগ্লিফিকস লিখন পদ্ধতি গণিত ও জোত্যির্বিজ্ঞানে পারদর্শী ছিল। মায়া জাতির ঐতিহ্য প্রায় দু'হাজার বছরের ঐতিহ্য।
ইনকা সাম্রাজ্য 'কেচুয়া' নামক নেটিভ আমেরিকানদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যা ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত প্রায় তিনশ' বছর ধরে রাজত্ব করে গেছে। ইনকা মূলত রহস্যময় সাম্রাজ্য। তাদের কোন লিখিত তথ্য আজ পর্যন্ত আবিস্কৃত হয়নি বলে তাদের সম্বন্ধে আর্কেওলজিক্যাল নিদর্শন থেকে অনুমান করা হয়। তাদের স্থাপত্যশৈলী আধুনিক মানুষকে ততটাই বিস্মিত করে যেমনটা করে মিশরের পিরামিড নির্মানশৈলী। কেচুয়া জাতির শাসকদের মর্যাদা দেবতাতুল্য বলে তাদেরকে ইনকা বলা হত। সূর্যদেবকে তারা ইনতি বলে ডাকত এবং সেই নামের প্রতিনিধিত্ব করত ইনকা শাসকগণ।
ইনকা সাম্রাজ্য একসময় বিস্তৃত ছিল বর্তমান পেরুর কুসকো ভ্যালি থেকে উত্তরে ইকোয়েডর এবং সুদূর দক্ষিণে বলিভিয়া, চিলি এবং আর্জেন্টিনা পর্যন্ত। পেরুর কুসকো ভ্যালিকে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু মনে করা হচ্ছে বর্তমান প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানকে ভিত্তি করে। ইনকাদের সবচেয়ে স্টেট অব দ্য আর্ট নিদর্শন যা আজ পর্যন্ত আবিস্কৃত হয়েছে তা হল মাচু পিচু - সমতল থেকে প্রায় একহাজার আটশ ফুট উপরে এক দুর্গ শহর।
ইনকাদের নির্মাণশৈলী খুবই নিখুঁত এবং সাদামাটা। মিশরীয় ফিরাউনদের মত তাদের সম্রাটগণও ডেমিগড মর্যাদার অধিকারী ছিল। ক্ষমতাধর ইনকা সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যায় স্প্যনিয় দখলদারিদের আক্রমণে ১৫৩২ সালে এবং অনেক পরে তাদের ধ্বংসস্তুপ থেকে ইতিহাসের পাতায় তুলে আনেন একজন উত্তর আমেরিকান এক্সপ্লোরার হায়ার্যাম বিংগাম (Hiram Bingham)। ১৯১১ সালে হায়ার্যাম বিংগাম তার ব্যক্তিগত ভ্রমন অনুসন্ধিৎসা থেকে চলতে চলতে মাচু পিচু দূর্গ নগরী - ইনকাদের শেষ আশ্চর্য নিদর্শন - আবিস্কার করেন। যখন তিনি প্রথম সে জায়গা খুঁজে পান তখন তিনি অনুমান করতে পারেননি যে তিনি একটা মূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু তার সহজাত অনুসন্ধিৎসা তাকে আবার সেখানে ফিরে নিয়ে যায় এবং পরবর্তীকালে পেশাদার প্রত্নতাত্ত্বিকদের সহায়তায় তিনি ইতিহাসের হারিয়ে যাওয়া এই সভ্যতাকে আবিস্কার করেন।
১৫৩২ সালে স্প্যানিশ দখলদার ফ্রান্সিসকো পিজারো তারা দলবল নিয়ে ইনকা সাম্রাজ্যে আক্রমণ করে এবং তাদের সম্রাটসহ সকলকে হত্যা করে। ইনকাদের বন্দুক, কামান জাতীয় আগ্নেয়াস্ত্র ছিলনা বলে তারা সহজেই স্প্যানিশ দখলদারদের হাতে পরাজিত হয়। মাচু পিচু দূর্গ নগরী মেঘাচ্ছন্ন পাহাড়ের মধ্যে অবস্থিত ছিল বলে তা একসময় হারিয়ে যায় মানুষের মন থেকে। সুবিস্তৃত ইনকা সাম্রাজ্য কয়েকজন ইনকা সম্রাটের অধীন ছিল। তারা হলেন টুপাক, ওয়াইনা কাপাক ও পাচাকুটেক। আবিস্কৃত প্রাচীন মাচু পিচু নগরী যা বর্তমানে পেরুর আন্ডিজ পর্বতমালায় অবস্থিত তা মূলত পাচাকুটেক সম্রাটের দূর্গ ও শীতকালিন নগরী ছিল বলে অনুমান করা হয়। আন্ডিজ হিমালয়, আল্পস্ ও রকির মত দক্ষিণ আমেরিকার পর্বতমালা (mountain range)।
ইনকা সভ্যতা সম্বন্ধে এখন পর্যন্ত যা কিছু জানা গেছে তার সবটুকুই বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের উপর ভিত্তি করে অনুমান করা। তাই মাচু পিচু নগরী এখনও এক রহস্যময় নগরী। ইনকাদের কোন লিখিত দলিলাদি পাওয়া যায়নি। তারা তাদের ধনসম্পদের হিসেব রাখত মূলত এক সারি দড়িতে গিট পাকিয়ে। এই এক সারি দড়ির প্রান্তগুলো আবার একটা দড়িতে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এগুলোকে কিপু বলা হত। এভাবে গণনা করার জন্য দড়ির বিভিন্ন গিটের বিভিন্ন অর্থ ছিল বলে মনে করা হত যার অর্থ ইনকা জাতির সাথেই হারিয়ে গেছে। একটা গিট থেকে অপর গিটের দূরত্ব এবং দড়ির রঙ ভিন্ন অর্থবোধক ছিল বলে অনুমান করা হয়।
ইনকা ভাল নির্মাতা গোষ্ঠী ছিল। দূর্গ ও শহরের পাশাপাশি তারা প্রায় ১৪ হাজার মাইল রাস্তা নির্মাণ করেছিল পুরো সাম্রাজ্য জুড়ে। তাদের স্থাপত্যশৈলীও অসাধারণ। মিশরীয়দের মত আজও কেউ বলতে পারে না তারা কীভাবে পাথর কেটে কেটে দেয়াল নির্মাণ করেছিল যা ভূমিকম্প সুরক্ষিত। দেয়াল নির্মাণ করতে গিয়ে পাথর কাটতে গিয়ে তারা আধুনিক কোন যন্ত্রপাতি ব্যবহারের কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এমনকি এত সুবিশাল পাথর এত উঁচুতে তোলার জন্যই বা তারা কী পন্থা ব্যবহার করেছে তাও এক রহস্য। পাথর নিখুঁতভাবে কেটে একের পর এক গেঁথে দেয়া হয়েছে কোনরকম মর্টারমিক্স তথা সিমেন্ট বা মাটি বা চুনের সহায়তা ছাড়াই। সম্পূর্ণ নির্মাণ প্রক্রিয়া তাই কিছু বিশেষজ্ঞের অনুমানভিত্তিক তত্ত্ব ছাড়া এক রহস্যই রয়ে গেছে।
ইনকাদের স্মৃতি ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো রহস্য হয়ে থাকার কারণ তাদের অধিক পরিমানে স্বর্ণ ও রৌপ্যের ব্যবহার। স্প্যানীয় দখলদাররা নেটিভ আমেরিকানদের আক্রমণ ও তাদের দেশ দখল করার কারণ স্বর্ণ ও রৌপ্যের লোভ। সেজন্য মনে করা হয় ইনকাদের স্বর্ণ ও রৌপ্যের ঐতিহ্যই তাদের ধ্বংসের কারণ হয়েছিল। একই কারণে তাদের বিভিন্ন নিদর্শন স্প্যানীয়দের দ্বারা লুট হয়ে যাওয়া ও সেগুলোর স্বর্ণ ও রৌপ্য গলিয়ে ফেলার কারণে ইনকাদের সম্বন্ধে অনুমান করা আরও দূরূহ হয়ে পড়ে।
(চলবে)
মন্তব্য
পড়ে নিলাম। ভালো লাগছে। চলুক।
পড়ছি! পরের পর্ব তাড়াতাড়ি আসুক।
ভালো লাগল। মায়াদের ২১/১২/২০১২ তারিখ সর্ম্পকে বিস্তারিত জানতে চাই।
নেটিভ না লিখে , আমেরিকার আদিবাসী লিখলে খুব ভাল লাগত ।
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...
হুমম...এ কথাটি আমিও বলতে চেয়েছি।
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
পড়ে ভালো লাগলো।
মাচুপিচুর সব জনগণ ঠিক কিভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেলো সে সম্পর্কে একটু আলোকপাত আশা করি। কারণ ঠিক যুদ্ধ করে এই শহর ধ্বংস করা সম্ভব ছিল বলে মনে হয় না।
#ওসিরিস
পরের পর্ব আসুক তাড়াতাড়ি... কবে যে দেখতে যেতে পারব সেই ছোটবেলা থেকে বড় হবার জন্য অপেক্ষা করেছি মাচু পিচু দেখার জন্য, আর এখন অপেক্ষা করছি বড়লোক হবার।
--------------------------------
কাঠবেড়ালি! তুমি মর! তুমি কচু খাও!!
**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।
মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।
জটিলস্য জটিল...তাড়াতাড়ি পরের পর্বগুলা চাই। পড়তে ভাল লাগছে...২/১ টা রেফারেন্স দিলে আরেকটু অসাধারণ হত!
-----------------------------
হতাশাবাদীর হতাশাব্যঞ্জক হতশ্বাস!
-------------------------------------------------------------
জীবন অর্থহীন, শোন হে অর্বাচীন...
ভালো লেখা। পরের পর্বের জন্য অপেক্ষায় থাকলাম।
তবে চলুক!
অনেক ভালো হয়েছে লেখাটা।
পাঠকদের মন্তব্য পেয়ে খুব ভাল লাগল। ইদানিং লেখার সময় পাই কম। পাঠকের ভাল লেগেছে জেনে পরবর্তী লেখাটা দিচ্ছি। অনেকে বলেছেন নেটিভ আমেরিকান না বলে বাঙলা পরিভাষাটা ব্যবহার করতে। আপনাদের মতামত শিরোধার্য। তবুও বলব নেটিভ আমেরিকান কথাটা রাখছি টেকনিক্যাল কারণেই। বর্তমান প্রেক্ষাপটে রেড ইন্ডিয়ান পদবাচ্যের বিপরীতে নেটিভ আমেরিকান কথাটাকে গুরুত্ব দেয়ার উদ্দেশ্যে। আমেরিকা তাদের পূর্বপুরুষের দেশ, তাদের নিজের দেশ। অন্যদের কী বলব!
অপ্রাসঙ্গিক হলেও আমি বলতে চাই কালদের 'ব্ল্যাক' বললে আমার কাছে আপত্তিকর মনে হয় না। কিন্তু তাদের 'আফ্রিকান আমেরিকান' বললে আমার আপত্তি আছে। তাদের যদি আফ্রিকান আমেরিকান বলি তাহলে অন্যদেরও ইওরোপীয়ান আমেরিকান বা এশিয়ান আমেরিকান ইত্যাদি নামে চিহ্নিত করতে চাই।
শিরোনামটা তাই অপরিবর্তিত থাকল। রেড ইন্ডিয়ান কথাটার বাঙলা পরিভাষা আমি কোথাও পাইনি।
মন্তব্যের জন্য সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
ইউটিউব ভিডিও দেখুন
___________________
সহজ কথা যায়না বলা সহজে
বিষয়বস্তু বেশ পছন্দের! ভালো লেগেছে।
একটা কথা বলি। একটু অগোছালো মনে হয়েছে লেখাটা। একটা টাইমলাইন অনুসরন করে লিখলে, অথবা স্থাপত্য, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, এরকম ভাবে লিখলে হয়তো আরেকটু সুখপাঠ্য হতে পারতো হয়তো।
আর হ্যাঁ, একটা ম্যাপ আর কিছু ছবি মনে হয় বেশ জরুরী।
পরের পর্ব পড়বো এখুনি।
নতুন মন্তব্য করুন