বুয়েটের সাথে কাগজে-কলমে সম্পর্কচ্ছেদের আয়োজন চলছে। আইনী প্রক্রিয়াটি বেশ সময়সাপেক্ষ। আপাতত সাময়িক তালাকনামার আশায় সকাল-সন্ধ্যা ধর্না দিতে হচ্ছে বুয়েটাদালতে। সকাল ১০ টার দিকে হয় হল, নয়তো ব্যাংক অথবা ই এম ই। সকালের অধিবেশনের পাট চুকে যায় ১১ টার মধ্যেই। বাড়ি ফেরার তাড়া থাকেনা। চাকুরিদাতারা এখনো আমাকে খুঁজে পাননি, তাই তাদের সময় দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। বুয়েট, টি এস সি কিংবা ডি এম সি হলে বসে আড্ডাবাজি চলে। অথবা হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে হাজির হই তক্ষশীলায়। কাছে পিঠে কোন চাকুরে বন্ধুর অফিস থাকলে সময় করে আমার বেকার বদনের একখান বেহায়া হাসিও ছুঁড়ে দিয়ে আসি মাঝে মধ্যে। খেয়ে না খেয়ে সাড়ে তিনটা বাজিয়ে হানা দিই বুয়েটের পরীক্ষাভবনে। সেখান থেকে আগামী দিনের দৌড়ঝাঁপের রুটিন জেনে নিয়ে বাড়িমুখী হই। যতক্ষণ তেল থাকে হাঁটতে থাকি, তেল ফুরোলেই বাসে ঝুলে পড়ি। বাড়ি ফিরে সচলায়তন, ফেসবুক, বি ডি জবস।
এভাবেই চালাচ্ছি বেশ কিছুদিন।
মাঝে মহাস্থানগড় দেখতে গিয়েছিলাম বগুড়া। চারদিনের শীতে জমাট বাঁধা শরীরটাকে তাঁতিয়ে নিতে সময় লাগলো ২৪ ঘন্টা। ১৪ তারিখ সকালে মনে হল আবারো রুটিনমুখী হওয়া উচিত।
শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবস।বুয়েটে গিয়ে আদৌ কাউকে পাব কিনা জানিনা। তাতে কী? ঢাকা তো আর বন্ধ নাই। কোথাও না কোথাও কাউকে না কাউকে তো পাবই। কম্বলের ওম থেকে নিজেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে গড়িয়ে গড়িয়ে বুয়েট পৌঁছুলাম। সৌভাগ্যক্রমে একজন সহৃদয় স্যারকে পেয়েও গেলাম যিনি নাক মুখ কুঁচকে আমার এস এস সি সার্টিফিকেট, ছবি এবং প্রথম কিস্তির ফর্মখানা সত্যায়িত করে দিলেন। এরপর পুরনো নিয়মে তা না না করে পাঁচটা বাজিয়ে, পলাশীতে এক প্লেট বাংলা নুডুলস গিলে বাড়িমুখী হলাম।
পলাশী থেকে নীলক্ষেত যাবার পথে দেয়াল জুড়ে ব্যানার লেখা চলছে।
“আজ বিজয়ের দিনে আমরা রক্ত স্বপথ নিলাম…”
“মামা, শপথ বানান ভুল। তালব্য স হবে।” মামা একটু বিব্রতভঙ্গিতে হেসে তার সহকারীকে ঝাড়ি দেন, “কইসিলাম না, শ হইব?”
এ বছরের মার্চে হয়তো বা শেষবার ব্যবহার করেছিলেন তিনি শব্দটি। অনভ্যাসে বানানে ঝুল-কালি পড়তেই পারে।
আমি এগুতে থাকি। ফেরি করে পতাকা বিক্রি হচ্ছে। ছোট, বড়, মাঝারি পতাকা।
এক বৃদ্ধ পতাকা বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করি, “সব পতাকা বিক্রি হয়ে গেলে পরে কী করবেন?”
“বাড়ি চইলা যামু।”
মৌসুমি পতাকাবুড়োকে বিদায় জানিয়ে আমি নিউমার্কেট ঘেঁষে এগুতে থাকি।
ঢাকা কলেজ, সায়েন্স ল্যাবের মোড় পার হয়ে আলিয়াঁজ ফ্রান্সেসে পৌঁছে একটা ব্যানারে চোখ আটকে যায়। ফটোগ্রাফি কোর্স। করব নাকি? ভেতরে ঢুঁ মেরে সুল্লুক সন্ধান করি। ফিসের অঙ্ক দেখে মাঝারি তাপমাত্রার ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ওদের এসি অফিসে ফেলে রেখে বেরিয়ে আসি।
এখান থেকে শুরু ফ্যাশান হাউস আর বুটিকগুলো। লাল-সবুজ, লাল-সবুজ, লাল-সবুজ। মাঝে দু’এক ফোঁটা হলুদ। লাল-সবুজ আর হলুদের অভিনব কম্পোজিশান দেখতে দেখতে পৌঁছাই ধানমন্ডি এলাকায়। কাছে পিঠে এক বান্ধবীর বাসা। ওর আম্মু ভীষণ আচার বিলাসী। এ এলাকায় আসলেই আমার আবার আমসত্ত্ব খেতে ইচ্ছে করে। কল দিয়ে জানতে চাইলাম বাসায় আছে কিনা। নাই। অফিসে। ২৭ নম্বরের কোন এক শপিং কমপ্লেক্সের দোতলার এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের খন্ডকালীন অধ্যাপিকা সে। আমাকে সেখানে যেতে বলে। অনেকদিন দেখা হয়না।২৭ নম্বরের দিকে হাঁটা দিই আমি।
সোবহানবাগে আবারো লাল-সবুজের ফ্যাশন প্যারেড।লাল-সবুজ ফতুয়া, শাড়ি আর লুঙ্গি পরে পাথুরে ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে শ্বেতাঙ্গ পুতুল মানব-মানবীরা।
দু’কদম এগিয়েই দেখি আমার বান্ধবী হাসিমুখে আমার পথ চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে সঙ্গে নিয়ে সে নাকি লাল-সবুজ জামা কিনতে যাবে।
“ফুচকা খাব।” অনেক ঘাম ঝরিয়ে এদ্দূর হেঁটে এসেছি। শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই মজুরি দেয়ার নিয়ম।
“আমি ভাবতেসিলাম ট্রেন্ডস এ যাব। দেখি নতুন কিসু আসে কিনা। তুমি কি আগে ট্রেন্ডস এ যাইতে চাও না খাইতে চাও?”
“আমি কোথাও যাইতে চাইনা। আমি শুধু খাইতে চাই।”
এক বোতল মিরিন্ডায় এক প্লেট ফুচকা গুলিয়ে খেয়ে শরীরে শক্তি সঞ্চার করি। উল্টোপথে ট্রেন্ডস পর্যন্ত হেঁটে যেতে ইচ্ছে করেনা আর। ওকে ভুলিয়ে ভালিয়ে মেইন রোডের গা বেয়ে গজিয়ে ওঠা খুচরো বুটিকে নিয়ে যাই। ও সেখানে জুতসই লাল-সবুজ জামা খোঁজে। আমি বুটিকের গোপণ স্পিকার থেকে ভেসে আসা গান শুনি, “এক সাগর রক্তের বিনিময়ে …”
মেয়েটা ভীষণ খুঁতখুঁতে। কোন জামাই পছন্দ হয় না। আমরা এগুতে থাকি। আড়ং এও পছন্দসই কিছু না পেয়ে ওর মন আবারো ট্রেন্ডস এর জন্য কাঁদতে থাকে।
“ওই, চল ট্রেন্ডস এ যাই।”
“অসম্ভব! আমি বাসায় যাব এখন।”
“আমি গাড়ি আনাইতেসি। তোমাকে পৌঁছায় দিবনে।”
“নাহ, যাব না।আমি বাজি ধরসি, ব্যক্তিগত কাজে গাড়ি ব্যবহার করবনা।(এটা সত্যি)”
ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি একটা রিকশা নিই। রিকশার সামনে একটা পতাকা বাঁধা। পতপতিয়ে পতাকা উড়িয়ে বাসায় ফিরি।
সারাদিনের ধুলো-ময়লা ধুয়ে এক কাপ চা হাতে নিয়ে ল্যাপটপ খুলে বসি।
সচলের নতুন ব্যানারটা খুব ভাল্লাগে।
ফেসবুকে দেখি সবার প্রোফাইল পিকচার বদলে যাচ্ছ।।
সবাই দেখতে লাল-সবুজ হয়ে যাচ্ছে একে একে …
মন্তব্য
- বেশ ঝরঝরে লাগলো লেখাটা।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
ধন্যবাদ।
_____________________
আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।
ভালো লাগলো দিনপঞ্জি।
হাঁস কে জানাই বিজয়ের লাল-সবুজ শুভেচ্ছা!
জেনে আমারো ভালো লাগলো।
লাল-সবুজের শুভেচ্ছা আপনাকেও।
_____________________
আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।
সাবলীল লেখা। চালিয়ে যান।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
ধন্যবাদ, ষষ্ঠদা। আপনার মন্তব্যে সাহস পেলাম।
_____________________
আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।
বাঃ, সুন্দর লাগলো আপনার লেখার স্টাইল!
ধন্যবাদ, পাঠকদা।
_____________________
আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...
ধন্যবাদ।
_____________________
আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।
ভালো লাগলো... চলুক
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
আপনার ভালো লাগলো জেনে আমারো ভালো লাগলো।
_____________________
আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।
বানানের ভুলের জন্য (তক্ষশিলা) ক্ষমাপ্রার্থনা করছি। আজ আজিজে গিয়ে তক্ষশিলার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় খেয়াল হল।
_____________________
আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।
খুব সুন্দর করে লিখেছেন। মন ভালো করে দিলেন। শুধু চলুক না, দৌড়াক...
______________________________________
আসলে কি ফেরা যায়?
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না
খুব ভালো লাগলো জেনে। ধন্যবাদ আপনাকে।
_____________________
আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।
খিপিটাপ !!!
বুয়েটে আসলে খাওয়াইতে ভুইলেন্না। কোলন্ডি।
_________________________________________
সেরিওজা
থেঙ্কু। বুয়েটে নাকানিচুবানি খাচ্ছি সাধ মিটিয়ে। বললে ভাগ দিতে পারি।
_____________________
আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।
অনেক ভাল্লাগলো লেখা।
ফেসবুকে প্রোফাইল ছবি বদলে যাচ্ছে ঠিকই...তবে আবারো বদলে যেতে সময় লাগবে না।
__________________________________
যাক না জীবন...যাচ্ছে যখন...নির্ভাবনার(!) নাটাই হাতে...
__________________________________
যাক না জীবন...যাচ্ছে যখন...নির্ভাবনার(!) নাটাই হাতে...
হুম... আফসোস সেখানেই। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
_____________________
আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।
লেখার ভঙ্গিটা দারুণ...শুভেচ্ছা রইলো! --------------------------------------------------
"সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে..."
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
ধন্যবাদ। শুভেচ্ছা আপনাকেও।
_____________________
আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।
নতুন মন্তব্য করুন