বৈরী পরিবেশ আমাদের বেঁচে থাকার সক্ষমতা সম্পর্কে আমাদের জানার বড় একটা অংশ এসেছে এক অসস্তিজনক সূত্রে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সামরিক বন্দীদের, বন্দী-শিবির এর অভাগা লোকজন এবং বেসামরিক নাগরিকদের উপর চালিত পরীক্ষাগুলি থেকে। নাৎসি জার্মানিতে, সুস্থ বন্দীদের অঙ্গ ছেদ করা কিংবা পরীক্ষামূলক অঙ্গ সংযোজন বা হাড় প্রতিস্থাপন করা হতো। এগুলোর উদ্দেশ্য ছিল জার্মান যুদ্ধাহত সৈন্যদের জন্য উন্নত চিকিৎসা খোঁজা। জার্মান বৈমানিকরা সাগরে পড়লে কতক্ষণ বেঁচে থাকতে পারে সেটা জানার জন্যে রাশিয়ার যুদ্ধবন্দীদের বরফ জলে ডুবিয়ে রাখা হতো। সেই একই উদ্দেশ্যে অন্যদেরকে নগ্ন গাত্রে বাইরের হিমশীতল আবহাওয়ায় দাড় করিয়ে রাখা হতো, একটানা চৌদ্দ ঘণ্টা পর্যন্ত। কিছু পরীক্ষার উদ্দেশ্য দেখলে মনে হনে হয় সেগুলা করা হয়েছিলো শুধুমাত্র তাদের অসুস্থ কৌতূহল মেটানোর খাতিরে। চোখের রং পাকাপাকিভাবে পরিবর্তিত হয় কিনা তা জানার জন্য এমনি এক পরীক্ষায় বন্দীর চোখে ইনজেকশনের মাধ্যমে রং ভরে দেওয়া হয়েছিলো । অন্যদের উপর চালানো হয়েছিল বিভিন্ন ধরনের বিষ এবং নার্ভ গ্যাস এর পরীক্ষা। অনেককে সংক্রমিত করা হয়েছিলো ম্যালেরিয়া, ইয়োলো ফিভার, টাইফাস আর স্মলপক্সে। “কনট্রারি টু পোষ্টওয়ার এপোলজিস” এ জর্জ এবং মাইকেল লিখেছিলেন " ডাক্তারদের সেই পরীক্ষাগুলো করর জন্য কখনোই বাধ্য করা হয়নি"। তারা সকলেই তা করেছিলেন স্বেচ্ছায়।
জার্মানিদের সেই ভয়াবহ পরীক্ষাগুলাকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলো জাপানিরা। বীভৎসতায় যদি নাও হয়ে থাকে, তবে ব্যাপকতায়। শিরো ইচি নামক এক ডাক্তার এর তত্ত্বাবধানে জাপানিরা গড়েছিল বিশাল এক প্রতিষ্ঠান। মাঞ্চুরিয়ার হারবিনে যার দেড়শত ভবন ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল দেড়হাজার একর জমির উপর। উদ্দেশ্য সেই একই। মানুষের শারীরিক সহ্যক্ষমতার সীমা বের করা, তা যে প্রকারেই হোক। ইউনিট সেভেন থ্রি ওয়ান নামে পরিচিত ছিল সেই প্রতিষ্ঠানটি।
তাদের পরিচালিত সাধরণ কোন এক পরীক্ষায়, চায়নিজ বন্দীদের খুঁটির সাথে বেঁধে রাখা হতো বোমা থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে। বোমাটি বিস্ফোরণ ঘটনার পর বৈজ্ঞানিকগণ সেই বন্দীদের কাছে যেয়ে খুঁটিয়ে আহতের বর্ণনার নোট নিতেন। সাথে এটাও দেখতেন আহতের মৃত্যু ঘটতে কত সময় লাগে। অন্য বন্দীদের উপর অগ্নিবর্ষী যন্ত্র (ফ্লেম থোয়ার) দিয়ে একই কারণে পরীক্ষা চালানো হতো। কোন সময় বন্দীদের অনাহারে ফেলা রাখা হতো কিংবা তীব্র শৈত্যে অথবা বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত করা হতো সেই একই জন্যে। সজ্ঞান অবস্থায় কারও কারও উপর চালানো হতো কাটাকুটির পরীক্ষা। কি কারনে তা কেউই জানে না। বেশীরভাগ অভাগাই ছিল যুদ্ধবন্দী চায়নিজ সৈনিক। কিন্তু ইউনিট সেভেন থ্রি ওয়ান মিত্র বাহিনীদের উপরও একই পরীক্ষা করতো, এটা নিশ্চিত করতে যেন তাদের তৈরি নার্ভ গ্যাস আর বিষ সমান ভাবে কাজ করে মিত্র বাহিনীর উপর। যখন কোন শিশু কিংবা গর্ভবতী মহিলাদের উপর পরীক্ষা চালানোর দরকার পড়তো, তাদের যোগার করা হতো হারবিনের রাস্তা থেকে, দৈব চয়নের ভিত্তিতে। ইউনিট সেভেন থ্রি ওয়ানে কত লোক মারা গেছে তা সঠিক কেউ জানে না, তবে এক হিসাব মতে সংখ্যাটি আড়াই লক্ষ পর্যন্ত হতে পারে।
এই সকল পরীক্ষানিরীক্ষার ফলাফল ছিল জার্মান আর জাপানীদের ভিন্ন এক যুদ্ধে বাকি পৃথিবীর থেকে এগিয়ে যাওয়া। তাদের অণুজীববিদ্যা, পুষ্টিবিদ্যা, ফ্রষ্টবাইট, সমরকালীন জখম আর সর্বোপরি নার্ভ গ্যাস, টক্সিন আর সংক্রামক রোগবালাই সংক্রান্ত জ্ঞানের দিক থেকে অগ্রবর্তী হওয়া। পরবর্তীতে জার্মানির অনেককে ধরা হয় এবং তাদের যুদ্ধাপরাধের বিচারও করা হয় কিন্তু প্রায় সকল জাপানীরাই থেকে যায় এ সকলের ঊর্ধ্বে । আমেরিকান বন্দীদের উপর চালানো পরীক্ষালব্ধ উপাত্ত সহভাগিতা করার শর্তে অধিকাংশ জাপানিদের বিচার থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ইউনিট সেভেন থ্রি ওয়ান যার পরিকল্পনা প্রসূত এবং যার তত্ত্বাবধানে চলতো, সেই ড: শিরো ইচি'কে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের পর তাকে তার সাধারণ জীবনে ফিরে যাবার অনুমতি দেওয়া হয়।
জাপানী এবং মার্কিনীদের কাছে সর্বোচ্চ গোপনীয়তার প্রকল্প ছিল ইউনিট সেভেন থ্রি ওয়ান। হয়তো সারাজীবন ধরে গোপনই থেকে যেত যদি কিনা ১৯৮৪ সালে, কোন এক পুরনো বই এর দোকানে, টোকিওর কিউ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র, বাক্স ভর্তি তাদের কুকীর্তির কাগজপত্র আবিষ্কার করে সবাইকে না জানাতো। ততদিনে শিরো ইচিকে বিচারের সম্মুখীন করার জন্য অনেক দেরি হয়ে গেছে। যুদ্ধপরবর্তী দেড় দশকের নিরুপদ্রব জীবনযাপন শেষে ৬৭বছর বয়সে, ১৯৫৯ সালে ঘুমন্ত অবস্থায় শান্তিতে মারা গিয়েছিলো শিরো ইচি।
* নাৎসি জার্মানিদের অ-সংবেদনশীলতার চিত্রটা অবিশ্বাস্য রকমের। ১৯৪১ সালে লিমবার্গের কাছে হাডামা (Hadamar) এর এক মানসিক হাসপাতাল, দশ সহস্রাধিক মানসিক রোগীদের মেরে ফেলে সেটা অফিসিয়ালি উদযাপন করা করেছিলো প্রীতি ভাষণ আর প্রত্যেক কর্মীর জন্য বিয়ার সরবরাহের মাধ্যমে।
মূল: বিল ব্রায়সন- দি বডি
মন্তব্য
ওয়েলকাম ব্যাক! সম্ভবত বছর তিনেক পরে লিখলেন। লেখাটা কি এতটুকুই? আগ্রহ মিটল না।
তারপর আছেন কেমন? এখনো কি ঐ রহস্যের দ্বীপে আছেন? এই করোনা ক্রান্তিকালে কিছু বাজাননি? আমাদেরকে একটু শোনান।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
ধন্যবাদ পাণ্ডবদা। আসলেই অনেকদিন পরে আসা হলো। বইয়ের এই অংশটুকু পড়তে যেয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সাথে এক মিল পেয়ে ভাবলাম অনুবাদ করে ফেলি। আমাদের দেশের যুদ্ধপরাধীদের বিচার আমরা করতে পেরেছি কিন্তু অনেক পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর শিরো ইচিরা আমাদের নাগালের বাইরে থেকে গেছে আন্তঃর্জাতিক আইনের মারপ্যাঁচে।
অট: সেই রহস্যজনক দ্বীপে আর থাকা হয় না বছর দুয়েক হলো পাণ্ডবদা। আপাতত ম্যাপল সিরাপের দেশে আস্তানা গেড়েছি। গানবাজনায় ভাটা পড়েছে পড়লেখার চাপে।
love the life you live. live the life you love.
আমার মনে হয় যদি কোন চাপ না নিয়ে একটু একটু করে আগান তাহলে গোটা বইটা এক্সময় অনুবাদ হয়ে যাবে। ভেবে দেখতে পারেন।
মূল ভূখণ্ডে আর লেখাপড়ায় ফিরেছেন জেনে ভালো লাগলো। এই পর্যায়ে লেখাপড়ার চাপ তো থাকবেই। সপ্তাহান্তে একটু টুংটাং পরের সপ্তাহটা চলার রসদ জোগায়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
চেষ্টা করবো আবার টুংটাং নিয়ে ফিরতে পাণ্ডবদা।
love the life you live. live the life you love.
জাতি-দেশ-কাল নির্বিশেষে হোমো স্যাপিয়েন্স প্রজাতিটি অদ্ভুত!
বিজ্ঞানী না হলেও, আমাদের দেশি ভাইদের গোদাটিও প্রায় একইভাবে বিদায় নিয়েছেন। (অন্যদের জন্য) নিরুপদ্রব জীবনযাপন ছাড়াই! অন্তত মরার আগে "দণ্ডিত আসামী স্ট্যাটাস" পেয়েছেন এটুকুই স্বান্তনা।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
নির্মমতা আর নিষ্ঠুরতার কোন স্কেল থাকলে সেটাতে আমাদের প্রজাতির অবস্থান থাকতো একবারে উপরের স্থানে সেটা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
দেশী পালের গোদা গোআজম যুদ্ধাপরাধী হিসাবে সাজা ভোগকালীন সময়ে মারা যাবে এইটা ভাবাই একসময় দিবাস্বপ্ন ছিল কিন্তু আমরা পেরেছি সেটা বাস্তবায়ন করতে। পাকিস্থানী সামরিক বাহিনীর সেই ২০০ অফিসার হচ্ছে শিরো ইচির ভাই ব্রাদার, অনেকেই শান্তিতে পটল তুলতে পেরেছে।
love the life you live. live the life you love.
জ্ঞান অর্জনের নামে মানুষ মানুষের প্রতি এত নৃশংসতা করতে পারে এটা ভাবতেও অসুস্থ লাগে। সম্ভবতঃ আরো ভয়ানক যে, হোমো স্যাপিয়েন্সরা এটা পৃথিবীর কোনও না কোনও প্রান্তে করে চলেইছে।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
স্ত্রীরোগবিদ্যার জনক জে. মারিয়ন সিমস কোনো রকম অবেদক (anaesthesia) ছাড়াই কৃষ্ণাঙ্গিনী ক্রীতদাসীদের ওপর কাটাছেঁড়া করে গেছেন। কিন্তু সবাই তাঁকে বাপ ডেকে অস্থির।
জানা ছিল না। পড়লাম এখন। মর্মান্তিক। জ্ঞানের প্রদীপ ধরে থাকা নির্যাতিত মানুষের কান্না অশ্রুতই থেকে যায়।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
আগিলা জামানাতেই কেবল না। এখনকার জামানাতেও হরহামেশা নানা প্রকার অষুধ আর টিকা এশিয়া আর আফ্রিকার গরিব দেশগুলোতে পরীক্ষা নীরীক্ষা করা হয়। তাতে যারা মারা যান তারাও অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করেই মরেন।
ইতরতা অবিনশ্বর!
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
সেইটাই।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
এটা হবার সম্ভাবনা একবারে যে নাই সেটা আমার মনে হয় না। বিশেষত এক্সপেরিমেন্টাল ড্রাগগুলা নিয়ে।
love the life you live. live the life you love.
নৃশংসতার বীজ কি মানুষের ভিতরেই থাকে বরাবর? বিবেক বা মানবিকতার একটা সরকারি ছুটি (যুদ্ধ পরিস্থিতি কিংবা ০০৭ লাইসেন্স হয়তো উচ্চতর মানবতার নামেই) পেলেই তার কাজে নেমে পড়ে। লেখাটার আরো কিছু অংশ পড়তে ইচ্ছে করছে।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
সম্ভবত তাই। আমাদের সভ্যতার বড় অংশজুড়ে আছে নিজের প্রতি করা নিজেদর নৃশংসতার ইতিহাস। সুযোগ পেলে বইটি পড়ে ফেলতে পারেন। বিল ব্রাইসন ঠকাবে না সেটা নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি। চেষ্টা করবো
কোন খণ্ড অনুবাদ নিয়ে আসতে ভবিষ্যৎতে।
love the life you live. live the life you love.
মানুষের প্রতি মানুষের এই নির্মমতা সত্যি বেদনাদায়ক । বিজ্ঞানের নামে এমন বীভৎসতার ইতিহাস আরও আছে । আশা করি আপনার লেখনিতে সেই ইতিহাসগুলোও আমরা জানতে পারব । ধন্যবাদ ।
নাজমুছ ছাকিব
নতুন মন্তব্য করুন