ভূতবিদ্যা বা ভূতবাজি

আশরাফ মাহমুদ এর ছবি
লিখেছেন আশরাফ মাহমুদ (তারিখ: সোম, ১১/০১/২০১০ - ৬:২২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


খামখেয়ালি বিদ্যুৎ চলে গেলে গল্পের আসর জমে; গ্রামে থাকলে উঠোনের দাওয়ায় কিংবা শহরে আমাদের বাসার খাবারঘরে। আমরা টগরা ছেলেমেয়েরা গোল টেবিলের আশপাশে উপনিবেশ অটুট করে বসতাম। রূপকথা বা গল্প বলার এই জীবনচর্চা আমার বরাবরই ভালো লাগে। জ্বি, জীবনচর্চা শব্দটা সজ্ঞানে ব্যবহার করা। মানুষ কথাঝুরি ও স্মৃতির জাবরকাটার মাধ্যমের বড় পরিসরে জীবনচর্চা করে।
তার কথাগুলো সাংসারিক বিষয়াশয় দিয়ে শুরু হয়, ক্রমেই অন্ধকার ঘনীভূত হওয়ার মতো সেসব প্রবাহিত হয় ভূতের গল্পের দিকে! ভূতের গল্প কিন্তু জীবন থেকে নেয়া।
একটু মুখবন্ধ লেখা যাক। গ্রামের বাড়িতে যাওয়া হতো প্রায় ছুটিতে। একান্নবর্তী বা বলে একশবর্তী-ও বলা চলে। আমার প্রপিতামহ থেকে শুরু করে সবার বাস্তুভিটে। বিশ্বায়ন ও নগরায়নের এই সময়ে অনেকে শহুরেফুল; তদাপি অনেকে তো এখনো ধানের গন্ধ ভালবাসে। বাড়ির সামনে ছোট দাদার গড়া দাতব্য চিকিৎসালয়, খামার বাড়ি, ইস্কুল, মক্তব, মাদ্রাসা ইত্যাদি। সেইসব স্থাপনার পিছনে সবুজ পাহারাদার- মানে গাছগাছালির সামন্তরাজ্য। সেই বনের মাঝে পারিবারিক কবরস্থান। ফলশ্রুতিতে, আকাশে চাঁদ না থাকলে, বিদ্যুৎমশাই বিয়াইবাড়িতে গেলে কিংবা জোনাকগুলো দেশান্তরী হলে পুরো এলাকাটা অদ্ভুত দেখায়। আমি নিজে-ও জায়গাটা দৌড়ে পার হই।
এতো গেলো গঠনের বর্ণনা। দাদার নাকি দু'টো বিড়াল ছিল যুবা বয়েসে; সে দু'টো নাকি ছ্দ্মবেশী জ্বীন! কিংবা আরেকটা গল্প বেশ সহজলভ্য- রাতে ইলিশমাছ ধুঁতে গেলে জলভূত মাছের ভিতরে ঢুকে যায়; ফলে ধৌতকারীর তীব্র জ্বর, অসুখ হয় ইত্যাদি।
এসব রূপকথার বা ভূতের গল্পে সৌন্দর্য থাকে, নিজস্ব আবেদন থাকে; নিজের যুক্তিটা সতেজ করে নেয়া যায় ভুল দেখিয়ে দিয়ে। একটা বিষয় চোখে পড়ে- ভূতবিদ্যার এসব গল্পে কিন্তু বাস্তববাদি উপদেশ থাকে। যেমন- বিড়াল, কুকুর ইত্যাদি উপকারী পশু, রাতে বাইরে থাকা উচিত না ইত্যাদি।
মানুষের এই গল্প বলা, অন্যভাবে বললে নিজের উপলব্দিকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দেয়া থেকেই সকল শিল্পের জন্ম; আমার মনে হয়। এই প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দেয়ার প্রক্রিয়া অন্য প্রাণীদের মাঝে-ও থাকে; মানবজাতির ক্ষেত্রে এটা ব্যাপক। এটা সম্ভবত প্রাকৃতিক, অর্থ্যাৎ সহজাত! মানুষের ডিএনএ'তে এসব ব্যাপার হয়ত রোপণ করা থাকে বংশানুক্রমে বিবর্তনে; মনে হয়।


এযুগে বিজ্ঞানভিত্তিক ভূতবাজি চলে; বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, পরাবাস্তব কবিতা বা গল্পে যেসব দৃশ্য, বস্তু বা নিদেনপক্ষে প্রাণীর অবয়ব সৃষ্টি করা হয় তার সাথে প্রাগৈতিহাসিক ভূতবাজির মিল আছে। কিন্তু যুগের চাহিদা, সময়ের উপহারের কারণে গঠন ও দৃশ্যে এসবের-ও বিবর্তন হয়েছে। এসব ভাবনার যৌক্তিক কারণ দেয়া না গেলে-ও কারণ খোঁজা যেতে পারে। জ্ঞান বিকাশের প্রচলিত ধারাতো এমনই!


ভূত বা অশরীরী এগুলোর সাথে মানুষের অন্তর্নিহিত মানসিক অবস্থা, পরিবেশ ইত্যাদির সম্পর্কের কথাতো আমরা জানিই। ইদানীং একটা চিন্তা খেলছে মাথায়- এসব অতিপ্রাকৃতিক (ভ্রান্ত) বিষয়ের সাথে স্বপ্নের কি কোন যোগাযোগ আছে? ভূতের গল্প লেখা হয় নি। লেখা হলে বুঝতে পারতাম কেমন করে চিন্তাটা আসে। তবে ধারণা করছি- মানুষ যেমন স্মৃতিসমূহ সাজায়, চিন্তা করে তেমনি ভৌতিক জিনিসের অবতারণা করতে ভালবাসে। এটা হতে পারে লোকদৃষ্টি পাওয়ার আশায়, হতে পারে মানসিক দুর্বলতা ইত্যাদির কারণে। কেন যেন মনে হচ্ছে ভাষার অপভ্রংশের মতো চিন্তার অপভ্রংশই এসব রহস্য সাহিত্য বা ভৌতিক উপাদানের জনক।


আমরা পরাবাস্তব সাজাই বাস্তবের বৈশিষ্ট্য, উপাদান, ধারণাকে এলেমেলোভাবে সাজিয়ে। যেমন ধরুন: আমি কবিতায় ব্যবহার করেছি 'মানানসই বিড়ালের ডানা।' বিড়াল কিংবা ডানা না দেখা হলে আমার লাইনটা লেখা হতো না! তবে মানুষ যেহেতু প্রাকৃতিকভাবে শৃঙ্খল বা সাজানো-গোছানো থাকতে চায়- পরাবাস্তব বর্ণনার ক্ষেত্রে-ও সে প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। পরাবাস্তব জগতের (ধরে নিচ্ছি এটি বিদ্যমান) সূত্রগুলো কি বাস্তব (পৃথিবীর জগতটাকেই বাস্তব জগত ধরে নেয়া যেতে পারে) জগতের মতো হবে? নাকি ঠিক উল্টো? কণা-প্রতিকণার মতো বাস্তব ও পরাবাস্তবের সাথে কোন সতীনপনা কিংবা ভাব থাকবে?


রহস্য সাহিত্যে কুযুক্তি বা হেত্বাভাস বেশি হয়ে থাকে; অন্তত সাহিত্যের অন্য ধারাগুলোর থেকে। ত্রৈধবিন্দুতে যেমন জলের তিন অবস্থার দেখা যাওয়া যায় তেমনি মানুষের মনে কি এমন কোন ত্রৈধবিন্দু বিরাজমান যেটা যুক্তি, কুযুক্তি ও নিরপেক্ষ একটা ভাবের মতো? আমি সত্য বলি না, আমি মিথ্যা বলি না, আমি নিরপেক্ষ বলি না- এরকম তিনটি অবস্থা থাকতে পারে।
ভূত বলে পৃথিবীতে কিছু না থাকলে-ও এর রহস্য অনেক কিছুর দিকে ঠেলে দেয়। অনেক কিছু অস্তিত্ব খোঁজার দিকে।


কই থেকে কই চলে গেলাম! ভূত দেখি এই লেখাতে ভর করল!


মন্তব্য

তিথীডোর এর ছবি

হাঃহাঃ, ভূতের রাজ্যে গন্ডগোল বাঁধাতে যাবেন না ভাইয়া.. ভুতের বাচ্চা, নীল ভূত নিকে দুজন অলরেডি আছেন!!

পড়তে ভাল্লাগলো..

--------------------------------------------------
"সুন্দরের হাত থেকে ভিক্ষা নিতে বসেছে হৃদয়/
নদীতীরে, বৃক্ষমূলে, হেমন্তের পাতাঝরা ঘাসে..."

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

আশরাফ মাহমুদ এর ছবি

সেকি! এই পোস্টে মাইনাচ পেলে তাদেরকে দোষারোপ করা যাবে! চোখ টিপি
আর তারা হামলা চালালে তিথী জাদুটোনা বাণ নিয়ে ঠেকিয়ে দিবে, তাই না? হাসি

==============================
ঢাকার মৌন ঘ্রাণে বকুলফুলের নাভি
==============================
হা-তে এ-ক প্র-স্থ জো-ছ-না পা-ড়ে-র ঘ্রা-ণ

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- ভূতের গল্প তো সবাই-ই লিখতে পারে। আপনি নাহয় গল্পের পেছনের গল্পটাই লিখলেন।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

আশরাফ মাহমুদ এর ছবি

আপনার মন্তব্য পড়ে মনে হলো ভূত ভয় পান! খাইছে

==============================
ঢাকার মৌন ঘ্রাণে বকুলফুলের নাভি
==============================
হা-তে এ-ক প্র-স্থ জো-ছ-না পা-ড়ে-র ঘ্রা-ণ

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

প্যারাগ্রাফগুলোর মাঝে মাঝে স্পেস দেন, নয়তো চোখে লাগে। এমন একটা বিষয়ে গুছিয়ে লেখার মত কঠিন কাজটা ভালোভাবেই করেছেন। তবে প্রত্যেক প্রসঙ্গে আমাদের সবার শোনা ঘটনাগুলো থেকে ব্যাখ্যা দিলে আলোচনাটা মনোজ্ঞ হত। বিশেষতঃ ভুত নিয়ে আলোচনা মজার না হলে কি চলে?

ভুত নিয়ে আপনার চিন্তাভাবনা আরো পড়তে চাই।

পুনশ্চঃ আপনার ক্যামেরাতো মেশিনগানের মত চলে, সেখানে কোন ভুতের ছবি ধরা পড়েনি?



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

আশরাফ মাহমুদ এর ছবি

মূলত চিন্তার জটটা খুলতে গিয়ে লেখা। বিস্তারিত লেখতে পারি পর্ব দু'য়ে।
আমি রসকসহীন মানুষ। পড়ার সময় কাউকে কাতুকুতু দিতে বলবেন। দেঁতো হাসি
এই জীবনে জলজ্যান্ত ললনার ছবি তো হয় নি, ভূতনগর তো বহুদূর! চোখ টিপি
সুন্দর মন্তব্য ও পরামর্শের জন্য অনেক ধন্যবাদ।

==============================
ঢাকার মৌন ঘ্রাণে বকুলফুলের নাভি
==============================
হা-তে এ-ক প্র-স্থ জো-ছ-না পা-ড়ে-র ঘ্রা-ণ

অতিথি লেখক এর ছবি

আরে আজিব!! ভাবলাম ভূতের গপ্প পড়বো। তা না.. কই থেইকা কই নিয়া গেলেন!!!

তবে,

আকাশে চাঁদ না থাকলে, বিদ্যুৎমশাই বিয়াইবাড়িতে গেলে কিংবা জোনাকগুলো দেশান্তরী
এই লাইনটা ব্যাপক গবেষণার ফসল মনে হয়। এই লাইন আমার মাথায় বোম মারলেও বের হইত না। মন খারাপ

- মুক্ত বয়ান।

আশরাফ মাহমুদ এর ছবি

ভূত ভর করেছে! এটা তো সাধারণ লাইন, বোমা মারলে তো মাথাই চলে যাবে- লাইন আসা তো দূরের কথা!

==============================
ঢাকার মৌন ঘ্রাণে বকুলফুলের নাভি
==============================
হা-তে এ-ক প্র-স্থ জো-ছ-না পা-ড়ে-র ঘ্রা-ণ

অতিথি লেখক এর ছবি

আহারে! ভাবছিলাম একটা জমজমাট ভূতের গল্প পাবো!

শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ ভাই। ভালো থাকুন।

শেখ আমিনুল ইসলাম

আশরাফ মাহমুদ এর ছবি

শুভেচ্ছা, আমিনুল।

==============================
ঢাকার মৌন ঘ্রাণে বকুলফুলের নাভি
==============================
হা-তে এ-ক প্র-স্থ জো-ছ-না পা-ড়ে-র ঘ্রা-ণ

অনীক আন্দালিব এর ছবি

ভূত থেকে ভূতে গেলে ভালই লাগলো!
এখানে একটা ব্যাপারই খুব আকৃষ্ট করলো, পরাবাস্তবতার উপমা আর উপাদান নিয়ে অংশটুকু। ইদানিং সুররিয়্যালিজম আর ম্যাজিক রিয়ালিজম নিয়ে কথাবার্তাও শুনছি অনেক। লেখায় চলেও আসছে ব্যাপারগুলো। আমার মনে হয় বড়ো লেখকেরা (বড়ো শক্তিমান অর্থে) প্রচুর পরিশ্রম করে একটা আলাদা জগৎ তৈরি করে নেন। যেটা বাস্তবের হাতে হাত ধরে চলে। উপাদানগুলো বাস্তবঘেঁষা হলেও তাদের চরিত হয় না। সেই জগতে পাঠকের অভ্যস্ত হওয়ার সম্ভাবনা নির্ভর করে লেখকের মুন্সিয়ানার উপরে। আর সেই জগতটা অনেক বেশি প্রভাবিত করে, ছোট বড়ো সবাইকেই!

এই অংশটা নিয়ে আরো কিছু লিখো। পড়তে ভালো লাগবে।

আশরাফ মাহমুদ এর ছবি

বাঙলা কবিতায় ইদানীং পরাবাস্তবিক উপাদান ব্যবহার হলে-ও গদ্য অপ্রতুল। আমি চেষ্টা করি। 'তিল-গপ্পো' ও অন্যান্য ছোটগল্পে। কিন্তু যেহেতু পাঠক-পাঠিকাদের পরিচিত বিষয় নয় প্রায় আমাকে 'মাথার উপ্রে দিয়া গেছে' টাইপ মন্তব্য পেতে হয়।
এমন মনোযোগী পাঠক পেলে লেখা যেতে পারে। অনেক ধন্যবাদ, ছন্নকুমার!

==============================
ঢাকার মৌন ঘ্রাণে বকুলফুলের নাভি
==============================
হা-তে এ-ক প্র-স্থ জো-ছ-না পা-ড়ে-র ঘ্রা-ণ

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

আপনার গল্প পড়তে পড়তে আপনার ভাষায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এটা পড়তে গিয়ে তাই খটকা খেলাম।
তাই সম্ভবত খুব মনোযোগ দিতে পারলাম না। অথবা আজ হয়তো মন অন্য কোথাও ডুবে আছে। শুধু শুধু আপনার ভাষার উপর দোষ দিয়ে বসে আছি।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

আশরাফ মাহমুদ এর ছবি

উঁহু, এটার ভাষা কিছুটা কাঠখোট্টা হয়ে গেছে; বোঝা যায়। অমায়িক মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ, নজরুল ভাই।

==============================
ঢাকার মৌন ঘ্রাণে বকুলফুলের নাভি
==============================
হা-তে এ-ক প্র-স্থ জো-ছ-না পা-ড়ে-র ঘ্রা-ণ

মাহবুব লীলেন এর ছবি

ভূত কই?

আশরাফ মাহমুদ এর ছবি

পালিয়ে গেছে!

==============================
ঢাকার মৌন ঘ্রাণে বকুলফুলের নাভি
==============================
হা-তে এ-ক প্র-স্থ জো-ছ-না পা-ড়ে-র ঘ্রা-ণ

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেকদিন পরে লগইন করে দেখি আপ্নে আমারে নিয়া লেখা দিসেন... তো আমার সম্বন্ধে লিখতাসেন আমার সাক্ষাতকার নিলেন না যে... পরে ঘাড় মটকাইয়া দিমু কইলাম খাইছে

লেখা জব্বর অইছে।

---নীল ভূত।

আশরাফ মাহমুদ এর ছবি

ভালো কথা মনে করাইছেন। সাক্ষাৎকার নিমু পরের পর্বে, চোখ রাইখেন। খাইছে

==============================
ঢাকার মৌন ঘ্রাণে বকুলফুলের নাভি
==============================
হা-তে এ-ক প্র-স্থ জো-ছ-না পা-ড়ে-র ঘ্রা-ণ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।