সারা জীবন ধরে শুধু একটাই মানুষের জন্য পথ চেয়ে বসে রয়েছিল সমর কাকু এটা জেনেও যে সে আর আসবার নয়? তবুও বসেছিল সমর কাকু, এরজন্য কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ বা অনু্যোগ কিছুই নেই, সোজা সাপটা সমর কাকু আমার সবথেকে কাছের মানুষ, আমার আব্দারের একমাত্র জায়গা, যেনো আমার ছোট্টবেলার মামাবাড়ী। যার কাছে রোজ না গেলে আমার রোজকার ভাত হজম হতো না।
আমার বাবার পাতানো বোন সোনাপিসীদের সাথে আমাদের রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই, অবে জেনেছি সোনাপিসীই নাকি ছোটবেলায় আমাকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে।
সেই সোনাপিসীর বাপ অনেক অনেক দূরে কোথায় কোনো এক ঘাটের মরা বুড়ো এক বামুনের সাথে বিয়ে দিয়ে সোনাপিসীকে দেশান্তরী করে ছেড়েছে। শুনেছি বিয়ের পরদিন নাকি চলে যাবার সময় সোনাপিসী মাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদেছিল। সেই থেকে সোনাপিসী আর বাপের বাড়ী আসে নি।
সমর কাকু আমাদের বাড়ীতে প্রায়ই আসত, নাঃ বিয়ে করে নি কাকু, একটু বড় হবার পর অবশ্য মাকে বার বার বলতে শুনতাম, “ঠাকুরপো এবার একটা বিয়ে কর, বয়স তো আর বসে নেই তাছাড়া বুড়ো বয়েসেই বা তোমাকে কে দেখবে বলো” ?
কিছু উত্তর দিত না সমর কাকু, চুপ করে নাথা নুয়ে শুধু শুনে যেতো আর একটু একটু মাথা নাড়াতো। খুব চাপাচাপি করলে বলতো, “কি হবে বৌদি আর একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করে, কিই বা হবে তাকে কষ্ট দিয়ে, যার থাকার কথা ছিল সে ত চলেই গেছে আমাকে ধোঁকা দিয়ে”, মনে আছে মা আর কথা বাড়াতেন না।
এই সমর কাকুকে ধরেছে মারণ রোগে, ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছে আর বড়জোর পাঁচ কি ছয় মাস, গলায় ক্যান্সার।
আজ বারো বছর পর বাপের বাড়ী এলো সোনাপিসী, শুনলাম বুড়ো বর মারা যাওয়ার পর নাকি সোনাপিসীকে শ্বশুর বাড়ী থেকেই নাকি তাড়িয়ে দিয়েছে তাই ওখানকার পাট পাকাপাকি ভাবে চুকিয়ে এবার বাপের বাড়ী চলে এসেছে।
সোনাপিসীর পুরোনো কোনো স্মৃতিই আমার মনে নেই, চোখ মুজে ভাবলে শুধু ঝাপসা একটা মুখ ভাসে। আজ এই প্রথম বার স্মৃতির কোটরে জমা করার মত করে দেখলাম সোনাপিসীকে। সাদা থান কাপড় পরা সোনাপিসী যেনো পটে আঁকা ছবি, পিসী আমার কপালে চুমু খেয়ে বলেছিল কেমন আছিস বুবু ? সম্ভবতঃ সোনাপিসীর মুখ থেকে সেই আমার প্রথম আর শেষ কথা শোনা।
কথা বলতে পারে না কাকু, সারাদিন বিছানায় শুয়ে, বেডসোলও হয়েছে, আহ কষ্ট খুব কষ্ট, কথা বলার শক্তিও হারিয়ে গেছে, ব্যাথা গলায় ভীষন ব্যাথা। কেউ নেই দেখাশোনা করার, যাদের একদিন সমর কাকুই দেখেছিল কষ্টের দিনে এরাই আজ সরে পড়েছে। তবু কেউ এলে শুধু চোখের কোন বেয়ে নোনা জল পড়ত অবিরত।
সমর কাকুর শরীর খারাপের খবর পেয়ে আর নিজেকে আটকাতে পারে নি সোনাপিসী, সবাইকে একরকম উপেক্ষা করেই সমর কাকুর বাড়ী গেছে, সোনাপিসীর পিশাচ বাপ বলেছিল ওই বাড়ীতে গেলে যেনো এবাড়ীর ছায়া আর কোনোদিন না মাড়ায়, কোনো উত্তর না করে পিসী বেরিয়ে এসেছিল। বারো বছর আগের আটকাতে পারলেও আজ আর কেউ পারে নি, ভালোবাসার প্রতিদানে যেনো আজ নিঃস হবার জন্যি পথে নেমে এসেছে সোনাপিসী।
আমার স্কুল ফাইনাল চলছে, পড়াশোনার চাপ ভীষন, তার মাঝেও রোজ স্কুল থেকে ফিরে ছ্যাগ্রাসে দুটো ভাত গিলে কাকুকে অন্ততঃ একবার করে দেখে আসি। জানি কাকুর অজানার দেশে পাড়ি দেবার দিন ঘনিয়ে এসেছে।
মমতাময়ী সোনাপিসী সমর কাকুর মাথায় গলায় হাত বুলানো, নিঃশব্দে নিবিড় আত্মপ্রত্যয়ে চলে রোগীর সেবা, কাকুর শুধু ফেলফেল করে তাকিয়ে থাকা। পিসীর শুধু কাকুর চোখের আড়ালে গিয়ে কাপড়ের খোঁট দিয়ে চোখ পোঁছা। শুধু ভাবি আর কতো ?
হাতে গোনা শেষ কটা দিন শুধু রয়ে যায়, শুধু প্রতীক্ষায় রয়ে যায় আমার পটে আঁকা সোনাপরী।
মন্তব্য
জীবনের সব অংক আসলেই মেলে না!
___________________________________
বিষন্নতা ছোঁয় আমায় মাঝে মাঝেই, কখনো কি ছোঁয় না তোমায়?
বড় এলোমেলো হিসাব... মনটা খারাপ হয়ে গেলো।
_________________________________
| ছোট্ট রাজকুমারের আরো ছোট্ট জগৎ |
_________________________________
_______________
::সহজ উবুন্টু শিক্ষা::
নতুন মন্তব্য করুন