প্রতিমা বেদীর জন্ম ১৯৪৯-এ, দিল্লীতে। ষাট আর সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে বোম্বের প্রসিদ্ধ মডেল ছিলেন তিনি। বিয়ে করেছিলেন চলচ্চিত্রাভিনেতা কবির বেদীকে। তাঁদের দু’ সন্তান: পূজা, সিদ্ধার্থ। কবীরের সাথে প্রতিমার বিচ্ছেদ ঘটে ১৯৭৮-এ। ১৯৭৪-এ তিনি সমালোচিত হন প্রকাশ্যদিবালোকে স্ট্রিকিংয়ের জন্য।
১৯৭৫-এ প্রতিমা ওড়িশি নাচে হাতেখড়ি নেন এবং অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই একজন স্বয়ংসম্পূর্ণ ওড়িশি নৃত্যশিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৮৯ সালে বেঙ্গালুরুর শহরতলিতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ভারতের সর্বপ্রথম নৃত্যগুরুকূল “নৃত্যগ্রাম”। ১৯৯৮ সালের ১৭ আগস্টে কৈলাস মানস সরোবর যাত্রার সময় ভূমিকম্প ও ভূমিধসে মারা যান এই শিল্পী।
আমাকে বলা হয়েছিল যে আমার জন্ম দিল্লিতে, ১৯৪৯-এর অক্টোবর মাসে। আমি বলি না যে আমি “জন্মেছিলাম” অমুক সময়ে, কারণ যেকোনোকিছুকে সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করতে দ্বিধা হয় আমার। সবকিছুই নির্ভর করে দৃষ্টিকোণের উপর। আর সত্যি কথা বলতে কী, দৃষ্টিকোণও অজস্র; প্রতিটিই নিজ নিজ অবস্থানে নির্ভুল। কোন অবস্থানে দাঁড়িয়ে নিজের গল্পটি বলব, প্রশ্ন সেটিই।
সবচেয়ে সহজ হয় যদি সোজাসুজি নিজের অবস্থান থেকে বলি। আমি চাইলেই বলতে পারি- আমার স্বামী একটা হারামজাদা যে কিনা দু সন্তানসহ আমাকে একা ফেলে গেছে। আবারো বিয়ে করেছে কোনোরকম অপরাধবোধ ছাড়াই। বলতে পারি, এক প্রতিষ্ঠিত আইনবিদ তথা আইনজীবী আমাকে প্রলুব্ধ করেছিলেন শরীরী সম্পর্কে। বলতে পারি বিবাহিত জীবনে আমার ভূমিকা ছিলো নেহাত দাসীর।
নিজেকে অসহায় এবং নিষ্পেষিত হিসেবে উপস্থাপন করা সবসময়ই সহজ। কিন্তু বাস্তবতা হলো, জীবন যারপরনাই জটিল। জড়বুদ্ধি ও সঙ্কীর্ণমনাদেরকে গল্প শোনাতে আগ্রহী নই আমি, যারা জীবনকে কেবলমাত্র সাদা এবং কালো দিয়ে আঁকেন।
স্বামীর জন্য সীতা কিংবা প্রেমিকদের জন্য রাধা হতে চাইনি কখনো, হইওনি। সন্তানদের জন্য যশোদা হতে পেরেছি কিনা সন্দেহ। এক কথায়, জগতসংসারের হিসেবমতে সবদিক দিয়েই আমি পুরোপুরি ব্যর্থ। স্ত্রী, রক্ষিতা, মা, কন্যা, বোন, বন্ধু সব হিসেবেই ব্যর্থ। ব্যর্থ একজন নারী হিসেবে। এবং অবশ্যই সামাজিক জীব হিসেবে। কেননা ২০০০ বছর ধরে প্রতিষ্ঠিত এবং সযত্নে লালিত প্রতিটি সামাজিক নিয়ম ভেঙেছি আমি। কোনো বাধা মানিনি কখনো। সমস্ত দুনিয়াকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যখন, যা খুশি তাই করেছি। আমার যৌবন, যৌনতা এবং বুদ্ধিমত্তা প্রদর্শন করেছি আমি চূড়ান্ত নির্লজ্জতার সাথে। ভালবেসেছি অনেককে, কারো কারো ভালোবাসা পেয়েছি (কাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছি অথবা আমাকে কে সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছে তা অবশ্য বলা মুশকিল)।
মানুষের কাছ থেকে বৈচিত্র্যময় সব প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। সময়ে সময়ে নির্বাসিত হয়েছি ভদ্রসমাজ থেকে। লাঞ্ছিত হয়েছি, ভ্রূকুটি দেখেছি, ভর্ৎসনা শুনেছি। এবং তাচ্ছিল্যভরে সেগুলো ঝেড়েও ফেলেছি প্রতিবার। আমার কিম্ভুতপনার কেচ্ছা লিখতে প্রেস কালি ঢেলেছে দেদার। অবশ্য প্রশংসিতও কম হইনি। মহিলারা নানাবিধ সমস্যা নিয়ে আমার কাছে ছুটে আসতেন সমাধানের আশায়। নবীনেরা আমাকে মানত আদর্শস্বরূপ। সন্তানদের কাছে আমি পূজনীয়। প্রেমিকেরা আমার প্রতি বিশ্বস্ত। আমার প্রাক্তন স্বামীর “বেস্ট ফ্রেন্ড” আমি এবং তাঁর সহধর্মিনী আমার সহোদরাতুল্য। আমার ছাত্রী এবং দর্শকদের কাছে আমি শ্রদ্ধেয়। আমার গৃহকর্মীদের কাছে আমি দেবীসম। কেন? জানি না। সত্যি বলছি, আদতেই সত্যটি জানা নেই আমার। তবুও যথেষ্ট দৃঢ়কন্ঠে বলতে পারি আমি, সুখী হওয়া সহজ। ভীষণ ভীষণ সহজ।
বেশিরভাগ লোকই বলবেন জীবনে অনেককিছু অর্জন করেছি আমি। কিন্তু আমি জানি, আমি কিছুই করিনি। নিজেকে বাঁচতে দিয়েছি মাত্র। নিজেকে প্রস্তুত রাখা চাই শুধু। জীবনকে অবাধে ঘটতে দেওয়ার জন্য। "নিজেকে নিজের খাঁচা থেকে মুক্ত করা”র চেয়ে বড় আর কিছু করা যায় না নিজের জন্য।
আফসোস কি নেই একেবারেই? আছে। যৌবনে যথেষ্ট কিছু করিনি বলে আফসোস হয়। শরীর পেকেছে, মন এখনো কাঁচা। দারুণ হতো যদি সবাই ধীমান বৃদ্ধ হয়ে জন্মাতে পারতাম আর মরতে পারতাম অবোধ শিশু হয়ে।
(চলবে)
[পাদটীকাঃ timepass এবং streaking শব্দ দুটোর লাগসই বাংলা প্রতিশব্দ খুঁজে পাইনি। কেউ জানালে উপকৃত হব।]
মন্তব্য
টাইম পাস - বইেয়র জন্য- জীবন যাত্রা বলা যেতে পারে।
TAG ১৮ বছর, তোমার কি ১৮ বছর কি হয়েছে বুনোহাস?- হা হা হা
ভাল লেগেছে।
আমার বয়স ১৮ থেকে ২৫ এর মধ্যেই ওঠানামা করে।
"টাইমপাস" শব্দটা চটুল অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে এখানে। অনেকটা "নাই কাজ তো খই ভাজ" ধাঁচের। মানুষের পুরোটা জীবনই নেহাত টাইমপাস। সে অর্থে "জীবন যাত্রা"র সাথে এর যোগাযোগ আছে। তবু "টাইমপাস" আর "জীবনযাত্রা" কে ঠিক সমার্থক মনে হচ্ছে না।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
_____________________
আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।
১৮ থেকে ২৫ এর মধ্যে উঠে আবার নামে কিভাবে ?!
--
অনুবাদ রসময় হয়েছে == চলুক ।
ষ্ট্রিকিং এর ছবিটা দেখেছিলাম যদ্দুর মনে পড়ে।
তবে ইনিই কি তিনি কিনা ঠাহর করতে পারছি না
--
Imtiaz Mirza
ভালো লেগেছে। পড়তে হবে বইটা।
প্রতিমা বেদীর জীবন বর্ণাঢ্য ছিল জানতাম, আগ্রহ বেড়েছে আপনারা লেখা ভূমিকা পড়ে।
--------------------------------------
যে কথা এ জীবনে রহিয়া গেল মনে
সে কথা আজি যেন বলা যায়।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
ভূমিকাটা আমার লেখা নয়। অনুবাদ। এই বইয়ের কোন বাংলা অনুবাদ আছে বলে আমার জানা নেই। পুরোটাই অনুবাদ করার ইচ্ছে আছে।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
_____________________
আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।
সরি...অনুবাদ বুঝতে পেরেছি কিন্তু বলতে ভুলে গেছি। অনুবাদটা ভালো হয়েছে। পুরোটা অনুবাদ হওয়ার আগেই মনে হয় আমি বইটা জোগাড় করে পড়ে ফেলব। আমার ধৈর্য বেশ কম
--------------------------------------
যে কথা এ জীবনে রহিয়া গেল মনে
সে কথা আজি যেন বলা যায়।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
অনুবাদ করতে চাচ্ছ সেটা খুব ভাল। অনুবাদটা ভাল লাগল পড়ে।
বুঝতে পারছি বইটা তোমাকে নাড়া দিয়েছে দেখেই অনুবাদ করতে চাচ্ছ।
কিন্তু নিজের এনালাইসিসটা জারি রেখ।
timepass র বাংলা হতে পারে "খেলা", মানে এই বইতে এই অর্থে হতে পারে..
অনুবাদ ভাল লেগেছে । ভূমিকাটাও ।
বইটা কেন ভাল লেগেছে সেটা আগে বলে নিলে বেশি ভাল হত।
অর্থাৎ অনুবাদের ভূমিকা আর কি!
বোহেমিয়ান
নতুন মন্তব্য করুন