সেই মহিলাটি

দেবোত্তম দাশ এর ছবি
লিখেছেন দেবোত্তম দাশ (তারিখ: শুক্র, ০৬/০৩/২০০৯ - ৬:১৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমার একমাত্র দিদির যখন বিয়ে হয়েছে সি সময় আমি ক্লাস ফাইভ এ পড়ি। আমি তখন পুঁচকে, বয়েস নয় কি দশ

দিদির বিয়ে হয়ে যাবার প্রায় পনেরো বছর অবদি আমাদের বাসায় মহিলা বলতে মা ছাড়া আর কেউ নেই। আজো মনে পড়ে ছোটবেলা মাকে অনেক সাধাসাধি করতাম একটা ছোট্ট বোন এনে দেবার জন্য। বলতে কোনো বাধা নেই বাড়ীতে অন্য কোন মহিলা না থাকায় সেই সময় কোনো রকম লাজ লজ্জা ছাড়াই নির্ভাবনায় আমরা আমাদের জামাকাপড় পাল্টাতাম

তা সেই পনেরো বছর পর মেজদার বিয়ে যখন হলো সেই প্রথম আবার আমাদের বাড়ীতে একজন মহিলার পদধুলি পড়লো, বাড়ীটার ভোল পাল্টে গেল। বাড়ীর কনিষ্ট সদস্য হিসেবে আমার আনন্দের সীমা ছিল না

দুবছরের মধ্যেই ঘর আলো করে আসা ভাইপো, বাঁধ ছাড়া আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। আমি কাকাই হলাম

স্বপ্ন আমি দেখি বটে কিন্তু অতি বড় উচ্চাকাঙ্খী আমি কোনদিনই ছিলাম না, বলা ভুল হলো আমরা কেউই ছিলাম না। মধ্যবিত্ত সংসার আমাদের ভালোই চলছিল, বেশ আনন্দে ছিলাম আমরা সবাই

অনন্দের সেই দিন গুলোতে সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়ে যেতো তার উপর অফিস যাবার তাড়া। ভাত মেখে দেওয়া থেকে শুরু করে অফিস ব্যাগ কোথায় আছে এমনকি ধোয়া মোজা অবদি কোথায় আছে সেটাও আমায় বলে দিতে হতো। মুখ বুজে হাসিমুখে এতসব অত্যাচার সহ্য করা সবাই পারে না, পারতো সেই মহিলাটি।

তার বছর তিনেকের মাথায় আমি বিবাগী হলাম, বৌদির কোল জুড়ে এলো তাঁর দ্বিতীয় সন্তান।

সব ঠিক ছিল তখনো, তখনো আমাদের ভরা গাঁঙ্গে চলছে নৌকা। কিন্তু সুখ নেই যার কপালে তার কি আনন্দে মেতে ওঠার অধিকার আছে ? রাজরোগ ধরা পড়লো বছর দুয়েকের মধ্যে, সেটাও আবার অনেকটা ছড়িয়ে গেছে, দেরী হয়ে গেছে, বলা চলে লাষ্ট ষ্টেজ। মুম্বাই এ ক্যান্সার রিসার্চ হাসপাতালে অপারেশন হলো, ওপারেশনের পরে ডাক্তাররা বলেই দিয়েছিল আর বেশীদিন নেই

দুই মাস আগে ২০০৮ এর ডিসেম্বরে দুসপ্তাহের ছুটি নিয়ে বাড়ী গিয়ে দেড়মাস থেকে এলাম, জানতাম এবারের দেখাই শেষ দেখা। আর হবে না দেখা আর হবে না ডাকা, আর বলা হবে না বৌদি ভাত দাও

ফিরে তবু আসতে হয়েছিল পেটের দায়ে। ফিরে এসেও মন পড়ে রয়েছিল ওখানে। কিছুই ভালো লাগতো না, লেখালেখি তো অনেক দূরের কথা

জানা ছিল আর বেশীদিন নয়, তবু কেন জানি মন মানতে চাইতো না। তিরিশ – বত্রিশ বছরের একটি মেয়ের এটা তো মরার বয়েস হতে পারে না। নাঃ মরতে সে চায়নি, শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গুলো ক্রমশঃ বিকল হয়ে এলেও করলেও ইচ্ছাশক্তি প্রচুর ছিল, বার বার বলতো আমাকে বোম্বে নিয়ে চলো আমার আবার অপারেশন হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।

এবার একবার তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম বলো তোমার কি চাই ? হেসে বলেছিল যার সবকিছু
আছে তার আর কি চাওয়ার থাকতে পারে !! তবু থাক যখন দরকার পড়বে আমি ঠিক চেয়ে নেবো।

কিছুদিন আগে যখন ফোন করলাম তখন শয্যাশায়ী অবস্থায় আমাকে বলল আমাকে বলেছিলে না আমি কি চাই ? প্লিজ তোমার দাদাকে বলো আমাকে তাড়াতাড়ি বোম্বে নিয়ে যেতে তাহলেই আমি আবার ঠিক হয়ে যাবো। সেইদিন চোখের জল আটকাতে পারি নি

কষ্ট তাকে বেশী করতে হয় নি, কাল রাতেই সে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। আমার মন খারাপ হয় নি, কষ্টও হয় নি, চোখ ভিজে গিয়েও ভেজে নি, শুধু বুকটা কেমন জানি করেছে, একটা কাঁটা কোথায় যেনো বিঁধে আছে, সবকিছু কি রকম জানি তেতো তেতো লাগছে। ভালো কিছু লাগছে না, লাগার কথা কি আদৌ

ভাবছি শুধু ভাইপো দুটোর কথা, বয়েস কত ওদের, বড়টা সাত আর ছোট্টটা চার

ঈশ্বর থেকে থাকলে শুধু প্রশ্ন একটাই করতে ইচ্ছে করে যে শিশুদুটো কি অন্যায় করেছে যে কিছু বুঝে উঠার আগেই ওদের মা হারাতে হয়েছে

মা শব্দের অর্থ বোঝার আগেই মা হারানো শিশুদের সান্তনাই বা কি করে দেয় কে জানে


মন্তব্য

অপ্রিয় এর ছবি

জীবন এমনই।
কিন্তু "সেই মহিলাটি"র ভেতরে আপনি যা দেখেছিলেন তাকে কখনও ভুলে যেয়েন না। আমরাও যাব না। "সেই মহিলাটি" যা রেখে গিয়েছেন আপনাদের সংসারে, আপনার মনে -তা ই আমাদের সকলের প্রতিদিন বেৎচে থাকার, কাজ করার প্রেরণা।

"সেই মহিলাটির" প্রতি শ্রদ্ধা।

+++++++++++++++++++++++++++++
ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই এই পাপীর, তবে বিশ্বাস করি এই আমি বিশ্বাসীদেরই প্রার্থনার ফসল

+++++++++++++++++++++++++++++
ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই এই পাপীর, তবে বিশ্বাস করি এই আমি বিশ্বাসীদেরই প্রার্থনার ফসল

ভূঁতের বাচ্চা এর ছবি

অনেকদিন পর আপনার লেখা পড়লাম।
কিন্তু পড়েই মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল।
--------------------------

--------------------------------------------------------

রানা মেহের এর ছবি

ভালো মানুষগুলো বোধহয়
খুব বেশী সময়ের জন্য আসেন না আমাদের কাছে।

ভাইয়ের সন্তানেরা ভালো থাকুক
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

মুশফিকা মুমু এর ছবি

কিছু বলতে পারলাম না ......................................................
খুব খারাপ লাগল মন খারাপ

------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

নিবিড় এর ছবি

হুম...............


মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

খারাপ লাগল খুব।
আমরা চাই বা না চাই, জীবন হয়ত এমনই।
আপনার ভাইয়ের ছেলেরা ভাল থাকুক, এই কামনা করি।

অতিথি লেখক এর ছবি

প্রিয় মানুষগুলো বোধহয় আমাদের ছেড়ে খুব দ্রুতই চলে যায়..., ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা ও তাই বলে।
আপনার জন্যে শুভ কামনা। ভালো থাকুন।
(শব্দশিল্পী)

মাহবুব লীলেন এর ছবি

...

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

মন্তব্য করা সম্ভব নয়, আপনাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করাটাও বোকামী। আপনি প্রাপ্তবয়ষ্ক মানুষ, একটু কষ্ট করে হলেও সব মানিয়ে নিতে পারবেন। আমার বুক জুড়ে হাহাকার উঠল শুধু বাচ্চা দু'টোর কথা মনে হতে। এটা কী হল! সমস্ত বিশ্বভ্রমাণ্ডের বিনিময়েও তো তাদের ক্ষতিপূরণ সম্ভব নয়।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

মন খারাপ
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

..................

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

রেনেট এর ছবি

মনটা খুবই খারাপ হল। মা ছাড়া জীবনের চেয়ে দুঃখের আর কিছুই হতে পারে না।
---------------------------------------------------------------------------
If your father is a poor man, it's not your fault ; but If your father-in-Law is a poor man, it's definitely your fault.

---------------------------------------------------------------------------
একা একা লাগে

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

অনেকদিন পর দেবুদা।
কিন্তু মনটা খারাপ হয়ে গেল।

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

দময়ন্তী এর ছবি

................................................
-------------------------------------------
"নিভন্ত এই চুল্লিতে মা
একটু আগুন দে
আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি
বাঁচার আনন্দে৷'

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

তানবীরা এর ছবি

মা হারানোর কোন সান্ত্বনা হয় না। বাচ্চা দুটোই পোড়াকপালী। ভালোবাসার স্থান বোঝার আগেই শূন্য হলো।

তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

স্নিগ্ধা এর ছবি

.......................................

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

পুরনো লেখা মনের মুকুরে। সাথে সেই পুরনো অনুভূতি।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।