রাতের গল্প---৩(গ)

ক্যামেলিয়া আলম এর ছবি
লিখেছেন ক্যামেলিয়া আলম (তারিখ: মঙ্গল, ১২/০৮/২০০৮ - ৭:০১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


অফিসের ডেস্কে বসে কাজে মন দেবার চেষ্টায় মন কিছু সময় যে কোন চিন্তার উর্ধ্বে চলে যায়। একটি ঘন্টা চোখের পলকে কেটে যায়। কাজ কমে আসে সময়ের দৌড়ানোও যেন থমকে দাঁড়ায়। বাকি এক ঘন্টার মধ্যে প্রায় পাঁচবার উঠে বাথরুমে গেল আর চা খেল বার তিনেক, পানি খেল দুই গ্লাস। তবুও আরও বার মিনিট বাকি ঘন্টা কাটা ছুতে। পাশের টেবিলের শাহানা ম্যাডামের হাসির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ফোনে কার সাথে যেন কথা বলে যাচ্ছে। অপু উঠে টেবিলের সামনে বসে থাকে।
অফিসটা যে কি হয়ে যাচ্ছে, আতিক ভাই। একটা কথা বললে মাটিতে পড়েনাÑবাতাসে যেন ভাসতে থাকে। তারপর ব্যাঙের মত তার দুই পা গজায়, দুই হাত গজায়, লেজ খসেÑএরপরে
বাকি শব্দগুলো আর কানে যায় না আতিকের। অপুটাকে কি বলবে আজ রাতের কথাটা? নাহ থাক, কেমন না কেমন হবে! পরে বলা যাবে।
মনে মনে ভাবলেও মুখ দিয়ে কথাটা বেরিয়ে যায়। অপু সাথে সাথেই জোড়ে সোড়ে এই বিষয়ের সাথে ডজনখানেক কথা জুড়ে সবাইকেই বলে বেড়ায়। লজ্জা পেলেও সবার কানে কথাটা যাওয়াতে খুব ভাল লাগতে থাকে আতিকের। অফিসটাকে আজ অন্যরকম আপন মনে হয়।

টিভি ছেড়ে অধীর আগ্রহে বসে আছে আতিক আর শান্তা। বিজ্ঞাপন চলছে একের পর এক।
ধ্যাৎ শালাÑ ফাউল সব মানুষজন চ্যানেলগুলার মালিক হয়ে বসেছে, ব্যবসা ছাড়া কিচ্ছু বুঝেনাÑ
শান্তা উঠে রান্না ঘর থেকে এক প্লেট মুচমুচে ভাজা মাংস সাথে আরও কি যেন এনে নামায়। দপ করে ইলেকট্রিসিটি চলে যায়। আতিকের হৃদপিন্ড কয়েকসেকেন্ড কোন বাতাস পায় না। একঘন্টার মামলা। এর মাঝে আসার সম্ভাবনাও নাই। নিঃশব্দে চাইলেও দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে জোড়ে। শান্তা চুপ করে এসে দাঁড়ায়। আতিকের মাথার চুল এলোমেলো করতেই আতিক বিরক্তে উঠে পড়ে খাট থেকে। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। অন্ধকার পাড়াটায় নক্ষত্রগুলো যেন জেকে বসেছে উপরটায়। কান্নার এক দলা গলায় উঠে আসে ওর।
এত খারাপ ভাগ্য কেন আমার?
দেখো কারেন্ট চলে আসবে, তুমি কিছু ভেবোনা।
শান্তার কথাটা শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয় মনে। মোবাইল চেপে সময় দেখে। সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে। হঠাৎ হাসি পায় আতিকের। হাসতে থাকে ও। শান্তা কিছুটা অবাক হয়ে তাঁকায়। তারপর বলে,
তোমার প্রাপ্তি দিন দিনই বাড়ছেÑ
কেন তোমার ভাল লাগছে না?
শান্তা ভ্রু কুচকায়।
না লাগছে নাÑ যাহ তুইÑ
শান্তা চপল পায়ে হেঁটে ভেতরে যায়। ঠুকঠাক শব্দ শুনে বোঝে খাবারগুলো ঢেকে রাখছে। মোবাইলে চোখ পড়ে মনটা দপ করে নিভে যায়। আর এক মিনিট। মোবাইলের লাইট বারবার জ্বালাতে থাকে। সময়টা স্থির হয়ে থেকে ধুপ করে বদলে গেল। আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে গেল রাত্রিটা। এক ছুটে দু’জন খাটে গিয়ে বসল। টিভি অন করা ছিলই। বিজ্ঞাপন চলছে। মাথার মধ্যে ঘূর্ণি খেলা করছে। হাবিজাবি কত কিছু আসছে। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ কোন অবয়ব তা দিয়ে তৈরি হচ্ছে না। এমন বাজে মাথা নিয়ে আর কখনই পড়তে হয়নি ওকে।
এখন প্রচারিত হচ্ছে আতিক রায়হানের রচনা আর ------
কান জ্বালা করা শুরু করল। চোখের কোণে এক ফোঁটা পানি। শুধু শান্তার উচ্ছসিত গলা। নাটকের নামের পরই রচনাকারীর নাম আসার সাথে সাথেই শান্তার মোবাইল বেজে উঠল।
আতিকের কানে ফোনটি চোখ আর মন টিভি পর্দায়। একগাঁদা প্রশংসা বাক্য ঝাড়লো অজন্তা। তারপরই আতিকের মায়ের ফোন। এরপর একে একে অনেক আত্মীয়। নাটকটি শেষ হল কয়েক হাজার বিজ্ঞাপন বিরতিতেও। স্তব্ধ আতিক বসে রইল টিভির সামনে। নিজের লেখা একটি নাটক। তাবৎ পৃথিবীর বড় বড় মানুষের ভীড়ে অনু পরিমান মূল্য নেই যার। তবু ভাল লাগছে আজ। অসম্ভব ভাল লাগছে। আর কোন কিছুই খেলা করছে না মাথায়। উঠে বারান্দায় গেল। আগ্রহ চেপে রাখতে না পেরে শাহানা ম্যাডামকে ফোন করল। জানাল, ভুলে গেছে দেখতে। আগ্রহহীন গলায় সিডিটা চাইল দেখে নেবার জন্য। অপুরও একই দশা। চুপ হয়ে গেল কিছু সময়। কোন বেদনায় নয়Ñ বোধহীন বোধের কারণে।
আকাশের নক্ষত্রগুলো এই আলোর মাঝে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কোটি কোটি আলোর সাথে নিস্তব্ধ ফ্যাকাশে চেহারার চাঁদটিকে আজ বড় বেশি ভাল লাগছে। শরীর পালকের মতন হালকা। মাথা ভরা শূণ্যতা নিয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেনা পৃথিবীতে এক অজানা অচেনা যুবক নিঃসীম শূণ্যতার পানে ধ্যনস্থ হয়ে চেয়ে রইল।

(সমাপ্ত)


মন্তব্য

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

নিজের লেখা একটি নাটক। তাবৎ পৃথিবীর বড় বড় মানুষের ভীড়ে অনু পরিমান মূল্য নেই যার। তবু ভাল লাগছে আজ। অসম্ভব ভাল লাগছে।

আমাদের নিজস্ব ভালোলাগাগুলো বোধহয় আমাদেরকেই দোলায় সবচেয়ে বেশি। আর এই চোখের কোণে পানি জমে ওঠা ভালো লাগা অনুভূতির চেয়ে মূল্যবান আর কিছু আছে বলে মনে হয় না।

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

কিন্তু রাতগুলো কেন পুরুষের মন দিয়ে অনুভব করা? কেন উল্টোটা নয়?

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

গল্পগুলো রাতের...
চোখের কোনে বাষ্প জমা
এই গল্পগুলো মোদের...

দুঃখ ঝেড়ে, কষ্ট মুছে
গহীন রাতের ছোবল থেকে
মুক্তি মিলুক 'ওদের'!

অনেক অনেক ভালো লাগল হাসি

কীর্তিনাশা এর ছবি

চমত্কার ক্যামেলিয়া আপু! এখনো মুগ্ধ হয়ে আছি।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

জানাল, ভুলে গেছে দেখতে। আগ্রহহীন গলায় সিডিটা চাইল দেখে নেবার জন্য। অপুরও একই দশা।

যাক আমার দলে তাহলে আরো লোক আছে
তবে আমি তাদের থেকে আরো উন্নত প্রজাতির
কেউ টিভিতে কোনো কিছু বলার সাথে সাথেই বলি সিডি দিতে
এমনকি বিজ্ঞাপন পর্যন্ত

০২
রক্ষে
বহু আকামের ভীড়ে টিভিটা আমার টাইমে কোনো ভাগ বসায়নি
নাহলে প্রতিটা দিনকে আটচল্লিশ ঘন্টায় বানিয়েও কুল পাওয়া যেতো না

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।