১
সারা গায়ে ডলে ডলে সর্ষের তেল মাখে নাহার। সারাদিন রাজ্যের ধুলা-ময়লায় পাথর ঘেঁটে গা একদম চিটচিট করে। কাজ শেষে ফিরে তাই অনেকখানি সময় নিয়ে গোসল করে নাহার, রোজ। তারপর হাতে পায়ে অনেকক্ষণ ধরে তেল মাখে, চুল আঁচড়ায়। সারা দিনের মধ্যে এইটুকু সময় ওর একেবারে নিজের। এটুকু সেরে সে রান্না করতে যায়, কাঠের আগুনে তেঁতে উঠে আবার রান্না সারে, তারপর সকলের খাওয়াদাওয়া শেষ করতে করতে ওর চোখের পাতায় ঘুমের নাচানাচি শুরু হয়। বিছানায় শোয়ামাত্র ঘুম।
আজ অবশ্য রান্না করতে হবে না। ছেলে আসার খবরে শাশুড়ি নিজেই কুপির আলোয় উঠানের চুলায় রান্না বসিয়েছে। নাহার তাই একটু স্বার্থপর হয়ে ওঠে। গায়ে তেল মাখা শেষ করে ভেজা চুলগুলো আরও একবার আঁচড়ায়, পিঠে ছড়িয়ে দেয় যত্ন করে। খুব কাজল আর টিপ পরতে ইচ্ছে করছে ওর, না থাক, শাশুড়ি দেখলে সে আরেক লজ্জ্বা। আর তাছাড়া ইলিয়াস কেন যে হঠাৎ আসছে তাও জানা নেই। সকালে ছোটলুর মোবাইলে কল করে শুধু বলেছে রাত আটটা-নয়টার দিকে বাড়ি পৌঁছাবে। কী বৃত্তান্ত কে জানে! তারপর নাহার কাজে গেছে, সারাদিন পাথর বওয়া আর মেশিনে দেওয়ার পর কাজ শেষে আসতে আসতে সন্ধ্যা আজও। এ বাড়ির একমাত্র মোবাইলও থাকে ছোটলুর কাছে, কথা আর হয়নি। নাহার ভাবে- আগে এসে নিক ইলিয়াস। আর সাজগোজ সব তোলা থাকুক আপাতত।
দেখতে দেখতে কেমন করে যেন এক বছর পার হয়ে গেল। বিয়ের পরপর নাহার যখন একলা থাকত, ইলিয়াস গার্মেন্টসে চলে যাওয়ার পর- খুব অস্থির লাগত। তাই মাস কয়েক পরেই একদিন বুকে সাহস করে পাথরের কাজের কথাটা বলেই ফেলে নাহার। এমন কিছু ভারি কাজ নয়, কেবল আস্ত পাথরগুলো ডালিতে করে এক জায়গা থেকে নিয়ে মেশিনে দিতে হবে; পাথর ভেঙ্গে বের হওয়ার পর সেগুলো ধরবার লোক আলাদা। কত মেয়েই তো করছে! প্রথমে গাঁইগুই করলেও পরে রাজি হয়েছে ইলিয়াস। শাশুড়ি অবশ্য এখনও তেমন খুশি না ব্যাপারটা নিয়ে নাহার জানে। না হোক, ওর অস্থির আর একঘেয়ে সময়টা ভালো কাটছে সেই বা কম কিসে?
নাহারের ছোট বেড়ার ঘরটায় এই মুহূর্তে সুখের প্রজাপতি ওড়ে। ওর বুকের ভেতরটা কেমন বিবশ লাগতে থাকে। ইলিয়াস আসছে ভালোই হলো- যে কথাটা ফোনে হাজার চেষ্টাতেও বলতে পারেনি নাহার, সেটা আজ সামনাসামনি বলবে ও। এখনও কেউ জানে না। কেউ জানে না নাহারের পেটের ভেতর গুটিসুটি মেরে দিনদিন বড় হচ্ছে আরেকটা প্রাণ। বমিটমি না হলেও নাহার ব্যাপারটা টের পেয়েছে মাসখানেক হলো, হিসেব করে দেখেছে সে, কোরবানি ঈদের প্রায় তিনমাস হলো, ইলিয়াস বাড়ি থেকে যাওয়ারও। অনেক লজ্জ্বার ভেতরও ওর অদ্ভুত একটা খুশি লাগতে থাকে- আর কেউ টের পাওয়ার আগেই ইলিয়াসকে ও জানাতে পারবে।
শাশুড়ি টাকি মাছের তরকারিতে ধনেপাতা দিয়েছে মনে হয়, খুব সুন্দর গন্ধ আসছে। নিজের খুশিটা আপাতত সামলে চুলার ধারে যায় নাহার। শাশুড়ি চোখ তুলে তাকায় ওর দিকে। "ও নেহার, এলাও কেন বা নাই। কতা হইচে নাকি তোর সাতে আর?"
"না আম্মা, মোবাইল তো ছোটলুর গোরোত। কতা হয় নাই"- নাহার হাতপাঁচেক দূর থেকে বলে। মোবাইল নিজের কাছে চব্বিশ ঘণ্টা রাখার জন্য ছোট ছেলের মুণ্ডুপাত করতে করতে শাশুড়ি টাকি মাছের তরকারি গামলায় ঢালে। এখন কাঁচামরিচ পুড়বে, আলুভর্তা ইলিয়াসের খুব পছন্দ; ভাতের হাঁড়িতে শাশুড়ি আলু দিতে ভোলেনি। নাহার তরকারির গামলাটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াতেই চমকে যায় প্রায়। বাড়ির দরজায় ছোটলুর সাথে দুহাত ভর্তি জিনিস নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে ইলিয়াস।
২
"অ্যাই, তোর জইন্যে দ্যাক কী আনচু!"- গলা নিচু করে প্রায় ফিসফিসিয়ে বলে ইলিয়াস। অবশ্য এমনিতেও জোরে কথা বলার উপায় নেই- ঘরের লাগোয়া ছোট করে ঘেরা বারান্দার একদিকে নিজের মাচানে মা শুয়েছে। ছোটলু ঘুমায় রান্নার চালায়। খেয়েদেয়ে কোথায় যেন বের হয়ে গেছে ও।
"কী"- নাহার চোখ বড় বড় করে তাকায়। এ ঘরে এখনও টিমটিম করে কুপি জ্বলছে। বাইরে সব নিঝুম, গোটা পাড়া ঘুমিয়ে গেছে নাকি কে জানে। নাহারের বড় বড় হয়ে ওঠা চোখ দেখে ইলিয়াস হাসে। তারপর চৌকির কোণার দিকের কাঁথাকম্বল সরিয়ে কী বের করে আনে।
"নেহার"- ইলিয়াসের গাঢ় স্বর ছাপিয়ে নাহার তখন অবাক হয়ে ওর হাতে ধরা জিনিসটার দিকে তাকায়। একটা নয়, ইলিয়াসের হাতে একজোড়া নূপুর! রূপার! নাহারের বিশ্বাস হতে চায় না। ঝিরিঝিরি পাতার নকশা করা নূপুরদুটো কুপির ঘোলাটে আলোতেও চকচক করে। একজোড়া নূপুরের ওর কত শখ, জানে ইলিয়াস। নিজে কাজ করেও একজোড়া নূপুরের টাকা জমেনি ওর আজও। সেই নূপুর! এক মুহূর্তেই সব পরিষ্কার হয়ে যায় নাহারের কাছে। তাহলে এই ইলিয়াসের হঠাৎ আসার রহস্য। নাহারের বুক ভরে যায়, কী বাচ্চা মানুষ রে বাবা! কয়দিন পরে আইসলে কী এমন ক্ষতি হইলহায়?
কী যে ক্ষতি হতো সে প্রশ্নের উত্তর দেবার তাড়া নেই ইলিয়াসের। ও সিনেমায় দেখেছে নায়িকার পায়ে নায়ক নূপুর পরিয়ে দেয়। ইলিয়াস একহাতে নূপুর নিয়ে আরেক হাতে নাহারের পা ধরে। লজ্জ্বায় বিবশ হয়ে যেতে যেতে নাহার বাধা দিতে ব্যর্থ হয়ে হাসে। হাসির দমকে ওর বুক কাঁপে, পা কাঁপে।
"নূপুরগুলা তোক খুপ মানাইচে নেহার!"- ইলিয়াসের এক ফুঁয়ে কুপি নিভে যায়। ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে চোখ সইয়ে নিতে নিতে নাহার ছোট্ট করে বলে "হু"। কথাটা ওর মানানোর স্বীকৃতি না কি ইলিয়াসকেই ফিরতি জিজ্ঞাসা বোঝা যায় না। তবে এমন অন্ধকারই নাহারের দরকার ইলিয়াসকে কথাটা জানানোর জন্য। নাহলে খুব লজ্জ্বা করবে ওর বুকের ভেতর তিরতির করে বেড়ে ওঠা একান্ত গোপন স্বপ্নের কথাটা জানাতে। ইলিয়াস কি অবাক হবে খুব? ইলিয়াসের দুই হাত নিজের হাতে নিতে যায় নাহার। কিন্তু নিতে গিয়েই টের পায় ইলিয়াস একদম চুপ হয়ে গেছে হঠাৎ। ওর হাতে একটু আগের উষ্ণতার ছিটেফোঁটাও নেই। অন্ধকারেই আরও ঘেঁষে যায় নাহার ইলিয়াসের কাছে- "কী হইল তোমার? চুপ করি গেইনেন ক্যান?" অস্থির লাগে ওর, দমবন্ধ লাগে।
নাহারের হাতে মুখ রেখে হঠাৎই কেঁদে ওঠে ইলিয়াস- চোখের জল ভিজিয়ে দেয় নাহারের সিটিগোল্ডের চুড়ি। "কী হইল"- অস্থির লাগতে থাকে নাহারের, হঠাৎ ইলিয়াসের এই কান্নার কোনো অর্থ খুঁজে পায় না ও। "নেহার! মোক মাপ করি দেইস।"- ইলিয়াসের ধরা গলার কথায় নাহার স্তব্ধ হয়ে যায়, বড্ড কু'ডাক ডাকে মন। "নেহার, মুই তোর একটা বইন আনচু রে। ঢাকাতে আচে। অক বাড়ি আনির চাও।" নাহারের শিথিল হাত খুলে পড়ে ইলিয়াসের হাত থেকে। "তুই মোক যা খুশি ক নেহার। অর প্যাটোত মোর ছইল"- নাহারের কানে কটা কথা ঢোকে নাহার নিজেও জানে না, শুধু টের পায় একটা বোনের জন্য যে আজীবনের প্রত্যাশা ছিল ওর, ইলিয়াসের 'বইন' শব্দে তা ভেঙে চৌচির হয়ে গেছে। বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতোন উঠে বসে ও, অন্ধকারেই নূপুরের মুখ খুঁজে খুলতে যায়। "নেহার, মোক ছাড়ি যাইস না নেহার"- ইলিয়াসের আর্তনাদে নাহারের হাসি পায়। না, এত রাতে কোথাও যাবে না ও, ওর যাওয়ার জন্য ভোরের আলো দরকার। নাহার খুব শান্ত হয়ে নূপুরের মুখ খুলতে থাকে, এখন নাহারের পায়ে নূপুরজোড়া শিকলের মতোন ভারি লাগছে, আপাতত ওর দরকার নূপুরজোড়া থেকে মুক্তি।
মন্তব্য
ভয়ে বলব, নাকি নির্ভয়ে?
---মোখলেস হোসেন
নির্ভয়ে বলুন জনাব
...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”
সংলাপ রচনায় আপনার দক্ষতা রীতিমতো ঈর্ষা জাগায়। তুলনায় বর্ণনা অনেকটাই বৈশিষ্ট্যহীন। প্রথম প্যারাগ্রাফটা ভালো লাগেনি। বাক্যগুলো যেন হন হন করে ছুটে চলা পথিকের মত, ঠিক বোঝা যায়না কোথায় চলেছে সে, কোথা থেকে এলো।
---মোখলেস হোসেন।
মতামতের জন্য অশেষ ধন্যবাদ প্রিয় লেখক। আপনি মনোযোগী লেখকের সাথে সাথে একজন গভীর মনোযোগী পাঠক তা বোঝা যায়। পরেরবার লেখার সময় আপনার মন্তব্য মাথায় রাখব। আর এই লেখাটা একটু তাড়াহুড়োকেউ লেখা- অনেকদিন লিখতে পারছিলাম না একেবারেই। সেই অবস্থা থেকে উত্তরণের একটা প্রচেষ্টা বলতে পারেন।
...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”
বা:! খুব সুন্দর লিখেছ দ্যুতিদিদি! ৫ তারা!
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ধন্যবাদ লহমা দা'। লেখার ভুলত্রুটিগুলো বললে না?
...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”
অদ্ভুত সুন্দর।
গল্পটার শুরুতে একটু স্মৃতিচারণের অবকাশে যদি এই বোনের াভাবের কথাটা ধরিয়ে দেওয়া যেত। তবুও আয়রনিটা দারুন ধারালো হয়েছে।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
ধন্যবাদ সোহেল ইমাম গঠনমূলক মতামতের জন্য। শুভেচ্ছা
...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”
বাঃ বেশ ভাল.....।
ধন্যবাদ
...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”
আমার ভালো লাগে তোমার লেখা। জীবনের সমকালীন চিত্র আঁকো। পরিপাটি যত্ন নিয়ে। আঞ্চলিক টানে কথোপকথন বেশ ভালো লেগেছে।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
তোমার লেখার গুণমুগ্ধ পাঠক আমি সাদিয়া'পু। ধন্যবাদ
...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”
এতো ভালো কেমনে লিখেন ! পড়তে পড়তে চোখের সামনে সব কিছুই যেন দেখছিলাম। অসাধারণ।
এ্যানি মাসুদ
ধন্যবাদ এ্যানি মাসুদ।
...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”
দুঃখ জাগানো ঘটনা । তবে বর্ণনা চমৎকার লেগেছে । হান্টার হান্টার
ধন্যবাদ
...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”
নায়িকার নাম পড়ে অট্টহাসি দিলেম সুইটি অনেকদিন পর তোমার লেখা পড়লেম। ভালো লেগেছে সেটি আর নাই বলি
নায়িকার নাম! আমারও মনে পড়লো, আমিও অট্টহাসি দিলেম তোমার সাথে সাথে
...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”
নতুন মন্তব্য করুন