দুই হাজার এক সনে প্রফেসর রিচার্ড সাটন (Richard Sutton) কিছু ব্লগ লিখেছিলেন। তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (কৃবু) শাখা রিইনফোর্সমেন্ট লার্নিং গবেষণার অন্যতম প্রবর্তক। চিন্তার গুরুত্বের কারণে অনেক কৃবু গবেষকের মাঝে ব্লগগুলো সমাদৃত। ইতোপূর্বে জর্জিয়াটেক বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি যোগ্যতা নির্ধারণ পরীক্ষার প্রশ্নে (PhD Qualifying Exam) ওনার ব্লগ ব্যবহৃত হয়েছে। সমকক্ষ-পর্যালোচিত (peer reviewed) বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রেও ব্লগগুলো একাধিকবার উদ্ধৃত হয়েছে (ব্লগ লেখকেরা উৎসাহিত হতে পারেন)। ওনার কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছিলাম ব্লগগুলো অনুবাদ করার। ভাবছি সবচেয়ে ভালো হয় অনুবাদের বদলে যদি ব্লগগুলোতে উপস্থাপিত ধারণাগুলোর উপর নিজের মতো করে আলোচনা করি। ওনার What’s wrong with AI, Verification: The key to AI এবং Verification ব্লগ তিনটির ভিত্তিতে নিচের আলোচনাটা করলাম।
আমাদের প্রশ্ন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (কৃবু) কী করে সম্ভব। এই প্রশ্নের উত্তরই বা কী করে করা সম্ভব? কেউ যদি বলতেই পারেন কীভাবে সফলতা আসবে, তাহলে তিনি নিজেই সেটা করে দেখান না কেনো? সেটাই রিচার্ড সাটনের প্রথম প্রতিক্রিয়া আমাদের প্রশ্নটির ব্যাপারে। যে কারো পক্ষে এমন দাবী করা তাই অদ্ভুত যে তিনি জানেন কীসে কৃবু সফল হবে। তবে ওনার মতে আমাদের কৃবু গবেষণা কেনো বিফল হচ্ছে সে নিয়ে আমরা নিশ্চয়ই পর্যালোচনা করতে পারি। সেখান থেকে অন্তত ধারণা পেতে পারি কোন গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটা আমরা এড়িয়ে যাচ্ছি।
রিচার্ড সাটনের মতে, কৃবু ক্রমাগত ব্যর্থ হচ্ছে কারণ কৃবুর গবেষকরা কৃবুর মূল লক্ষ্যের ব্যাপারে সচেতন নন। আর সেই লক্ষ্যটা হলো এমন কৃবু সিস্টেম তৈরি যা নিজের অর্জিত জ্ঞান নিজেই রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারে। এর বিপরীতে অধিকাংশ সিস্টেমই মানুষের হস্তক্ষেপের উপর অত্যাধিক নির্ভরশীল। গবেষকেরা তাদের সিস্টেমের ভেতরে নিজেদের পরিচিত জ্ঞানগুলো যেমন চেয়ার, টেবিল ইত্যাদি বস্তুর ধারণা কোড করে দিচ্ছেন। কৃবু সিস্টেমকে যখন কয়েকটি পছন্দের মধ্যে একটি বাছাই করতে হচ্ছে (যেমন খেলার চাল), তখন যে স্কোর ফাংশনটা ব্যবহার করে বাছাই করা যাবে সেটাও গবেষক নিজ হাতে নক্সা করে দিচ্ছেন। তারপর যখন সিস্টেমটি একটি অদেখা ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত কাজটি করতে ব্যর্থ হচ্ছে, যেমন একটি ভিন্ন ডিজাইনের চেয়ারকে চেয়ার বলে চিনতে ব্যর্থ হচ্ছে, তখন মানুষকে আবার তার কোডে হাত দিতে হচ্ছে। অথবা আমাদের কোড করা স্কোর ফাংশনটি যখন দুটি বিশেষ পছন্দের মধ্যে ভুলভাবে বাছাই করছে, তখন নক্সাকারী আবার স্কোর ফাংশনটি পরিবর্তন করছেন। অর্থাৎ প্রকৃত অর্থে সিস্টেম তার পরিপার্শ্বের বস্তুগুলোর বা তার পছন্দের বাছাইগুলোর জ্ঞান নিজে রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা যাচাই করতে পারছে না। এর রক্ষণাবেক্ষণ প্রকৃত অর্থে করছে মানুষ। এখন আমরা ভাবছি চেয়ারকে চেয়ার বলে চিনতে পারা দৃষ্টিগণনা গবেষণার (computer vision) বিষয়। সেখানের গবেষকরা যেদিন আরও উন্নতমানের চেয়ারসনাক্তকারী প্রোগ্রাম তৈরি করবেন, সেদিন পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। কিংবা ভিন্ন ভিন্ন পছন্দের মধ্যে শ্রেয় বাছাই কোনটা সেটা নির্ধারণের জন্যে মানুষকে বসে বসে অজস্র ডেটা লেবেল করতে হবে। কিন্তু এর অর্থ হলো কৃবু সিস্টেমটা গুটিকয়েক প্রোগ্রামারের ধারণায় যতোটুকু ধরে ততোটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকবে; তার বাইরের সমস্যাগুলোতে সিস্টেমটা থাকবে নিষ্ফল।
এটা এক ধরনের তত্ত্ব-উদ্ঘাটন বিরোধী বা প্রকৌশল-চর্চা কেন্দ্রিক অবস্থান, যেখানে যেকোনো উপায়ে সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টাটা গ্রহণীয়। এখানে সিস্টেমের সফলতাটা অনেকাংশেই উদ্ভাবকের কোনো বিশেষায়িত জ্ঞান কিংবা অন্তর্দৃষ্টির কৃতিত্ব। এটা কৃবুয়ের মূল লক্ষ্যের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ। কিন্তু এমন করাই আজকাল প্রশংসনীয়।
এর বিপরীতে রিচার্ড সাটন একটি স্বীকার্য প্রস্তাব করছেন, যাকে তিনি বলছেন ‘যাচাইকরণের মূলনীতি’:
অর্থাৎ যে জ্ঞানটার শুদ্ধতা সিস্টেমটা নিজে যাচাই করতে পারছে না, সেটা ঠিক তার নিজের জ্ঞান নয়। আমরা ভাবতে পারি সিস্টেমটা যেহেতু একটা চেয়ারসনাক্তকারী প্রোগ্রাম ব্যবহার করছে, ফলে চেয়ার সংক্রান্ত জ্ঞানটা তো তার নিজেরই জ্ঞান। কিন্তু যাচাইকরণের মূলনীতি বলছে যে সিস্টেমটা যেহেতু অভিজ্ঞতা থেকে কোনটা চেয়ার আর কোনটা চেয়ার নয় নিজে যাচাই করতে পারছে না, এটা অতোটা তার নিজের জ্ঞান হয়ে উঠে নি। এ কারণে সে যখন চেয়ার সনাক্ত করতে ব্যর্থ হচ্ছে তখন তাকে মানুষের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। চেয়ারের যে জ্ঞানটি কোড করে সিস্টেমে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, সেটা প্রকৃত অর্থে মানুষের দ্বারা ধৃত ও যাচাইকৃত জ্ঞান।
এর মানে এটা বলা নয় যে চেয়ারসনাক্তকারী প্রোগ্রামগুলো কোনো কাজের নয়। তবে যখন সেটাকে কৃবু সিস্টেমের কাছে গছিয়ে দেওয়া হবে, তখন সেই জ্ঞানটাকে তার নিজের পক্ষে যাচাই করার সুবিধাটা থাকতে হবে। চেয়ার কী বস্তু? আমাদের কাছে এর একটা বিশেষ পরিচয় আছে। এই পরিচয়টা গড়ে উঠেছে আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। অন্য যে মানুষগুলোরও একই অভিজ্ঞতাটা আছে, তাদের সাথেই আমরা কেবল এই চেয়ার নামক বিমূর্ত ধারণাটি ভালোভাবে ভাগাভাগি করতে পারি। কিন্তু কল্পনা করুন যার চেয়ার সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। সে কীভাবে এ সম্পর্কে ধারণা নিবে? আমাদের বলা বর্ণনা থেকে? নাকি এটা নিয়ে নাড়াচাড়া করে, অভিজ্ঞতা অর্জন করে? কৃবু সিস্টেমের ক্ষেত্রে আমরা আমাদের নিজস্ব বর্ণনাটাই সিস্টেমের উপর চাপিয়ে দিচ্ছি। অর্থাৎ আমরা চেনা বিভিন্ন বস্তু সম্পর্কে নৈর্ব্যক্তিক একটা ধারণা সিস্টেমকে দেয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু আমরা নিজেরা কিন্তু বিভিন্ন বস্তুকে নৈর্ব্যক্তিক ধারণাগুলোর উপর ভিত্তি করে চিনি না, যতোটা চিনি নিজেদের সঞ্চিত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করে। কৃবু সিস্টেমগুলোকেও তেমন করতে দিতে পারতে হবে।
ফলে আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে চেয়ারের জ্ঞানটা যতোটা গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে সম্ভবত বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো কৃবু সিস্টেমের ইন্দ্রিয় (বিভিন্ন সেন্সর ইনপুট) ও অভিজ্ঞতার সাপেক্ষে কোন জ্ঞানটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা। হয়তো কৃবু সিস্টেমের সাপেক্ষে “বসার যোগ্য বস্তু”ই কেবল গুরুত্বপূর্ণ। কোনটা চেয়ার আর কোনটা নয় সেটা চিনিয়ে দেয়ার চেয়ে বরং কৃবু সিস্টেমের নিজের সাপেক্ষে বসা বলতে কী বোঝায় সেটা নির্ধারণ করা অনেক বেশি সহজ। সেক্ষেত্রে আমাদের কাছে কোনটা চেয়ার, সেটা আর কৃবু সিস্টেমের কাছে গুরুত্বপূর্ণ থাকে না। বরং তার নিজের সাপেক্ষে “বসার যোগ্য বস্তু”ই গুরুত্বপূর্ণ। এবং সেটা চেয়ার নাও হতে পারে। তবে সেটা কিন্তু প্রকৃত অর্থে কোনো সমস্যা নয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যে সিস্টেমটা নিজে এখন যাচাই করতে পারে যে কোথায় সে বসতে পারে আর কোথায় সে পারে না। এভাবে তার নিজস্ব “বসার যোগ্য বস্তুর” ধারণাটা সে নিজেই যাচাই করে শুধরে নিতে পারে মানুষের রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়াই।
এভাবে রিচার্ড সাটন কৃবু গবেষণায় যাচাইকরণের মূলনীতিকে সামনে নিয়ে আসতে চেয়েছেন। এই মূলনীতিতে প্রোথিত রয়েছে বিজ্ঞানের একটি শক্তিশালী দর্শন শাখার প্রচ্ছন্ন প্রভাব। আর সেই দর্শন মতে - যে তত্ত্ব পর্যবেক্ষণ দ্বারা যাচাই করা যায় না তা অর্থহীন। একে আমি সংক্ষেপে বলি - পর্যবেক্ষণ-অসাধ্য তত্ত্ব অর্থহীন। এ নিয়ে বিজ্ঞানের দর্শন নামে ও অধিবিদ্যা বনাম বিজ্ঞান নামে দুইটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম। লজিক্যাল পজিটিভিস্টরা (নৈয়ায়িক প্রত্যক্ষবাদ) অধিবিদ্যক (metaphysical) বক্তব্যকে নাকচ করার জন্যে - ‘যে তত্ত্ব পর্যবেক্ষণ দ্বারা যাচাই করা যায় না তা অর্থহীন’ - এই মূলনীতিকে সামনে নিয়ে আসেন। এ নিয়ে বিস্তর তর্ক আছে। তবে আধুনিক বিজ্ঞান এর উপর দাঁড়িয়ে আছে। এ কারণে আইনস্টাইন প্রদত্ত সূত্রকে প্রতিষ্ঠিত হবার জন্যে অপেক্ষা করতে হয় পর্যবেক্ষণ দ্বারা যাচিত হওয়া পর্যন্ত। এই প্রত্যক্ষবাদ কৃবুতে আরো শক্তিশালীভাবে প্রযোজ্য হতে পারে। আমরা একইভাবে প্রশ্ন করতে পারি - যে জ্ঞান একটা কৃবু সিস্টেমের নিজের কাছে যাচাই-অসাধ্য, তার কাছে সেটার উপযোগিতাটা কতোটুকু?
রিচার্ড সাটন ব্যাপারটাকে এভাবে উপস্থাপন করছেন না যে কিছু কৃবু সিস্টেম যাচাইকরণ ব্যবহার করে আর কিছু সিস্টেম করে না। বরং যাচাইকরণকে তিনি একটি মাত্রা হিসেবে দেখছেন, যার মাঝে বিভিন্ন সিস্টেম বিন্যস্ত। অর্থাৎ একটা সিস্টেম আরেকটা থেকে বেশি যাচাইকরণ ব্যবহার করছে বা কম করছে - এমন। ওনার ব্লগ তিনটি পাঠ করে আমি কৃবু সিস্টেমের তিনটি ভিন্ন ক্ষেত্র পেয়েছি যেখানে তিনি যাচাইকরণের সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
যাচাইকরণের প্রথম ক্ষেত্র হচ্ছে ‘পছন্দ বাছাই’। এক ভাবে চিন্তা করলে পছন্দ বাছাই কৃবু সিস্টেমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যেকোনো বুদ্ধিধারী সত্তার ক্ষেত্রেও আসলে এটা বলা চলে। এভাবে ভাবা যায় যে আমরা প্রতি নিয়ত আসলে বিভিন্ন উপায়ের মধ্যে একটা বাছাই করছি। এই মুহূর্তে আমি লিখতে লিখতে জানালার দিকে তাকাতে পারি, অথবা নাও পারি। পাঠক এই মুহূর্তে পাঠ থেকে বিরত হতে পারেন অথবা এগিয়ে যেতে পারেন। এটা হচ্ছে বিভিন্ন ক্রিয়ার (action) মধ্যে একটা বাছাই করে নেয়া। এর অধিকাংশ বাছাই-ই আমরা সচেতনভাবে করছি না। কিন্তু ভাবা যেতে পারে যে আমরা প্রতি নিয়ত আমাদের অজস্র ক্রিয়াসাধনের উপায়ের মধ্যে একটা বাছাই করছি। একটা কৃবু দাবাড়ু প্রতিবার নির্ধারণ করছে তার সকল উপায়ের চালের মধ্যে কোনটা সে বাছাই করবে। এক অর্থে কৃবু সিস্টেম মাত্রেই ক্রিয়া সাধন আর ক্রিয়া সাধন মাত্রেই বিভিন্ন উপায়ের মধ্য একটা বেছে নেয়া। যখন মানব প্রোগ্রামার একদম নির্ধারণ করে বলে দিচ্ছেন দুটো পছন্দের মধ্যে কোনটা কৃবু সিস্টেম সবসময় বাছাই করবে, সেটাকে বলা চলে বাছাইকরণে যাচাইয়ের সম্পূর্ণ অভাব। কারণ সে এখানে কেবল আজ্ঞাবাহী। নিজের ভালো মন্দ নিজে জানে না। এর বদলে সফল কৃবু দাবাড়ুগুলো যেমন ‘ডিপ ব্লু’ একটা স্কোর ফাংশন ব্যবহার করে তার পছন্দ বাছাই করে থাকে। প্রত্যেকটা সম্ভাব্য ক্রিয়াকে স্কোর ফাংশনটা একটা স্কোর প্রদান করে থাকে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ স্কোরপ্রাপ্ত ক্রিয়াটিকে সিস্টেমটি সম্পাদনের জন্যে বাছাই করে নেয়। একে সম্পূর্ণ যাচাইহীনতার চেয়ে উন্নত বলা চলে। কারণ স্কোর ফাংশনটা মানুষের একেবারে হাতে কলমে নির্ধারণ করে দেয়া আজ্ঞার চাইতে অনেক বেশি সাধারণ ও নিয়মানুগ। ফলে তার পছন্দগুলো থেকে সে স্কোর ফাংশন দ্বারা যাচাই করে বাছাইটি করছে বলা চলে। এরকম স্কোর ফাংশনের ব্যবহার আমরা দাবা ছাড়াও প্রায় অধিকাংশ কৃবু সিস্টেমের ক্ষেত্রেই ব্যবহার করতে পারি।
রিচার্ড সাটন বলছেন, আমরা যাচাইয়ের পরিসীমাকে আরো বাড়াতে পারি। যেমন, অনেক ক্ষেত্রেই বাছাইয়ের স্কোর ফাংশনটি একবার প্রদানের পর আর পরিবর্তন করা হয় না। সেক্ষেত্রে পছন্দ বাছাইটা যাচাইকৃত হলেও স্কোর ফাংশনটি নিজে যাচাইকৃত নয়। যে স্কোর ফাংশনটি দেয়া হয়েছে, সেটাকেই নিয়ম ধরে বার বার ব্যবহার করা হচ্ছে। এর বদলে স্কোর ফাংশনটা নিজেই সময়ের সাথে যাচাইকৃত হবার মাধ্যমে আরো উন্নত হতে পারে। যেমন ব্যাকগ্যামোন নামক বোর্ড খেলাটির প্রথম মানবসমকক্ষ প্রোগ্রামটি শুরুতে একটা খুব সাধারণ মানের স্কোর ফাংশন দিয়ে শুরু করলেও খেলায় হার জিতের মাধ্যমে নিজের স্কোর ফাংশনটি ক্রমাগত উন্নত করার কারণেই এতোটা সফল হয়েছে। ফলে তার চাল বাছাই ক্রমাগত উন্নত হয়েছে। স্কোর ফাংশনের এরকম স্বয়ংক্রিয় উন্নয়নই হলো যাচাইকরণের দ্বিতীয় ক্ষেত্র।
যাচাইয়ের তৃতীয় ক্ষেত্র হচ্ছে বস্তু সম্পর্কে, জগত সম্পর্কে জ্ঞানের যাচাই। সেখানেই চেয়ার বা দরোজার প্রশ্ন। জগত সম্পর্কে জ্ঞান কৃবু সিস্টেমের জন্য কেনো গুরুত্বপূর্ণ? এক অর্থে জগতের জ্ঞান আর ক্রিয়া বাছাই একে অপরের পরিপূরক। সঠিক ক্রিয়া বাছাইয়ের জন্যে প্রয়োজন পরিপার্শ্ব সম্পর্কে শুদ্ধ জ্ঞান। একটা কৃবু বা যেকোনো সাধারণ বুদ্ধিমান সিস্টেমকেই মূলত ভাবা যায় যে সে প্রতি নিয়ত ক্রিয়া বাছাই করছে। এমন কি এমনও ভাবা যায় যে সে ক্রিয়া বাছাই করতে সম্ভবত একটা স্কোর ফাংশন ব্যবহার করছে। কিন্তু স্কোর ফাংশনটা নিশ্চয়ই শুধু সম্ভাব্য পছন্দ বা ক্রিয়াগুলোর উপর নির্ভর করেই স্কোর করে না। পরিস্থিতির উপরও নির্ভর করে। যেমন খুব সরলীকরণ করে বলা যায়, একটা লেখা পড়া আর না পড়া দুটো ক্রিয়া। ভাবা যায় যে কোনো কোনো লেখার ক্ষেত্রে পাঠের মাঝখানে আমার স্কোর ফাংশনটি পড়া জারি রাখার ক্রিয়াটিকে বাছাই করে, আবার কোনো কোনো লেখার ক্ষেত্রে আর না পড়ার ক্রিয়াটিকে বাছাই করে নেয়। তার মানে স্কোর ফাংশনটি নির্ভর করে পরিস্থিতির উপর। আর পরিস্থিতি প্রকাশিত হয় দৃষ্টি, শ্রবণ, ঘ্রাণ ইত্যাদি ইনপুট দ্বারা ও প্রাক্তন অভিজ্ঞতার দ্বারা। লেখা লেখার জায়গায় থাকলেও মানুষের কাছে লেখা তার চেয়ে বেশি কিছু। একটা লেখাকে আমরা দেখি নিজস্ব অনুভূতি ও পূর্ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। লেখাকে বিশ্লেষণ করি সেটার উপর ভিত্তি করেই। সেখানেই জাগতিক জ্ঞানের অবস্থান। একটা চেয়ার বা দরোজার ধারণা বা জ্ঞান আমাদের মাঝে গঠিত হয় আমাদের উপর ক্রমাগত আসা দৃষ্টি শ্রবণ ইত্যাদি ইনপুট বা পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে। এভাবে জগতের বা পরিপার্শ্বের জ্ঞান আমাদের পরিস্থিতিকে নির্মাণ করে। স্কোর ফাংশন সেই পরিস্থিতিকে ব্যবহার করে সঠিক ক্রিয়াটি বাছাই করে। ফলে জগত সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান সঠিক ক্রিয়া বাছাইয়ের জন্যে প্রায় অপরিহার্য।
এখন কীভাবে সেই জ্ঞানটা যাচাই করে শুদ্ধ করে নেয়া যাবে সেটাই এখানে প্রশ্ন। ধরুন কৃবু সিস্টেম একটা বস্তুকে দেখার পর তার উপর বসবে কি বসবে না বিচার করছে। অর্থাৎ বসা আর না বসা এই দুটো ক্রিয়ার মধ্যে তার বাছাই করা প্রয়োজন। এর জন্যে সিস্টেমটি তার স্কোর ফাংশনের দ্বারস্থ হবে। স্কোর ফাংশনটি সিস্টেমের ‘বসার যোগ্য বস্তু’-সংক্রান্ত জ্ঞানটিকে ব্যবহার করতে পারে জানার জন্য যে বস্তুটি আদৌ বসার যোগ্য কিনা। হয়তো জ্ঞানটি বলবে যে বর্তমান বস্তুটি বসার যোগ্য। সেক্ষেত্রে স্কোর ফাংশনটি বসার ক্রিয়াকে না বসার ক্রিয়ার তুলনায় বেশি স্কোর দিবে। সিস্টেমটি তখন বস্তুটির উপর বসার চেষ্টা করে ধরি ব্যর্থ হলো। সেক্ষেত্রে যাচাইকরণ মূলনীতিটি অনুসারে আমরা প্রস্তাব করতে পারি যে সিস্টেমটির উচিত তার ‘বসার যোগ্য বস্তু’ সম্পর্কিত জ্ঞানটিকে নিজে নিজে এমনভাবে পরিবর্তন করা যাতে বর্তমান বস্তুটিকে আগামিতে আরো একটু কম বসার যোগ্য বলে মনে হয়। এর বিপরীতে আমরা এখন আমাদের প্রোগ্রামারকে ডেকে বলি বস্তুটা চেয়ার ছিলো নাকি ছিলো না সেটার ভিত্তিতে পুনরায় লেবেল করতে কিংবা কোডটা পরিমার্জন করতে। অর্থাৎ আমরা এখনো কৃবুকে আমাদের নিজেদের যাচাই করা জ্ঞানের বিচারে দেখছি, সিস্টেমটির নিজের জ্ঞানের বিচারে না।
এভাবে বিভিন্ন উপায়ে যাচাইকরণের মূলনীতিকে যদি ব্যবহার করা যায়, তাহলে কৃবুর সম্পূর্ণ সফলতা না হোক অন্তত বর্তমান অবস্থা থেকে কিছুটা উত্তরণ অন্তত কল্পনা করা যায়।
মন্তব্য
ভাল লাগলো,
চালিয়ে যান
এই লেখাটা শেয়ার করলাম! অগ্রীম ধন্যবাদ!
নতুন মন্তব্য করুন