মালেকার বয়স ৪০। সংসারে একা। স্বামী খোঁজখবর নেয় না। মেয়েদের সংসারে থাকতে রাজি নন। তাই নিজের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। কাজ করতেন রানা প্লাজার আট তলায়। ধসে পা ভেঙেছে। কোমরের নিচের অংশ আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে অকেজো হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সুস্থ হয়ে আবারো কাজ করতে চান তিনি। অন্যের গলগ্রহ হয়ে থাকতে রাজি নন।
ঘরে ফেরার পর কী কাজ করবেন তা নির্ভর করছে মালেকার শরীরের নিম্মাংশের পরিণতির উপর।
রেবেকার পরিবারের ৭ জন কাজ করতেন রানা প্লাজায়। রেবেকা আর তার স্বামী মুস্তাফিজ বেঁচে গেছেন। বাকি ৫ জনের মধ্যে একজনের লাশ পাওয়া গেছে। চারজন নিখোঁজ। রেবেকার ডান পা কেটে ফেলতে হয়েছে। তার পরিবারের খবর এখনো জানানো হয়নি তাকে। স্ত্রীর চোখ বাঁচিয়ে ফিসফিসিয়ে মুস্তাফিজ বলেন, “বুঝেনই তো। তার মাও আর নাই। এইটা জানাইতে পারতেসি না। আমরা তো সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে ভয় পাই। তার (রেবেকা) সামনে কিছু বলতেও পারতেসি না।”
ওয়ার্ডের বাইরে গিয়ে মুস্তাফিজের বাড়িতে ফোন করে মৃত আর নিখোঁজদের নাম লিখে দিই একটা কাগজে, যাতে কেউ জিজ্ঞেস করলে মুস্তাফিজকে মুখে কিছু বলতে না হয়।
১৯ বছরের রাশিদার পা ভেঙে গেছে। তিনি কাজ করতেন রানা প্লাজার পাশের ভবনে। রানা প্লাজা ধসে পড়লে তার একটি অংশের নিচে চাপা পড়ে ওই ভবনের একাংশ। সুস্থ হয়ে তিনি আর কাজে ফিরতে চান না। পড়ালেখা এগিয়ে নিতে চান।
৪৫ বছরের সুফিয়া মেরুদণ্ডে আঘাত পেয়েছেন। শরীরের নিচের অংশ অকেজো। স্বামী রফিক বললেন, “যাদের হাত নাই, পা নাই তাদের সবাই টাকা দেয়। তার আঘাত দেখা যায় না। কিন্তু সে তো আর কখনো চলতে ফিরতে পারবে না। এইটা কেউ দেখে না।”
জরিনার বয়স ৩৫। রানা প্লাজার আট তলায় ছিলেন। আঘাতে দু পা ভেঙে গেছে। হাতের আঙুল কাটা পড়েছে। চোখে সমস্যা দেখা দিয়েছে। পেট ফুলে ঢোল। ওয়ার্ডে মাদরাসার এক ছেলে দোয়া পড়ার জন্য টাকা চাইছিলো। জরিনার সাথে কেউ ছিলো না তখন। আমাকে বললেন, “একটা কোরান শরীফের দাম কত? কেউ টাকা দেন ওরে। আমার জন্য দোয়া করত।”
টাকা পেয়ে ছেলেটা দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে গেল জরিনার গায়ে।
পঙ্গু হাসপাতালের ডি ওয়ার্ডে এমন ১০২ জন আবদুল আলিম, মালেকা, রেবেকা, রাশিদা, সুফিয়া, জরিনার সাথে দেখা হলো। মৃত্যুঞ্জয়ী মানুষগুলোকে দেখে অবাক হচ্ছিলাম, আঁতকে উঠছিলাম। কাছে গেলে অনেককিছু বলেন তারা। একটা কথা জিজ্ঞেস করলে ঘুরিয়েপেঁচিয়ে অনেক কিছু বলে ফেলেন। বুঝতে পারি উনারা কথা বলতে চান। ভেতরের প্রচণ্ড চাপটুকু বের করে দিতে চান। গল্পচ্ছলেই জানতে পারি তাদের সংসারের গল্প। গার্মেন্টসে কাজ করতে আসার পটভূমি। তারপর চাপা পড়ার গল্প। কোন গার্মেন্টসে কাজ করতেন জিজ্ঞেস করলে বেশিরভাগই উত্তর দিতে পারেন না। কোন তলায় কাজ করতেন বলতে পারেন শুধু। এরা সবাই পরিবারের অন্যতম অথবা একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তি। বেশিরভাগই নারী। নারীদের অনেকেই স্বামীপরিত্যক্তা। সংসারে খরচ কেমন জিজ্ঞেস করলে পরিবারের নানান ফিরিস্তি দিতে থাকেন। খরচের হিসেব দিতে বেগ পেতে হয়। আনুমানিক হিসেব শুনে বিস্মিত হই। এত কম খরচে কীভাবে সংসার চলে? সুস্থ হয়ে এরা কেউই গার্মেন্টসে ফিরতে চান না। কেউই না। “যেই ভয়টা পাইসি, এই কষ্ট না ভুললে বাঁচব না”- এমন বক্তব্য অনেকেরই। কেউ কেউ পড়ালেখায় ফিরে যেতে চান। কেউ কেউ ঘরে বসে সেলাই বা খেতখামারের কাজ করতে চান। ঢাকা ছাড়তে চান সবাই।
প্রায় সবাই শুরু থেকেই বিনামূল্যে চিকিৎসা পাচ্ছেন। হাতে গোনা কিছু পরিবার দুর্ঘটনার পরপরই আশপাশের বেসরকারি ক্লিনিকে নিয়ে গেছেন দুর্গতদের। সেখানে বেশ মোটা অংকের খরচ গুনতে হয়েছে তাদের। সেই টাকা উদ্ধারের পথ পাচ্ছেন না কেউ। হাসপাতালে দেখতে আসা লোকজন টাকা দিলেও সবাই টাকা পাচ্ছে না বলে জানালেন। বেছে বেছে বিশেষভাবে আঘাতপ্রাপ্তদের টাকা দেন বেশিরভাগই। হাসপাতাল থেকে বের হয়ে গেলে সেই সাহায্যটুকুও পাওয়া যাবে না বলে আশংকা দুর্গতদের।
সাহায্য দিতে আসছেন অনেকেই। কেউ ব্যক্তিগতভাবে। কেউ সংগঠনের তরফ থেকে। কেউ কাপড় আনছেন, কেউ খাবার। কেউ আনছেন অর্থ। কেউ হয়ত ওয়ার্ডে এসে বললেন উনি তিনজনকে টাকা দেবেন। বেছে বেছে সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তিকে (শরীরের এক বা একাধিক অঙ্গ হারিয়েছেন এমন) খুঁজে টাকা দেবেন। কেউ কেউ সাথে ফটোগ্রাফার নিয়ে আসেন। সংগঠনের হর্তাকর্তা টাকার খাম হাতে তুলে দিচ্ছেন। চারপাশ থেকে হুড়মুড়িয়ে ছবি তুলে যাচ্ছেন কয়েকজন। মা আর দুই মেয়ে মিলে টাকা দিতে এসেছিলেন। মা বেডে বেডে গিয়ে খোঁজ নেন। এক মেয়ে ৫০০ টাকার একটা করে নোট তুলে দেয়। অন্য মেয়ে ছবি তোলে। জানতে চাইলাম ছবি তুলছেন কেন। বললেন, “আমাদের ভাইয়া দেশের বাইরে থাকে তো। ও দেখতে চেয়েছে।”
এই হট্টগোলের ফাঁকেই নিরন্তর শ্রম দিয়ে চলেছেন কিছু স্বেচ্ছাসেবী। কিছু স্বেচ্ছাসেবী দলের সাথে আলাপ হয়ে গেল এই সুবাদেই। অনেকেই একই কাজ করছেন। রোগীদের সহায়তা, তথ্য সংগ্রহ। বিচ্ছিন্ন উদ্যোগগুলোকে একীভূত করার ব্যাপারে সবাই একমত। সবার উদ্যোগ আর পরিকল্পনা নিয়ে আলাপও হলো।
প্রথমদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত ছিলাম। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম বলে এক চাচা হাত চেপে ধরে বেডের পাশের টুলে বসিয়ে দিলেন। ফেরার সময় উনাদের সাথে ভাত খেতে সাধলেন কেউ কেউ। এক বেডে গিয়ে পানি চাইলাম। গ্লাস ধুয়ে পানি দিলেন রোগীর স্বামী। পানি খেয়ে গ্লাস ফেরত দিতে হাত বাড়িয়েছি। তিনি বললেন, "থ্যাংক ইউ"। ভেতরটা গুমরে উঠল। জীবন তাদের এতটাই বঞ্চিত করেছে যে তারা এটাও জানেন না, তাদের দুর্গতির দায় কোথাও না কোথাও আমারও।
ধন্যবাদ তো দূরের কথা, ক্ষমা পাওয়ার যোগ্যতাও হয়ত আমার নেই।
মন্তব্য
আহত এই মানুষগুলোর বেঁচে থাকার সংগ্রাম যে কতো কঠিন হবে, তা কল্পনারও বাইরে!
'শাহানা' ঘটনাটা বললেনা যে?
আরো কত ঘটনা যে আছে! কোনটা রেখে কোনটা বলবো? যে মেয়েটা দুই পা হারিয়ে এ্যাপোলোতে তার গ্রামের বাড়ি থেকে ফোন আসছে বারবার। ওর কাটা পা দুটো যেন বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ওরা পা দুটো কবর দেবে।
_____________________
আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।
আমরা একদিন হয়তো ভুলে যাবো সাভার গণহত্যার কথা। কিন্তু এই হাজার হাজার পরিবার এই ক্ষত বয়ে যাবে পরবর্তী কয়েক প্রজন্ম ধরে...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
ফেসবুকের স্ট্যাটাসে পড়েছিলাম অর্ধেকটা। যে অংশটা দেখে মেজাজটা খ্যাচ করে উঠলো,
এর মধ্যেও বিজনেস করতে লেগে গেছে। দোয়া একটা ফাউ জিনিস বিনা পয়সায় করতে পারে না। ফকিরের বাচ্চা।
~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~
মানুষগুলোর কথা আমরা দ্রুত ভুলে যাবো। ঘটনার পর ঘটনা ঘটে এই দেশে। কোনটা ছেড়ে কোনটাকে মনে রাখবে মন?
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
শুধু লেখা নয় আপনার কাজের জন্য, আন্তরিকভাবে শুরু থেকেই বিভিন্ন ভাবে এই অবহেলার শিকার মানুষদের পাশে সক্রিয়ভাবে থাকার জন্য - স্যালুট।
নতুন মন্তব্য করুন