একজন আব্দুল আজিজের চলতে থাকা জেহাদ

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি
লিখেছেন ধ্রুব বর্ণন (তারিখ: শুক্র, ০৫/১১/২০১০ - ৮:৪৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


বৃষ্টির রাতে রিক্সাটা যে পথ ধরে এগুচ্ছে, সে পথের শেষে কেবল একটা সিল্কের বোরকা দেখতে পাওয়াটা ভালো কথা নয়। বৃষ্টিস্নাত রাস্তা চকচক করছে। চকচক করছে সিল্কের বোরকা। পর্দায় মুখ ঢাকা। কিন্তু আমি আশংকা করতে পারছি এর আড়ালে কে আছেন।

রিক্সাটা এপথে আর না এগুলে পারে। বোরকা পরিহিত মহিলাটি আর দাঁড়িয়ে না থাকলে পারেন। রাস্তায় আরো চৌদ্দটা মানুষের ভিড়ে সেই মহিলা বা আমার মুখ আড়াল হয়ে যেতে পারে। এতসব সম্ভাবনার ভিড়ে কেবল একটি ঘটনাই অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠলো। জনমানবশূন্য রাস্তায় আমার রিক্সাটি অবধারিতভাবে সিল্কের বোরকা পরিহিত মহিলার দিকে এগিয়ে যেতে থাকলো। ওনাকে আড়াল করে আজ আর আমার গন্তব্যে যাওয়া হবে না। ওনার পাশ দিয়ে রিক্সাটা যাবার সময় আমি সমান আতংক আর আশা নিয়ে তাকিয়ে আছি পর্দাটার দিকে, সেটা যাতে সরে না যায়, এবং যাকে আশংকা করছি তাকে যাতে দেখতে না পাওয়া যায়। কিন্তু উনি পর্দাটা সরালেন, পান খাওয়া দাঁতে হেসে আব্দুল আজিজের মা বললেন - কেমন আসো ধ্রুব? আর ওনার পান খাওয়া চোখের মধ্যে আমার আতঙ্কিত একটা স্পন্দন আটকে গেল। নাহ! আমি ওনাকে দেখতে চাই নি এই পথে। আমি ওনাকে আর কখনো দেখতে চাই না ...

- ধ্রুব উঠো। ধ্রুব। মা ডাকছেন। আমি চোখ মেলে তাকালাম।

- আব্দুল আজিজ আসছে। নিচের তলায় দাঁড়ায় আছে। তোমার সাথে দেখা করতে চায়।

আমি বিস্ময় আর উদ্বেগ নিয়ে বললাম - ও আমাদের নতুন বাসার ঠিকানা পেল কি করে?

মা আমার উদ্বেগ দেখে কথাটা বলবে কি বলবে না চিন্তা করে বলে ফেলল - আব্দুল আজিজের মায়ের সাথে কয়দিন আগে রাস্তায় দেখা হলো। হাসতে হাসতে জিগ্গেস করলো, ধ্রুব কেমন আছে, অনেকদিন দেখি না। ...

আব্দুল আজিজ আমার প্রাক্তন ছাত্র। এখন কামরাঙ্গীর চরে একটা মাদ্রাসায় পড়ে। না, আমি তাকে মাদ্রাসার পড়াশোনায় সাহায্য করি নি। এলাকার কোনো একটা কলেজে সে পড়ত। আমি তাকে এইচ এস সি পরীক্ষার জন্য পড়াতে গিয়েছিলাম। নয় দিন পড়িয়েছিলাম। আটদিনের মাথায় সে আমাকে বলেছিল, আপনেরে মনে হয় শেষ পর্যন্ত আমি খুন করুম না।

আব্দুল আজিজকে পড়ানোটা একটা দুর্ঘটনা ছিলো। আমি পড়াতে গিয়ে আশা করি নি, ছাত্র সম্পূর্ণ মাদ্রাসার ছাত্রের বেশভূষায় থাকবে। গালে দাঁড়ি, মাথায় টুপি, গায়ে মরা আকাশী রঙের আলখাল্লা। আব্দুল আজিজ গড়নে একদম হালকা পাতলা। মুখটা লম্বা, চিকন। মাথাটাও। মুখে সর্বক্ষণ দুনিয়াদারির প্রতি একটা তাচ্ছিল্যের হাসি, চোখে অবিচল নির্লিপ্ততা। কন্ঠ তেলাওয়াতের, ধীর, নিচু, এক ঘেঁয়ে, এবং শীতল।

সেই আব্দুল আজিজ আমার নতুন বাসায় আমার সাথে দেখা করতে এসেছে। যখন পড়াতাম, তখনের বাসা থেকে এখনের বাসা ভিন্ন। আগের বাসাতেও আব্দুল আজিজ মাঝে মাঝে দেখা করতে আসত। বিকালে না পেলে রাতে আসত। ঘরের ভেতরে ঢুকত না। সিঁড়ি ঘরে দেখা করে চলে যেত। তেমন কিছু বলত না। খুব শীতলভাবে হাসত, আর বলত - আপনার মত মানুষদের সাথে মাঝে মাঝে দেখা করাটা একটা জরুরত।

সেই জরুরতের ধারাবাহিকতা চলছে। আমি চাই না সে ধারাবাহিকতা চলুক। আমি নির্বিঘ্নে থাকতে চাই। কিন্তু আব্দুল আজিজ আমাকে আবার খুঁজে বের করে।

এই আব্দুল আজিজকে যখন আমি ত্রিকোণমিতি বুঝাতাম, সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত বইয়ের একটা কোণে। তার দৃষ্টি দেখে বলে দেয়া যেত, সে আমার কথা শুনতে পাচ্ছে না, তার চোখ নড়ছে না, দৃষ্টি কোনো একটা শব্দে আবদ্ধ, আর মগ্ন হয়ে আছে অন্য কোনো চিন্তায়। আমি তার মনোযোগ আকর্ষণ করতে গেলে সে বলত আপনি আপনার কথা বলতে থাকেন। মাঝে মাঝে বলত, এসব শিক্ষার কোনো মূল্য নাই যে বোঝেন? এগুলো হইলো শয়তানি শিক্ষা। আমার মা আপনারে ভাড়া কইরা আনসে আমারে এইসব শয়তানি শিক্ষা দেবার জন্যে। আমার মারেও শয়তানে ধরসে।

- কতগুলা জিনিস আছে, খুব সহজেই বইলা দেওয়া যায়। এই যেমন আমি বলতে পারি, আপ্নে নমাজ পড়েন না। খেরেস্তানি বিদ্যার মধ্যে বুঁদ হইয়া আছেন। ছোটবেলা থেইকা এগুলা পড়তে পড়তে আপনার মস্তিষ্কে পচন ধৈরা গেছে। আমার কিন্তু একটা দায়িত্ব আছে আপনারে নমাজ পড়ানোর। অথবা সেই অনুযায়ী আপনার উপর ব্যবস্থা নেওয়ার।

- বেশ। নিও। কিন্তু আমার দায়িত্ব তোমাকে ত্রিকোণমিতি পড়ানো। অংকটা বুঝার চেষ্টা কর।

- আপনি কোনটা বুঝতে বলতেসেন আমারে? আব্দুল আজিজ কলমটা আমার হাত থেকে নিয়ে অর্ধেকটা অংক করে, তারপর অনর্থক বলে উদাসভাবে কলমটা আবার রেখে দেয়। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলে, আমি এইচ এস সি পরীক্ষাটা দিবো না। আমি একটা মাদ্রাসায় ভর্তি হইসি। আমার মারে এইটা এখন জানানর দরকার নাই।

আব্দুল আজিজ দুই ভাই এক বোন। সে সবার ছোট। বোন তখন বুয়েটে মেকানিকালে পড়তেন। ভাই গাজীপুর আই ইউ টিতে। আব্দুল আজিজের বাবা মৃত। বিধবা মা সংসার চালায় তাদের পাঁচ তলা বাসার ভাড়ার টাকা দিয়ে।

আব্দুল আজিজ মাঝে মাঝে আমার সাথে কেন দেখা করে? আমাকে কেনো তার নজরে রাখা দরকার?

- টিক্কা পাড়ায় আমার একটা হুজুর আছে। পড়ানোর সেই দিনগুলোতে এসব কথা বলত আব্দুল আজিজ। ২০০০ সালের কথা।

- সপ্তাহের মইধ্যে ধরেন দুই দিন কমসে কম ওনার কাসে যাই। ওনার চিন্তাটা আমার সাথে পুরাপুরি মিলে। এই শয়তানি শিক্ষা আর সমাজব্যবস্থা কিভাবে উপড়াইয়া ফেলা যায়, সেই নিয়া ওনার গভীর চিন্তা ভাবনা আছে। তবে উনি ওনার পরিকল্পনা কেবল চিন্তা ভাবনার মইধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাননা। ওনার কাছে আমাদের শত্রু দের একটা লিস্টি আছে। আপনাদের বড় বড় কবি সাহিত্যিকরা ওই লিস্টে আছেন। তবে লিস্টটা কমপ্লিট না।

আমি তাকে বোঝাতাম, আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ করেও চাইলে সে তার ধর্ম কর্ম পালন করতে পারে। এর জন্যে তার মাদ্রাসায় যাবার দরকার নেই। শত্রু র লিস্ট রাখারও দরকার নেই। কারণ তাদের ধর্ম কর্ম পালনে বাংলাদেশে কোনোকালে কেউ বাঁধার সৃষ্টি করে নি।

- আপনি যে বাংলাদেশের ইসলাম নিয়া কোনো এলেম রাখেন না বুঝা যায়। আপ্নে জানেন হাসিনার সরকারের উপরে আলেমরা কিভাবে ক্ষেইপা আছেন? গতবারের খালেদার টার্মে আমার বড় ভাই মাদ্রাসায় গিয়া যেই মানের শিক্ষা নিতে পারসেন, ওই শিক্ষা নেবার সুযোগ এই সরকারের আমলে আমার নাই। আমার বড় ভাই অস্ত্রের ট্রেনিং নিসেন। আমিও ট্রেনিং নিয়া আফগানিস্তানে জেহাদে যাইতে চাই। কিন্তু এখন অস্ত্রের ট্রেইনিং বন্ধ। সত্যিকারের ইমানদার তৈরির কোনো রাস্তাই আর রাখে নাই এই মুরতাদ সরকার। মাদ্রাসায় এইসব শিক্ষা এখন নিতে গেলেই ধরপাকড় করে। আমার হুজুর ঘোষণা দিয়া দিছে, শেখ হাসিনা না মরলে এই দেশে ইসলাম ধ্বংস হইয়া যাবে। এইটা নিয়া আলেমদের একটা পরিকল্পনা আছে। আমরা মনে প্রাণে চাই সামনের ইলেকশনে খালেদা জিয়া আসুক।

সে ২০০০ সালের কথা। তখনও জঙ্গি বলে বাংলাদেশে কোনো কিছুর অস্তিত্ব আমি জানি না, দুয়েকটা কানাঘুষা ছাড়া। মাদ্রাসায় অস্ত্র ট্রেইনিং, শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা, এইসবই আমার কল্পনার বাইরে। আমার মনে হত ছেলেটা উন্মাদ। কল্পনা আর বাস্তবতার কোনো পার্থক্য সে করতে পারে না। টিক্কা পাড়াতেও হয়ত তার কোনো লিস্টওয়ালা হুজুরই নাই। কোটালি পাড়ায় বোমা হামলার পরিকল্পনা ফাঁস হবার পর আমার টনক নড়ে গেল। এরপর অনেকদিন ধরে মনে হয়েছিল কল্পনা আর বাস্তবতার ফারাকটা হয়ত আমারই বেশি ছিল।

আমি যখন আমার শেষ চেষ্টাস্বরূপ তাকে বিজ্ঞানের গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করতে লাগলাম, সে তার হলুদ রাতের ধূসর ঘোলা চোখে আমাকে জিগ্গেস করলো, আপনি কি আল্লাহ খোদায় বিশ্বাস করেন?

মাদ্রাসায় অস্ত্র ট্রেইনিং নিয়ে ইসলাম কায়েম করতে চায় সে। সেই অস্ত্রের ট্রেইনিং নেয়া যাচ্ছে না দেখে তার হুজুরগোষ্ঠীর জন্যে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জীবন একটি হুমকি এখন। সেই ছেলে আমার কাছে জানতে চায়, আমি আল্লা-খোদা মানি কিনা।

- আমি অনেক চিন্তা ভাবনা করে এই ব্যাপারে যে সিদ্ধান্তে উপনীতে হয়েছি, সেই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আমি সৎ থাকতে চাই। চিন্তা ভাবনা করে আমার মনে হয়েছে, ধর্মে বিশ্বাস যুক্তি-নির্ভর না। . . .

- আপনি মানেন কি মানেন না?

বাধ্য হয়ে খুব সংক্ষেপে আমি যে উত্তর করেছিলাম, আব্দুল আজিজ সেই উত্তরকে দীর্ঘক্ষণ ধরে শুনেছিল, বিস্ময় ভরে। সেদিন আমার আর আব্দুল আজিজ, দুজনের জন্যই দিনটা ছিলো বড় কঠিন।

আর যে কয়টা দিন ওকে পড়াতে গিয়েছিলাম, সে অত্যন্ত অপ্রকৃতস্থের মত আচরণ করেছিল। আমার সামনে জোরে জোরে আওয়াজ করে বই দিয়ে মশা মারত, যে মশা আমি দেখতে পেতাম না। চোখ বন্ধ করে এক হাত দিয়ে বার বার টুপিটা চেপে চেপে মাথায় বসাতো। পড়ার টেবিল থেকে উঠে ঘরের মধ্যে উদ্দেশ্যহীনভাবে পায়চারী করত।

শেষের একটা দিন বলল, আমারে একটা কাজ করতে হইসে। আপনার কথা আমার হুজুরের সাথে আলোচনা করসি। উনি নিশ্চিত কইরা বলসেন, আপনার মত মানুষরাই আমাদের প্রধান শত্রু । যথাসময়ে এইসব মানুষদের উপর ব্যবস্থা নেওয়া হইবে। এইটা নিয়া আমার চিন্তাটা এখন কমসে। তয় আপনেরে মনে হয় শেষ পর্যন্ত আমি খুন করুম না, কারণ আমার মনে হয় আপনের মধ্যে সঠিক পথে আসার গুণাগুণ এখনো অবশিষ্ট আছে। কিন্তু আমরা একদিন মাঠে নামমু। সেইদিন আপনারে বাঁচাইতে পারমু, এই গেরান্টি দিতে পারতাসি না।

আব্দুল আজিজের দৃষ্টিতে আমার এই সঠিক পথে আসার গুণাগুণ অবশিষ্ট থাকাটা ছিল আমার জন্যে একটা অপ্রাপ্তি। এমন অপ্রাপ্তি, যেখানে প্রাপ্তিটাকেও নিশ্চিন্তে কামনা করা যায় না।

শেষের দিন আব্দুল আজিজ আমাকে বলে, মারে জানায়া দিসি। আপনার কাসে আমি আর পড়ুম না। আমার হুজুর বলসে, আপনার কাসে পইড়া আমার মাথা নষ্ট হইয়া যাইতেসে।

এটাই অবধারিত ছিলো। তবে আমি তাকে অনুরোধ করেছিলাম এইচ এস সি পরীক্ষাটা দিতে। প্রয়োজনে এমন কারো কাছে যেতে, যাকে তার সহ্য হয়। আমার খুব কাছের একজন বন্ধু নিষ্ঠার সাথে তাবলীগ করে। যদিও সে বলেছিল - তাবলীগের সাথে তার মেলে না, তবু আমি আমার বন্ধুর ফোন নম্বর তাকে দিয়েছিলাম।

আব্দুল আজিজ আমার সেই তাবলীগ বন্ধুর কাছে গিয়েছিল। কিন্তু সে এইস এস সি পরীক্ষা দেয় নি। জানতে পারলাম যখন হঠাৎ করে একদিন সে আমার আগের বাসায় এসে হাজির।

আগের চেয়ে তার চেহারায় তখন অনেক বেশি আনন্দমাখা। কামরাঙ্গীর চরে একটা রেজিস্ট্রেশনহীন মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছে সে এবং বি এন পির টার্ম চলছে তখন। আব্দুল আজিজ যা চেয়েছিল, মনে হয় সেটা সে পেয়েছে। মানুষের মন অদ্ভূত। যা সে আকাঙ্ক্ষা করে, তা পেলে একটা শিশুর মত আনন্দে মেতে ওঠে। যদিও সেই আকাঙ্ক্ষাটা মোটেও শিশুসুলভ না।

আব্দুল আজিজ আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল কারণ সে চায় আমি একদিন তার সাথে কামরাঙ্গীর চরে যাই। তার ধারণা, আমার ওখানে যাওয়া প্রয়োজন। তাহলে আমার মধ্যে একটা পরিবর্তন আসতে পারে।

আব্দুল আজিজ যখন আসতো, আমার শুধু ইচ্ছা করত জিগ্গেস করতে, কোটালি পাড়ার বোমা হামলার পরিকল্পনাটা সে জানত কিনা। কিন্তু আমি কথা বাড়াতাম না। আমি চাইতাম আব্দুল আজিজ আর না আসুক। আমি আমার কল্পনার অবাস্তব বাংলাদেশে বাস করতে চাই। ভাবতে চাই এখানে এমন কেউ বাস করে না, যে মানুষের লিস্ট করে আর তাদেরকে নজরে রাখতে চায়, বিশেষ একটা দিনে শিকার করার জন্যে। আব্দুল আজিজের সাথে দেখা হলে আমি সেটা আর ভুলে থাকতে পারতাম না। আব্দুল আজিজের মায়ের সাথেও দেখা হত রাস্তাঘাটে। উনি বোরকা পরে রাস্তার মোড়ে যেভাবে দাঁড়িয়ে থাকতেন, আর আমাকে দেখলে যেভাবে পান খাওয়া দাঁতে হাসতেন, আমার মনে হত আমার সাথে দেখা করার জন্যেই, আমার নতুন বাসার ঠিকানাটা নেওয়ার জন্যই দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি চাইতাম ওনার সাথেও আমার দেখা না হোক।

আমার অনেক বন্ধু বলেছে, আমি আমার চাচাতো ভাই, যিনি সে সময়ে পুলিশের কমিশনার ছিলেন এবং বি এন পি আমলে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অপারেশনের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাকে কেনো জানিয়ে দেই নি। অনেকে বলেছে, একজন শিক্ষক হিসেবে আমি কেনো তাকে সুপথে আনার সকল চেষ্টা করি নি। আমি উদাস বোধ করেছি। স্বার্থপর একক সত্তা হিসেবে নিজের জীবন যাপন করে যেতে চেয়েছি, যতদিন পর্যন্ত নির্বিঘ্নে বেঁচে থাকা যায়। তাই বাসা যেদিন বদল হলো, আমি সবচেয়ে বেশি চেয়েছি, আব্দুল আজিজ যেন আমার ঠিকানাটা আর না পায়।

কিন্তু আব্দুল আজিজের জেহাদ চলতে থাকে। তার কল্পনার ইউটোপিয়া বাস্তবায়নের লক্ষ্যে, তার কওমের স্বার্থ রক্ষার্থে ঠিকই সে আমাকে খুঁজে খুঁজে চলে আসে। আসে কামরাঙ্গীর চরে যাবার দাওয়াত নিয়ে। সে যথারীতি আমার বসার ঘরে ঢুকবে না। সিঁড়ি ঘরে দাঁড়িয়ে একটা জীবন্ত অবিশ্বাসী প্রাণীর বেঁচে থাকাটা তার বিস্ময়ের কাছে আমানত রেখে প্রত্যক্ষ করে যাবে।


২০০৫ সালের স্মৃতিচারণ।


মন্তব্য

তাসনীম এর ছবি

ভয়ংকর।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

তেমনটাই লাগত সে সময়!

স্পর্শ এর ছবি

এইরকম চিজ দেশে কম নাই। আমি নিজেও দুয়েকজনকে চিনি।

লিখেছেন খুব সুন্দর। সরকারের উচিত, 'আবদুল আজিজদের' একটা লিস্ট বানানো। তারপর নজরে রাখা। নাইলে পরে মুশকিল হতে পারে।


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

অভিজ্ঞতা শেয়ার করুন!

তারাপ কোয়াস এর ছবি

ঘটনাতো দেখি ভয়াবহ।


love the life you live. live the life you love.

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

যাদের কখনো এমন অভিজ্ঞতা হয় নি, তাদের অনেকে তো দেখি আমাকে বলে, এটা কোনো ব্যাপারই না।

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

ঘটনা ভয়াবহ। তবে আপনার লেখার বাঁধুনী অসাধারণ! সাধারণ বিষয়ে একটা ব্লগ পড়েই মুগ্ধ হলাম। লেখা জারি রাখুন।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

ধন্যবাদ। অনেক উত্সাহিত বোধ করলাম!

সুরঞ্জনা এর ছবি

দুঃস্বপ্ন দেখলাম যেন।
............................................................................................
স্বপ্ন আমার জোনাকি
দীপ্ত প্রাণের মণিকা,
স্তব্ধ আঁধার নিশীথে
উড়িছে আলোর কণিকা।।

............................................................................................
এক পথে যারা চলিবে তাহারা
সকলেরে নিক্‌ চিনে।

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

দুঃস্বপ্নই।

দ্রোহী এর ছবি

মুগ্ধ হয়ে পড়লাম। আপনার লেখার বুনোট ও গাঁথুনি অসাধারণ।


কাকস্য পরিবেদনা

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

ধন্যবাদ।

স্বাধীন এর ছবি

বেশ সুন্দর ফুঁটিয়ে তুলেছো। তোমার গল্প লেখার হাত কিন্তু বেশ ভালো। চর্চাটা চালিয়ে যেও। প্রবন্ধগুলোকেও এরকম সহজ ভাবে লেখার কথাটা মাথায় রেখো।

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

প্রবন্ধ যখন লেখি, পূর্বশর্ত হিসেবে সকল অনুভূতি ছেঁটে ফেলে দেই। পড়ে থাকে কেবল চিন্তার ক্যাকটাস।

অতিথি লেখক এর ছবি

বিষয় ভয়ঙ্কর, লেখাটা খাসা হয়েছে।আমি মুগ্ধ।

--------- দেবাশিস মুখার্জি ---------
[db.mukherjee.blog@gmail.com]

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

ধন্যবাদ।

সিরাত এর ছবি

এরকম সবার লাইফেই আছে ব্রাদার। হাসি আপনারটা একটু বেশি পারসিসটেন্ট কেস হয়তো।

আমার বিক্রমপুরে বিয়ের দাওয়াত খেতে গিয়ে একবার এক আন্টির কথা শুনে মাথা ঘুরে গেছিলো। টিভি তো পুরাই হারাম, রেডিও-ও যে কেন, সেটা শুনে আমি আমার মিনুফুপুকে বলি: "কি বলে মিনাম্মু ওরা?" ফুপুর উত্তর ভুলে গেছি যদিও। চোখ টিপি

যাহোক, বেশি ভয়ের কিছু নাই, সবই দৃষ্টিভঙ্গী। এটাও জীবন, এটারেও উপলব্ধি করতে পারা উচিৎ। হাসি আপনি পারসেন এবং তা নিয়ে লিখসেন, সাধুবাদ!

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

হাসি । বাইঁচা থাকলে ইনশাল্লাহ আরো অনেক উপলব্ধি হবে।

কনীনিকা এর ছবি

২০০০ সালে চট্টগ্রামের একটি নামকরা স্কুলে আমি দশম শ্রেণীতে পড়তাম। নিজের কিছু সহপাঠীদের দেখে তখনই আমার অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে। ক্লাসের ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ছেলেমেয়েদেরকে তো বটেই, উদারচেতা মুসলমান সহপাঠীদেরকেও নানানভাবে ওরা হেনস্থা করত। ওদের দু'একজনের সাথে তখন আমি কথা বলে দেখেছিলাম, তখনই তারা একটি জঙ্গী সংগঠনের সাথে জড়িত। তাদের স্বপ্ন ছিল তারা যে করেই হোক দেশে ইসলামী আইন কায়েম করবে। পরে যখন ওরা বুঝতে পারে আমি ওদের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করি, তখন তারা আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু ঠিক আপনারই মতন আমারও খোঁজ নেয়া বন্ধ করেনি। ওদেরকে দেখে সবসময়ই আশঙ্কা করতাম ভবিষ্যতে খারাপ সময় আসবে। ওদের কথা মাঝে মাঝে আমার বাবা মাকে বলতাম। তাঁরা বিশ্বাস করতে পারতেন না। একটি আধুনিক স্কুল, যেখানে সবসময়েই বাঙালি সংস্কৃতি এবং মুক্তচিন্তার চর্চা হচ্ছে, সেখান থেকে কি করে এরকম জঙ্গী সাম্প্রদায়িক মানসিকতার শিক্ষার্থী তৈরি হতে পারে, তাঁরা তা বুঝতে পারতেন না। তাঁরা বলতেন আমি কম বয়সে বেশি বেশি বুঝে ফেলছি। কি আর বলব! আর আমার সেই সহপাঠীরা এখন শিবিরকর্মী, একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, আরেকজন চট্টগ্রাম মেডিকেলে।

সরকার কোনদিনই এই সব আব্দুল আজিজদের লিস্ট তৈরি করবে না। এটাই হচ্ছে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কথা।
------------------------------------------------------------------
It is impossible to be a mathematician without being a poet in soul.

------------------------------------------------------------------
It is impossible to be a mathematician without being a poet in soul.

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

ব্যাপারগুলো কিন্তু এমনই। যখন ঘটে, কেউ পাত্তা দেয় না। ফলাফল দেখার আগ পর্যন্ত মানুষের টনক নড়ে না। আপনার ঘটনাটার উপর একটা লেখা দেবার দাবী থাকলো। আপনার ঘটনাটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখাটা অসাধারণ হয়েছে। কোনো ট্যাগ না থাকলে একে অনায়াসেই গল্প বলা যায়। অবশ্য এটা গল্প নয়, বাস্তবতা।

অনন্ত

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

ধন্যবাদ।

পৃথিবী [অতিথি] এর ছবি

পোষ্টের ট্যাগ না দেখলে আমি বিশ্বাসই করতাম না এটা সত্য ঘটনা। এসব ঘটনা কোথাও শেয়ার করলে শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই একসাথে "ইসলামবিদ্বেষ" এর বুলি আওড়ানো শুরু করে। যে জাতি নিজেকে শোধরাতে চায় না, সেই জাতিকে কেউই সাহায্য করতে পারবে না।

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

এসব ঘটনা কোথাও শেয়ার করলে শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই একসাথে "ইসলামবিদ্বেষ" এর বুলি আওড়ানো শুরু করে।

একদম ঠিক বলেছেন। এমন যে ঘটতে পারে ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু আপনার উপলব্ধির সত্যতা পেয়েছি। যারা এসব বলে, তাদের মন মানসিকতাও এরকম - "আপনি কোন পক্ষে নিশ্চিত করুন। আপনি হয় আমাদের পক্ষে, না হলে বিপক্ষে।" সবাই রাজনীতির কথা বলে, দুর্নীতির কথা বলে, বিপ্লবের কথা বলে, ভিন্ন মতকে নিশ্চিহ্ন করতে চায়, এদের কেউ কিন্তু একজন নির্বিবাদী মানুষকে নির্বিঘ্নে বেঁচে থাকতে দিতে চায় না।

রানা মেহের এর ছবি

গল্প অনেক ভালো লাগলো। ভয় ভয় লাগলো।
শুধু একটা ব্যাপার। মাত্র নদিন পড়িয়ে এতোটা ডিটেইল তথ্য পাওয়া
একটু অদ্ভুত মনে হয় ।
------------------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

দীর্ঘ নয়টা দিন ছিল আপু। ভিন্নমতের প্রতি অশ্রদ্ধার কারণে ওই কয়টা দিনে আব্দুল আজিজের মূল আগ্রহ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল আমাকে হুমকি-ধামকি, ভয়-ভীতি সহকারে সবক দেয়া। যেটার জের ওই নয়দিনের বাইরে গড়িয়েছে।

দুষ্ট বালিকা এর ছবি

ঘুম ভাঙ্গেনা কেন! মন খারাপ

-----------------------------------------------------------------------------------
...সময়ের ধাওয়া করা ফেরারীর হাত থিকা যেহেতু রক্ষা পামুনা, তাইলে চলো ধাওয়া কইরা উল্টা তারেই দৌড়ের উপরে রাখি...

**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।

মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

কেন?

অতিথি লেখক এর ছবি

ব্যপারটা আসলেই চিন্তার। কিন্তু লিস্টের বদলে লিস্ট তো সংঘাতের পদোদ্ধনি। না করেই বা উপায় কি?

আপনার লেখনী খুবই শক্তিশালী।

অমিত্রাক্ষর
অমিত্রাক্ষর@জিমেইল ডট কম

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

করণীয় নিয়ে চিন্তা করা দরকার।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

লেখা মারাত্মক ফাইনৈছে।

----------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

সাঈদ আহমেদ এর ছবি

আপনার লেখার ধরন মুগ্ধ করলো। সেই সাথে আরেকটা কথা মনে করিয়ে দিল-- যুদ্ধাপরাধীদের মোকাবেলার চেয়েও অন্ধবিশ্বাসীদের মোকাবেলা কঠিন হবে!
-----------
চর্যাপদ

-----------
চর্যাপদ

অতিথী এর ছবি

বেশি 'আরবাইজড' একদিকে আমরা এইরকম জঙ্গীবাদের আশংকায় আছি।
আবার সেদিকে না গিয়ে উলটো দিকে হেঁটে নষ্ট সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মধ্যে আছি।

আসলে আমাদের চাওয়াটা কি হওয়া উচিত?

সচল জাহিদ এর ছবি

অনেক পরে হলেও পড়লাম। ভয়াবহ ব্যাপার। আমার একটি অভিজ্ঞতা শেয়ার করলামঃ সবুজের হলদে রোগ

----------------------------------------------------------------------------
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
সচল জাহিদ ব্লগস্পট


এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।

সবজান্তা এর ছবি

সুরঞ্জনার মন্তব্যটাই করতে চাই- দুঃস্বপ্ন দেখলাম যেন !

অপছন্দনীয় এর ছবি

এদের মাথায় যে কী থাকে!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।