সংস্কৃতিমনার আধিপত্য ভাবনা

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি
লিখেছেন ধ্রুব বর্ণন (তারিখ: শনি, ০৩/০৩/২০১২ - ৩:১২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সেদিন সংস্কৃতিকর্মী ও দেশে বিদেশের প্রধান সম্পাদক নজরুল মিন্টোর ‘ভাষার বিকৃতিরোধ আবশ্যক’ পড়ার চেষ্টা করছিলাম বিডিনিউজ২৪ এর মতামত বিশ্লেষণে। এটা ভালো লেগেছে যে বিডিনিউজ২৪ সবদিকের মতামত প্রকাশের চেষ্টা করছে। নজরুল মিন্টোকে তার মতামত প্রকাশের জন্যে ধন্যবাদ জানাই। ওনার মাধ্যমে অনেক ভাবনা সম্পর্কে আমরা অবগত হই। ওনার লেখাটি একটি বদ্ধ ঘরের খোলা জানালা হয়ে ঘরের ভেতরটা আমাদের দেখতে সাহায্য করেছে। আমি বেশ কয়েকবার পড়ার চেষ্টা করেছি। এখনো করছি। ওনার লেখার একটি পূর্ণাঙ্গ সমালোচনা কখনোই সম্ভব হয়ে উঠবে বলে মনে করি না। আমি সমালোচনার চেষ্টাতেও যাবো না। বরং ওনার লেখাটার একটা-দুটো বিষয়ের পুনর্পাঠ করি।

একজন সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে শুরুতেই তিনি সংসদ সদস্যদের অপ্রমিত ভাষায় বক্তৃতা প্রদানকে কটাক্ষ করার চেষ্টা করেছেন। এতে বোঝা যায়, কিছু কিছু জনপ্রতিনিধি ওনাকে প্রতিনিধিত্ব করেন না বলে হয়তো উনি ক্ষুদ্ধ। তা জনপ্রতিনিধি প্রতিনিধিত্ব আসলে করেন ওনার নির্বাচন অঞ্চলের মানুষদেরই। তাদের ভাষা বক্তৃতায় ব্যবহার করার ব্যাপারে ওনার এই আপত্তি সেক্ষেত্রে জনমানুষের মুখের ভাষার ব্যাপারেই আপত্তি। মানুষের মতপ্রকাশসহ অন্যান্য রাজনৈতিক মাধ্যমকে গণমানুষের কাছ থেকে সংস্কৃতিমনা উচ্চভাষাশ্রেণীর কাছে সংরক্ষিত করে নেওয়ার একটা চেষ্টা যেনো এই ভাবনায় প্রতিধ্বনিত হয়। এই ভাবনা থেকে উচ্চারিত হয় যে চাষাভূষা প্রতিনিধি হোক আপত্তি নেই, কিন্তু মুখ খুললে তাকে শুদ্ধভাষায় কথা বলতে হবে। শাসকশ্রেণীর অংশ হলে শাসকশ্রেণীর ভাষা বলে উঠতে পারতে হবে। চাষাভূষা দিয়ে শাসকশ্রেণীর দূষণ চলবে না।

এরপর তিনি প্রায় যেনো অপ্রাসঙ্গিকভাবেই ভিন্ন ভিন্ন বাংলা কিবোর্ড থাকা নিয়ে কটাক্ষ করলেন। নানারকম কিবোর্ড থাকার সমস্যাটা যদিও তিনি ব্যাখ্যা করেন নি, তবে এর ‘কুফল’ আমরা ভোগ করছি জানালেন। ব্যাপারটাকে বলেছি ‘প্রায় যেনো অপ্রাসঙ্গিক’। তবে যদি ওনার আপত্তিটার বিশ্লেষণে যান, হয়তো দেখতে পােবন, এখানে বাংলা কিবোর্ডের বিষয় উত্থাপন আসলে একেবারেই প্রাসঙ্গিক। এই আপত্তি প্রকৃতপক্ষে অপ্রমিততা নিয়ে, বহুত্ব নিয়ে। এই হা-হুতাশ হলো নানা রকমের বিপক্ষে। নানারকম কিবোর্ডে ঠিক আপত্তি কোথায় আর কী কুফল বিস্তারিত বলা না হলেও আঁচ করতে পারি, এতে যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, বেছে নেয়ার যে বাড়তি ভাবনা তৈরি হয়, তাতে অনেকের ভেতরে অস্বস্তি তৈরি হতে পারে। কেউ অবশ্য কোনো কিবোর্ড চাপিয়ে দেন নি আমাদের উপরে, বরং পসরা খুলে বসেছেন, আমাদের সুযোগ আছে এটা অথবা ওটা বেছে নেওয়ার। কিন্তু উনি বলছেন, ‘একেকজন একেক ধরনের বাংলা কী-বোর্ড তৈরি করে আমাদের হাতে ধরিয়ে দিলেন।’ ওনার এই চাপিয়ে দেওয়ার ভাবনাটা কল্পিত। প্রকৃত অস্বস্তি বহুত্ব নিয়ে, বিভিন্নতায়। এখানেও তিনি প্রমিত কিছু আশা করছেন। তবেে শুধু প্রমিতকরণ করেই এই ভাবনা থামবে বলে মনে হয় না। কারণ প্রমিতের পাশাপাশি অন্যান্যগুলোও যে ব্যবহার হতে থাকবে এটা অবশ্যম্ভাবী। এখন কেউ ইউনিবিজয় ব্যবহার করেন, অনেকে অভ্র ফনেটিক ব্যবহার করেন। যেটাকেই প্রমিত করা হোক, আমি এখন ম্যাকে রূপালি কিবোর্ড ব্যবহার করি, সেটাই হয়তো করে যাবো। অভ্রতে এমনকি সুবিধাই দেয়া আছে নিজের ইচ্ছামতো কিবোর্ড বানিয়ে নেওয়ার। ফলে প্রমিতকরণ হলেও এই ভাবনার চক্ষশূল বহুত্ব (ও তার ‘কুফল’) দূর হবে না। এই ভাবনা তখন অপ্রমিতগুলোর অনুপস্থিতিও চাইবে। এখানে মূল ভাবনাটা প্রমিতকরণের পক্ষে, কেবল প্রমিতের প্রচলনের পক্ষ এবং অন্যান্যগুলো অপসারণের বিপক্ষে, এটাই আমরা বুঝে উঠতে পারি।

এভাবে প্রমিতকরণ, প্রমিতের ভাবনা, একমাত্র ‘সঠিকটা’ প্রচলনের ভাবনার সপক্ষ বারবার লেখায় উচ্চারিত হয়। যেমন বুদ্ধিজীবীদের কোনো কিছুতে একমত না হবার জন্যে হা-হুতাশ পরিলক্ষিত হয় লেখায়। বুদ্ধিবৃত্তি আর মতামতের একপ্রকার পূর্বশর্ত বলা চলে দ্বিমত হতে পারাকে। সব বুদ্ধিজীবীদের কোনো বিষয়ে একমত না হওয়াই বাঞ্ছনীয়। বুদ্ধিজীবীর মতের দ্বারা একাত্মতা তৈরি হচ্ছে না কি বিভাজন তৈরি হচ্ছে সেটা তার বিবেচ্য নয়। কিন্তু নজরুল মিন্টো বলেন, ‘সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত কেবল আমাদের রাজনীতিবিদরাই করছেন না, তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা আরও বেশি করে করছেন।’ অর্থাৎ পুনর্বার বিভিন্নতা ও বিভ্রান্তি সমার্থক হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে এই ভাবনায়। বুদ্ধিজীবীরা নানারকমের ভাবনা দিয়ে মানুষকে ভাবিত করছেন, এটা এই ভাবনার কাছে অস্বস্তিকর।

একইভাবে উনি বলেন, ‘উত্তর আমেরিকাতে অনেক কিছুই বৈধতা পেয়েছে। তাই এফএম ব্যান্ডে তাদের সঙ্গীত প্রচারিত হলো বলে জাতীয় মর্যাদা পেয়ে গেলো এমন মনে করার কিছু নেই।’ এখানে ‘তাদের সঙ্গীত’ বলতে র্যাপসঙ্গীতের কথা বোঝানো হয়েছে। তবে কী বিষয় নিয়ে বলা হচ্ছে, সেটা ব্যতিরেকেও বোঝা যায় যে উদ্ধৃতিতে বহুত্বের বিপরীত অবস্থানটাই নেয়া হচ্ছে। তাই তিনি ‘উত্তর আমেরিকাতে অনেক কিছুই বৈধতা পেয়েছে’ বলার মাধ্যমে উত্তর আমেরিকাকে কটাক্ষ করছেন বলে মনে হলেও আসলে তিনি কটাক্ষ করছেন ‘অনেক কিছু’কে, এবং ‘অনেক কিছুকে বৈধতা’ দেওয়ার চর্চাকে। অনেক কিছু বরাবরই এই ভাবনায় একটা সমস্যা। এবং এর উত্তরণ হলো প্রমিতকরণে। তাই তিনি বলেন, ‘জাতীয় মর্যাদা পেয়ে গেলো এমন মনে করার কিছু নেই’। অর্থাৎ কিছু কিছু জিনিস জাতীয় মর্যাদাপ্রাপ্ত। জাতীয় মর্যাদা কী বস্তু তা নিয়ে যদি ভাবিত হন, তাহলে জানুন, এই জাতীয় মর্যাদা লাভ হলো সেই প্রতিমকরণেরই আরেকটি ব্যবহারিক সমার্থক। মূল কথা হলো একটা স্ট্যান্ডার্ড থাকতে হবে। একটা শ্রেয় প্রকার থাকবে। সেটা জাতীয়ভাবে প্রচারযোগ্য। এবং সম্ভবত কেবল সেটাই জাতীয়ভাবে প্রচারযোগ্য। যেহেতু উত্তর আমেরিকার মতো করে অনেক কিছু বা বহুত্বকে আমাদের বৈধতা দেওয়ার প্রয়োজন নেই, ফলে দাঁড়াচ্ছে যে গণমাধ্যমে সেই বিশেষ জাতীয়-মর্যাদাপ্রাপ্ত প্রমিতরা বাদে বাকিদের প্রচার করতে দেওয়ারও প্রয়োজন নেই।

এটাতো গেলো ওনার উদ্ধৃত ওই বক্তব্যের বিষয়টার বিশদে না গিয়েই ওনার বক্তব্য উৎসারিত বহুত্ব বনাম প্রমিতের পাঠ গ্রহণ। এবার যদি বিষয়ের বিস্তারিতে যান, সেখানেও পাওয়ার মতো থাকবে অনেক কিছু। খোলা জানালা বদ্ধ ঘরের সব রত্নই যে আমাদের সামনে আজ হাজির করেছে। র্যাপ সঙ্গীতের বিষয়টি আসলে এখানে এসেছে এটা বোঝানোর জন্যে যে পশ্চিমে অপ্রমিত র্যাপ সঙ্গীত প্রচার হয় মানেই এই নয় যে আমাদের এখানে অপ্রমিত ডিজ্যুস বাংলায় এফএম রেডিওতে উপস্থাপনা করা যাবে। র্যাপ সঙ্গীত সম্পর্কে সংস্কৃতিকর্মী নজরুল মিন্টোর সংস্কারমূলক ভাবনাটা জানা যায় উনি যখন বলেন, ‘এসব সংগীতে থাকে অপরাধজগতের খবরাখবর, গালাগালি, যৌনতা, ইত্যাদি। র্যাপ সঙ্গীতকে রাস্তার সংগীত বলে আখ্যায়িত করা হয়।’ তিনি উত্তর আমেরিকার কী কী ধরনের ‘অনেককিছু’কে আমাদের দেশে বৈধতা দিতে রাজি নন, এখানে পরোক্ষে সেটারই একটা আকৃতি পাওয়া যায়। অনেকটা এমন যে উনি আমাদের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছেন - আপনি কি চান যে এখন বাংলাদেশেও এফএম রেডিওতে রাস্তার ছেলেরা অপরাধজগতের খবরাখবর, গালাগালি, যৌনতা প্রচার করুক?

যারা জাতীয় মাধ্যমে ভাষা প্রমিতকরণের ঝাণ্ডাবাহী, তাদের অনেককেই আঞ্চলিকভাষার কথা জিজ্ঞেস করলে শোনা যায়, প্রতিটি আঞ্চলিকভাষাকে তার নিজ নিজ অবস্থানের স্বীকৃতি দেওয়া হবে। শুনতে ভালো এই কথাটি কিন্তু বড়ই শোষণমূলক। ঢাকার ‘প্রমিত’ এলিট সংস্কৃতিশ্রেণীর পক্ষ থেকে উপশহর ও গ্রামাঞ্চলের দরিদ্রশ্রেণীর মানুষকে ‘স্বীকৃতি প্রদানের’ বয়ান এটা। অধিকার যেনো প্রমিতরা সংরক্ষণ করেন যে তারা অন্যান্যদের আলাদা করে একটা স্বীকৃতি দেবেন। এই ভাবনায় প্রায়শই টেলিভিশনের আলাদা একটা সময় বরাদ্দ থাকে আঞ্চলিকভাষার অনুষ্ঠানের জন্য। ঘোষণা দিয়ে সেসময় আঞ্চলিকভাষার অনুষ্ঠান প্রচারিত হবে। যাতে সংস্কৃতিমনারা নিশ্চিন্তে, বিনা অস্বস্তিতে সেটা এড়িয়ে যেতে পারেন। না বলে ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ হঠাৎ আঞ্চলিক ভাষায় অনুষ্ঠান শুরু হলে তো আবার সেই বহুত্বের বিভ্রান্তি। তা কোনো পুরো চ্যানেল বা স্টেশন জুড়েই যদি আঞ্চলিক ভাষা থাকে, সে ব্যাপারে ওনাদের কী মত? নজরুল মিন্টো বলেন, ‘আজ যদি রংপুরে একটি রেডিও স্থাপন হয় আর সে রেডিওতে রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচার করা হয় কারো কিছু বলার নেই। শ্রোতারা জানে এটা রংপুরের আঞ্চলিক রেডিও ষ্টেশন। কিন্তু জাতীয় প্রচার মাধ্যমে কিছু প্রচার করতে গেলে প্রমিত ভাষাতেই প্রচার করা যুক্তিযুক্ত এবং বিশ্বের সব দেশই এটা মেনে চলে।’ অর্থাৎ রংপুরভাষী চ্যানেল বা স্টেশন জাতীয় প্রচার মাধ্যম হিসেবে সারা দেশে প্রচারের জন্য আসতে পারবে না। তা সারাদেশজুড়ে কি রংপুরবাসীরা নেই? নাকি থাকতে নেই? নাকি অন্যত্র থাকলে রংপুরের ভাষার স্টেশন শোনার তাদের অধিকার নেই? তেমন স্টেশনে ঠিক কার অসুবিধা হয়? প্রমিত কানের। তা এড়িয়ে গেলে কী হয়? সেখানে চলে আসে সংস্কৃতিমনার আধিপত্যবাদী ভাবনা। পুরো দৃশ্যমান দুনিয়াটা তাদের অনুকূল হতে হবে। আমার যেটা ভালো লাগে না, সেটা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকার পরেও সেটাকে বন্ধ করে দেওয়ার প্রয়োজনটা কোথা থেকে আসে, সেই যুক্তিটার জন্যে আমাদের অপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু সে যুক্তিটা আর আসে না।

সংস্কৃতিমনাদের ভাবনায় অন্যের ব্যবহার্য ভাষাটাও সংস্কৃতির ঝাণ্ডাবাহীদের দ্বারা সংরক্ষিত। সেই সংরক্ষণমূলক, সামন্তবাদী অধিকারমূলক ভাবনাটা উচ্চারিত হয় যখন নজরুল মিন্টো বলেন, ‘যে কথা বলা হচ্ছে তা হলো ভাষাকে যেভাবে দূষিত করা হচ্ছে তা আর বাড়তে দেয়া যায় না’। তো ভাষা নিজে কোনো অদ্ভুত জানোয়ার নয়, কোনো ইউক্যালিপ্টাসও নয় যে সেটার কোনো রকমকে আলাদা করে বাড়তে না দেওয়ার চিন্তা আমরা করবো। ভাষা বাড়ে বা কমে মানুষের মুখে, মানুষের ব্যবহারে। ফলে ভাষার কোনো রকমকে বাড়তে না দেওয়ার অর্থ হলো মানুষের মুখকে, মানুষের ভাষা-ব্যবহারকে সংরক্ষিত করা। যেনো কেউ কেউ মানুষের ভাষা-ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার সংরক্ষণ করে। বড় অদ্ভুত এই ভাবনা। ভাষার উপর রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের কুফল ভেবেছিলাম ভাষা আন্দোলনের সময় থেকেই আমরা জানি। কিন্তু এলিট উচ্চ শাসকশ্রেণীর ভাষা-খবরদারির খাসলত যেনো দূর হতেই চায় না।

সংস্কৃতি মনে অনেক সময় সুরুচি সুস্বাস্থ্যের সমতুল্য। ফলে, নজরুল মিন্টো যখন বলেন ‘সারা পৃথিবীর হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলো থাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন’, তখন অনেকে যদি ভাবেন যে তিনি আমাদের দেশে অস্বাস্থ্যসম্মত নোংরা হাসপাতালগুলোর কথা এখানে তুলনা করবেন, তাহলে জানুন, উনি আসলে সুরুচি বনাম অরুচির তুলনা করছেন। কারণ ঠিক পরের বাক্যেই তিনি বলছেন, ‘আমাদের দেশে হাসপাতাল-ক্লিনিকের বাইরে ডাক্তারদের ডিগ্রী সম্বলিত সাইনবোর্ডের জঙ্গল দেখে আমাদের রুচিবোধের দীনতার কোন স্তরে আমরা আছি তার প্রমাণ পাওয়া যায়।’ অর্থাৎ সারা পৃথিবীর হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলো যেনো রুচিকর সাইনবোর্ড বহনের মাধ্যমেই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। তবে রুচি স্বাস্থ্যের মতোই জানতাম ব্যক্তিগত ব্যাপার। কেউ যেমন সুস্বাস্থ্য রক্ষায় বাধ্য নয়, তেমনি সুরুচি একটা চমৎকার ব্যাপার হতে পারে, কিন্তু সুরুচির পরিচয় দেয়া বাধ্যতামূলক নয়। কিন্তু প্রসারণবাদী সংস্কৃতি মনে সুরুচিও প্রমিতকরণের আওতায় একটা বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে ধরা দেয়। তাই তিনি বলেন, ‘এগুলো দেখার জন্য কি কেউ নেই? কোন প্রতিষ্ঠান নেই?’ আরেকটা কমিটি গঠনের দিকনির্দেশনার আঁচ পাই।

ওনার একটা হিতোপদেশ দিয়ে শেষ করি, ‘আমি মনে করি, শব্দ যদি রুচিশীল বা মার্জিত না হয় তাহলে তাকে যেভাবে আছে ঐভাবেই রেখে দেয়া উচিত। তাতে ঐ শব্দের ওজনটা থাকে।’ এভাবে রুচিশীল সংস্কৃতিমনারা দিকে দিকে সংস্কৃতি আর উৎকর্ষ ছড়িয়ে এগিয়ে যেতে থাকেন সমগ্র বাংলাদেশকে জয় করার লক্ষ্যে, একটা প্রমিত কাঠামোর মধ্যে সবাইকে এক কাতারে দাঁড় করানোর লক্ষ্যে। আঞ্চলিক, চাষা-ভূষাদেরকেও ওনারা স্বীকৃত দেন চিড়িয়াখানার মতো আলাদা খাঁচা করে দিয়ে। কারণ হীন যদি না থাকে, কাকে দেখে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব উপলব্ধি করবেন? কিন্তু ‘অরুচিশীল’, ‘অসংস্কৃত’, বিপ্লবী অপ্রমিত ও ‘ভুল’রা তাদের এই শ্রেণীশাসনের বাইরে থেকে যায়। তারা এই উঁচুনিচু ভেদকে থোড়াই কেয়ার করে। তাই ভাষাউচ্চশ্রেণীদের এই নিয়ে খচ্খচ্ করতে থাকে। কীভাবে তাদেরকে ভাষা শাসনের মধ্যে আনা যায়! আশার বিষয়, এই শ্রেণীহীনদের মারার জন্যে সরকারের ডাণ্ডাটা তাদের দোস্তদের পকেটেই আছে!


মন্তব্য

তাপস শর্মা এর ছবি

চলুক চলুক চলুক

৫২ এর পর কতটা ২১ ফেব্রুয়ারি গড়িয়ে গেছে। তাজা প্রাণ এখনো মরমে মরমে কাঁদে। রগড়াতে রগড়াতে বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি মিশিয়ে ‘মোদের গরব মোদের আশা’ এখন ‘ঘেটে ঘ’। তাতে কি হল? এই প্রজন্ম দিব্বি খুশি এই নিয়ে। এটাতেই নাকি ‘মনের ভাব’ ভালো ভাবে প্রকাশ পায়? বিন্দাস! ভাষা এখন ‘মাল’। হায় জেন ‘Y’ এর কল্যুকাল ল্যাঙ্গোয়েজ!

দ্রোহী এর ছবি

আপনার সমালোচনা পড়ে বুঝলাম নজরুল মিন্টো সাহেব তার নিজের কুয়াটাকেই পৃথিবী ভেবে বসে আছেন। কম্পিউটার প্রযুক্তি সম্পর্কে যে তাঁর যে কোন প্রকার স্পষ্ট বা অস্পষ্ট ধারনা নাই সেটা কিবোর্ড লেআউট বিষয়ক অংশটুকু থেকেই বোঝা গেছে। আমেরিকা বিষয়ক অংশটুকু পড়ে মনে হলো ওনার ধারণা উত্তর আমেরিকায় রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলেই ধরে পুটু মেরে দেয়। ভাষা নিয়ে কিছু বলার সাহস নেই। প্রমিত উচ্চারণে কথা বলতে পারি না, আঞ্চলিকতার টান এসে পড়ে। আজেবাজে কথা বলে শেষে যদি স্বীকৃতি না পাই?

ইদানীং বিডিনিউজ হিতোপদেশ দেয়ার কাজ বেশ ভালভাবেই করছে। বিডিনিউজের মান্যগন্য লেখকেরা কেউ কেউ বাংলা শেখার জন্য বার্ট্রান্ড রাসেল পড়তে বলেন, কেউ আঞ্চলিক ভাষাকে স্বীকৃতি দেয়ার নিশ্চয়তা দেন।

আজব এক দেশ বাংলাদেশ! যে যে বিষয়ে যত কম জানে সে সেই বিষয়ে ততোবড় বিশেষজ্ঞ। ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রণেতা জাতীয় দৈনিকে লিখে দাবি করে অভ্র সফটঅয়্যার দিয়ে হ্যাক করা যায়। যে দেশের হাল এমন সে দেশের মিডিয়া যে মুরুক্ষুদের দখলে চলে যাবে এ আর এমন কী! সাধে কি আমরা দুনিয়ার দরিদ্রতম দেশগুলোর একটা হই?

হিমু এর ছবি

অধিকার আর উপযোগিতাকে আমরা মাঝেমধ্যে গুলিয়ে ফেলি। একজন বিচারকের অধিকার আছে চাটগাঁইয়া ভাষায় বিচারের রায় ঘোষণা করার, কিন্তু সেটা কি উপযোগী হবে? সংসদে নোয়াখালির ভাষায় নোয়াখালির সাংসদ বক্তৃতা দেয়ার অধিকার সংরক্ষণ করেন, কিন্তু সেটা কি বোধগম্য হবে? প্রমিত ভাষার উদ্দেশ্য অধিকারের চেয়ে উপযোগিতার জায়গায় বেশি ঘুরপাক খায়।

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

প্রমিত ভাষার উদ্দেশ্য অধিকারের চেয়ে উপযোগিতার জায়গায় বেশি ঘুরপাক খায়।

একমত, এবং সেখানেই তার পদচারণা সীমাবদ্ধ থাকা দরকার। বা প্রশ্ন করা যায়, উপযোগী হওয়া কতোটা বাধ্যতামূলক। নাকি সেটা স্বাভাবিকভাবেই অনুপযোগীর অনুপযোগিতার দ্বারা বিয়োগের মাধ্যমে সমাধিত হয়ে যাবে।

অন্যদিকে প্রমিত ভাষাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে এলিট শ্রেণীর পক্ষে সংরক্ষণ ও আধিপত্যের বিস্তারও ঘটে।

হিমু এর ছবি

উপযোগী হওয়া কিছু ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক তো বটেই। তবে অনেক ক্ষেত্রেই বাধ্যতামূলক নয়। যেমন পাঁচবার (নাকি সাতবার?) জব্বারের বলী মর্ম সিং ত্রিপুরা ডিউটির সময় আমাকে রাস্তায় পেয়ে ত্রিপুরা ভাষায় জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলে আমি বিপদে পড়ে যাবো। অথচ মর্ম সিং ত্রিপুরার মাতৃভাষা চর্চার অধিকারকে আমি পূর্ণমাত্রায় সমর্থন করি। এক্ষেত্রে একটা লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কার ব্যবহার বাধ্যতামূলক। আমরা বাংলা ভাষাকে সংবিধানে সেই সর্বজনবোধ্য সাধারণ্যে ব্যবহার্য লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছি। এই বাংলা ভাষা প্রমিত বাংলা ভাষা।

প্রমিত ভাষাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে যে "এলিট শ্রেণী", তাদের মূল মতলবের জায়গাটা বুঝতে হবে। এখানে প্রতিপক্ষ প্রমিত ভাষা নয়, বরং এলিট শ্রেণীটাই। প্রমিত ভাষাকে আক্রমণ করে সেই এলিট শ্রেণীর এলিটপনা দমন করা যাবে না। কারণ প্রমিত ভাষা তাদের আশ্রয় নয়। তারা চাইলে কাল থেকে অপ্রমিত ভাষাতেই তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা শুরু করতে পারে। বাংলা সাহিত্যের ক্রাইমমাস্টার গোগো ব্যর্থ ঢ়ৈষূ তো ভাড়া খাটতে বসেই আছে।

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

প্রমিতকে ভেঙে এলিটের প্রতিপক্ষতা করার উপযোগ নিয়ে আমারও সন্দেহ আছে। পরিকল্পিতভাবে প্রমিত ভাঙার বিপ্লবের মধ্যে নব্য এলিটশ্রেণী গঠনের ইচ্ছাকেও বিদ্যমান কল্পনা করা সম্ভব। তবে এসবের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ আবার প্রশ্নাসীন। আর প্রমিতকে প্রয়োজন ব্যতিরেকে বাধ্যতামূলক করার প্রচেষ্টার মধ্যে যখন আধিপত্যমূলক দূরঅভিসন্ধিৎসা বিরাজ করে, তখন তার প্রতিরোধ মাত্রই কিন্তু প্রমিতের বিরোধিতা নয়। বরং এটা জোরাজুরির ভাবনাটার বিরোধিতা।

স্পর্শ এর ছবি

চলুক


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

কাজি মামুন এর ছবি

ধ্রুব ভাই,
নজরুল মিন্টোর লেখাটি পড়লাম। উনার লেখাটিতে অনেক অসংগতি রয়েছে। আপনি সুন্দর জবাব দিয়েছেন। আপনি আলোচনায় আনেননি, এমন আরও কয়েকটি বিষয় আমি কোট করছি উনার লেখা থেকে, যা আমার মতে আলোচনার দাবী রাখেঃ

মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল হচ্ছে আদালত। আদালতের নির্দেশই চুড়ান্ত নির্দেশ। বাংলা ভাষা দূষণ রোধে আদালত দায়িত্ব নিয়েছে এর চাইতে সু-সংবাদ আর কী হতে পারে? আর আদলত যাদেরকে এ কাজের জন্য যোগ্য মনে করেছে তাদেরকেই সে দায়িত্ব দিয়েছে।

সভ্য সমাজে বসবাস বলে আমাদের আদালতের রায় মেনে নিতে হয়। কিন্তু আদালত মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল হিসাবে নিজেকে প্রমান করতে পেরেছে সবসময়? আদালতের নির্দেশ মনঃপুত হলে 'চুড়ান্ত নির্দেশ' আখ্যা দিয়ে আমরা বিরুদ্ধবাদীদের দমন করতে নেমে পড়ি; আর মনঃপুত না হলে আমরাই কি সমালোচনায় বিদ্ধ করে তুলি না?

প্রতি বছর ইংরেজী অভিধানে নতুন নতুন শব্দ সংযোজিত হচ্ছে।

এ ব্যাপারে উনার আপত্তি নেই। অথচ তার আগেই উনি বলেছেনঃ

লাইব্রেরীর অর্থ কী নিশ্চয় বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজ মাত্রই জানেন। ‘রেষ্টুরেন্ট’ লিখা সঠিক, না ‘হোটেল’ লেখা সঠিক এর জন্য কি আদালতের দ্বারস্থ হতে হবে?

এখন 'লাইব্রেরী' শব্দটা বাংলা ভাষায় সংযোজিত হলে উনি আপত্তি করবেন কেন, তা বোধগম্য নয়।

মফস্বলের কথা বাদই দিলাম, রাজধানী ঢাকা শহরের অধিকাংশ সাইনবোর্ড ভুল বানানে ভরা।

এটা কি বাংলা ভাষার প্রতি অবজ্ঞা থেকে ঘটে না শিক্ষার অভাব থেকে? একে কি ভাষার দূষন বলব না শিক্ষার দূষন বলব?

সারা বিশ্বে প্রত্যেকটি জাতি তার ভাষাকে আরও মার্জিত, আরও রুচিশীল করে তোলার জন্য প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে।

'আরও মার্জিত বা রুচিশীল করে তোলা' দ্বারা আসলে কি বোঝায়? ভাষা কি জোর করে মার্জিত/ রুচিশীল করে তোলা যায়? সরকার কি আইন করবে গালিগালাজ বা নোংরা বা অরুচিকর ভাষা ব্যবহারে? নাকি রুচিশীল বলতে বোঝায় মোবাইল ফোনের বাংলা 'মুঠোফোন' না করা (যেটাতে উনার আপত্তি রয়েছে)? অথবা, বহুল ব্যবহৃত ইংরেজী শব্দগুলো ব্যবহার না করে বাংলা বলা? আমি নজরুল মিন্টোর কথাটা বুঝতে পারিনি; রূপম ভাইয়া সাহায্য করবেন?

সবশেষে, আপনার লেখার শানিত যুক্তিগুলো কোট করতে চাই, যা অসম্ভব ভাল লেগেছেঃ

এই ভাবনা থেকে উচ্চারিত হয় যে চাষাভূষা প্রতিনিধি হোক আপত্তি নেই, কিন্তু মুখ খুললে তাকে শুদ্ধভাষায় কথা বলতে হবে। শাসকশ্রেণীর অংশ হলে শাসকশ্রেণীর ভাষা বলে উঠতে পারতে হবে। চাষাভূষা দিয়ে শাসকশ্রেণীর দূষণ চলবে না।

কিন্তু উনি বলছেন, ‘একেকজন একেক ধরনের বাংলা কী-বোর্ড তৈরি করে আমাদের হাতে ধরিয়ে দিলেন।’ ওনার এই চাপিয়ে দেওয়ার ভাবনাটা কল্পিত। প্রকৃত অস্বস্তি বহুত্ব নিয়ে, বিভিন্নতায়। এখানেও তিনি প্রমিত কিছু আশা করছেন।

অর্থাৎ পুনর্বার বিভিন্নতা ও বিভ্রান্তি সমার্থক হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে এই ভাবনায়। বুদ্ধিজীবীরা নানারকমের ভাবনা দিয়ে মানুষকে ভাবিত করছেন, এটা এই ভাবনার কাছে অস্বস্তিকর।

অধিকার যেনো প্রমিতরা সংরক্ষণ করেন যে তারা অন্যান্যদের আলাদা করে একটা স্বীকৃতি দেবেন।

ফলে ভাষার কোনো রকমকে বাড়তে না দেওয়ার অর্থ হলো মানুষের মুখকে, মানুষের ভাষা-ব্যবহারকে সংরক্ষিত করা। যেনো কেউ কেউ মানুষের ভাষা-ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার সংরক্ষণ করে।

কিন্তু প্রসারণবাদী সংস্কৃতি মনে সুরুচিও প্রমিতকরণের আওতায় একটা বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে ধরা দেয়।

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

আমি নজরুল মিন্টোর কথাটা বুঝতে পারিনি; রূপম ভাইয়া সাহায্য করবেন?

আমার লেখা থেকেই উত্তর কোট করি

আমি বেশ কয়েকবার পড়ার চেষ্টা করেছি। এখনো করছি। ওনার লেখার একটি পূর্ণাঙ্গ সমালোচনা কখনোই সম্ভব হয়ে উঠবে বলে মনে করি না।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।