তখন আমি ক্লাস থ্রি তে পড়ি, বেশ রোগা পটকা চেহারা আমার। ক্লাসের বাকি ছেলে মেয়েদের চাইতে শারিরিক শক্তিও অনেক কম, সুতরাং বাকিরা যে যে তাদের গায়ের জোর আমার উপর ফলাবে তা একেবারে বলাই বাহুল্য।
“জোর যার মুলুক তার” কথাটা অবশ্য সেই সময়ই আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছিলো।
বয়সে বড়, গায়ে-গতরে বড় বন্ধুদের থেকে তাই মাঝে মধ্যেই স্কুলে গাট্টা গোট্টা খেতাম। প্রথম প্রথম ব্যাপারটা অনেকটা মেনে নিলেও দিনে দিনে কিন্তু মারের বহর বেড়েই চলল। ব্যাপারটা একদিন অসহ্য হয়ে এলো। ওদিকে স্কুলে স্যার দিনিমণিদের বলব বলে মাটিতে পুঁতে ফেলার ভয় দেখায়। ভয়ে আমি প্রায়ই সিঁটিয়ে থাকি, স্কুল থেকে বেরিয়ে একরকম পালিয়েই বাড়ি আসি। দিনকে দিন আমি ভীতু থেকে ভীতুতর হয়ে পড়ছিলাম।
বয়েসে ছোট হলেও ভয়ে আর লজ্জায় কাউকে কিছু বলতেও পারি না। কি করবো কি করবো ভেবে একদিন আমার সবথেকে কাছে বন্ধু দাদুকে সব বলে ফেললাম।
স্বাধীনতা সংগ্রামী দাদুকে শুধালাম “আছে কি কোন উপায়”?
আমার কথা শুনে সামান্য হাসেন দাদু। বলেন “ দাদুভাই, আমরা খালি হাতেই দু-দুবার শত্রুদের তাড়িয়েছি। একবার সাতসমুদ্র তেরো নদীর পার থেকে আসা শত্রুদের আর একবার আমাদের নিজেদেরই ঘরে ডেকে আনা শত্রুদের, সবাইকেই কিন্ত আমরা মেরে তাড়িয়েছি।“
তাই নাকি, কি করে? শুধাই আমি।
একদিন সব নিজেই জেনে যাবে। তারপর সব প্রশ্নের উত্তর জানা সবব্জান্তা দাদু আমার, আমায় একটা গোল চামড়ার টুপি দিয়ে বললেন, “দাদুভাই এটা কিন্তু যেই সেই টুপি নয়, এটা একটা জাদু টুপি আর এই টুপিটা যে পরে সে-ই অদৃশ্য হয়ে যায়”
টুপিটা দেখে আমার চোখ চকচক করে উঠলো, শিরার শিরায় শিহরণ বয়ে গেল। টুপিটা দেখতেই কিন্তু জাদুটুপি জাদুটুপি লাগছে। কি সুন্দর বাদামী রঙের উপরের দিকটা লম্বা চোঙের মত। গল্পের বইয়ে পড়া ঠিক হ্যামিল্টনের ইঁদুর তাড়ানো বাঁশিবাদকের টুপির মতো।
আর যায় কোথা, টুপিটা হাতে নিয়েই পরে ফেললাম... এদিক ওদিক তাকালাম ... কি ব্যাপার ... সত্যিই কি আমাকে দেখা যাচ্ছে না, সত্যিই তো তাই। দাদু আমাকে আর দেখতে পাচ্ছে না...
দাদু আমাকে ডাকছে, “দাদুভাই কোথায় গেলে, টুপিটা খোলো না হলে যে দেখতে পাচ্ছি না”। আমি কি তাহলে সত্যি সত্যি অদৃশ্য হয়ে গেছি!
নিজেকে সামলাতে পারি না। এমন একটা উপহার পেয়ে শুধু পুলকিতই হলাম না দাদুকে আনন্দে জড়িয়ে ধরলাম।
টুপিটা পরে ঠাম্মার কাছে ছুটে যাই, টুপিটা পরে দেখাই। ঠাম্মারও একই অবস্থা, ঠাম্মা আমাকে দেখতে পায় না, বাবা মা কেউ আমাকে দেখতে পায় না, আনন্দে আর খুশীর চোটে আমি টুপিটা খুলতেই চাই না।
এমন একটা অমূল্য উপহার পেয়ে স্বভাবিক ভাবেই অনেক রাত অবধি আমার ঘুম হলো না। ফন্দি আঁটতে লাগলাম কাল আমার শক্তিমান বন্ধুদের নাকি (শত্রুদের!!) কি করে জব্দ করবো।
পরদিন স্কুলে গেলাম সেই টুপিটা নিয়েই। মনে মনে ভাবলাম আয় দেখি আজ। যথারীতি সেদিনও ঠিক সময়েই স্কুল ছুটি হলো। অন্যান্য দিনের মত আজো আমার অসুর বন্ধুরা আমাকে পাকড়ালো। আমি মুচকি হেসে জাদু টুপিটা পরে ফেললাম। মুহাহাহা আর আমায় দেখতে পাচ্ছে না ... আয় দেখি বাছারা ...
কিন্তু কোথায় কি, একটা ঘুঁসিতেই আমার মাথার জাদু টুপি মাটিতে গড়াগড়ি, চোকখে অন্ধকার দেখতে পেলাম। সেদিন মারটা একটু বেশিই খেয়েছিলাম। ব্যাপার কি! মাথায় ঢুকলো না, বুঝলাম না জাদু টুপিটা কেন ওদের সামনে কাজ করলো না। ধুলো মাখা টুপিটা নিয়ে বাড়ি ফিরলাম ব্যার্থতা আর একরাশ মনের দুঃখ নিয়ে।
দাদু আমার সব জানতেন, আগে থেকেই তিনি তৈরী ছিলেন।
সেদিন রাতে আমার দাদু বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমাকে গল্প শোনালেন, এই পৃথিবীতে নাকি আসলেই জাদু বলে কিছু নেই। দাদু আরো বললেন এই পৃথিবীতে তোমাকে প্রতিনিয়ত কেউ সাহায্য করতে আসবে না, তোমার নিজেকে নিজেই সাহায্য করতে হবে। আর গায়ের জোর, তা গায়ের জোরের অবশ্যই প্রয়োজন তবে তার থেকে বেশি প্রয়োজন মনের জোরের। মানুষ মনের জোরে তার নিজের থেকেও বেশি শক্তিশালী জানোয়ারদের বশ করেছে। মনের জোর থাকলে নাকি অসম্ভবকেও সম্ভব করা যায়। সুতরাং তোমার থেকে বড়দের দেখে ভয় পেয়ে যেও না। রুখে দাঁড়াও, সমস্যা থেকে পালালে চলবে না, তার মোকাবিলা করতে হবে, তবেই সে তোমার থেকে পালাবে না হলে সে আরো চেপে বসবে।
দাদু আরো অনেক কিছু বলেছিলেন সেদিন কিন্তু আমার মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছিলো, শরীরের জোরের চাইতেও মনের জোরের অনেক বেশি প্রয়োজন। মনের জোর না থাকলে কিসসু হবে না। এই দুনিয়ায় তোমাকে একমাত্র তুমিই রক্ষা করতে পারো। সুতরাং হে অজেয় জাগো, তোমায় নিজেকে নিজে রক্ষা করো।
পরদিন আমি সত্যি সত্যি রুখে দাঁড়িয়েছিলাম আমার মারকুটে বন্ধুদের বিরুদ্ধে, মার খেয়েছিলাম সেদিনো, একথা ঠিক, কিন্তু সেদিন আমার মনের জোর দেখে অনেকেই পিছিয়ে গেছিলো। ভয়ে মাথা নুইয়ে মার না খেয়ে রাস্থার পাশ থেকে একটা আধলা ইট তুলে নিয়েছিলাম সেদিন মনেরই জোরে... সেদিন আমার রুখে দাঁড়ানো দেখে অনেকই আমার বন্ধু হয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল।
দিনে দিনে দিন বদলায়... আমি সেই রোগাই রয়ে যাই কিন্তু আমাকে আর স্কুলে কেউ আর ঘাঁটাতে সাহস পায় না। মনের জোর আমার শরীরের জোরকেও ছাড়িয়ে যে যায়।
ছবিসুত্রঃ- ইণ্টারনেট থেকে নেওয়া।
মন্তব্য
ইন্সপায়ারিং!
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !
------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !
খুব ভাল্লাগ্লো।
--------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার
ধন্যবাদ শুভাশীষ
------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !
------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !
থ্রি বা ফোরে এমনই একটি গল্প আমাদের সময় বাংলা পাঠ্য বইয়ে পড়েছিলাম।গল্পের নাম বা লেখকের নাম মনে নেই।
একটা ছোট ছেলে মালিকের দোকানের সব কাজ করত। একদিন ঝড়-তুফানের মধ্যে মালিক বাড়ি থেকে পান আনতে বলে। সে মালিকের কথা মত দৌড়ে পান এনে দিল ।সব কাজ করার পরও যখন-তখন তাকে মারধর করা হত।
গল্পের শেষ লাইন অনেকটা এরকম -----
“ভয় কাতুরে মাহবুব আজ ভীষন সাহসী” ।
গল্পের শেষে ভয় কাতুরে মাহবুবকে পিটাতে গেলে সেদিন সে মালিকের লাঠি ধরে ফেলে।
আমরা ছোট হলেও বড়দের কাছে দেশে কী হচ্ছে না হচ্ছে শুনতাম। সে সময় এরশাদের আমলে দেশে কিছু চেয়ারম্যান ছিল যারা ট্রাকে করে পাঠানো গম ট্রাক সহ বেচে দিত। এমনই একজন পা-চাটা চামচা চেয়ারম্যান তখন আমাদের এলাকায় গম চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে। এ নিয়ে এলাকায় ছেলে-বুড়ো সবার মাঝে গোপনে আলোচনা-সমালোচনা, কিন্তু প্রকাশ্যে কেউ কিছু বলত না ।
আমাদের শ্রেনীকক্ষে শিক্ষার্থীর তুলনায় টেবিল-চেয়ার ছিল কম। যারা আগে আসত তারাই টেবিল-চেয়ারে বসত, বাকীরা সামনে মাটিতে কাঠের উপর বসত।
ক্লাসে যেদিন এই গল্পটা পড়ানো হয়, তার পরদিন চেয়ারম্যানের ছেলে পরে এসেও টেবিল-চেয়ারে বসতে চাইল।
“গম চোরের হোলা এক ঘুষিতে দাত হালাই দিমু, জেরে আইচত নীচে বয়।“
ধমক খেয়ে বাধ্য ছেলের মত সে নীচে গিয়ে বসল।
বিপ্লব কুমার কর্মকার
গল্পটার নাম "ঝড়ের পরে", মানিক বন্দোপাধ্যায়ের। গল্পটার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পুরো গল্পটা ছন্দ মিলিয়ে করা। মনে পড়ে কিনা দেখুন তো - শুরুটা ছিল,
সবাই অবাক, সবাই ভাবে ব্যাপারখানা কী?
ভয়কাতুরে মহ্বুব আজ এমন সাহসী!
কাঁপুনি নেই, কঁকানি নেই, হেঁট করে নেই মাথা,
দু'টি চোখে ভীরুতা নেই, জড়ানো নয় কথা।
রাতারাতি মানুষ হল সে -
আহা মানুষ মানেই ছেলেমানুষ।
আর শেষটা ছিল,
অবাক সবাই, সবাই ভাবে ব্যাপারখানা কী?
ভয়কাতুরে মহ্বুব আজ এমন সাহসী!
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
ধন্যবাদ বিপ্লব, আপনার সত্যিকারের গল্পটা পড়েও ভালো লাগলো
পাণ্ডবদা কেমন আছেন! মানিকবাবুর ওই গল্পটা পড়া হয় নি তবে আমাদের চারপাশে এমন অসংখ্য উদাহরন ছড়িয়ে আছে নিশ্চয়ই
------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !
------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !
আমার খবর মন্দ না। আপনি ভালো তো? অনেকদিন পর আপনার পোস্ট দেখে ভালো লাগলো। এভাবে লম্বা ডুব না দিলেও পারেন।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
ভালো লাগলো
_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না
_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না
ধন্যবাদ শাহেনশাহ
------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !
------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !
অনেকদিন পর আত্মবিশ্বাস জাগানিয়া একটা লেখা পড়লাম। ধন্যবাদ দেবোত্তম দা। ভালো থাকবেন।
ধন্যবাদ মানিক, কিন্তু কাকের পরবর্তী পর্বগুলি কোথায়?
------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !
------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !
নতুন মন্তব্য করুন