বুরকিনির নিষিদ্ধকরণ ও নারী স্বাধীনতা

আশরাফ মাহমুদ এর ছবি
লিখেছেন আশরাফ মাহমুদ (তারিখ: বুধ, ৩১/০৮/২০১৬ - ১২:০৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

[justify]ফ্রান্সের সর্বোচ্চ আদালত শুক্রবার Riviera town of Villeneuve-Loubet শহরটি ছাড়া-ও প্রায় আর-ও ৩০ টি শহরের সৈকতে বুরকিনি নামক পোষাক পরিধানের বিরুদ্ধে করা জরিমানা ও আইনকে বাতিল করেছে, এবং বলেছে যে এইসব শহরের মেয়রগণ তাদের ক্ষমতার অতিরিক্ত ব্যবহারের মাধ্যমে বুরকিনি নিষিদ্ধকরণ সংক্রান্ত আইন প্রয়োগ করেছেন।
বুরকিনি হচ্ছে ইরান-বংশোদ্ভুত লন্ডন (যুক্তরাজ্য) প্রবাসী একজন ফ্যাশন ডিজাইনারের করা এক ধরণের পোষাক, মুসলিম নারীরা যেনো সৈকতের আনন্দ উপভোগ করতে পারেন তাদের বিশ্বাসের সাথে সামঞ্জস্য পোষাক পরিধান করে সেই কথা মাথায় রেখে পোষাকটি করা, অর্থাৎ, নারীদের চুল ও শরীরের অন্যান্য অংশের ত্বক ঢেকে রাখে, যা বিকিনি কিংবা অন্যান্য সমুদ্রসৈকতে পরিহিত পোশাকের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়।
ফ্রান্সের সর্বোচ্চ আদালতের এই আইনকে বেআইনী ঘোষণা যতোটা ধর্মীয় আচারের প্রতি সম্মান দেখানো তারচেয়ে বরং এই ঘোষণা নারী স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজনীয়।


ঘটনাটি অনেকটা এইরকম: আইনের পোষাক পরিহিত চার-পাঁচজন পুলিশ অস্ত্রের মুখে একটি সৈকতে একজন মুসলিম নারীকে তার বুরকিনি পোষাক খুলতে বাধ্য করছেন এবং অনেককে এই পোষাক পরিধানের কারণে জরিমানা করেছে। ফ্রান্স সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ একটি রাষ্ট্র, এবং জনসাধারণের সম্মুখে ধর্মীয় আচার কিংবা ধর্মীয় ব্যাপার নির্দেশ করে এমন পোষাক পরার বিরুদ্ধে আইন ও নীতি রয়েছে, এবং কোনো সরকারী আধা-সরকারী কর্মচারী ধর্মীয় পোষাক পরতে পারবে না। ফ্রান্সের এইসব উপকূল বা সৈকত-প্রধান শহরে বুরকিনি ও হিজাব জাতীয় পোশাকের নিষিদ্ধকরণ সাম্প্রতিককালে ইসলামিক মৌলবাদি ও সন্ত্রাসী সংগঠন আইসিস আল কায়েদা- এদের হামলার ফলে অতিরিক্ত সতর্কতা ছাড়া-ও মূলত সরকার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে বুরকিনি ও এই ঘরনার পোষাক মূলত নারীদের দাসত্বকে (ধর্মীয় ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতি) প্রতিনিধিত্ব করে, এবং ফ্রান্সের ধর্মনিরপেক্ষ নীতির সাথে যায় না, এই পোষাক মূলত বিপদজনক (যেহেতু আড়ালে কী বা কে লুকিয়ে আছে)।

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য আইনবিভাগের উপর থেকে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের প্রভাব বিস্তার দূরে রাখা জুরুরি, বিশেষ করে ফ্রান্সের মতো রাষ্ট্র যা সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ এবং বহুজাতিক ও বহুসংস্কৃতির (ও বহুধর্মের)। তবে একটি রাষ্ট্র যেমন নির্ধারণ করে দিতে পারে না আপনি কোন ধর্ম পালন করবেন, কী ধর্মীয় আচরণ পালন করবেন, তেমনি রাষ্ট্রের উচিত নয় নির্ধারণ করে দেয়া যে কোন ধরণের ধর্মীয় আচরণ বা পোষাক পরিধান করা যাবে না, সেইক্ষেত্রে রাষ্ট্র ব্যক্তিগত চিন্তা, নির্বাচন, ও স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে।

ফ্রান্স তার ভূখণ্ডে বুরকিনি বোরকা ইত্যাদি ধর্মীয় পোষাকের নিষিদ্ধকরণ করতে পারে, কিন্তু দেখতে হবে যে এই ধরণের আইন স্বার্বজনীন কিনা, অর্থাৎ অন্যান্য ধর্মের পোষাকের ক্ষেত্রে-ও নিষেধ প্রযোজ্য কি না। দেখা গেলো যে খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের (যেমন নানদের পোষাক) পোষাক সৈকতে নিষিদ্ধ নয় (যদিও মেয়ররা বলছেন এই আইন অন্য ধর্মের ক্ষেত্রে-ও প্রযোজ্য, কিন্তু তারা সেইসব পরিধান করে গেলে জরিমানার শিকার হন না, কিংবা অস্ত্রের মুখে কাপড় পরিত্যাগের জন্য চাপে পড়েন না। সর্বোপরিভাবে, বুরকিনির নিষেধ বৈষম্যমূলক এবং নারীদের স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করা।


পিতৃতান্ত্রিক ও পুরুষতান্ত্রিক পরিবেশ ও সমাজে (তা পৃথিবীর যেখানেই হোক, বঙ্গদেশ বলুন কিংবা উন্নত দেশ ফ্রান্স) যেনো সবাই নির্ধারণ করে দিতে চায় নারীরা কী পরবে কী পরা উচিত, কীভাবে চলবে কেনো চলবে এইসব! কিন্তু কেনো? ইতিহাস ও সমাজ জুড়ে দেখা যায় যে ক্ষমতাবান ও লিঙ্গবাদী পুরুষরা নির্ধারণ করে দিতে চায় নারী তার শরীরের কতোটুকু অংশ দেখাবে, কিংবা দেখাবে না। নারীদের মেক-আপ পরা “প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে ঢেকে দেয়”, কিংবা মেক-আপ না পরলে আবার নারী আবেদনময়ী হয়ে উঠেন না; উঁচু জুতো পরা নিষেধ, কিংবা উঁচু জুতো না পরা-ও “অপেশাদারিত্ব।“ এইসব নির্বাচনের নির্ধারণ কেনো কেবল নারীকেই বহন করতে হয়। একজন পুরুষ স্যুট কিংবা হিপি-জিপসী পোষাক পরবে কিনা তা নির্ধারণ যতোটা না করা হয় নারীদের ক্ষেত্রে তার হাজার গুণ বেশি হয়, কারণ হিসেবে তা হতে পারে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, পারিবারিক ইত্যাদি। অর্থাৎ, পুরুষ, এবং তাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নির্ধারণ করে দিতে চায় একজন নারী কী ধরণের পোষাক পরবে, কতোটুকু পরবে; তাই ফ্রান্সের বুরকিনি নিষেধের বিরুদ্ধে বলা এককভাবে কেবল ধর্ম-স্বাধীনতা কিংবা ধর্ম-নিরপেক্ষতার জন্য বলা নয়, বরং নারী-স্বাধীনতার জন্য বলা। একজন নারী যদি সমাজ, স্বাধীনতা ও ইতিহাস বুঝে-ও বুরকিনি পরতে চায় তবে তাকে সেই স্বাধীনতা দেয়া উচিত, তেমনি একইভাবে অন্য নারী যদি সৈকতে সময় উপভোগের জন্য বিকিনি পরতে আগ্রহী তবে তাকে-ও সেই স্বাধীনতা দেয়া প্রয়োজন। ব্যক্তিগতভাবে একজন ধর্মনিরপেক্ষ ও নিধার্মিক লোক হিসেবে আমি চাই না জনসম্মুখে ধর্মীয় পোষাকের উপস্থিতি, কিন্তু এই পোষাক যদি আরো দশ মানুষের মনে শান্তি বজায় রাখে এবং আমার চলার পথের অন্তরায় না হয় তবে আমি এইটুকু মেনে নিতে পারি।


এই কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে বুরকিনি নিষিদ্ধকরণ ফ্রান্সের ইসলামভীতি ও অভিবাসীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণকে নির্দেশ করে। ফ্রান্সের রয়েছে ইসলামভীতি ও অভিবাসীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ দীর্ঘ ইতিহাস, ২০০৫ থেকে বোরকা নিষিদ্ধ ফ্রান্সে। অন্যান্য আরবদেশ থেকে ভাষাগত মিলের জন্য ফ্রান্সে অনেক অভিবাসী এলে-ও ফ্রান্স চায় এইসব অভিবাসীরা ফ্রান্সের সংস্কৃতিকে মেনে নিবে নিজেদের সংস্কৃতিকে বিসর্জন দিয়ে। অর্থাৎ, অভিবাসীদের ক্ষেত্রে ফ্রান্সের নীতি হচ্ছে আত্তীকরণ (assimilation), মানিয়ে নেয়া বা সমঝোতানীতি (accommodation) নয়। অথচ আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের কিংবা কানাডার অভিবাসীদের ইতিহাস ও নীতি (এবং নানাবিধ গবেষণা) নির্দেশ করে যে মানিয়ে নেয়া বা সমঝোতানীতি হচ্ছে উত্তম, মূল ভূখণ্ডের নীতি ও সংস্কৃতিকে অভিবাসীরা যেমন নিজেদের করে নেন তেমনি অভিবাসীদের সংস্কৃতি ও চর্চার প্রতি-ও মূল ভূখণ্ডের শ্রদ্ধা অথবা প্রশ্রয় থাকে। অভিবাসীদের প্রতি বর্ণবাদী আচরণ এখানে-ও হয়, তবে ফ্রান্সে বর্ণবাদটা সাজানো হয় ধর্মনিরপেক্ষতার মোড়কে, এই যা। তাইতো নিউ ইয়র্কে আপনি পাবেন চায়না টাউন, ইতালিয়ান টাউন ইত্যাদি নামে এক সংস্কৃতির অভিবাসীদের ছোট ছোট সমষ্টিস্থান কিংবা কানাডা তাদের প্রতিরক্ষা বাহিনীতে শিখদের তাদের মাথার পাগড়ি ব্যবহারের অনুমতি রয়েছে, কিংবা অতি সাম্প্রতিককালে আরসিএমপি পুলিশদের ক্ষেত্রে নারী সদস্যগণ হিজাব পরতে পারবেন।
বুরকিনি নিষেধ ও সেই আইনকে বেআইনী ঘোষণাসহ ইত্যাদি বিষয়ক তুলে ধরে যে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ও চর্চায় হস্তক্ষেপ করে রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখতে চাইলে খেয়াল রাখতে হবে সেইসব নীতি একান্ত ব্যক্তিগত স্বাধীনতার প্রতি বিরুদ্ধ হয়ে ওঠে কিনা। ধর্মের নামে নারীর স্বাধীনতায় যেমন অনাধিকার চর্চা করা উচিত নয়, তেমনি নারীর যেকোনো নির্বাচনের অধিকারে অনাধিকার চর্চা করা-ও অকাম্য। নারীকেই নারীর পোষাক নির্বাচন করতে দেন।

[/justify]


মন্তব্য

শূন্য  এর ছবি

যারা অভিবাসী তারা তো একপ্রকার আশ্রিত I তাই তাদের উচিত যে দেশে তারা আশ্রয় নিচ্ছে সে দেশের আইন ও সংস্কৃতির প্রতি সম্মান দেখানো I
হ্যাঁ,হয়তো বলতে পারেন জঙ্গিবাদ উস্কে যাবে কিন্তু যেসব দেশ ফ্রান্স এর মতো নয় তারাও তো জঙ্গিবাদ দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে I

হাসিব এর ছবি

যারা অভিবাসী তারা তো একপ্রকার আশ্রিত I

আশ্রিত মানে কী? অভিবাসীরা বিপদে পড়ে আশ্রয় নেয় সবাই ব্যাপারটা এরকম? ইউএসে, কানাডা কি তাহলে আশ্রিতদের দেশ বলবো আমরা?

তাই তাদের উচিত যে দেশে তারা আশ্রয় নিচ্ছে সে দেশের আইন ও সংস্কৃতির প্রতি সম্মান দেখানো I

ফর এক্সামপল, সৌদি আরব?

আশরাফ মাহমুদ এর ছবি

অভিবাসীরা আশ্রিত না, যেসব পশ্চিমা ধনী দেশগুলো অভিবাসী নেয় তাদের অর্থনীতি নির্ভরশীল অভিবাসীদের উপর। আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ নোবেলজয়ী অভিবাসী নতুবা প্রথম প্রজন্মের সন্তান।
আইন ও সংস্কৃতি পাথরে খোদাই করা জিনিস না, প্রয়োজনে পরিবর্তন আবশ্যক। বর্ণবাদ আইন হইলেও তা বর্ণবাদই।
আমি তো জঙ্গিবাদ নিয়ে কথা বলছি না, নারী স্বাধীনতা নিয়ে বলছি।

দিগন্ত এর ছবি

২০০৫ থেকে বোরকা নিষিদ্ধ ফ্রান্সে।

আমার ধারণা মুখ ঢাকা যেকোনো পোশাক নিষিদ্ধ ফ্রান্সে।

সবাই নিজের পোশাক নিজেই নির্ধারণ করলে সমস্যা নেই। দিগম্বর জৈনদের পোশাক-বিহীন থাকার অধিকারও সবাই মেনে নেবে। সমস্যা হল এই স্বেচ্ছা বিষয়টা নিয়েই। ভারতে যখন সতীদাহ নিয়ে আলোচনা হয়েছিল, তখনো হিন্দু মৌলবাদীদের যুক্তি ছিল স্বেচ্ছায় সহমরণে কারও সমস্যা থাকার কথা নয়। দিগম্বর জৈনরাও স্বেচ্ছায় পোশাক থেকে দূরে থাকে। স্বেচ্ছাটা কি সত্র্যিই স্বেচ্ছায় সেটা নিইয়েই প্রশ্নটা। ফ্রান্সের অবস্থান এ বিষয়ে এক মেরুতে সে নিইয়ে সংশয় নেই। কিন্তু উল্টো পাশে স্বেচ্ছা যে পারিপার্শ্বিক শিক্ষা দ্বারা প্রভাবিত সে নিয়েও সংশয় নেই। দূরের প্রশ্ন মনে হলে - পারিপার্শ্বিক শিক্ষা বিষয়টা শোধরাবে কে?


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

আশরাফ মাহমুদ এর ছবি

জ্বি, মুখ ঢাকা পোশাক নিষিদ্ধ, কানাডাতেও মুখ ঢাকা পোশাক নিষিদ্ধ।
সতীদাহের সাথে এই ব্যাপারে মাত্রাগত পার্থক্য আছে, সতীদাহ আত্মবিধ্বংসী ব্যাপার ছিলো, সেই তুলনায় বুরকিনি দুধভাত। আর নগ্নতার ব্যাপারটা অনেকের জন্য, যেমন শিশুদের জন্য ট্রমাজনক হইতে পারে।

ঠিক বলেছেন, পারিবারিক শিক্ষা অথবা ধর্মীয় শিক্ষার ব্যাপার আলাদা করা কঠিন।
দেখলাম অনেক অমুসলিমও বুরকিনি পরতে আগ্রহী, যেমন রোদেপোড়া কিংবা আলার্জি থেকে বাঁচতে অথবা বিকিনির মতো শরীর পুরোপুরি দেখাতে স্বস্তিবোধ করেন না যারা।

দিগন্ত এর ছবি

সমস্যাটা হল স্কিন-সমস্যা বনাম পারিবারিক শিক্ষার কারণে বুরকানি-পরিহিতাদের সংখ্যার অনুপাত। এই সংখ্যা দ্বিতীয়দের দিকে অনেকটাই ভারী।
তাছাড়া রোদে পোড়া বা এলার্জি বাঁচাতে বুরকানি পরার অনেক বিকল্প আছে (ক্রিম)। বুরকানী আর বিকিনির মাঝে অনেক ড্রেস আছে যা পরে জলে নামা যায়।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

পুতুল এর ছবি

আমরা বেড়াতে গিয়েছিলাম এক পরিচিত পরিবারে। এক মেয়ে আমাদের আঁচলের চেয়ে এক বছরের বড়, ছেলেটা আঁচলের সমবয়সী। হোষ্ট পরিবারের মেয়েটি কোরান শেখে কোন এক আরবী ভাষি শিক্ষিকার কাছে। এই নিয়ে পরিবারটি বেশ গর্বিত। আমরা কী বলে কোন সমস্যায় পরি এই ভেবে কিছু বল্লাম না। আমার মেয়ে ভারত নাট্যম শিখতে যায়। এই সমাজে সে সব চেপে যেতে হয়। বিদায়ের সময় দেখি: আঁচল আর চারুর দু'হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে আছে চার-পাঁচটা বিভিন্ন রকমের পুতুল। বেশ দামী দামী। আমি ভাবলাম একি বিপদ! এখন চারুর হাত থেকে এই পুতুল ছাড়িয়ে নিয়ে হোষ্ট মেয়েটির কাছে ফেরৎ দেয়া হবে একটা বড় চেলেঞ্জ। আঁচল কিছুটা বুঝলেও চারু বোঝানো কঠিন। কিন্তু আমাদের সে সব কিছুই করতে হলটা। সবুজ পাতায় ঢিকা গোলাপের পাঁপড়ির মতো মিষ্টি মুখ খানি হিজাব থেকে বের করে হোষ্ট মেয় বলল: সব পুতুল ও চারু-আঁচলকে দিয়েদিয়েছে। এই সব খেলনা দিয়ে খেলা পাপ।

এই বয়সে (৬ বা ৭) খেলনা নিয়ে বাচ্চারা ঝগড়া-ঝাটি, মারা-মারি কত কিছু করছে। অন্তত আমাদের অভিজ্ঞতা সেরকমই। আর সেই হতভাগী শিশুটি কোরান শেখার প্রভাবে আমার বিবেচনায় একটি স্বাভাবিক জীবন যাপন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সেই বাচ্চাটি বড় হচ্ছে চারু-আঁচলকে পাপী ভেবে। কারন তাকে শেখানো হয়েছে পুতুল খেলা পাপ। অন্য বহু সমস্যায় আর গেলামনা।

এই দেশের সব শিশু সমান সুবিধা ভোগ করবে, সে গ্যারান্টি দিচ্ছে তাদের সরকার। তাহলে সরকারের উচিৎ হবে, এই (কোরান পড়া) শিশুটিকে এমন ভাবে এই দেশেরই অন্য অনেক শিশুকে পাপী, ঘৃণ্য, তুচ্ছ ভে্বে বেড়ে উঠার সুযোগ দেয়া? আপাত দৃষ্টিতে হিজাব তেমন কিছুইনা। কিন্তু এর মস্ত্বাত্বিক বহু নেতিবাচক প্রভাব ব্যাক্তি ও সমাজের উপড় পড়ে। রেষ্টুরেন্টে বসে যার-যার, তারতার পয়সায় খাচ্ছি। কিন্তু সেখানে যেহেতু বেশীর ভাগ মুসলমান এবং হিজাব পরিহিত মুসলিম আছেন, সে জন্য আমি বিয়ার নিজের পযসায়ও কিনে খেতে পারব না। আমাকে তাদের বিস্বাসের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। এই কারণে হিজাক, বুরকা, বিকিনী যাই বলেন, এক: নিজের প্রতি সুপেরিয়র, এবং অন্যের প্রতি ইনফিরিয়র কমপ্লেক্স তৈরী করে। দুই: পুরুষের চেয়ে নারীর মূল্য-মান-জ্ঞান-বিদ্যা-শিক্ষা কম তার স্বীকৃতি নিজেই দেয়। এর মধ্যে হীনমণ্যতা ছাড়া আর কিছু নেই। অবশ্য বিস্বাশ এম্নিই মানুষৈর স্বাধীন চিন্তা লুপ্ত করে দেয়।
মজার ব্যাপার হল কোরনে কিন্তু হিজাব বিকিনী বুরকার কথা কোথাও লেখা নেই। কাজেই সাধু সাবধান।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

আশরাফ মাহমুদ এর ছবি

ঘটনাটা দুঃখজনক। এভাবে ধর্ম ও ধর্মের নামে শিশুকাল থেকে মগজধোলাই হয়। অনেকে, যেমন ডকিন্স, মনে করেন শিশুকালে ধর্মশিক্ষা দেয়া এক ধরনের অ্যাবিউজ।
অন্যের বিশ্বাসের প্রতি সম্মান দেখানো মানে কিন্তু এই না যে নিজের সুখ উপভোগ আহ্লাদ বিসর্জন দেয়া, আমার মনে হয়। বিয়ারের ঘটনা যদি ধরি, আমি হলে বিয়ার নিতাম, আর সম্মান দেখানোর এই প্রত্যাশা থেকেই রমজানে অনেক মুসলমান আশা করে হিন্দু মালিকানাধীন হোটেল দিনে বন্ধ থাকবে!
সমস্যা হচ্ছে ধর্মপক্ষ ও ধর্মনিরপেক্ষ উভয় দলই নারীর পোষাক নির্ধারণ করে দিতে আগ্রহী।

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

আপনার লেখা আর মন্তব্যগুলো পড়ে কাল নিচের ছোট্ট লেখাটা লিখেছি।

ছোটবেলায় আমি পুতুল দিয়ে খেলতাম। আমার ভাই খেলতো গাড়ি দিয়ে। আমার গাড়ি দিয়ে খেলতে মন চাইতো না। আমি পুতুলকে সাজাতাম। টিপ, কাজল দিয়ে। মায়ের পিতলের কাজলদানি থেকে লুকিয়ে আঙুলে করে কাজল এনে পুতুলের চোখে লেপটে দিতাম। সাদা রঙের কাপড়ের পুতুলে কলমে আঁকা চোখদুটির কাজল আমার হাতের পানিতে নোংরা হয়ে গেলে কেঁদে কেটে হেঁচকি তুলতাম। মা আমাকে আবার পুতুল বানিয়ে দিতো। সেলাই মেশিনের ড্রয়ার থেকে কালো সেলাই সুতো দিয়ে পুতুলের চুল হতো, চারকোণা রুমালের মতো কাপড়টাকে ভাঁজ করে মা পুতুলের আকৃতি দিতো। কাপড়ের ভাঁজে ঝাড়ুর শলা ঢুকিয়ে কৌশলে দেয়া হতো হাত। আমি জুতোর বাকসের মধ্যে পুতুলের সংসার সাজাতাম। বাবা, মা আর মেয়ে পুতুল। একদিন সেই পুতুল পরিবারকে আমি ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিলাম।

কোনো মন খারাপ ছাড়াই প্রিয় সঙ্গীদের সাথে বিচ্ছিন্নতাও আমি মেনে নিলাম। দাদী যখন বললো, পুতুল খেললে আল্লাহ গুনাহ দেয়, তখন আমি দাদীর কাছে গুনাহ দেখতে চেয়েছিলাম, দেখি দেখি, গুনাহ কেমন দেখি! আল্লাহ কী করে গুনাহ দেয়? অামাকে একটু দাও তো! দাদী আমাকে সুন্দর করে বোঝালেন। ভয় নাকি ভক্তি আমার মনকে অাচ্ছন্ন করেছিল আমি বুঝিনি। তবে দাদীর কাছে প্রশ্ন করে আমি নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম যে, গাড়ি দিয়ে খেললে গুনাহ হয় না। তখন অামার কি যে হলো, আমি তখন বাবা-মায়ের কাছে গাড়ি চাইলাম। লাল রঙের গাড়ি, অাগুন নেভানোর। শুনে বাবা হাসলো, মা হাসলো। কিন্তু অামাকে গাড়ি কিনে দিলো না।

মেয়েরা গাড়ি দিয়ে খেলে না শুনে আমার কিন্তু মন খারাপ হলো না। আমি মুগ্ধপাঠের মতো শিখলাম, আমি মেয়ে, আমার খেলনা আলাদা। আমার নতুন খেলনা প্রয়োজন দেখে বাবা বৈশাখি মেলা থেকে আমাকে হাঁড়িপাতিলের সেট কিনে দিলো। এই খেলনাগুলো আমাকে দারুণ সংসারী করে তুললো। গাড়ি কেনার কথা আমি আর কখনো বলিনি।

আমার ভাই যখন ছুটির দিনে বাবার সাথে বাজারে যাবার প্রস্তুতি নিতো, আমি নিজের অপটু হাতে তড়িঘড়ি চুল আঁচড়ে কানের দুপাশে দুটো ক্লিপ আটকে দৌড়ে তাদের পিছু পিছু সিঁড়িতে নামতাম। মা আমাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে আসতো, মেয়েদের যখন তখন বাইরে যেতে নেই। বাসায় অনেক কাজ। অবসরে ঘরকন্না শিখে নিতে হয়।

নিজের ভুল বুঝতে পেরে আমি মায়ের সাথে টেবিল গোছাতাম, শরবত বানাতাম। ভাই আর বাবা এসে খাবে। বাবার জন্য অপেক্ষায় থেকে থেকে আমার মনটা খুশিতে ভরে উঠতো, আমি জানতাম বাবা নির্ঘাত আমার জন্য কিছু আনবে। বাজারের থলে থেকে ভাই যখন লাটিম বের করতো আমি তখন খুশি মনে দেখতাম। বাবা আমার জন্য কিছু আনার কথা ভুলে গেছে বলে আমার মন খারাপ হতো না। ভাইয়ের পিছু পিছু লাটিমের চক্কর দেখতে দেখতে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করতাম।

নিজের জন্মগত সৌভাগ্যকে উপভোগ করতে করতে একদিন আমি বড় হলাম। আমার প্রিয় টবের গাছগুলোতে পানি দিতে যখন ভাবছি, কেমন অদ্ভুত রক্তাক্ত এই বড় হওয়া! মা হৈ হৈ করে দৌড়ে আসলো, এই ভর সন্ধেতে নাপাক শরীরে গাছের সামনে যাসনে! নিজের মূর্খামিতে জিব কেটে প্রশ্নহীন আমি বাইরের আলো ছেড়ে চার দেয়ালের অন্ধকারে ফিরে আসি।

এভাবেই সেই ছোটবেলা থেকে আমি অন্ধকারকে ভালোবাসি।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

আজ থেকে দশ পনের বছর আগে ঢাকায় মুখ ঢাকা বোরকা সব চেয়ে বেশী পড়তো সেই সব মেয়েরা, যাদের সর্ব সমক্ষে চেহারা দেখাতে অসুবিধা আছে, যেমন সিনেমার এক্সট্রা, কল গার্ল, এমন কি সরাসরি রুপপোজীবী যারা, তারাও। যে কারনেই হোক, এখন অনেক স্বাভাবিক মেয়েও পুরোপুরি মুখ ঢাকা বোরকা পড়ছে। এর একটা নেতিবাচক ফল ইতিমধ্যেই পড়তে শুরু করেছে ঢাকার সমাজে। আমার দু ভাগ্নি(পরস্পর সহোদরা)বাসার সামনে একে অপরের সাথে কথা বলছিল। তাদের একজন আধুনিক হিজাবে আবৃত, অন্যজন ছিল স্বাভাবিক পোশাকে। অকস্মাৎ একটা গাড়ল টাইপের অভব্য ছেলে তাদের সামনে এসে উদ্ধত স্বরে হিজাববিহীন বোনটিকে বলে বসলো- "ঐ মেয়েটা এত সুন্দর পোশাকে চলাফেরা করে, আর তুমি এরকম বেপর্দা বেশরমের মত চল কেন? এখন কেউ যদি তোমাকে কিছু বলে বসে, সেইটা কি তার দোষ, নাকি তোমার?" ইদানিং জুম্মার নামাজের খুৎবায় ঠিক একই ধরনের বক্তব্য প্রদান করে চলেছেন আমাদের পাড়ার মসজিদের ইমাম সাহেব। সম্প্রতি গুলশানের হলি আর্টিজানেও জেহাদি ভায়েরা একই ধরনের জোশে বলীয়ান হয়ে হিজাবী বোনেদের প্রতি অকুণ্ঠ সম্মান আর হিজাবছাড়াদের পৈশাচিকভাবে জবাই করেছিল বলে জানা যায়।
বুরকিনা বা বুরকা বা হিজাবের সবচেয়ে বড় বিপদ এটাই। স্বাভাবিক পোশাকের অন্যান্য মেয়েদের জন্য এটা ধীরে ধীরে একটা বিপদের কারন হয়ে উঠছে। সেটা সৌদি কিংবা বাংলাদেশ কিংবা ফ্রান্স, যেখানেই হোক না কেন।

সোহেল ইমাম এর ছবি

ইদানীং তিন চার বা তার চেয়েও কম বয়সী শিশুদেরও একটু মুখ খোলা বোরখা পরাতে দেখা যাচ্ছে। আগে এটা খুব বেশি দেখিনি এখন প্রায়ই দেখি। কোন কোন বাচ্চাদের স্কুলের পোষাকটার সাথেই হিজাবের ব্যবস্থাও দেখছি। আমাদের দেশের আবহাওয়ায় এটা কি শিশুদের স্বাস্থ্যের জন্য বিরূপ প্রভাব ফেলবেনা? হতে পারে ঘরে এই বাচ্চা গুলোকে হয়তো এসব পরানো হয়না, কেবল বাইরে গেলেই পরানো হয়। কিন্তু স্কুলের সময়টাও তো কম নয়।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

guest_writer এর ছবি

আজকের সমাজ এখনো নারীদের নিয়ন্ত্রণ করতে চায় সে বিষয়ে একমত। তবে বুরকিনি নিষদ্ধকরণ বিষয়ে ধর্মকে সরিয়ে রেখে চিন্তা করলে আরেকটি আঙ্গিক পাওয়া যায়। বেশ অনেকটা সময় ধরেই পশ্চিমা দেশগুলো নানা আক্রমণের লক্ষ্য। তাই সেটি থেকে নিজেদের নাগরিকদের রক্ষা করতে তারা মরিয়া। মধ্যপ্রাচ্য কিংবা এশিয়ার কিছু দেশে এখনো ধর্ম নিয়ে যে হাইপারসেনসিটিভিটি (hypersensitivity) সেটি থেকে পশ্চিমা দেশগুলো অনেক আগেই বেরিয়ে এসেছে। তাই পশ্চিমা দেশগুলো নিজেদের নিরাপত্তার জন্য যা করা দরকার তা সহজে করতে পারে। বুরকিনি নিয়ে যে সমস্যাটি সেট কোন পুরুষের পোষাক হলেও হতে পারত। হতে পারে আমরাই ধর্মকে বেশী গুরুত্ব দেই বলে বেশি চোখে লাগছে।

- দূরের বাতিঘর

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।