এখানে স্বাধীনতার ব্যাপারটি কোন জায়গায়? এই বাছাই প্রক্রিয়ার কোন অংশটাকে স্বাধীন ইচ্ছার প্রয়োগের দাবী বলা যায়? সম্ভবত এই কথা বলতে পারাটাকে যে আপনি ইচ্ছে করলেই ভ্যানিলা আইসক্রিম বাছাই করতে পারতেন। তবে করেন নি। কিন্তু আসলেই কি ব্যাপারটা তাই? আপনি চকোলেট আইসক্রিমটি বাছাই করে ফেলার পর কি আসলেই দাবী করতে পারেন যে চাইলেই আপনি ভ্যানিলা আইসক্রিমটি নিতে পারতেন?
বাছাইয়ের সময় আপনার তখনকার মেজাজ, আইসক্রিমের চেহারা, তার দ্বারা আপনার মস্তিষ্কে সৃষ্ট প্রণোদনা, এই সবই তো নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে হয়েছে। আপনার নিজস্ব পছন্দ, পূর্বে এই আইসক্রিমগুলো স্বাদের অভিজ্ঞতা, এইসবের সমন্বয়ই তো আপনার মস্তিষ্কের সিদ্ধান্ত-গ্রহণকারী ইউনিটটিকে প্রভাবিত করেছে। এখন আপনার এই সব গণনাকারী ফাংশনের বাইরে আপনার মস্তিষ্কের ভেতরে অথবা আপনার দেহের ভেতরে আপনাকে চালনাকারী আরেকটি কোনো সত্তা কি আছে যা আপনার সিদ্ধান্ত-গ্রহণ ক্ষমতাকে দখল করে নিয়েছে? কোনো আত্মা? আপনার আসল আমি? আছে নাকি এমন কিছু?
বরাবরের মতই, আত্মা সংক্রান্ত বক্তব্য বিজ্ঞানের দর্শনানুসারে অর্থহীন তত্ত্ব। কারণ আত্মা কথাটার মধ্যে একটা অধিবিদ্যাগত দ্যোতনা আছে। আপনি যদি বলেন বিজ্ঞান দ্বারা তার ব্যাখ্যা একসময় সম্ভব, তাহলে আপনি আসলে বলছেন ওই আত্মা বস্তুটার ভৌতিক, কার্য-কারণগত ব্যাখ্যা সম্ভব। কিন্তু তখন আর জিনিসটা আত্মা বা আধিভৌতিক কোনোকিছু থাকে না। বরং এর উপর আরোপিত ফাংশনগুলো মস্তিস্ক বা স্নায়ুতন্ত্রের মত ইউনিটগুলোতে বন্টিত হয়ে যায়। আবার যদি আপনি বলেন, আত্মা জিনিসটার এমন উপাদান আছে যা ভৌতিক না, তাহলে সেই কথা আপনি আর যাচাই করতে পারেন না। ফলে এ সংক্রান্ত বক্তব্য উভয় উপায়ে অর্থহীন।
ফলে আমরা মেনে নিচ্ছি যে, আপনার এই বাছাই প্রক্রিয়াতে আপনার শারীরিক, ভৌতিক ফাংশনগুলোর বাইরে অন্য কোনো আধিভৌতিক প্রভাব ছিল না। আপনার মস্তিষ্কের বিভিন্ন গণনা ইউনিট আপনার এই বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত তৈরি করেছে। আর সেই গণনার প্রকৃতি প্রভাবিত হয়েছে মূলত আপনার মস্তিষ্কের ইউনিটগুলোর গঠন আর এ যাবতকাল পর্যন্ত পৃথিবী থেকে প্রাপ্ত আপনার অভিজ্ঞতা, ইন্দ্রিয়ানুভূতি বা সেন্সরি-পারসেপশন দ্বারা। এখন এই নির্ধারিত ভৌতিক কাঠামোটিতে আপনার স্বাধীনতাটা কোথায়?
আপনার গণনা ইউনিটের সিদ্ধান্ত তৈরি হয়েছে আপনার মস্তিষ্ক ও তার ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে, যার গঠনের উপর আপনার কোনো হাত নেই। পৃথিবী হতে শিশুকাল থেকে প্রতি নিয়ত আপনি যে ইন্দ্রিয়-অভিজ্ঞতা গ্রহণ করছেন, যেগুলো আপনার পছন্দ, অভিরুচিকে তৈরি করেছে, সেগুলোও আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে আপনার সমস্ত স্নায়ু দিয়ে প্রতি নিয়ত প্রবেশ করেছে। যে কয়টি ইন্দ্রিয়-অভিজ্ঞতা আপনি নিজে বেছে গ্রহণ করেছিলেন বলে আপনি মনে করছেন (যেমন ফুটবলে লাথি মেরেছিলেন, প্রিয়জনকে চুমু খেয়েছিলেন), সেগুলো বাছাই করার পেছনেও আবার আপনার মস্তিষ্কের গণনা ইউনিটগুলোই দায়ী ছিল। আর সেই গণনা আবার প্রভাবিত হয়েছিল আপনার সে-সময়কার মস্তিষ্কের গঠন আর তদাবধি আপনার ইন্দ্রিয়-অভিজ্ঞতার সমন্বয় দ্বারা।
এখানে একটা চক্র তৈরি হয়েছে। এই চক্রের শুরু আপনার জন্ম থেকে। বিষয়টা চক্রাকার হলেও, এখানে কিন্তু কোনো একটা পর্যায়েও আপনার নিজস্ব, আলাদা কোনো ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগের সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। আপনি মস্তিষ্কের একটি বিশেষ কাঠামো ও তার গঠন-বর্ধনের কোডিং নিয়ে জন্ম নিয়েছেন। তারপর আপনার আয়ত্ত্বের বাইরে আপনার ইন্দ্রিয় হয়ে সমস্ত স্নায়ুতে পৃথিবীর তাবৎ তথ্য প্রবেশ করেছে। আপনার মস্তিষ্কের গণনা ইউনিটগুলো সেই তথ্যকে প্রক্রিয়াকরণ করেছে। এবং তার ভিত্তিতে সাধ্যমতো সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অভিজ্ঞতার সাথে সেই সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা বেড়েছে। বেশিরভাগ সিদ্ধান্তের ফলাফল ছিল কোনো একটি পেশিতে (পা, জিহ্বা) বিশেষ নড়াচড়ার একটি সংকেত পাঠানো। এই-সবই গণনাকৃত হয়েছে সুনির্ধারিত উপায়ে। এখানে আপনার স্বাধীনতা কোথায় ছিল? আপনি কি আসলেই চকোলেট না বেছে ভ্যানিলা আইসক্রিম বাছাই করতে পারতেন?
শেষ চেষ্টা করা যাক। এতক্ষণ ধরে নেয়া হয়েছে আপনার মস্তিষ্কের গণনা একটি নির্ধারিত প্রক্রিয়া বা ডিটারমিনিস্টিক প্রসেস (deterministic process)। অর্থাৎ হুবহু একই পরিস্থিতিতে আপনাকে এই বাছাইয়ের সুযোগ দেয়া হলেও আপনি বারবার ঠিক চকোলেট আইসক্রিমটিই বেছে নিতেন। এখন আসুন কল্পনা করি, আপনার প্রক্রিয়াকরণ ইউনিটের কর্মকাণ্ড পুরোপুরি নির্ধারিত প্রক্রিয়া নয়। বরং এতে অনির্ধারিত অংশ বা স্টোকাস্টিসিটি (stochasticity) আছে। এবং ধরলাম প্রকৃত র্যান্ডমনেস (randomness) বলে কিছু আছে। ফলে ধরে নিচ্ছি, আপনার মস্তিষ্কের সিদ্ধান্ত-গ্রহণকারী ইউনিট কিছু নির্ধারিত প্রক্রিয়ার সাহায্যে মস্তিষ্কের ক্ষমতা আর পূর্বাভিজ্ঞতা ব্যবহারের পাশাপাশি একটি মুদ্রাও ব্যবহার করে সিদ্ধান্ত গ্রহণে র্যান্ডমনেস আনয়নের জন্য।
ফলে গণনা-ইউনিটের নির্ধারিত ফাংশনগুলো গণনার মাধ্যমে আপনার বাছাইয়ের অপশনগুলোর উপর কিছু সম্ভাবনা নির্ধারণ করে। তারপর ওই সম্ভাবনার উপর ভিত্তি করে মুদ্রা নিক্ষেপ করে নিক্ষেপের ফলাফলের উপর ভিত্তি করে শেষ সিদ্ধান্তটি নেয়। হয়ত গণনার ভিন্ন ভিন্ন ধাপে এই একই প্রক্রিয়া ব্যবহৃত হয়। ফলে এখন আর বলা চলে না যে ঠিক একই পরিস্থিতিতে আপনি বারবার চকোলেট আইসক্রিমটিই বাছাই করতেন। হুবহু একই পরিস্থিতিটি যদি বারবার পুনর্নির্মাণ করা যেত, তবে এখন দেখা যেত মাঝে মাঝে আপনি ভ্যানিলা আইসক্রিমও বেছে নিচ্ছেন। বহুবার এটা করা গেলে দেখা যাবে আপনার চকোলেট আর ভ্যানিলা আইসক্রিম গ্রহণের একটা সম্ভাবনা বিন্যাস তৈরি হয়েছে।
ভালো কথা। কিন্তু এখানেও কি আপনার স্বাধীনতার সন্ধান পাওয়া গেল? আপনার এই যে হুবহু একই পরিস্থিতিতে একবার চকোলেট আর একবার ভ্যানিলা আইসক্রিম বেছে নেবার ব্যাপার তৈরি হলো, সেতো আপনার গণনা-ইউনিট ব্যবহৃত মুদ্রাটির বদৌলতে। সেই মুদ্রার সম্ভাবনা বিন্যাসে তো আপনার কোনো হাত নেই। কোন মুহূর্তে কোন পিঠ পড়বে, তাতে তো আপনার কোনো প্রভাব নেই। বলা চলে ওই মুদ্রাটি স্বাধীন। ঠিক স্বাধীনও না, খামখেয়ালী। কিন্তু আপনি? আপনি আপনার গণনা সরঞ্জাম, আপনার অনুভূত ইন্দ্রিয়-অভিজ্ঞতা আর বড়জোর একটি মুদ্রা দ্বারা নির্ধারিত। এগুলো তাদের নিজস্ব নিয়মে তাদের প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন করে। আর তারই প্রতি মুহূর্তের সামষ্টিক প্রতিচ্ছবি হলেন স্বাধীন-ইচ্ছাবিহীন এই আপনি।
একজন যুক্তিবাদী হলে আপনি ব্যাখ্যাটি সহজেই যৌক্তিক বলে মানবেন। তবে একজন একনিষ্ঠ বিজ্ঞান-ঘনিষ্ঠ-চিন্তক হলে এই বর্ণনার মাঝ পথেই আপনার মাথায় প্রশ্ন আসার কথা, ফ্রি-উইল বা স্বাধীন-ইচ্ছার অস্তিত্ব কি আদৌ একটি বিজ্ঞানসম্মত জিজ্ঞাসা? আমার গবেষণাগুরুর কাছে স্বাধীন-ইচ্ছার অস্তিত্বের প্রশ্নটা তুললে তিনি বলেন, স্বাধীন-ইচ্ছার অস্তিত্ব হইলো দ্রষ্টার চোখে। কেউ যদি চায় সে ভাববে, মানুষ তো পুরাই তার গণনা সরঞ্জামের দাস। এখানে স্বাধীন-ইচ্ছা কই? আবার কেউ যদি চায় তো ভাবতে পারে, মানুষের গণনা সরঞ্জামের এই যে গণনার ক্ষমতা, এইটাইতো হইলো স্বাধীন-ইচ্ছা! পুরাই বাচনিক ব্যাপার।
মন্তব্য
যুক্তি দিয়ে অনেক কিছুই প্রমাণ করে ফেলা যায়। বেলা সাড়ে ১১টা সময়কেও আমি রাতের যে কোনো সময় বানিয়ে দিতে পারি (বিভিন্ন দেশে আত্মীয় স্বজন থাকলে যা হয় আরকি)
আরেকটু বেশি চিন্তা করলে বেলা সাড়ে এগারটা আবার কী জিনিষ ... চাঁদে যে থাকবে তাঁর সময় কেন জি.এম.টি. দিয়ে নির্ধারিত হবে। বা মঙ্গলে যে থাকবে। ... ... ... ... আরেকটু আগালে: সময় আবার কী জিনিষ ... টাইম এন্ড স্পেস ... টুইন প্যারাডক্স ... ....
আপনার লেখাটাও এরকম লাগলো ... ...। মাঝে মাঝে ভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে দেখার অভ্যাস খুবই ভালো
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
একদম ঠিক কথা বলেছেন শামীম ভাই
তবে যুক্তি দিয়ে চিন্তা করার অভ্যাস মাঝে মাঝে কেন? সবসময়ই ভালো
"স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায়..?"
তবে কিনা,
"মরিতে চাহিনা,
এই সুন্দর ভুবনে
সকলের মাঝে আমি
বাঁচিবার চাই..!"
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
সঠিক!
আচ্ছা, স্বাধীন ইচ্ছা কি আত্মার সাথে প্যাকেজ আকারে আসে? মানে, আত্মার অস্তিত্ব ভুল প্রমাণিত হলে কি স্বাধীন ইচ্ছাও বাতিল হয়ে যাবে? আমরা যদি চিন্তা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়াকে ভৌত প্রক্রিয়া হিসেবে দেখাতে পারি, তবে তো স্বাধীনতা নামক অবভাস বা phenomenon স্রেফ নির্ধারণবাদ এবং চান্সের মিশেলে অবরোহিত হয়ে যায়, তাই নয় কি?
আত্মা তত্ত্ব অবিজ্ঞানসম্মত।
ফলে আত্মা নিয়ে যেকোন বক্তব্য অর্থহীন। এমন কি ভুল প্রমাণের চেষ্টাও। স্বাধীন-ইচ্ছা ধারণাটাও একই পরিমাণ অবিজ্ঞানসম্মত, অর্থহীন।
একদম। আসলে এর অস্তিত্ব, আমার গবেষণাগুরু যেমন বলেছেন, কেবল দ্রষ্টার চোখে বিরাজ করে (একেকজনের একেক কন্সেপ্ট)। যেসব ধারণার অস্তিত্ব কেবল দ্রষ্টার চোখে বিরাজ করে, সেগুলো অর্থহীন।
ধন্যবাদ এতো সুন্দর মন্তব্যের জন্য।
সুন্দর বিশ্লেষণ। লেখাটির জন্য ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ স্বাধীন ভাই!
দারুন বিশ্লেষণ...মাথাটা হালকা গুলানি খাইল মনে হয়...
তাওতো ভালো হালকার উপর দিয়ে গেছে
ভাল আলোচনার জন্য ধন্যবাদ।
আমার নিজের মত বলতে পারি, যখন আমি আইসক্রীমটা পছন্দ করছে তখন যদি কেউ এসে কোনো একটা বিশেষ আইসক্রীম নেবার জন্য চাপাচাপি না করে, বা যদি কেউ আগে থাকতে শাসিয়ে না রাখে কোনো একটা ফ্লেভার নেওয়ার জন্য, তাহলে বলব যে আমি আমার স্বাধীন ইচ্ছাতেই চকোলেট ফ্লেভারটা নিয়েছি।
কৌস্তুভ
সেই বলাটা কি স্বাধীন ইচ্ছাতেই বলবেন? নাকি আপনার মস্তিষ্ক হিসাব করে বের করেছে যে এটা বলাটাই বেটার, সেকারণে বলবেন?
পুরাই বাচনিক ব্যাপার!
ভাল লাগল।
এই টপিক নিয়ে কোথায় যেন পড়েছি মনে পড়ছে না।
থ্যাঙ্কস!
~~সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা মানুষের মুক্তির জন্যে সংগ্রামের সময় অপরাধীর অধিকারের কথাটাও ভুলে যায় না।
আমি 'ধরব'ও না, 'বেছে'ও নেব না। আমি কারো এক্সপেরিমেন্টের গিনিপিগ হবো না। আমি ভ্যানিলাও খাব না, চকোলেটও খাবো না। দুইটাই ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আমি স্ট্রবেরি ফ্লেভার খাব। সুতরাং আমি স্বাধীন। আমি স্বাধীন। বল বীর / চির স্বাধীন মম শির ...
সিরিয়াসলি, স্বাধিন ইচ্ছা না থাকলে বা না মানলে 'নৈতিক দায়িত্বের' কি হবে ? তাহলে তো যে কেউ যে কোন কিছু করে পার পেয়ে যাবে কিন্তু কিছুই বলা যাবে না। যুদ্ধাপরাধীরা তো এই ডিফেন্সে পগার পার হয়ে যাবে !
আচ্ছা, এভাবে কি বলা যায় না যে - ব্যাখ্যা হতো সম্ভব কোন একটা স্তরে, কিন্তু তারপরও আত্না ভৌতিক না হয়তো, কিম্বা 'ভৌতিক' হলেও - অন্ততঃ এর উপর আরোপিত ফাংশনগুলো মস্তিস্ক বা স্নায়ুতন্ত্রের মত ইউনিটগুলোতে বন্টিত হয়ে যায় না - কারন সসীম-ক্ষমতাসম্পন্ন মানব-মস্তিষ্ক উদ্ভাবিত সীমিত যুক্তিবিদ্যা ও যুক্তিজ্ঞানের ফ্রেইমওয়ার্কের বাইরেও আরও লক্ষ-কোটি গুন উন্নত বিজ্ঞান সম্ভব যেখানে হয়তো ঐ সসীম-ক্ষমতাসম্পন্ন-মানব-মস্তিষ্ক উদ্ভাবিত সীমিত যুক্তিবিদ্যা ও যুক্তিজ্ঞানের মৌলনীতিগুলিই একদম বাতিল হয়ে যায় বা তুচ্ছ প্রতিভাসে পরিণত হয়, এবং ঐ লক্ষ-কোটি গুন উন্নত বিজ্ঞান বা যুক্তিজ্ঞানের ফ্রেইমওয়ার্কে বা মাত্রায় বিচার করলে আত্না তথাকথিত ভৌতিক বা ভৌতিক নিয়মে পরিচালিত না হয়েও, বা হয়েও, বা উচ্চতর কোন নিয়মে পরিচালিত হয়ে, ব্যাখ্যাযোগ্য হতে পারে এবং মোটেই এর উপর আরোপিত ফাংশনগুলো মস্তিস্ক বা স্নায়ুতন্ত্রের মত ইউনিটগুলোতে বন্টিত না হয়ে আরো উচ্চতর কোন 'ভৌতিক' বা 'অভৌতিক' স্তরে বা মাত্রায় বন্টিত হয় যা সীমিত চিন্তাশক্তিসম্পন্ন মানবমস্তিষ্কজাত সীমাবদ্ধ বিজ্ঞান ও যুক্তিবিদ্যা ব্যাখ্যা করতে পারছে না। তাই বলে একে অস্তিত্বহীন বা অর্থহীন বলা যায় না কোনমতেই! বড়জোর মানুষের অর্থবোধের গণ্ডীর চেয়ে উচ্চতর অর্থসম্পন্ন বলা যেতে পারে হয়তো। কি বলেন ?
সুন্দর প্রশ্ন! ধন্যবাদ।
প্রথমটা নিয়ে প্রথমে বলি। যুদ্ধাপরাধ। ধরুন বিজ্ঞান বের করে ফেলল যে আমাদের সব ক্রিয়া একদম পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র মেনে চলছে। আমাদের নিজস্ব আলাদা কোনো ইচ্ছা প্রয়োগের উপায়ই নেই। এখন আমি যদি আপনাকে গিয়ে (কথার কথা ) মেরে আসি, বিজ্ঞানের এই আবিষ্কার কি আপনাকে আটকাবে আমার কর্মটাকে অপরাধ হিসেবে সনাক্ত করতে এবং ব্যবস্থা নিতে?
বিজ্ঞান বা দর্শনের সব আলোচনা সর্বদা আমাদের জীবনে বা সমাজে প্রভাব রাখতে বাধ্য কিনা এ নিয়ে বহু আগে থেকে তর্ক আছে। ফলে আপনার এই প্রশ্ন আসাটা খুবই স্বাভাবিক। ঠিক এই মুহূর্তে মুক্তমনায় এই বিষয়টি নিয়েই তর্ক চলছে। ঘুরে আসতে পারেন। আমার অবস্থান হচ্ছে, বৈজ্ঞানিক বা দার্শনিকভাবে স্বাধীন-ইচ্ছা সম্পর্কে যে সিদ্ধান্তেই আশা যাক, আমরা যেহেতু সেটা মানতে বাধ্য না, তদানুযায়ী সমাজকে শৃঙ্খলিতও করা যাবে না। আমার মনে হয়, সামাজিক ক্ষেত্রে মানুষের বা জনগণের ইচ্ছার উপর বিজ্ঞানের একটা আবিষ্কার চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব না। যুদ্ধাপরাধ করে মানুষ পার পেয়ে যাবে না এটা আমরা নিশ্চিত করতে যেহেতু বদ্ধপরিকর, রাজাকাররা কপালের দোষে মানুষ খুন আর ধর্ষণ করে থাকলেও পার পাবার তাদের উপায় নেই, শাস্তি তাদের পেতেই হবে।
আর, দ্বিতীয়, অর্থহীন বলতে আমি অস্তিত্বহীন বোঝাই নি। বিজ্ঞানের দর্শনে অর্থহীন বা meaningless এর বিভিন্ন অর্থ আছে। সেটা নিয়ে এই লেখার শুরুতে কিছু ব্যাখ্যা দিয়েছিলাম, পড়তে পারেন। এছাড়া এই লেখাটাও পড়তে পারেন। রেফারেন্সের জন্যে লজিক্যাল পজিটিভিজম, ভেরিফিকেশানিজম, কার্ল পপার, ইত্যাদি পড়তে পারেন। এগুলো আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তিমূলক দর্শন। সংক্ষেপে বললে, অর্থহীন বলতে বিজ্ঞানের দর্শনে বোঝায় যেটা নিয়ে বিজ্ঞান আলোচনা করতে পারে না, যেটা নিয়ে বৈজ্ঞানিক প্রকল্প তৈরী করা যায় না, কারণ ওগুলোর পর্যবেক্ষণ নেই, ফলে যাচাইযোগ্যতাও নেই। এর মধ্যে আত্মা, পুনর্জন্ম, ফেরেশতা, জিন, ভুত, ইত্যাদি পরে। ফলে এগুলো "মানুষের অর্থবোধের গণ্ডীর চেয়ে উচ্চতর অর্থসম্পন্ন" এমনটা বিজ্ঞানের পক্ষে বলা সম্ভব না।
~~সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা মানুষের মুক্তির জন্যে সংগ্রামের সময় অপরাধীর অধিকারের কথাটাও ভুলে যায় না।
আচ্ছা, ঠিক আছে। কিন্তু, "অর্থহীণ" না বলে, "মানুষের অর্থবোধের গণ্ডীর সীমাবহির্ভুত" বা স্রেফ "অযাচাইযোগ্য" বললে টার্মটা আরো 'বৈজ্ঞানিক' এবং অব্জেক্টিভ হতো না ? এই টার্মটাকেই তো আমার বরং খানিকটা অবৈজ্ঞানিক মনে হচ্ছে।
যাহোক, নামকরন বা টার্মিনোলজি নিয়ে কুতর্ক করবো না। আপনার বক্তব্য বুঝতে পারছি।
এ বিষয়ে অর্থহীন কথাটা ব্যবহারের লেগাসি সম্ভবত ভেরিফিকেশানিজম এবং লজিক্যাল পজিটিভিজম থেকে, কারণ তারা জ্ঞানকে বা অর্থকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করত।
~~সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা মানুষের মুক্তির জন্যে সংগ্রামের সময় অপরাধীর অধিকারের কথাটাও ভুলে যায় না।
প্রচলিত ধারনা খোলনলচে বদলে দিতে আপনার লেখাগুলোর জুড়ি নেই! মানুষের ''স্বাধীন-ইচ্ছা বলে কি কিছু আছে?'' - এই প্রশ্ন শৈশব থেকে সঙ্গী হয়ে আছে আমার; এবং আমি জানি আমার মত অনেকেই আছেন এমন। অসংখ্যবার বিতর্কে লিপ্ত হয়েছি বিষয়টি নিয়ে, যেখানে প্রচলিত ধর্মকেন্দ্রিক যুক্তিগুলোই প্রাধান্য পেত! তুলনায় আপনার লেখাটি সে পথে হাটেনি; বরং বিজ্ঞানকেন্দ্রিক যুক্তির ঝড়ে আমাদের প্রচলিত বিশ্বাস-আবেগ-অহংকার বড় ধরনের নাড়া খেয়েছে!
আমার বহুদিনের জমানো প্রশ্নের উত্তর পেয়েছি এই লেখাতেও। যেমনটা সবসময় পাই আপনার লেখা থেকে। তবে দুর্ভাগ্যজনক হল, আপনি অনেক দিন লিখছেন না।
মন্তব্য করে যাইতেছি তো সমানে।
নতুন মন্তব্য করুন