মাথাটা সামনে ঝাঁকুনি খেয়ে আচমকাই পেছনে ছুটে গেল আরেকবার, অতিকষ্টে চোখ খুলে তাকালাম- বাজে অবস্থা সামনে, বাস, মাইক্রো, প্রাইভেট কার, সিএনজি মিলিয়ে রাস্তাটাকে সাক্ষাত নরক লাগছে এখন। তার উপর হর্নের বিকট শব্দে কানও পাতা দায় ঠিকমতো। ড্রাইভারের আর দোষ কী! এমন রাস্তায় বাস, কার যাই চলুক না কেন, এক মিনিট অন্তর অন্তর ধাক্কা খেয়ে থেমে যাওয়াই নিয়তি। মনে মনে ঢাকা শহরটাকে আরেকবার গালি দিলাম, অবশ্য শান্তিও লাগলো যে এই পচা শহরে আর বেশিদিন থাকতে হচ্ছে না। এখানে কতক্ষণ বসে থাকতে হবে কে জানে! মাথা ধরে আসছে আবার, চোখ মেলে রাখতে পারব না আর বোধহয়।
বাঁ পাশের সহযাত্রীর কনুইয়ের খোঁচায় তন্দ্রাটা কেটে গেল আবার, এক ঝটকায় নয়, একটু একটু সময় নিয়ে। ‘এপাশে তো আর জায়গা নেই আপু। আপনি ঠেলছেন কেন বারবার?’- আমার বিরক্ত স্বরেও সহযাত্রীর মধ্যে বিকারের কোনো লক্ষ্মণ দেখতে পেলাম না। কী আশ্চর্য, একবার তাকালো না পর্যন্ত! ড্রাইভারের উল্টোপাশের এই লম্বা সিটটায় হিসেবমতো চারজনই বসা হয়েছে তবু এই মহিলা বারবার নড়েচড়ে আমাকেই কেন গুঁতো দিচ্ছে মাথায় ঢোকে না বাবা। মেজাজটা চড়ে যাচ্ছে আবার কিন্তু এই গরমে ঘামতে ঘামতে কিছু বলতে ইচ্ছে করলো না আর। তারচেয়ে চোখ বন্ধ করে থাকি, বিরক্ত সহযাত্রীদের ঘাম, ড্রাইভারের বিরক্তিতে চিমসে যাওয়া মুখ কিছু দেখতে হবে না তাহলে। সামনের লম্বা যানজটের দিকে তাকিয়ে ভরসা খুঁজে পাওয়ার কোনো কারণ দেখতে পেলাম না। মুখ ঘুরিয়ে আবার যখন চোখ বন্ধ করতে যাব- তখনই চোখে পড়লো ছেলেটাকে। সোজা তাকিয়ে আছে আমার দিকেই। আশ্চর্য! আমি এতক্ষণ খেয়ালই করিনি! নিজে নিজেই বুঁজে আসা চোখের পাতাকে টেনেটুনে খুলে সামনে তাকালাম ভালো করে- ড্রাইভারের পেছনের সিটটায় পা ঝুলিয়ে কোনোরকম বসে আছে, ওর তাকাবার কথা বাসের পেছনদিকে, তা না ঘাড় ঘুরিয়ে এদিকেই তাকিয়ে আছে হাঁ করে!
আমি ছেলেটাকে মেপে দেখি, সরাসরি তাকাই ওর দিকে, ঘুম-তন্দ্রার খোঁজ থাকে না। আজকালকার একেকটা মানুষ যা সব শুয়োরের বাচ্চা! তেমন কেউ হলে কপাল খারাপ আছে তোমার বাছা, কিল থাপ্পড় একটাও মাটিতে পড়বে না। না, এ ছেলেটার চোখে তেমন কিছু খুঁজে পাই না। টকটকে নীল একটা সস্তার আধপুরনো গেঞ্জি গায়ে, উশকোখুশকো চুল, হাত পায়ের রুক্ষতা এই দূর থেকেও বোঝা যাচ্ছে- বয়স পনেরো বা বিশও হতে পারে, বুঝতে পারি না। ছেলেটার তাকানোটা অদ্ভুত, এমনকী আমি তাকিয়ে আছি দেখেও ওর কোনো বিকার নেই! কেবল একবার মাথা চুলকে পেছনে তাকালো সেকেন্ড কয়েকের জন্য। ব্যস! যেই কে সেই! আমি বুঝতে পারি না আমার দিকে এমন অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে থাকার কী আছে- ডেকে ঝাড়ি মারব? কেমন দ্বিধা হয়, যদি বলে বসে আমি তো আপনার কিছু করিনি, তখন? এবার মেজাজ খারাপের চেয়ে কেমন অসহায় লাগতে থাকে।
তারপর হঠাৎ করেই বিদ্দুৎচমকের মতোই বোধহয় আমি বুঝতে পারলাম, এই ছেলেটা আসলে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে নেই, ও তাকিয়ে আছে আমার গলার চিকন চেইনটার দিকে। ভীষণ অস্বস্তি লাগতে শুরু করে এবার। আমি ঘাড়ের একপাশ থেকে চুলগুলো পিঠে এলোমেলো করে ছড়িয়ে দিই। দূর! কিছুদিন থেকে বাসেটাসে চড়া হয় না তেমন, এই দুর্যোগটার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। সামনে ঈদ, এখন যে ছিনতাইকারিদের অত্যাচারটা নিয়মমাফিক বাড়বে, এ তো জানা কথাই। নিজের উপরই বিরক্ত লাগে এইবার। চেইনটা আমার আশির্বাদের, সৈকত আর আমি একসাথে পছন্দ করে কিনেছি, এখন খোয়া গেলে?
অস্বস্তি এড়াতে আমি উল্টোপাশের জানালায় তাকাই, বাসটা ফাঁকফোঁকড় দিয়ে একটু একটু করে এগিয়ে কখন সোনারগাঁর সামনে এসে আবার নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে। না, পাঁচতারকা হোটেলটা আজ আমার মনে তেমন কোনো আগ্রহই জাগায় না, বিরক্তির উদ্রেক করে বরং, বাসটা ছাড়লে বাঁচি। ‘এই যে ভাই, পানি ন্যান, পানি…’ এই রোজার দিনেও ঠিকই এক পিচ্চি পানির বোতল হাতে দরজায় এসে পড়েছে, হেলপার জাদুকরি ভঙ্গিতে সাজানো টাকা ধরা হাতের আঙুলের টোকায় পানির বোতলঅলাকে ভাগিয়ে দেয়। আমি এবার পুরো বাসের উপর চোখটা বুলিয়ে আনি। হাঁ করে ঘুমানো, কপাল কুঁচকে বিরক্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকা, পড়ে ফেলা খবরের কাগজ পাখা বানিয়ে বাতাস খাওয়া একেকজন যাত্রীকে নিয়ে বাসটা সিগনাল পেরিয়ে সামনে চলে আসে আর এঁকেবেঁকে জায়গা করে নিয়ে শামুকের গতিতে চলতেও থাকে ফার্মগেটের দিকে। সিটিং সার্ভিস বাসেও অল্প ক’জন যাত্রী ঠিকই পেছনদিকে দাঁড়িয়ে আছে, আমার কনুই গুঁতোনো সহযাত্রীও মাথা হেলিয়ে সেই ঘুম দিচ্ছে।
নীল গেঞ্জির ছেলেটা উঠে দাঁড়ায় সিট থেকে। ফার্মগেটে নামবে মনে হয়, দরজা পর্যন্ত এগিয়ে একদম বাসের দরজায় দাঁড়িয়ে পড়ে। মুশকিল তো! কী করতে যে ছাই দরজার পাশে বসেছিলাম আজ! হাতের ব্যাগটার ফিতে ভালো করে হাতে পেঁচিয়ে নিই কিন্তু চেইনটাকে ঠিক কেমন করে কী করব বুঝতে পারি না। ছেলেটা আমার সিটের পাশে দরজার গায়ে একটা হাত রাখে, বাসটা থেমে যাবে আরেকটু গিয়ে, অন্য কয়েকজনও পেছন থেকে উঠে এসেছে, নামবার প্রস্তুতি। ‘হাতটা সরাও তো এখান থেকে’- আমার কড়া কণ্ঠস্বরে চমকে উঠে ছেলেটা হাত সরিয়ে নেয় কিন্তু তেমনই তাকিয়ে থাকে আবার। অদ্ভুত! বাস ওভারব্রিজের নিচ দিয়ে এসে মোড় পেরিয়ে থামে, নীল গেঞ্জি নামে আরও কয়েকজনের সাথে। আমি হাত দিয়ে গলা ছুঁয়ে দেখি, চেইনটা যথাস্থানে আছে। যাক, বাবা! উফ! যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিল এই ছেলে!
মানিক মিয়া এভিনিউ প্রায় ফাঁকা, মিরপুর রোডও। শ্যামলী পৌঁছাতে বেশিক্ষণ লাগে না আর। একটা রিকশা নিয়ে বাসায় পৌঁছাই এবার, মনটা ভালো লাগছে। বদমাশ ছেলেটা কিছু করতে পারেনি- শান্তি! আচ্ছা, ও তাকিয়ে ছিল কেন ওভাবে? আমার কলিগ নাজরান অবশ্য আজই বলছিল যে আমার চেহারা নাকি বাংলাদেশের সবচেয়ে কমন চেহারা। তাহলে আমি কি ওই ছেলের বোনের মতো দেখতে? মার মতো? ওইজন্য্ই অমন অবাক হয়ে দেখছিল? নাকি আসলেই চেইনটার উপর নজর ছিল ওর?... দূর! মরুক গে, যা হয় হোক, আমার তাতে কী? কিছু তো হয়নি শেষ পর্যন্ত। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে আমি গুনগুন করে গাই- আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে, বসন্তের বাতাসটুকুর মতো… প্রিয় গান আমার, খুব প্রিয় গান। পিঠের উপর ছড়ানো চুলগুলো জ্বালাচ্ছে খুব। আমি চুলগুলো একপাশে সরিয়ে দেব বলে গলায় হাত দিই- গলা খালি, আমার চেইনটা নেই!
মন্তব্য
চেইনটা নেই। কিন্তু কেন নেই!
ভাবনাদা, ছোটগল্পের মজাটাতো সেখানেই, আপনি একজনের দিকে চোখ রাখতে রাখতে আরেকজন এসে নিয়ে গেছে।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
জিনিয়াস সাদিয়া'পু আমাদের সন্দেহের পাত্রেরা অনেক সময়ই নির্দোষ হয়। এই ছেলেটা যে টেনশনটা দিয়েছিল সেই টেনশন করবার দরকারই ছিল না আসলে। অথচ এর টেনশনে থাকতে থাকতেই জিনিসটা খোয়া গেল।
...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”
অ, তাইলে তুমি আশেপাশেই ছিলে! শেষে তুমিই...
কেন নেই, সেটা একটা প্রশ্ন বটে। চেইনটা হারালো কিন্তু নিলো কে? কুইজ কুইজ ভাবনাদা’
...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”
আপনার সাথেই খুব কড়া চোখে নজর রাখছিলাম। কিন্তু লাভ হলোনা। ধুর্ত চোরের হাত সাফাইটা ধরতেই পারলামনা।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
চোরটাকে খুঁজে পেয়েছেন শেষ অব্দি?
...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”
গত তিন মাসে তিনটি মুঠোফোন হারিয়ে আর্থিক ও মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় আপনার এই লেখাটা পড়লাম। কি বলব ঠিক বুঝতে পারছি না।
-অতোকেন
আপনাকে কী বলব বুঝতে পারছি না তো। গড়ে মাসে একটা করে মুঠোফোন হারালে তো বিপদ! সাবধানে থাকবেন। আর এই গল্পের শুধু ওই চেইন হারানো অংশটাই গল্প, বাকিটা একদম ‘সত্য ঘটনা অবলম্বনে(!)’
...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”
টান টান উত্তেজনা ছিল দেবদ্যুতি। অনেকদিন পর এসে তোমার আমার লেখা পাশাপাশি পেয়ে ভাল লাগছে।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
আমারও ভালো লাগছে। ভালবাসা জেনো
...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”
এত জিনিস হারাও? একটু সাবধানে থেকো বাপু। সচলে তোমার দেখাসাক্ষাত নেই কেন বলো তো!
...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”
জিনিষ হারিয়ে গেলে খুব মন খারাপ লাগে। সারা জীবনে কত কি যে হারিয়েছি, হারিয়ে চলেছি! একটা সপ্তাহে কিছু না হারালেই অবাক লাগে। তবু, হারিয়ে গেলে মন খারাপ হওয়েই যায়।
"কী আশ্চর্য, একবার তাকালো না পর্যন্ত!" ... ... "আমি ঘাড়ের একপাশ থেকে চুলগুলো পিঠে এলোমেলো করে ছড়িয়ে দিই।" ... ... "আমার কনুই গুঁতোনো সহযাত্রীও মাথা হেলিয়ে সেই ঘুম দিচ্ছে।" ... ... "পিঠের উপর ছড়ানো চুলগুলো জ্বালাচ্ছে খুব। আমি চুলগুলো একপাশে সরিয়ে দেব বলে গলায় হাত দিই- গলা খালি, আমার চেইনটা নেই!"
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
কিছুদিনের বিরতি শেষে সচল হতেই আপনার সাহিত্যে প্রথমে ডুব দিলাম। খুবই ভালো লাগলো। বাহ ! সার্থক ছোট গল্প।
এ্যানি মাসুদ।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
নতুন মন্তব্য করুন