সমুদ্র পাড়ের গান

তারাপ কোয়াস এর ছবি
লিখেছেন তারাপ কোয়াস [অতিথি] (তারিখ: সোম, ২১/০৩/২০১১ - ৬:৪২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সেলফোনে সকাল সাড়ে ছয়টায় এলার্ম দেয়া। প্রতিদিন নির্ভুলভাবে ওই সময়টাতে কর্কশ শব্দ করে জাগিয়ে তোলে। অনেকরকম এলার্মটোন নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করেছে, লাভ হয়নি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম বাজনাটা যখন প্রতিদিন ঘুম থেকে তোলার দায়িত্ব পায়, কিছুদিনের মধ্যেই তা চরিত্র পাল্টিয়ে ভিলেনের রূপ নেয়। যেন সকালবেলা নায়কের ঘুম ভেঙ্গে দিয়ে ব্যাপক বিনোদন পাচ্ছে, তাই যতটা সম্ভব কর্কশ শব্দ করা যায়! ঘুম থেকে উঠে মিনিট পনেরোর মধ্যেই রেডি হয়ে মাইক্রোওয়েভ ওভেনে এক কাপ পানি প্রবেশ করিয়ে পাক্কা এক মিনিট পঞ্চাশ সেকেন্ড অপেক্ষা করা। ইনস্ট্যান্ট কফি এক চামচ আর কফি-মেট ২চামচ সাথে ১টা শুগার কিউব। কফি প্রস্তুত। তারপর বাইকে চড়ে কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে রওনা।
ছোটবেলায় কতবার ভেবেছে টাকা হলে একটা মোটরসাইকেল কিনবে, দিগবিজয়ী সম্রাটের মতো সেটা নিয়ে সারাদিন টোটো করে ঘুরে বেড়াবে । স্বপ্নগুলোতে শুধু পজিটিভ দিকই থাকতো। প্রতিদিন বাধ্যতামূলক ভাবে তা চালতে হলে সেটা যে চরম একঘেয়েমি ব্যাপার হতে পারে সে তিক্ততা সেখানে থাকতো না। প্রথম প্রথম এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে যেতো। চারদিকে নীল সমুদ্র, সবুজ টিলা, হয়তো দূর দিয়ে চলে যাচ্ছে কোনও বিশাল কার্গো জাহাজ কিংবা একপাল সৌন্দর্য শিকারী পর্যটক নিয়ে বিপুলায়তনের প্রমোদ তরী। নাম না জানা হাজারো সামুদ্রিক পাখি বা ছোট্ট দ্বীপগুলি। ধীরে ধীরে এই অপার্থিব সৌন্দর্যগুলোও ম্লান হয়ে আসতে থাকে। অনেকটা উইন্ডোজ মুভি মেকারের ফেড আউট ইফেক্ট এর মত। আজকাল কোন কিছুতেই আর কোনকিছু যায় আসে না। দম দেয়া যন্ত্রের মত শুধু চলছে।

দীর্ঘদিন বেঁচে থাকাটা আসলে একটা কষ্টকর ব্যাপার। একঘেয়েমি ব্যাপার। সব থেকে খারাপ হল এই একঘেয়েমির লুপ থেকে বের হবার চেষ্টাও ওই লুপের মধ্যেই ঢুকে পড়ে। তাই আজকাল আর সে চেষ্টা আর করা হয় না।
সারাদিন ব্যস্ততার পর আবার সেই বাইকে চেপে ঘরের উদ্দেশ্যে পথ পাড়ি দেওয়া। তারপর আবার সকাল, আবার সেই কফি, বাইক..... ক্যামুর নায়ক এর সাথে কোন পার্থক্য থাকে না।

সেদিনের সেই সন্ধা একটু ব্যতিক্রম হল। অন্যসব দিনের মতই কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছাড়াই নামহীন একটা ব্যস্ত দিন শেষ করে ওর বাহনে চেপে ফিরছে। দীর্ঘ গাড়ির মিছিল এর পিছনে। সন্ত জর্জে প্রবেশ করে গাড়িগুলো যার যার গন্তব্যে পৌঁছে যায়। শুধু একটা বাকি থাকে। রাস্তাঘাটগুলো মুখস্থ হয়ে গেছে। সামনের ওই গতি রোধকের সামনেই এই ধ্বজভঙ্গটাকে ওভার টেক করা যাবে। না হলে আরও দীর্ঘক্ষণ এর পিছন পিছন এগুতে হবে। ড্রাইভারটা মনে হয় কোন টিপিক্যাল বুড়ো, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। ৪০কিমি উপর উঠচ্ছে না। গতি রোধকের কাছে আসতেই ওর বাহনের গতিবেগ বাড়িয়ে গাড়িটার পাশে চলে আসে। তারপর ব্রেক চেপে আবার গতিবেগ বাড়ায় রুটিন মাফিক। দেখে ওই বুড়োটাও গাড়ির গতিবেগ বাড়িয়ে দিয়েছে। মনে মনে হাসে ও । বুড়ো জানে না যে ওর সদ্য কেনা অটোম্যাটিক বাইকে চোখের পলকে ষাট কিমি উঠিয়ে ফেলা যায়। বুড়ো পড়ে থাকবে হাজার আলোকবর্ষ পেছনে। গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ শুনে বুঝতে পারে শয়তান বুড়ো গ্যাস প্যাডেল ফ্লোরের সাথে চেপে ধরেছে। ঠিকাছে তাহলে তাই সই। ওর বাইকের থ্রটলে মোচর বাড়িয়ে দিতেই বাইক গর্জে উঠে আরও বেগে ছুটতে থাকে। কিন্তু আজ ওই ধ্বজভঙ্গটা যেন পণ করেছে এই ফালতু রেসে ওকে হারাবেই! সামনে দ্রুত রাস্তার বাক এগিয়ে আসছে। এখনি ব্রেক করা দরকার।ওদিক থেক কোন গাড়ি আসলে মুখোমুখি সংঘর্ষ অনিবার্য। কারণ ওর বায়ে রয়েছ শয়তান বুড়োর গাড়ি আর ডানদিকে নিরেট দেয়াল। ব্রেক করলেও বাঁদিকের গাড়ির পেছনে আসতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। ঠিক কি কারণ জানে না ও গতিবেগ কমাল না। সারাজীবন পরাজিত হতে হতে হয়তো আর একবার কোন অর্থহীন রেসেও পরাজিত হতে চায় নি বলে। কিংবা জীবন নিরর্থক এই ভাবনা থেকে! সহসাই মোড়ের ওদিক থেকে একটা গাড়ি বের হয়ে আসে। আর মাত্র দুই এক সেকেন্ড এর ব্যাপার। তারপরই ঘটবে ঘটনাটা। ওর ভয়ানক ভয় পাওয়া উচিত, কিন্তু কেন যেন আশ্চর্য রকমের শান্ত লাগছে, মনে হচ্ছে সময় ধীর গতিতে চলছে। পরিচিত কারও মুখ মনে এলো কি? না ফেলে আসা জীবনের জন্য দু:খবোধ? এসব কিছুই মনে হল না। শুধু বুঝতে পারলো হেরে গেছে ও । চোখ বন্ধ করার পরিবর্তে শেষ মুহূর্তে থ্রটলটা পুরো ঘুরিয়ে দিলো। এর পরের কয়েক মুহূর্ত একটু ঝাপসা। শুধু মনে আছে বিপরীত দিক থেকে আসা গাড়িটা হার্ড ব্রেক করে দাড়িয়ে পড়েছে ওর থেকে কয়েক ফিট দুরে, আর ওই সামান্য একটু ফাঁক দিয়ে তীব্র বেগে বাইক নিয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছে। পেছনে শুনতে পেয়েছিলো তীব্র হর্নের শব্দ।

বাসায় ফিরে জিম বিম এর বোতল থেকে খানিকটা তরল উষ্ণতা গলায় চালান করে দেয়। অনেকদিন ঘুমিয়ে থাকা অকেজো বিবেক জাগ্রত হয়। অপরাধ বোধ হয় জীবন নিয়ে বাজি খেলার জন্য।

আবার সকাল হয় একই নিয়মে। সেই পুরনো কফি, তারপর আবার সেই বাহনে চেপে চলা।
শুধু নতুন সংযোজন গতকালের নিয়মভাঙ্গা ঘটনা আবারও নিয়মমাফিক ঘটার সম্ভাবনা।


মন্তব্য

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

ভালো লেগেছে

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

তারাপ কোয়াস এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-


love the life you live. live the life you love.

তিথীডোর এর ছবি

আজকাল কোন কিছুতেই আর কোনকিছু যায় আসে না।

দীর্ঘদিন বেঁচে থাকাটা আসলে একটা কষ্টকর ব্যাপার।

এই দুটো লাইনে তারা দাগালাম..

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

তারাপ কোয়াস এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ তিথীডোর।


love the life you live. live the life you love.

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখা ভালো লেগেছে। শুধু একটা প্রশ্ন, জীবনের কাছে পরাজিত কেন? মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে কোন চেনা মুখ খুঁজে পেল না, তাই? আমার খুব অবাক লাগে যখন শিক্ষিত, কর্মক্ষম কোন মানুষ এই ধরনের মন্তব্য বা হতাশা প্রকাশ করে। আমাদের জীবন কি এতোই তুচ্ছ! অনেকদিনের একটা স্বপ্ন যদি পূরণ না হয় বা প্রিয়জন যদি দূরে চলে যায় অথবা আরেকজনের মতো পরিপাটি সংসার হয়ত পেলাম না; তো কী এসে গেল? একটা পাইনি তো আরেকটা পেয়েছি। আমরা যারা লেখাপড়া করার সুযোগ পেয়েছি, সুস্থ আছি, কর্মক্ষম আছি, তারা কি কখনো চিন্তা করি কত বড় ভাগ্যবান আমরা। এতো সুন্দর পৃথিবীতে এই ভাগ্যবান মানুষেরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কেন আমি বুঝতে পারি না। আসলেই বুঝতে পারি না!
-রু

তারাপ কোয়াস এর ছবি

"যাহা পাই তাহা ভুল করে পাই, যাহা চাই তাহা পাই না" হয়ত একারণেই হাসি
লেখা ভালো লাগার জন্য ধন্যবাদ।


love the life you live. live the life you love.

পাগল মন এর ছবি

ভাবছিলাম ছবি দিবেন আরো কয়েকটা, কিন্তু এতো দেখি নির্ভেজাল গল্প। তবে গল্প বেশ ভালো লেগেছে।

প্রথম প্রথম এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে যেতো। চারদিকে নীল সমুদ্র, সবুজ টিলা, হয়তো দূর দিয়ে চলে যাচ্ছে কোনও বিশাল কার্গো জাহাজ কিংবা একপাল সৌন্দর্য শিকারী পর্যটক নিয়ে বিপুলায়তনের প্রমোদ তরী। নাম না জানা হাজারো সামুদ্রিক পাখি বা ছোট্ট দ্বীপগুলি। ধীরে ধীরে এই অপার্থিব সৌন্দর্যগুলোও ম্লান হয়ে আসতে থাকে। অনেকটা উইন্ডোজ মুভি মেকারের ফেড আউট ইফেক্ট এর মত। আজকাল কোন কিছুতেই আর কোনকিছু যায় আসে না। দম দেয়া যন্ত্রের মত শুধু চলছে।

এই লাইনগুলো একদম মিলে গেল আমার সাথে।

------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।

তারাপ কোয়াস এর ছবি

লেখা ভালো লেগেছে জেনে ভালো লাগলো। জীবন ক্লান্তিকর, একঘেঁয়ে একটা ব্যাপার, তাই হয়তো একজনের গল্প আরেকজনের সাথে এত তাড়াতাড়ি মিলে যায়!


love the life you live. live the life you love.

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

একাকীত্ব টের পাওয়া যায়। প্রবাস জীবনের নস্টালজিয়া?

যেটাই হোক ভালো থাকুন।

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

তারাপ কোয়াস এর ছবি

ফিহা সমীকরণের মত চক্রে আটকা দেঁতো হাসি অনেক ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।


love the life you live. live the life you love.

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখাটা আর দশজন একলা মানুষের গল্পের মতই চেনা। আচ্ছা যেসব মানুষগুলো সংসারী তারাও কী এমন ভাবেন, জীবনটা একঘেয়ে? আমার মনে হয় ঠিকই ভাবেন। যত যাই হোক, ঘড়ি ধরে তাদেরও চলতে হয় তো! ঘড়ি ধরে চলাটাই কেমন একঘেয়ে, না? গল্পের বাইক ছুটিয়ে চলা মানুষটির জন্য একটা ছোট্ট উপদেশ, 'সাবধানে বাইক চালাবেন প্লিজ!'

- আয়নামতি

তারাপ কোয়াস এর ছবি

গল্পের বাইক ছুটিয়ে চলা মানুষটি সাবধানেই চালায় তবে আশেপাশের লুকজন আরও সাবধানী তাই একে হালকা
বেপরোয়া লাগে হাসি
চমৎকার মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ।


love the life you live. live the life you love.

কৌস্তুভ এর ছবি

হুমম... রোজই সকাল হয় একই নিয়মে, কেবল দিনগুলো বদলে যায়...

তারাপ কোয়াস এর ছবি

মন খারাপ


love the life you live. live the life you love.

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

দীর্ঘদিন বেঁচে থাকাটা আসলে একটা কষ্টকর ব্যাপার। একঘেয়েমি ব্যাপার

হ...

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

তারাপ কোয়াস এর ছবি

আপনেও কি প্রহস এ যোগ দিলেন নাকি নজরুল ভাই হাসি [প্রবাসী হতাশাবাদী সংঘ]


love the life you live. live the life you love.

তারানা_শব্দ এর ছবি

নিজেই খুব হতাশ, হয়তো একারণেই লেখাটা একটু বেশিই ভালো লাগলো!!! হাসি

"মান্ধাতারই আমল থেকে চলে আসছে এমনি রকম-
তোমারি কি এমন ভাগ্য বাঁচিয়ে যাবে সকল জখম!
মনেরে আজ কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক-
সত্যেরে লও সহজে।"

তারাপ কোয়াস এর ছবি

ভালো লেগেছে জেনে ভালো লাগলো। হতাশ হওয়া খুব একটা ভাল কথা না(কারে কি কই, নিজেইতো চরম হতাশ মন খারাপ


love the life you live. live the life you love.

তারাপ কোয়াস এর ছবি

রিটন ভাই অনেক ভালো লাগলো আপনার মন্তব্যটা পেয়ে।
অট: মাঝে মাঝে কিছু মুখ অজানা কারণে স্মৃতিতে গেঁথে থাকে, বহুকাল আগে বিটিভে দেখা আপনার সেই মুখ এখনও মনে করতে পারি হাসি


love the life you live. live the life you love.

লুৎফর রহমান রিটন এর ছবি

তারাপ কোয়াস নামটায় কেমন যেনো তাপস কোয়ারা তাপস কোয়ারা ধ্বনির সাদৃশ্য।
লেখা ভালো লেগেছে।

হাবু বেশ বড়সড়,গাবুটা তো পিচ্চি
হেরে গিয়ে হাবু বলে--উৎসাহ দিচ্ছি!

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

লেখা ভাল্লাগছে।

তারাপ কোয়াস এর ছবি

লইজ্জা লাগে ধন্যবাদ শুভাশীষদা।


love the life you live. live the life you love.

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।