নিভে যাওয়া আগুনের শিখার ঘুষঘুষুনি উত্তাপটুকুও থেমে গেছে কখন, শুধু কালো কালো কয়লার মতো স্তূপ হয়ে পড়ে আছে কালকে পর্যন্ত যা ছিল চেয়ার, টেবিল, ঘরের বেড়া, দরজা, চৌকাঠ। এখন আর আলাদা করে চেনা যায় না কিছুই, কেবল আধপোড়া টিনগুলো একটু দূরে নিজেদের ক্ষয়িষ্ণু অস্তিত্ব জানান দিতে লালচে পোড়ামাটির দগদগে রঙ নিয়ে শুয়ে আছে মাটিতে।
নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ের কুয়াশা সারারাত বৃষ্টির মতো ঝরেই পোড়া কাঠ, বাঁশের মধ্যে সঞ্চারিত উত্তাপটুকু নিভিয়ে দিয়েছে যত্ন করে। এখনও সমানে ইলশেগুঁড়ি কুয়াশা ঝরেই চলেছে, রোদ না ওঠা পর্যন্ত ঝরতেই থাকবে; তারপর যতই রোদের সোনারঙ ঝিকিয়ে উঠবে চারপাশ জুড়ে, ততই কুয়াশা কমতে কমতে কমতে কমতে একটা সময় একেবারেই নাই হয়ে যাবে। আর ততই আরও স্পষ্ট আরও কালো কুচকুচে হয়ে উঠবে পোড়া বাঁশ-কাঠের ছাই-কয়লার স্তূপ!
পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া কেদারের ভিটার উপর কুয়াশার ভেতর দাঁড়িয়ে সামনের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকেন মাস্টার। ওপাড়ার মোজাম, জলিলসহ উন্মত্ত পরিচিত মানুষগুলোর হাতের আগুন থেকে তাঁর বাড়িটা বেঁচে গেছে কাল, হয়ত বাড়িটা এ পাড়ায় নয় বলে। সামনে জগদীশ, চানু, ভোলাদের পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া ভিটার দিকে তাকিয়ে মাস্টারের বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। এই কালই এ পাড়ায়ও বাড়িগুলো ছিল, মানুষগুলো ছিল, গরুগুলো ছিল! কালকে থেকে বুকের ভেতর গেঁড়ে বসা শঙ্কাটা বুঝি আরও ঘনীভূত হয়- তাঁর বাড়ি, তাঁর পাড়ারও এ হাল হতে কতক্ষণ? কাল আসতেই পারেননি তিনি, বড়ছোট মিলিয়ে গোটাছয়েক স্ট্রোকের পর এসব সহ্য করতে পারেন না আজকাল। তবু আজ সারারাত নির্ঘুম কাটানোর পর এই শীতভোরে ছুটে না এসে পারেননি কিছুতেই।
গায়ের পাতলা শাল ভেদ করে কার্তিকের ভোরের কনকনে বাতাস মাস্টারের ঈষৎ ঢিলে হয়ে যাওয়া চামড়ায় বসে যেতে চায় যেন। নাহ্, এবার বাড়ি ফিরতে হয়, এলোমেলো হয়ে যাওয়া শালটা ভালো করে গায়ে জড়ান তিনি। ওপাশের আবছা জটলাটা থেকে কে যেন ধীর পায়ে এগিয়ে আসতে থাকে তাঁর দিকে- বিষয়টায় আজ কেমন অস্বস্তি লাগতে থাকে তাঁর। কে হবে? মন কু’ডাক ডাকে নিজের অজান্তে। তবু নিজের পাদু’টো যেন তাঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে একই জায়গায়।
এতক্ষণে অস্পষ্ট অবয়বটা এবার স্পষ্ট হয়ে ওঠে- শাহাদুল! পাশের পাড়ার চোর আর ছিনতাইকারী শাহাদুল! গতকালকের আগুনে পোড়া প্রায় নিশ্চিহ্ন হিন্দু ভিটায় শাহাদুল ইসলাম কী করে সে প্রশ্ন মনে আনতেও ভয় পান মাস্টার। সে কী কারণে এই ভোরবেলায় এখানে এসেছে, তা ভেবে পান না তিনি। শাহাদুল এসে থামে একেবারে মাস্টারের পাশে- “মামা, দ্যাশটাত আর মানুষ নাই বাহে!”- শাহাদুলের কথায় কী বলবেন ভেবে পান না মাস্টার। তাঁর মনে হয়, হয়ত শাহাদুলও তাঁরই মতো ফেসবুক বোঝে না, স্ট্যাটাস বোঝে না, আগুনও বোঝে না। কিংবা কে জানে- হয়ত শাহাদুলের মনে অন্য কিছু আছে। মাস্টার তাই চুপ করে থাকাকেই সমীচীন জ্ঞান করেন।
“এত বিয়ানে ঠাণ্ডার মইদ্যে তোমরা আইসচেন এটেকোনা! হাঁটো, মুই তোমাক বাড়ি পইয্যন্ত আগে দ্যাও”- শাহাদুলের কথায় হাতের লাঠিটা ঠিক করে নিয়ে মাস্টার হাঁটতে থাকেন তাঁর বাড়ির দিকে। তাঁর পেছন পেছন হাঁটে শাহাদুল, পাতলা হয়ে আসতে থাকা কুয়াশার ভেতর। এই সক্কালবেলায় মাস্টারের পেছন পেছন হাঁটতে হাঁটতে শাহাদুলের আবার মনে পড়ে নদী ভেঙে সহায়-সম্বল হারানো তিন বছর বয়সী ওর পরিবার যখন তিন জেলা পরে এ গ্রামে এসে পৌঁছায়, তখন মাস্টার মামার বাপই তাদের জায়গা দিয়েছে থাকার। ওই বাড়িতেই পুরোটা শৈশব-কৈশোর কেটেছে ওর। সকালের প্রথম আলোয় ওর সামনে লাঠি ধরে ধীর পায়ে হেঁটে যাওয়া শালে ঢাকা ভিন্ন ধর্মের মানুষটার, ওর ছোটবেলার পাতানো মামার বিধ্বস্ত অবয়বটা দেখে শাহাদুলের মনে কেমন এক অপার্থিব মায়া জাগে!
আর ওদিকে, শাহাদুলের সামনে সামনে সামনে হাঁটতে থাকা মাস্টারের মাথায় বেজে চলে শাহাদুলের প্রথম কথাটা- "দ্যাশটাত আর মানুষ নাই বাহে!" মাস্টারের সমস্ত অন্তরাত্মা এ কথাটা অবিশ্বাস করতে চায়, মুছে ফেলতে চায় মাথার ভেতর থেকে। কিন্তু তিনি সফল হন না, মাথার ভেতর কথাটা যেন একই সুরে দুলে দুলে বেজে চলেছে। জীবনে এই প্রথম মানুষের উপর বিশ্বাস হারানোর প্রচণ্ড কষ্ট বুকে চেপে মাস্টার হেঁটে চলেন তাঁর বাড়ির পথে। তারপর হাঁটতে হাঁটতে মাস্টারের মনে হঠাৎই প্রশ্নটার উদয় হয়- মানুষ যদি নাই থাকে দেশটায়, তো শাহাদুল তাঁকে এই সাতসকালের দহনকালে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে যায় কেন? দীর্ঘশ্বাস আরও একটা বের হয় তাঁর বুক চিরে- তিনি জানেন, এ প্রশ্নের কোনো উত্তর হয় না।
মন্তব্য
অনেক দিন পর আপনার লেখা পড়লাম। এই বিষয়টি নিয়ে গল্প খুব একটা চোখে পড়েনি আমার। অবশ্য আমার পড়া খুবই সীমিত। পাঠক হিসেবে একটু আক্ষেপ রয়ে গেল দেবদ্যুতি।আরও কিছু সংলাপ হলে যেন বেশ হতো। দুটো কারণে বললাম- এক, দুজন মানুষের কথোপকথন সবসময়ই আমার ভালো লাগে। দুই, উত্তরবঙ্গের ভাষায় কী যেন একটা আছে!
---মোখলেস হোসেন।
শক্তিশালী লেখনী তোমার, দিদি।
আছে, মানুষ আছে। প্রশ্ন হতেই পারে - কতজন মানুষ আছে?
উত্তর -
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
মানুষ আছে, অমানুষের ভীড়ে মন দোলাচলে দোলে।
এ্যানি মাসুদ
আজকের দিনের গল্পটাকে অনায়াসে পঞ্চাশ বছর, একশ' বছর বা আরও আগের সময়ে, অন্য আরও অনেকখানে বসিয়ে দেয়া যায়। হয়তো ভবিষ্যতেও গল্পটা 'ফিট' করে যাবে। আগুনে পোড়া প্রায় নিশ্চিহ্ন ভিটাটা হিন্দুর না হয়ে মুসলিমের, বৌদ্ধের, সাঁওতালের, শিখের, আজীবকের ............. যে কারোও হতে পারে।
মানুষ খুব বিচিত্র জীব। একটা পাখি, একটা মাছ বা অন্য কোন প্রাণীকে বাঁচানোর জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা, অশ্রু ফেলা মানুষেরা আবার চোখের পাতা না কাঁপিয়ে অন্যত্র শিশুদের উপর ক্লাস্টার বোমা ফেলে।
Thou shalt ascend and not descend, O man! Life and alertness do I prepare for thee. Mount, forsooth, this imperishable, pleasant car; then in old age thou shalt hold converse with thy family! (Atharva-Veda, VIII, 1, 6)
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
অনেকদিন পর আপনার একটা গল্প পেলাম। সুন্দর লাগলো। আপনার লেখার ক্ষমতা দেখলে ঈর্ষা। কলম চলুক, আরো গল্প আসুক।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
নতুন মন্তব্য করুন