কাল সন্ধ্যায় স্টেশনে নেমে যখন সে দেখে কেউ আসেনি বাড়ি থেকে তাকে নিতে তখন কী মনে করে গোপনে সংগ্রহ করা ঠিকানা দেখে অনাদির বাড়িটা দেখতে যায়। হয়তো কৌতুহল মেটাতে, কিংবা বাড়ি গেলে যে বিরক্তিকর অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের পর্বের ভিতর দিয়ে তাকে যেতে হবে বলে তার মনে হচ্ছিলো সেটাকে যতোটা সম্ভব দূরে ঠেলতে। অন্তত এটুকু বলা যায় কোন প্রত্যাশা ছিলো না, যা ঘটার প্রত্যাশা থাকলেও থাকতে পারতো তা অবশ্য ঘটেও নাই এবং এখন বোঝা যায় তা ঘটার কোন সম্ভাবনাও ছিলো না। প্রত্যাশাহীন এইসব ঘোরাঘুরিতে তার বেশ দেরী হয়ে যায়, ফলে শেষ পর্যন্ত সে যখন যমুনার মাঠে পা বাড়ায় তখন রাত।
বাড়ি থেকে কেউ না আসায় সে অবাক হয় নি। একটা ক্ষীণ আশা ছিলো যে ছেলে রাতে একা একা যমুনার মাঠ দিয়ে আসবে এটা ভেবে মা অন্তত গোপনে কাউকে পাঠাবে, কিন্তু তা আর হয়ে ওঠে নি দেখা যায়। অবনি ঠিক বুঝতে পারে না পুত্রবধুর সাথে মনোমালিন্য বাবা-মা’র কাছে কার গুরুত্ব বেশী কমিয়েছে- তার নাকি যমুনার বরের! লোকে বলে যমুনার মাঠে যমুনার বর ভুত হয়ে ঘোরে। মাঠের ভিতর দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তায় নেমে অবনি মনে মনে ঠিক করার চেষ্টা করে কোনটা বেশী অনভিপ্রেত, এই হাস্যকরভাবে মারা যাওয়া নাকি এই ভৌতিক গুজব হয়ে বেঁচে থাকা। শত বছর ধরে বহু হাস্যরসের যোগান দিয়ে চলা গল্পটা তার ঠোঁটে বরাবরের মতো গতরাতেও হাসি এনে দেয়। যমুনার বর কাজ করছিলো মাঠে। দুপুর রোদে তৃষ্ণায় বুক শুকিয়ে কাঠ, অথচ বউএর দেখা নেই। অনেক পর দেখা যায় দূরে যমুনাকে, আসছে ভাত আর জলের ঘড়া নিয়ে। জলের জন্য অস্থির হয়ে ছোটে সে বউএর দিকে, খেয়াল নেই হাতে রয়ে গেছে তখনো গরু চড়ানোর লাঠি। অন্যদিকে বরের পিটুনি খেয়ে অভ্যস্ত যমুনা ভাবে বর আসছে লাঠি দিয়ে পিটতে দেরী করার জন্য। সে দেয় উল্টা দিকে দৌড়। কিছুক্ষণ দৌড়াদৌড়ির পর হাত থেকে পড়ে জলের ঘড়া যায় ভেঙ্গে। সেই দ্রুত শুকিয়ে আসা ভেজা মাটির পর মুখ রেখেই বরের মৃত্যু। সবচেয়ে বড় ট্রাজেডী বোধহয় এই যে মরে যেয়ে, এমনকী ভুত হয়েও, সে নিজের নাম কাউকে মনে রাখাতে পারে নি। এই মাঠের নাম যমুনার মাঠ তো বটেই, তার ভুতের নামও যমুনার বরের ভুত।
যমুনার বরের ভয় অবশ্য অবনির নেই। যদি কোনদিন একটু থেকেও থাকে তা দূর করে দিয়েছিলো সুরসী, ষোড়শীবালা। এই মাঠ, মাঠের ভিতর দিয়ে যাওয়া পথ এবং এসবের পর নেমে আসা রাত্রি মানেই যেনো সুরসী। আগে সে শুধু চিনতো এই শহর থেকে তাদের গ্রামে চলে যাওয়া রাস্তাটা, সুরসী তাকে চিনিয়েছিলো আশেপাশের জমি। তারা অমাবস্যার অন্ধকারেও জানতো কোথায় আছে নরম ঘাস আর কোথায় আছে সূর্যের তাপে ফাটা মাটি। সুরসীদের বাড়িতে তার যাওয়ার উপায় ছিলো না। কলকাতায় তার লাম্পট্যের ইতিহাস সামান্য একটু রঞ্জিত হয়ে তখন গ্রামের মানুষের মুখে মুখে। সুরসীর বাবা তার ছোটবেলার মাস্টার, একটু লজ্জা তো করেই। সুরসী আসতো রাতে। কীভাবে আসতো অবনি জানে না কিন্তু অবনি বাড়ি থাকলে নিয়মিতই আসতো যমুনার বরের ভয়ে জনশূন্য যমুনার মাঠে। সুরসীর মুখেই অবনি শুনতো তাকে নিয়ে গ্রামে চলা কেচ্ছাকাহিনী। শুনে শুনে যেটা সত্যি সেটা স্বীকার করে বাকিগুলোকে বাতিল করতো। অকপট দোষ স্বীকার আর সেই সাথে পরবর্তীতে এমন না করার প্রতিশ্রুতি বেশীরভাগ সময়েই একটা লম্বা সময় ধরে কাজ করে, তখনোও করতো। বলা যায় অবাস্তব ছিলো সেসব রাত্রি। কলকাতার বিরামহীন লাম্পট্যের দিনে নানারকম বিছানায় অভ্যস্ত অবনীর কাছেও এই নরম ঘাসের স্বাদ একেবারে নতুন তো ছিলোই, নতুন ছিলো এক গ্রাম্য মেয়েকে অবলীলায় শাড়ি খুলে এক জায়গায় ভাঁজ করে রাখতে দেখা যাতে ধুলা না লাগে।
অবনি সুরসীকে জিজ্ঞাসা করেছিলো এক রাতে, ‘তুই কবে সত্যি সত্যি ষোড়শী হবি বলতো?’
-তুমি জানো না? হয়ে গেছি তো বছরখানেক আগে।
-ওমা, বিয়ে করবি না?
-আত্মীয়স্বজন বাবাকে খোঁচাচ্ছে সেই কবে থেকে, এবার মনে হচ্ছে বাবার কানে গেছে।
-আমকে বিয়ে করবি?
-তা তো হবে না, তার থেকে চলো পালিয়ে যাই কলকাতায়, নাহলে আরো দূরে। ওখানকার লোকরা তো আমাদের চেনে না, বললেই হবে আমরা বর-বউ।
সুরসী জানতো বিয়ে নয়, তাদের নিয়তিতে যদি কিছু থাকে তবে এই পালানোই। এই কাল রাত্রেও বিমূঢ় অবনি মাটি থেকে উঠে বসতে না বসতেই তাকে দুঃসংবাদটা দিয়েই সুরসী যে আবার শুরু করার কথা বলেছিলো কিংবা বলতে যাচ্ছিলো, সেই শুরু করাও সম্ভব হলে শুরু হতো পালানো দিয়েই। কিন্তু সদ্য আঘাত পাওয়া ঠোঁটের যন্ত্রনা, কেবল পাওয়া দুঃসংবাদ আর শেষ কথাটার খোঁচা, সব মিলিয়ে সুরসীকে এক অতিপ্রাকৃত ডাইনি বলে মনে হচ্ছিলো তার কাছে। যেনো বাড়িতে যাওয়া বলে নয়, সুরসীকে ভয় পেয়েই সুরসীর কথা অবিশ্বাস করার পরেও ছুটেছিলো বাড়ির দিকে।
অবনির উচিৎ হয় নি সুরসীকে অবিশ্বাস করা। এখন দিনের আলোতে শিউরে ওঠে অবনি, ভাগ্যিস সুরসী পিছে পিছে এসেছিলো। আসলে কাল রাত ছিলো সব সম্ভবের রাত। না হলে অবনি কি স্বপ্নেও ভেবেছিলো যমুনার মাঠে পুরনো দিনের মতো পাওয়া যাবে সুরসীকে, বলবে, ‘দাঁড়িয়ে আছি তোমার জন্য’। ‘কিভাবে জানলি আমি আসছি?’ এ প্রশ্ন আর করা হয়ে ওঠেনি। স্মৃতি যখন এরকম অসম্ভব ভাবে আবার বর্তমান হয়ে ওঠে তখন কোন প্রশ্ন আর মনে আসে না একেবারে।
প্রথম চুমুটার পর সুরসী বলেছিলো, ‘আমি কি আগের মতোই আছি? নাকি অন্যপুরুষে বদলে গেছি অন্যভাবে?’ এসব খোঁচা আসাটাও স্বাভাবিক। এরকম একটা রাত শুধু স্বপ্ন আনবে তা তো হতে পারে না, আর এসব কথার খোঁচাও তো স্বপ্নই, শুধু দুঃস্বপ্নটাই যদি না আসতো শেষে!
অবনি নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলো। বলেছিলো, ‘কী করতে পারতাম আমি?’
-চিঠি পেয়েছিলে আমার?
-হ্যাঁ, কিন্তু কীভাবে-
-তাইতো, কীভাবে কায়স্থ হয়ে একটা নাপিতের মেয়েকে ঘরে নেওয়া যায়, তাকে নেবার জন্য তো আছে যমুনার মাঠ!
-তুই তো ভালোই আছিস, ভালো ছেলের সাথে-
-আচ্ছা! আমার চিঠির একটা কথাই শুধু ভালো লেগেছিলো তোমার, না? আমার বরের টাকার কথা? পড়েই একেবারে দায়মুক্ত হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে। ভাবলে, যাক, আমিও জিতলাম, সুরসীও জিতলো। মুখটা একটু কাছে আনো তো দেখি, আমার থুথু অতদূর যায় না।
অবনি কি চেষ্টা করে নি একেবারে? বাবা শিউরে ঊঠেছিলো শুনে, বলেছিলো, ‘এক পুরুষ মাস্টারি করে ওরা কি নাপিত থেকে কায়স্থ হয়ে ওঠার সাধ করে? আর সে মেয়েও তো এমন কোন রাজরানী না দেখতে। আছে কী তার? শুধু একটা বাহারি নাম’। যমুনার মাঠের গল্প আর যাই হোক বাবাকে যায় না বলা তাই কী আছে ‘সে মেয়ের’ বোঝানো হয় না তা। শুধু হঠাৎ করেই এই তিক্ত উপলব্ধি হয় যে প্রায় পুরো প্রাপ্তবয়স্কজীবন বাবাকে অগ্রাহ্য করে আসলেও এবার আর তা পারবে না। বাবা বিরক্তিকর মূল্যহীন হলেও বাবার সম্পত্তি তা না। তার পরেও আশা হয়তো থাকতো, হয়তো সে কাটিয়ে উঠতো সম্পত্তির লোভ, কিন্তু সে সময় আর পাওয়া গেলো না। পরদিনই বাবা ছুটলো সুরসীদের বাড়ি তাদের সাহসের পরিমাপ করতে। সব শোনার আগেই স্তম্ভিত সুরসীর বাবা, ‘আপনার ছেলেতো নামকরা লম্পট। তার সাথে আমার মেয়ে... কী সর্বনাশ!’
ফলশ্রুতিতে সুরসী নিখোঁজ হলো একদিন পর থেকেই, অন্তত অবনির জীবন থেকে গতরাতের আগ পর্যন্ত। হ্যাঁ, চিঠি একটা এসেছিলো বটে মাস ছয়েক পর। সে চিঠিতে ছিলো পরিস্থিতির বিস্তারিত বর্ণনা, ছিলো মিনতি, ছিলো অনুরোধ, ছিলো পরিকল্পনা। স্বীকার করতে হয় পরিকল্পনাটাও ছিলো বেশ ভালো। বিশেষ করে সুরসীদের যে এতো গয়না আছে তা অবনি ধারনাও করতে পারে নি কোনদিন। কিন্তু অবনির বাপও তো বসে ছিলো না এদ্দিন! গিট্টু সে লাগিয়েছে আগেই। তার ঠিক করা অবনির হবু শ্বশুরেরও কৃপণ বলে কোন দুর্নাম নেই। অবনি বারবার চিঠি পড়ে, নিজের পরিস্থিতি- বিশেষ করে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে এই বলে নিজেরে বুঝ দিলো যে, যাক আশাতীত ভালো ছেলের সাথে বিয়ে হচ্ছে সুরসীর।
কিন্তু এসব বললে কাজ হবে না জানতো অবনি। অভিজ্ঞতা থেকে সে জানে অজুহাত দেওয়া নয়, সুরসীর কাছে এখন বাধ্য হওয়ার সময়- সে মুখটাই আগিয়ে দিলো। এর ফলে পাওয়া রাতের দ্বিতীয় চুমুটাও ছিলো প্রত্যাশিত, এতো রাতে ঝুঁকি নিয়ে সুরসী নিশ্চয় শুধু ঝগড়া করার জন্য যমুনার মাঠে দাঁড়িয়ে নেই। প্রত্যাশিত ছিলো হাতের স্পর্শের সংকেতে হাঁটু গেড়ে নীচু হয়ে বসার নির্দেশও। শুধু তার পরে যখন সে সুরসীরও নিচু হওয়ার অপেক্ষায়, তখন পর্যাপ্ত আলোর অভাবে তার কিঞ্চিৎ পিছিয়ে যাওয়াটা খেয়াল করতে না পারায় মুখের পর লাথিটা এসে পরে অপ্রত্যাশিতভাবে হঠাৎ।
মুখে নিজের রক্তের স্বাদ আর মগজে না-ক্রোধ, না-বিষ্ময়, না-ব্যথা এইরকম এক অনুভুতি কিংবা ঐ তিনটা মিশিয়ে বানানো এক অনুভুতি নিয়ে সে উঠে বসতে না বসতেই সুরসী তাকে দুঃসংবাদটা দেয়, যেনো এও এক প্রতিযোগীতা, তাকে স্বর্গে তুলে দ্রুততম সময়ে পাতালের অতলে তলিয়ে দেওয়া।
-বাড়ির সবার কলেরা? তুই... তুই এতোক্ষণ বলিসনি ক্যান?
-এটা তোমার কাছে দুঃসংবাদ নাকি? তোমার ভালো লাগছে না? সম্পত্তি তোমার ভাগেরটুকু তো পাচ্ছোই, তোমার ছোট ভাইয়েরটুকুও পাচ্ছো, সেও পড়েছে কলেরায়। শোনো, ঐ লাথিতে অনেক কিছু শোধবোধ হয়ে গেছে... ধরো সবকিছু শোধ হয়ে গেছে। তোমার বাবার চোখ রাঙানি থাকছে না, এতো সম্পত্তি সব তোমার, আমরা আবার...
-তুই... তুই একটা...
-হিহিহি... ভালো লাগছে না সত্যিই? আচ্ছা, আচ্ছা, ঠিক আছে, তাহলে আর দেরী কিসের? যাও তবে ডাক্তারের কাছে। তাড়াতাড়ি যাও, খুব তাড়াতাড়ি। ঠিকানা তো জানোই, নাকি? হিহিহি...
অবনি বিশ্বাস করে না কিছু, মনে হয় সব ফাজলামি, প্রতিশোধ নিতে উদ্ভট রসিকতা। উঠে পড়ে বাড়ির দিকে দৌড় দেয় সে। শুনতে পায় পেছনে সুরসী চিৎকার করে, ‘আগে বাড়িতে যেয়ো না, ডাক্তারের কাছে যাও, ডাক্তারের কাছে। সব মরে যাবে, ডাক্তারের কাছে যাও’।
বাড়িতে যেয়ে বারান্দায় উঠতে গিয়েই সে বমিতে পা পিছলিয়ে আছাড় খায়। উঠে ভালো করে ঠাহর করে দেখে বারান্দায় তিনটা দেহ নিঃসাড় পড়ে। শুধু যেনো পরিচয়হীন তিনটা দেহই, আর কিছু না। চারদিক প্রায় আলোহীন আধাঁর তো বটেই, যমুনার মাঠের বতাস না আসতে পারায় শব্দহীনও যেনোবা। এতোই ভীতিকর সে নিঃস্তব্ধতা যে প্রথমে মনে হয় মারাই গেছে সব। তারপর, তার পায়ের শব্দেই হবে হয়তো, একটা মাথা একটু উঁচু হয় আর সে তার বাবার কন্ঠস্বর শুনতে পায়, ‘অবনি... আইছিস বাবা... কাছে আয় বাবা, কাছে আয়’। আর একটা দেহ একটু পাশ ফেরে (সত্যিই কি?), তার মায়ের কাতরানি বেরিয়ে আসে সেখান থেকে।
সেই দুর্গন্ধময় হতবুদ্ধিকর আধাঁরে সে যখন নিজেই চলৎশক্তিহীন, বুঝতে পারে পিছনে সুরসী এসে দাঁড়িয়েছে। সুরসী তার কাঁধে হাত রাখে, বলে, ‘যাও ডাক্তার নিয়ে আসো, এক্ষুনি যাও’। অবনি উঠে দাঁড়ায় কিন্তু তার বাবা তাকে বাঁধা দেয়। ‘ঐ ডাইনির কথা শুনিস না অবনি। মরে যাচ্ছি রে বাবা, আমার কাছে বস। ভগবানই তোরে পাঠায়েছে, আমার কাছে বস’। সুরসী যেনো কণ্ঠ দিয়েই অবনির শরীরে ঝাঁকি দেয়, ‘বুঝতেছো না তুমি সবাই মারা যাচ্ছে? দাঁড়িয়ে আছো কেনো, তাড়াতাড়ি যাও’। অবনি শেষে দৌড় দেয় গ্রামের পথ দিয়ে যমুনার মাঠের দিকে। শেষ মূহুর্ত্তে প্রায় অমানুষিক শক্তিতে অবনির বাবা চিৎকার করে উঠে বসতে চায় কিন্তু পেরে ওঠে না, কিংবা কে জানে, হয়তো সুরসীর উপস্থিতিই তাকে আবার শুয়ে পড়তে বাধ্য করে।
ফিরতি তিন মাইল পথ মাঠের ভিতর দিয়ে কীভাবে এসেছে বলতে পারবে না অবনি। ডাক্তারের বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়িয়ে একবার মনে হয় না আসায় ভালো ছিলো। ফিরে যেয়ে আর কাউকে জীবিত দেখতে পাবে সে আশা আর করে না সে। কিন্তু এসে যখন পড়েছেই তখন ডাক্তার নিয়েই সে ফিরবে। এখন দেখা না গেলেও অবনি জানে বাড়িটার দরোজায় বেশ বড় বড় করে নাম লেখা আছে- ডাঃ অনাদি শীল। সে প্রাণপণে কড়া নাড়তে থাকে।
হারিকেন হাতে দরোজা খুলে দেয় অনাদি। এরকম রাতবিরাতে কড়া নাড়ার শব্দ শুনে সে অভ্যস্ত। প্রথমেই অবনির মুখটা দেখে বলে, ‘আপনার ঠোঁটতো দেখি বিশ্রীভাবে কেটে গেছে। গুন্ডায় ধরেছিলো বুঝি?’
হাপাতে হাপাতে অবনি উত্তর দেয়, ‘না, গুন্ডা না, ও এমন কিছু না। তাড়াতাড়ি চলেন আমার সাথে। আমার খুব বিপদ, আমাদের বাড়ির সবার কলেরা’।
-আবারও কলেরা! কোন গ্রামে বাড়ি আপনার?
-নৃসিংহপুর।
-নৃসিংহপুর! মাঝরাতে ইয়ার্কি? জানেন নৃসিংহপুর আমার শ্বশুরবাড়ি?
-জানি, জানি। আপনার স্ত্রীই পাঠিয়েছে আমাকে।
-আমার স্ত্রী! কী নাম আপনার?
-অবনি।
-অবনি রায়?
অবনি মাথা ঝাকাতেই অনাদি হারিকেন পাশে রেখে তার জামা চেপে ধরে, বলে, ‘সুরসী কোথায়?’ অবনি অবাক হয়ে জবাব দেয়, ‘কেনো নৃসিংহপুর! আপনার শ্বশুরবাড়ি। জানেন না আপনি?’ ঘুষিটা তার পরেই আসে। পরবর্তী দু-এক মিনিট ঘুষির কারনেই হোক আর পরিস্থিতি উদ্ভটত্বে মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়াতেই হোক অবনি জ্ঞান হারিয়ে থাকে।
জ্ঞান ফিরে উঠে বসার পর প্রথমে তার মনে হয় আশেপাশে অনাদি নেই। একটু পরেই অবশ্য অনাদিকে দেখা যায় এক টুকরো কাগজ নিয়ে ঘরে ঢুকতে। কাগজটা অবনির হাতে দিয়ে আবার জিজ্ঞেস করে সুরসী কি কলকাতায় রয়ে গেছে নাকি তার সাথে এসেছে। এ প্রশ্নের কী জবাব দেবে বুঝতে না পেরে অবনি কাগজটা পড়ে, দেখে সেটা সুরসীর চিঠি। চিঠিতে অনাদিকে বিদায় জানিয়ে কলকাতায় অবনির কাছে যাচ্ছে বলে লিখেছে। এইবার যেনো একটু আলো দেখতে পায় অবনি।
-আপনাকে ফাঁকি দিয়েছে। আর এভাবে বলে কয়ে কেউ প্রেমিকের কাছে... মানে ঘর ছাড়ে নাকি? কলকাতায় যায় নি সে। নৃসিংহপুরে আছে। আমি দেখে এসেছি।
-নৃসিংহপুর কেনো যাবে? সেখানে তো কেউ... কলেরার কথা কী বলছিলেন?
-আমার বাড়িতে সবার কলেরা, আপনি তাড়াতাড়ি না গেলে...
-আপনি জানেন না নৃসিংহপুর কলেরায় উচ্ছেদ হয়ে গেছে মাসখানেক আগে? যে দু-এক জন বেঁচে আছে তারা তো আর কেউ এখন নৃসিংহপুর থাকে না।
প্রথমে অবনি কথাগুলো বুঝতেই পারে না, এরপর বুঝতে পারলে সে অনাদির ভুল ভাঙ্গাতে যায় কিন্তু হঠাৎ তার মনে হয় এই অদ্ভুত রাতে কেউই বোধহয় ঠিক ভাবে কোন কিছু বুঝে উঠতে পারবে না তাই সে সেই চেষ্টা বাদ দিয়ে অনাদির কাছে ভোর পর্যন্ত থাকার অনুমতি প্রার্থনা করে, কারণ তার পক্ষে আর এই রাতে যমুনার মাঠে সুরসীর সাথে দেখা হয়ে যাবার ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব না।
পরদিন সকালে তারা দু’জন, অবনি আর অনাদি, বোধহয় সুরসীকে খোঁজার জন্যই, যমুনার মাঠে এসে দাঁড়ায়। অবনি বুঝতে পারে অনাদিই ঠিক, যমুনার মাঠের ভিতর নৃসিংহপুর গ্রাম তার মুমূর্ষু জনশুন্য ঘরবাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কিছু না বলে অবনি হঠাৎ ফিরতি পথ ধরে। পেছন থেকে অনাদি চেঁচায়, ‘ও মশাই চললেন যে বড়ো? খুঁজবেন না সুরসীকে?’ ফিরে না তাকিয়েই মাথা নাড়ায় অবনি। সে জানে খুঁজে লাভ নেই, কারণ নৃসিংহপুরে না- সুরসী আসলে নিখোঁজ হয়ে গেছে যমুনার মাঠে।
ব্রুনো
মন্তব্য
গল্পের উপস্থাপনাটা চমৎকার লেগেছে।
যদিও অনেকদিন পরে বাড়ি ফেরা লোকের সাথে কিছুকাল আগে মরে যাওয়া মানুষের ভুতের দেখা হওয়া তারপর, জানা যে সবাই আগেই বিদায় হয়ে গিয়েছে -এটা অনেক পুরোনো স্ট্রাকচার; তবুও আপনার উপস্থাপনাটা এত ভালো লেগেছে যে শেষ পর্যন্ত মনযোগ আটকে রেখেছিল। আবার, সবকিছু হ্যালুসিনেশন হলেও লাথিতে ঠোঁট কেটে যাবার ঘটনাটার (প্রাকৃত) ব্যাখ্যাই বা কি?
আরো, আরো লিখবেন।
শুভেচ্ছা
হ্যাঁ। আমি চেষ্টা করেছি যাতে গল্পে এই ব্যাপারটা মাইনর হয়ে থাকে, যাতে পাঠকের মনে না হয়- ও আচ্ছা, এই ক্লিশে ট্যুইস্টের জন্যই গল্পটা লেখা। এইজন্যেই অনাদির কাছে প্রথম শোনার পরে দেখবেন অবনির প্রতিক্রিয়া অনেক কম নাটকীয় ছিলো এবং সেটা শোনার পরপরই গল্প শেষ হয়ে যায় নি।
এই ব্যাপারটা যা ভেবে আমি গল্পে এনেছিলাম তা ভাষায় প্রকাশ করা দেখা যাচ্ছে একটু কঠিন হয়ে যাচ্ছে তাই কিছু কথা রাখতেছি গুপন ।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
ব্রুনো, ভাল লেখেন যাঁরা- মনে রাখবেন, পাঠকেরা তাঁদের লেখার জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। সে অপেক্ষা করানোটাও এক ধরণের পাপ!
ফিরে এলে, তাই
তবে আপনার চমৎকার শেষ চমকের অপেক্ষায় ছিলাম, সেই ধাক্কাটা এবার দিতে পারেননি কিন্তু
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
একবছর পরেও মনে রাখার জন্য কৃতজ্ঞ।
অসাধারণ! স্রেফ অসাধারণ! অনেকদিন পর এমন টান-টান একটা বাংলা গল্প পড়লাম। ট্যাগে আপনার নামটা রেখে ভালো করেছেন। এখন আগের গল্পগুলোও পড়ে আসি।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
ট্যাগে আমার নামটা দেওয়ার উদ্দেশ্য অনেকটা ওরকমই ছিলো, যাতে লেখাগুলো চাইলেই খুঁজে পেতে পারি।
একদিনে আপনাকে চারবার দেওয়া হচ্ছে :D। আশা করি আপনি খুব বেশী খাটো হয়ে যান নি!
দারুন লাগল
ইসরাত
লেখা খুব তরতর করে এগিয়েছে। একটানা পড়েছি। মুস্কিল হচ্ছে, ভুত-প্রেত-দত্যি-দানা কি ভ্যাম্পায়ার-অয়ারউল্ফ ইত্যাদির গল্প চেনা-জানা ছক-এর বাইরে বানান অত্যন্ত কঠিন কাজ। গল্প-র মধ্য দিয়ে অন্য বার্তা দিতে চাইলে সেটা অন্য কথা। কিন্তু বিশুদ্ধ গা-ছম-ছমে গল্প বানান খুব-ই সমস্যা।
আপনার সব কটি লেখা পড়ে এলাম। ভাল লাগল। পরের লেখার অপেক্ষায় থাকলাম।
- একলহমা
সেটাই, হরর হতেই হবে এরকম কোন কথা নেই, ফ্রেম হিসেবেও ব্যবহার করা যায়।
অনেক ধন্যবাদ।
সুন্দর লিখছেন। ১ বছর ৩ মাস কই ছিলেন ভাই। আরো ঘন ঘন লেখা দেন।
আমি এখানেই ছিলাম শুধু গল্পেরা ছিলো না
চেষ্টা করবো ঘন ঘন লেখা দেওয়ার। পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
ভাইরে, আপনার লেখার হাত সেই রকমের। থাইমেন না।
=======================
কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;
অনেক অনেক
ভালো
অবনি আর অনাদি খুব কাছাকাছি নাম। আরেকটু দুরবর্তি হতে পারতো।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
আমি আবার ইচ্ছে করেই একটু কাছাকাছি নাম দিলাম
আসলে অনাদিকে আর একটু বিস্তারিত করার ইচ্ছা ছিলো, পরে মনে হলো ক্যানভাস হুদাই বড় হয়ে যাচ্ছে। ধন্যবাদ পড়ার জন্য।
বাহ!
~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
দারুণ লেগেছে। এই প্রথম আপনার লেখা পড়া হলো।
অনেক শুভকামনা আপনার জন্য, আপনার লেখার জন্য।
-------------------------------
কামরুজ্জামান পলাশ
ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।
দারুণ!
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
____________________________________________________________________________________
তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।
নতুন মন্তব্য করুন