স্মৃতি- ১

কেমিকেল আলী এর ছবি
লিখেছেন কেমিকেল আলী (তারিখ: শনি, ০৪/০৮/২০০৭ - ৯:৩০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কলেজে ভর্তি হব বলে অনেক ঘটা করে ঢাকা আসলাম। বড় ভাই ঢাবি'র রসায়নের ছাত্র (৯২ ব্যাচ) হওয়ায় তার কাছেই উঠলাম যথারীতি শহিদুল্লাহ হলের এক্সটেনশনের ১২ নং রুমে। আমার বড় ভাই্য়ের সাথে আমার সম্পর্ক ছিল বন্ধুরমত। বলা যায় সবকিছুই শেয়ার করতাম। কয়েকদিন পরে ভর্তি হলাম শুভেচ্ছা কোচিং সেন্টারের বকশিবাজার শাখায়। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে একসাথে ভর্তি হলাম এই শাখাতেই। বন্ধুরা ছিল সবাই আশেপাশেই। আস্তে আস্তে বড় ভাইয়ের রুমমেটদের সাথে খাতির হতে থাকল। এর মধ্যে আফরাদ ভাই (প্রাণ রসায়ন), রফিক ভাই অন্যতম। রফিক ভাই সেই রকম সব কবিতা লিখত আর সাথে আবৃত্তি তো ছিলই। নতুন বাসায় উঠার আগ পর্যন্ত সেই ১২ নং রুমেই থাকতে হল।

আমার বড় ভাইয়ের আর একজন বন্ধু ছিল নাম কামাল। আমাদের গ্রামেরই । উনি পড়তেন জগন্নাথে। মাঝে মাঝেই উনি আসতেন। একদিন আমি দুপুরে ক্যান্টিনে খেতে যাব এমন সময় কামাল ভাই এসে হাজির। বড় ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করতেই আমি বললাম, ভাই তো ক্লাস থেকে আসবে সেই বিকালে।
কামাল ভাই বলল, তুই তাহলে একটু দেরি কর, আমিও তোর সাথে খেতে যাই। দুইজন একসাথে গেলাম খেতে ফজলুল হক হলের ক্যান্টিনে। খেতে খেতে কামাল ভাই কয়েকটা (ক্যান্টিনের ভাষায়) মুরগী ও গরু সাবার করেছে আর আমি ২ টা মুরগীতেই আটকে গেলাম। আর তার সাথে ছিল সবজি। বিল দেবার আগে কামাল ভাই আমাকে বলছে এই শোন তুই কোন কথা বলবি না। আমি মাথা নেড়ে সম্মতি দিলাম।

ম্যানেজার বয়কে বলছে এই বিল কত? ঐ ছেলেটা হিসাব করছে এমন সময় কামাল ভাই বলল, শোন ম্যানেজার ঐ ৫/৬ এর হিসাব বাদ দে মোট ৩ টার হিসাব কর। ম্যানেজার কয় ভাই এইটা কি বলেন? কামাল ভাই বলল, বহিরাগতরা এসে ফাও খেয়ে গেলে তোদের সহ্য হয়, আর আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অরিজিনাল ছাত্র কয়েক টাকা কম দিলেই তোদের যত সমস্যা?

শেষ পর্যন্ত, ম্যানেজার টাকা কমই রেখেছিল। একদিন বড় ভাইকে এই কথা জানানোর পরে ভাই আর উনার সাথে আমাকে খেতে যেতে নিষেধ করল। কিন্তু সেকথা আর পুরোপুরি মানতে পারিনি।

আস্তে আস্তে কলেজে ভর্তির দিন কাছে আসতে থাকল। আমার অনেকদিনের ইচ্ছা নটরডেম কলেজে ভর্তি হবার। তাই নটরডেম কলেজের জন্যই বেশি পড়ালেখা করতে থাকলাম। রেজাল্টের কিছুদিন আগে বা পরে ঠিক মনে নাই, ঘোষনা আসল মার্কসের ভিত্তিতে কলেজে এডমিশন হবে। এই কারনে কিছুটা শান্তি পেলাম। কারন ভরসা ছিল নিজের নম্বরের উপর।

এর মধ্যে বড় ভাইয়ের গোটা বন্ধুমহলে পরিচিত হয়ে গেলাম। নতুনভাবে পরিচিত হলাম সোমেশ্বর অলির গ্রামের "মাটি" আপা, খুলনার রনা আপা, পন্‌চোগড়ের আনিচ ভাই, দুলাল দা রাজবাড়ি, আর ঢাকার বুশরা সাজিদ, ফোটন দা।
এর মধ্যে বুশরা সাজিদ হল ভাইয়াদের সাথে ফার্ষ্ট ক্লাস ফার্ষ্ট। কাকতালীয়ভাবে সেই বুশরা সাজিদের সাথে কথা হল এই কানাডা এসে। উনি এখন ইউনিভারসিটি অব আলবার্টাতে এমএসসি করছেন। ফোটন দার কথা অনেক বেশি মনে মনে পরে। কারন জগন্নাথ হলের সেই পুলিশী নির্যাতনের শিকার ফোটন দা কে নিয়ে অনেক কাহিনী হয়েছিল। সবাই ধারনা করেছিল উনি মারা গেছেন কিন্তু উনি মারা যান নি।

নটরডেম কলেজে চান্স হল, ভর্তি হতে গিয়েও নানা কারনে হয়ে উঠেনি। এর মধ্যে টাকা পয়সা আর বন্ধুমহল ছিল অন্যতম। আমার বন্ধুরা সবাই রাইফেলসে ভর্তি হয়েছিল। তাদের সাথে থাকার জন্য আমি ঢাকা কলেজেই ভর্তি হলাম। আর কলেজ শুরুর আগেই নতুন বাসায় উঠলাম বকশিবাজারে। আমরা সবাই খুশি বকশিবাজারে বাসা নিয়ে। কারনটা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ন ছিল। আর সেটা হল বদরুননেছার কাছে বলে।

এরই মাঝে বড় ভাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল তার ফাইনাল পরীক্ষা নিয়ে। আর আমরা ব্যস্ত হয়ে গেলাম কলেজ নিয়ে। কিছুদিন ক্লাস করে ঈদের ছুটিতে সবাই মিলে হৈ হুল্লোর করে বাড়িতে গেলাম ঈদ করতে।

আমার খুব করে পীড়া দেয় এই বাসে করে বাড়ি যাবার স্মৃতিটা। সেই ঈদে আইয়ুব বাচ্চুর "কষ্ট" ক্যাসেট টা রিলিজ হয়। আমার বড় ভাই সেই ক্যাসেটের ২টা কপি কিনে। একটা তার প্রেমিকাকে দেবার জন্য। বাসে করে যাবার সময়, আমরা একটা ক্যাসেট দিলাম গাড়ির সুপারভাইজারকে গাড়িতে বাজানোর জন্য। ক্যাসেটটা কিছুক্ষন চলার পরে গাড়ির বাকী যাত্রীরা আমাদেরকে অনেক বকা দিয়েছিল বাজে ক্যাসেট দেবার জন্য।

আমার এখনও সেই দিনগুলো চোখের সামনে ভাসে। সেই কথা মনে করলেই চোখটা ঝাপসা হয়ে আসে। ঈদটা হয়েছিল ফ্রেব্রুয়ারীর ২১ তারিখে। ২২ তারিখে দুপুরে আমার বড় ভাই উনার বন্ধুর বাড়ি থেকে ফিরল রাত ১০ টারও পরে। ক্লান্ত থাকার কারনে উনার সাথে আর বেশি কথা হয়নি সেই রাতে। ঘুমালাম একই রুমে। রাত ২ টা ২৫ মিনিটে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল কেমন জানি একটা শব্দে। আমি উঠে লাইট জ্বালাতেই দেখি আমার বড় ভাই কেমন করছে। আমি অল্পক্ষন চেষ্টা করলাম উনার কি হয়েছে তা জানার জন্য উনি কোন কথাই বলতে পারেন নাই। ঈদের কারনে বাড়িতে সবাই ছিল। আমি দৌড়ে সবাইকে ডেকে আনার পরে আমার বড় ভাই আর মাত্র ১/২ মিনিট ছিল এই পৃথিবীতে। সব মিলে আমি ঘুম থেকে জাগার পরে উনি ৩/৪ মিনিট জীবিত ছিলেন। কার সাথে উনার জীবনের শেষ কথা হয়েছিল তা ঠিক আমি মনে করতে পারি না।
এখনও ফ্রেব্রুয়ারী মাস আসলে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। বাচ্চুর "কষ্ট" শুনলে কষ্ট লাগে, মনে পরে আগের সেই কথা স্মৃতিগুলো।


মন্তব্য

কেমিকেল আলী এর ছবি

আরে বস, আপনাগো লেখার কাছে এইসব কোন লেখা নাকি?

উৎসাহ দেবার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।