যমুনি ফিরে এসেছে - (যমুনি পাগলী ০২)

দেবোত্তম দাশ এর ছবি
লিখেছেন দেবোত্তম দাশ (তারিখ: রবি, ২৯/০৩/২০০৯ - ৯:৫৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

auto
সেদিন স্কুল থেকে ফেরার সময় দেখি হটাৎ কোন এক কারনে বাজারে রৈ রৈ পড়ে গেছে। কি ব্যাপার! নাহ্ বছর পাঁচেক আগে বাজার থেকে তাড়িয়ে দেওয়া পেটফোলা যমুনি পাগলী নাকি আবার ফিরে এসেছে আমাদের বাজারে। আর এবার সে একা নয় সাথে তিন/চার বছরের এক অস্থিচর্মসার ছেলে (স্থানীয় ভাষায় যাকে বলে কেঁচোতে খাওয়া)

সবাই মিলে ঘিরে রয়েছে যমুনিকে, সব্বাই পাগলীর উপস্থিতি উপভোগ করছে, যমুনি অবশ্য কাউকে কিছুই বলছে না শুধু সে তার শিশুটিকে সদা আগলে রাখছে। কেউ সামনে গিয়ে বাচ্চাটাকে দেখতে চাইলেই যমুনি শিশুটাকে আড়াল করে ফেলছে, চোখে এমন ভাব যেনো কেউ তার বাচ্চাটাকে কেড়ে নিতে পারে

যমুনির সেই পাঁচ বছর আগে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার প্রথম কিছুদিন ওকে নিয়ে জোরে-শোরে খেজুরে আলাপ আর মুখরোচক আলোচনা চলেছিল বটে, কিন্তু অচিরেই কর্মব্যস্ত বুবুক্ষু মানুষগুলি যমুনিকে ভুলেও গিয়েছিল

সদ্য ফেরা যমুনিকে অন্যেদের মত আমিও কৌতুহলের দৃষ্টিতে দেখলেও আলুথালু বেশে পাগলী মা আর রুগ্ন শিশুটিকে দেখে অচিরেই মনটা তেতো হয়ে গেল। কি রকম জানি আনমনা আর বিস্বাদ একটা মনোভাব নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম

**********

যমুনির থাকা নিয়ে স্পষ্টতঃই বাজার কমিটি দুভাগ হয়ে গেল। একপক্ষ কোনভাবেই যমুনিকে বাজারে থাকতে দেবার পক্ষপাতি নয়, তার মত পাগলী তার উপর দুশ্চরিত্রা, কার না কার বাচ্চা পয়দা করেছে, সে এখানে থাকলে বাজারের লোকজনেদের উপর নিশ্চয়ই কুপ্রভাব পড়বে আর অন্যপক্ষের যুক্তি হচ্ছে যমুনি অনেকদিন ধরে এই বাজারে থেকেছে এতদিন যেখানে ছিল সেখান থেকে তাড়া খেয়ে এতবছর পরে সে আবার এখানেই ফিরে এসেছে এই ভেবে যে এখানে তাকে থাকতে দেবে, পাগলী হলেও যমুনি তো মানুষ নেই সুতরাং এই বাজারে থাকার অধিকার যমুনি পাগলীর আছে। আরো একটা অকাট্য যুক্তি হচ্ছে যমুনি থাকবে বাজারে, তাকে তো আর কেউ কারো বাড়ী থাকতে দিচ্ছে না সুতরাং তাই নিয়ে কারোরই অত মাথা ব্যাথা হবার কোনো কারন নেই, বাজারটা তো কারোর একার কেনা জায়গা নয়

এও নাকি শোনা গেছে বাজারে সবচেয়ে বড় মুদিদোকানের মালিক নিতাই আর পাইকারী মাছের কারবারী আনোয়ার যমুনির বাজারে থাকার স্বপক্ষে মতামত দিয়েছে। মাথামোটা নিতাই আর অর্ধশিক্ষিত আনোয়ারকে বাজারের সবাই চেনে। সবাই জানে এরা যেমন গোঁয়ার তেমনিই এদের গায়ের জোর তার উপর হালে ওদের দুজনেরই টুপাইস হয়েছে, দুটিতে আবার গলায় গলায় মিল। বদরাগী আনোয়ার আর খ্যাপা ষাঁড় নিতাইকে সবাই ভয় পায়। বদনাম করে অবশ্য সেইসব স্বার্থান্বেষী লোকেরা যারা নিজেদের প্রয়োজনে সাদাকে কালো করতে পারে আর কালোকে সাদা করতে পারে অবশ্য এসব বদনাম হয় আড়ালে আবডালে, সামনাসামনি কিন্তু কারোর নিতাই বা আনোয়ারের বিরুদ্ধে ট্যাঁ-ফ্যুঁ করার সুযোগ নেই, কে জানে বাজারের মধ্যেই হয়তো বা খুন হয়ে যেতে হতে পারে। তাই কেউই পারতঃ পক্ষে ওদের সঙ্গে লাগালাগি করে না

সাধারন গরীব মানুষদের কাছে কিন্ত আনোয়ার আর নিতাই তাদের রক্ষক, যে কোন অন্যায় এর বিরুদ্ধে গায়ের জোরে আর পয়সার জোরেই হোক নিতাই আর আনোয়ার রুখে দাঁড়াবেই। আনোয়ার আর নিতাই হচ্ছে গরীব দুঃখীদের রবিনহুড

অবশ্য আমি এসব প্রত্যক্ষ কিছুই শুনতে পাই নি, কাকার দোকানে কাজ করে ঝণ্টু আর ছানাদার আলোচনা কানে এসেছিল। ওরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল “নেতাই আর আনুয়ার” না থাকলে নাকি আজই পাগলীটাকে সবাই মিলে ওর ছাওয়াল সমেত তাড়াত। তবে বলা যায় না এত কিছুর পরও এরা যে এখানে টিঁকে থাকতে পারবে তার কোন গ্যারাণ্টী কেউ দিতে পারছে না

দ্বিতীয়বারের মতো চলে যেতে হয়নি যমুনিকে। মনেহয় আগেরবার যমুনিকে তাড়িয়ে দেওয়া দলটি বোধহয় অন্যদের তুলনায় এবার ওজনে হাল্কা পড়ে গেছিলো। কেনো জানিনা মন ভীষন ভালো হয়ে গেলো। একটু আধটু বুদ্ধিশুদ্ধি হবার পরই থেকে নানা রকম সুখ-দুঃখ দেখে বড় হওয়া আমার জীবনে এটা ছিল যেনো সত্যিকারের এক সুখ, অন্যের সুখে সুখী হওয়া বোধহয় এটাকেই বলে। জানিনা আমাদের বাজারে থাকতে পেয়ে যমুনি সুখী হয়েছিল কি না, আমি কিন্তু খুব খুশী হয়েছিলাম

সেদিন প্রথমবারের মতো মনে হয়েছিল আসলেই সারা দুনিয়াটা জুড়ে ভালো মানুষের ছড়াছড়ি, আরো মনে হয়েছিল যতদিন অবদি পৃথিবীতে একটিমাত্র ভালোমানুষ অবশিষ্ট থাকবে ততদিন পর্য্যন্ত যমুনিরা আশ্রয় পেতে থাকবে

ছবি সুত্রঃ- অন্তর্জাল


মন্তব্য

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

হুমম। ঠিক।

___________________________
বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

কিছু ভালো মানুষ আছে বলেই তো দুনিয়াটা সুন্দর আর উপভোগ্য।

তীরন্দাজ এর ছবি

এমনি এক পাগলী আমাদের পাড়াতেই ছিল। তার এমনি একটি বাচ্চাও ছিল।

হ্যা, মাঝে মাঝে আমারও মনে হয়, পৃথিবীতে ভালো মানুষদের সংখ্যাই বেশী। কিন্তু সে মনে হওয়াটি একেবারেই ক্ষণিক।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

বিপ্লব রহমান এর ছবি

ভাল লাগলো। চলুক


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

এইসব অনুভূতির প্রকাশ বলে, আমাদের দেবুদাও একজন অনেক ভালো মানুষ।
ভালো থাকবেন আপনি।

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

অনিশ্চিত এর ছবি

শেষ প্যারাটাই আসল। মানুষকে আশাবাদী করে তোলে।

যমুনীর মতো মানুষ সারা বাংলাদেশেই আছে। পার্থক্য এতোটুকুই- একে পাগলী বলা হয়, অন্যদের পাগল অবস্থা দেখা যায় না।
‌‌-------------------------------------
হাত বাঁধা, কিন্তু দড়ি মুক্ত - হায় পৃথিবী!

‌‌-------------------------------------
হাত বাঁধা, কিন্তু দড়ি মুক্ত - হায় পৃথিবী!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।