“সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা আমাদের এই দেশ ওশিয়ানিয়া” - এই বলে শুরু হয় ‘নাইনটিন এইটি ফোর’ মুভিটা। কণ্ঠ ভেসে আসতে থাকে স্ক্রিন থেকে। ‘সত্য মন্ত্রণালয়ের’ কর্মীদের দেখানো হচ্ছে সরকারী প্রচারণামূলক ভিডিও। দেখানো হচ্ছে দেশের শৈর্য্য, বীর্য, সংগ্রামের কাহিনী। ওশিয়ানিয়া যুদ্ধে লিপ্ত। বিশ্বযুদ্ধের পরে সমগ্র পৃথিবী ভাগ হয়ে গেছে তিন মহারাষ্ট্রে - ওশিয়ানিয়া, ইউরেশিয়া আর পূর্বেশিয়ায়। পৃথিবীর প্রায় পুরোটা ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে গেছে, আফ্রিকা আর ভারত বাদে। ওই দুই অঞ্চল নিয়ে তিন মহারাষ্ট্রের চলছে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ।
ওশিয়ানিয়া চরম রাষ্ট্রবাদী ও কর্তৃত্ববাদী একটি রাজনৈতিক ‘পার্টি’ দ্বারা শাসিত। এখানে অন্য কোনো পার্টি নেই। অন্য দুইটি সমশক্তিধর মহারাষ্ট্রেরও একই অবস্থা। একটা মাত্র রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া। নাগরিকের প্রতিটি কর্মকাণ্ডে চলে নজরদারি। অবশ্যই নাগরিকের ‘কল্যাণের’ জন্য। প্রকৃত-পালক ঈশ্বর যেমন নজর রাখেন, পালেন পোষেন তার বান্দাদের। পার্টির সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, প্রধান, সদাশয় ‘বিগ ব্রাদার’ সর্বদা সকল নাগরিকের উপর নজর রাখেন। বলা হয় - ‘বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং ইউ।’ সব জায়গায় তার খোমার ছবি ঝুলতে থাকে - যেখানে তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আপনার দিকে। টিভি স্ক্রিনে সারাক্ষণ ভাসে সেই মুখ।
প্রতিটি ঘরে রয়েছে বিশাল একটি সরকারি টিভি। সারাক্ষণ সেখানে প্রচারিত হয় সরকারি খবর। যুদ্ধের গাঁথা। ধরা পড়া মীরজাফরদের নামের লিস্ট। নাগরিকের দায়িত্ব ও করণীয়। সরকারি উৎপাদন, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসেবার শনৈ-শনৈ উন্নয়ন। কখনোই বন্ধ করা যায় না এই টিভি। ঘুমোবার সময়ও না। কেবল শব্দটা একটু নিচু করা যায়। টিভি স্ক্রিনের সাথে যুক্ত আছে একটা ভিডিও ক্যামেরা। সেটা দিয়ে সর্বদা নজর রাখা হয় কে কী করছে ঘরের ভিতরে।
খাবার অপ্রতুল। বাসস্থান নোংরা, জরাজীর্ণ। রাজপথ যুদ্ধে-বোমাবিস্ফোরণে ধ্বংসাবশেষের স্তূপে পরিণত। এমতাবস্থায় মানবতা, নাগরিকাধিকারের প্রশ্ন পার্টির ভাষ্যে বাতুলতা। পার্টি এক হাতে সব দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। নাগরিকের মঙ্গলের জন্য তার উপর নজরদারি করছে। নিশ্চিত করছে কোনো ভিন্ন রাষ্ট্রপক্ষের মীর জাফর যেনো মিথ্যা সংবাদ, রোগশোক না ছড়ায়। সকল তথ্য যেনো নিয়ন্ত্রিত থাকে। সকল উৎপাদন ও উন্নয়ন যেনো রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে হয়।
‘সত্য মন্ত্রণালয়ের’ হলঘরে ভিডিওতে দেখানো হচ্ছে ‘বীর ওশেনিয়া’ সেনাদের শত্রু ইউরেশীয়দের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কাহিনী। জাতির অমোঘ লক্ষ্য হলো এই যুদ্ধ জয়। এই যুদ্ধে ইউরেশিয়া চিরশত্রু, পূর্বেশিয়া চিরবন্ধু। আর রয়েছে এক দেশদ্রোহী বিশ্বাসঘাতক ইমানুয়েল গোল্ডস্টেইন। তেমনটাই ওশেনিয়া মহারাষ্ট্রের একমাত্র শাসক পার্টিটির প্রচারিত ভিডিওটিতে বলা হতে থাকে। স্ক্রিনে গোল্ডস্টেইনের চেহারাখানি আসতেই চিৎকার করে এই বিশ্বাসঘাতকের নাম উচ্চারণ করতে বলা হয়। হলভর্তি ‘সত্য মন্ত্রণালয়ের’ কর্মীরা চিৎকার করতে থাকে ‘গোল্ডস্টেইন’, ‘গোল্ডস্টেইন’!
গোল্ডস্টেইন অনুনয় বিনয় করে এই ভিডিওটিতে বলতে থাকে -
“পার্টির সব কথা মিথ্যে! পার্টির সকল কর্ম অসৎ। একটা মিথ্যা যুদ্ধে আমরা লিপ্ত। পার্টি আমাদের বিশ্বাস করাতে চায় আমরা এক মহান যুদ্ধে লিপ্ত। যাতে আমাদের রাগ ও ক্ষোভটাকে আমরা আমাদের আসল শত্রু - পার্টির - বিপক্ষে চালিত করতে না পারি। বিগ ব্রাদার বলে কেউ নেই। এটা পুরোটাই মিথ্যা, বানোয়াট একটা চরিত্র। রাষ্ট্রের প্রকৃত শাসকরা হলো অদেখা অজানা, নির্মম কিছু গুটিবাজ। পার্টি ওশিয়ানিয়ার মানুষের সেবা করে না, তারা সেবা করে কেবল নিজেদের। আমরা মোটেও ইউরেশিয়ার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত নই! তোমাদেরকে পার্টির দাস করে রাখা হয়েছে। চোখ খুলে দেখো তোমাদের সাথে কী হচ্ছে! পার্টি তার নিজের মানুষের উপর বোমা নিক্ষেপ করছে। ইউরেশিয়া নয়, পার্টিই তোমাদের প্রকৃত শত্রু। জেগে ওঠো! এদের গদি ছাড়া করো। তোমাদের কিছুই হারানোর নেই। কিন্তু পাবার আছে সবকিছু!”
গোল্ডস্টেইনের কথাগুলো ঢাকা পড়ে যায় “মীর জাফরের কল্লা চাই, কল্লা চাই” রবে। মিনিটখানেক তীব্র ঘৃণার মহোৎসব শেষে স্ক্রিনে ভেসে আসে মহান বিগ ব্রাদারের ছবি। স্বস্তি ফিরে আসে জনমনে। সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো উচ্চারণ করতে থাকে - ‘বিগ, বিগ, বিগ।’
এক বিপ্লবের মাধ্যমে এই শাসক পার্টির উত্থান। কিন্তু পার্টির ভাষ্যমতে বিপ্লব এখনো শেষ হয় নি। বিপ্লব চলমান। সকল নাগরিককে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে সেই বিপ্লবের পথ সুগম করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সকল মানুষের ইচ্ছা যখন পার্টির ইচ্ছার সাথে একীভূত হবে, তখন বিপ্লব পূর্ণ হবে। বিপ্লবের সফলতা হলো পরম গোষ্ঠিস্বার্থে। কিন্তু এর অন্তরায় হলো ব্যক্তিক চিন্তা।
চিন্তা! চিন্তা ওশেনিয়ায় অপরাধ। বাক-স্বাধীনতা নেই। চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতাও নেই। পার্টির স্বার্থের সাথে অসামাঞ্জস্যপূর্ণ ব্যাপার নিয়ে ভাবাও নিষিদ্ধ। থটক্রাইমের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। ফলে ব্যক্তিকে তার স্বার্থপর ব্যক্তিস্বার্থের চিন্তা করা থেকে দূরে রাখার চেষ্টায় পার্টি ব্যস্ত। তাদের ভাষ্যে চিন্তার উৎপত্তি ও বিস্তার ঘটে কেবল শব্দ দিয়ে। শব্দের বাইরে চিন্তার অস্তিত্ব নাই। শব্দ যদি সীমিত করে দেয়া হয়, চিন্তাও তখন সীমিত হয়ে যাবে!
যেসব চিন্তা পার্টিবিরোধী, সেসব চিন্তার শব্দগুলোকে বিলুপ্ত করে দিলে সেইসব চিন্তাগুলো কল্পনা করাও অসম্ভব হয়ে পড়বে। তাই পার্টি ‘নিউস্পিক’ বা নতুনবোল নামে একটা নতুন ভাষা উদ্ভব করে। এই ভাষার শব্দগুলো ইংরেজি থেকে নেয়া, কিন্তু অল্প কিছু শব্দ দিয়ে ভাষাটা গঠিত। মুক্তি, ব্যক্তিবাদ, মুক্তচিন্তা, ইত্যাদি ধারণাকে ধারণ করে এমন সব শব্দকে বাতিল করা এর অন্যতম উদ্দেশ্য। শব্দ সীমিত করার জন্যে সমার্থক অনেক শব্দ এখানে বাতিল। ভালো বা ‘গুড’ শব্দটা আছে, কিন্তু ‘ব্যাড’, ‘বেটার’, ‘গ্রেট’, বা ‘এক্সিলেন্ট’ নেই। এর বদলে আছে যথাক্রমে - ‘আনগুড’, ‘গুডার’, ‘প্লাসগুড’ আর ‘ডবলপ্লাসগুড’।
২০৫০ সাল নাগাদ নতুনবোলের বাইরে কোনো শব্দ বা ধারণার অস্তিত্ব থাকবে না। অতীতের সকল জ্ঞান ও ইতিহাস পুনর্লিখিত হবে নতুনবোলে। শেক্সপিয়ার, মিল্টন, বায়রন পাঠ করা যাবে কেবল নতুনবোলের ভাষায়। মূল লেখাগুলো ধ্বংস করা হবে। যাতে পার্টি-নির্ধারিত ‘সত্য’ ভিন্ন অন্য কোনো সত্যের অস্তিত্ব না থাকে। আর এই সাহিত্যকর্মগুলোর নতুন সংস্করণগুলোতে থাকবে তারা যা বলেছিলো ঠিক তার উল্টো কথাগুলো। পার্টির নিজের নামটিই - ইংলিশ সোশ্যালিজম - নতুনবোলে হয়ে গেছে “ইংসক” (Ingsoc)।
পার্টির স্লোগান হলো “যুদ্ধই শান্তি”, “মুক্তিই দাসত্ব”, “অজ্ঞতাই শক্তি।” এমন স্ববিরোধী ধারণাগুলো একবাক্যে একত্র করা হয়েছে যাতে শান্তি, মুক্তি এবং অজ্ঞতা এই ধারণাগুলোর স্বরূপ জনমনে বিকৃত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। তবে নতুনবোলের ভবিষ্যত সংস্করণে মুক্তি বা ‘ফ্রিডমের’ মতো শব্দগুলোই আর থাকবে না, যাতে মুক্তির ধারণাটাই চিন্তায় ধারণ করা অসম্ভব হয়! এভাবে ভাষাকে যেদিন “নিখুঁত” করা যাবে, বিপ্লব সেদিন সম্পন্ন হবে।
পার্টির অন্তরায় যে ‘ব্যক্তিক চিন্তা’, তার আরেক হাতিয়ার হলো পরিবার। মানুষ পরিবার গঠন করার ফলে ক্ষুদ্র, ব্যক্তিক, স্বার্থপর চিন্তায় প্রলুব্ধ হয়। নিজের কথা ভাবে, বা কেবল নিজের আপনজনের কথা ভাবে। নিজের জন্য আয় করতে চায়, উন্নতি করতে চায়, খরচ করতে চায়। পার্টির স্বার্থের বাইরে ভাবার প্রণোদনা পায়। তাই পার্টি পরিবারের গঠনকে ভাঙতে চায়। তারা পরিবারের শিশু কিশোরদেরকে স্কাউট হিসেবে রিক্রুট করে তাদের নিজেদেরই পিতামাতার বিরুদ্ধে! পিতামাতা কোনো পার্টিবিরোধী কাজ বা চিন্তায় লিপ্ত কিনা বের করার জন্যে সন্তানেরা তাদের সর্বদা নজরে রাখে।
পরিবার গঠনের সূত্রপাত হলো মিলন ও সন্তান উৎপাদন। পার্টির বৈজ্ঞানিক গবেষণার অন্যতম লক্ষ্য তাই মিলনের আনন্দ উপভোগকে নিশ্চিহ্ণ করা। মিলনের আনন্দ নেই, মিলন নেই, পরিবার নেই, ব্যক্তিবাদী চিন্তাধারক শব্দ নেই, ব্যক্তিক চিন্তাও সেখানে অস্তিত্বহীন!
মুভির মূল চরিত্র উইন্সটোন স্মিথ ‘সত্য মন্ত্রণালয়ের’ কেরানি। তার কাজ ইতিহাস পুনর্লিখন। অতীতের সব পত্রিকা ঘেঁটে ঘেঁটে পার্টির সাথে অসামাঞ্জস্যপূর্ণ এমন সব খবরগুলোকে পার্টির সাথে সামাঞ্জস্যপূর্ণ খবর দিয়ে পুনরায় লেখা। আর আগের পত্রিকাটিকে ধ্বংস করে ফেলা। এভাবে পার্টি হয়ে উঠতে থাকে সর্ববিরাজমান। পার্টির বিচরণ শুধু বর্তমান ও অনাগত ভবিষ্যতেই না, পার্টি সকল অতীতে বিরাজ করতো - জনমনে এই সংকেত ও স্মৃতিই তারা প্রদান করতে চায়। প্রকৃত ইতিহাস তখন কেবল বিরাজ করবে মানুষের স্মৃতিতে। আর মানুষের স্মৃতি ক্ষণস্থায়ী, নশ্বর। সেইসব মানুষ ধবংস হলে বেঁচে থাকবে কেবল পার্টির বর্ণিত ইতিহাস।
স্মিথ তার কাজে দক্ষ। কোনো পার্টি মেম্বার হয়তো মীর জাফর হিসেবে আখ্যায়িত হলো, তাকে ভস্মীভূত করাও সম্পন্ন হয়ে গেছে। স্মিথের দায়িত্ব পড়লো তার সকল স্মৃতি ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলার। অতীতের পত্রিকায় হয়তো লেখা আছে তিনি অমুক সনে পার্টির অমুক মেড্ল পেয়েছেন। ওই জায়গায় লেখা হলো কোনো বীর শহীদ যোদ্ধা মেড্লটি পেয়েছেন। ভস্মীভূত পার্টি মেম্বারটির কোনো নাম, ছবি, চিহ্ণ কোথাও আর থাকলো না।
কিন্তু এর ভেতরে স্মিথ উপলব্ধি করতে থাকে, সে পার্টিকে আসলে ঘৃণা করে, সে বিগ ব্রাদারকে ঘৃণা করে, সে গোষ্ঠিবাদকে ঘৃণা করা, সে গোষ্ঠিবাদের বীরত্বের, সংগ্রামের গাঁথাকে ঘৃণা করে। ঘৃণা করে মানুষকে বিশুদ্ধীকরণের তাদের প্রচেষ্টাকে। সে ব্যক্তিবাদ তাড়িত। সে নিজের ভাবনায় তাড়িত হতে চায়। সে কলুষিত হতে চায়। সে একজন থটক্রিমিন্যাল!
স্মিথ চোরাকারবারির কাছে যায়। যায় পতিতার কাছে। নিজের ঘরের ক্যামেরাকে আড়াল করে লিখে ব্যক্তিগত ডায়েরি। পার্টির কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে সে সংগ্রামে লিপ্ত হয় তার অফিসেরই এক নারী কর্মীর সাথে সম্পর্কে লিপ্ত হয়ে। তারা পালিয়ে দূরের বনে গিয়ে মিলিত হয়। সম্পর্ক আরো গড়ালে স্মিথ তার পরিচিত চোরাকারবারিটির সহায়তায় একটা টিভি ও ক্যামেরাবিহীন গোপন কক্ষ ভাড়া করে। সেখানে স্মিথ তার সঙ্গিনীকে নিয়ে যায়। বার বার। তারা বুঝতে পারে তাদের ভালো সময়গুলো শেষ হয়ে আসছে। কিন্তু তারা আবার মিলিত হয় সেখানে।
সে সময় স্মিথের কথা হয় এক পার্টি মেম্বার ও’ব্রায়ানের সাথে। ও’ব্রায়ান পার্টির অনেক উপরতলার মেম্বার। নিজের ঘরের টিভিস্ক্রিনটা বন্ধ করার বিশেষাধিকার সে ভোগ করে। কিন্তু সে দাবি করে গোপনে সে ইমানুয়েল গোল্ডস্টেইনের সহচর। পার্টির অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরির চেষ্টা করছে। ও’ব্রায়ান স্মিথকে একটা বই পড়ার জন্যে দেয়।
স্মিথ বাসায় গিয়ে বইটি খুলে। বইটির প্রথম পাতায় লেখা - এটি নতুনবোল ভাষার অভিধানের নতুন সংস্করণ। কিন্তু সে টের পায় যে প্রত্যেক পাতার সাথে আরেকটি পাতা হাল্কা আঠা দিয়ে লাগানো। স্মিথ আঠা লাগানো প্রথম পাতাটি খুলে। তাতে লেখা বইটির নাম আসলে - “গোষ্ঠিশাসনের তত্ত্ব ও প্রয়োগ”, লেখক ইমানুয়েল গোল্ডস্টেইন। স্মিথ আঠা লাগানো দ্বিতীয় পাতাটি খুলে পড়তে থাকে -
“পার্টির মৌলিক তত্ত্ব অনুসারে - যুদ্ধটা সত্যি না মিথ্যা তাতে কিছু আসে যায় না। যুদ্ধটা যদি সত্যিও হয়, সেই যুদ্ধে বিজয় অসম্ভব। যুদ্ধটা করা হচ্ছে জেতার জন্যে নয়, বরং চিরকাল সেটা চালিয়ে যাওয়ার জন্যে। আধুনিক যুদ্ধের মূল লক্ষ্য হলো উৎপাদনকে ধ্বংস করা। শ্রেণীবিভাজিত সমাজকে টিকিয়ে রাখার একমাত্র উপায় হলো দারিদ্র আর অজ্ঞতাকে জিইয়ে রাখা। সর্বদাই যুদ্ধাবস্থা জারি রাখা হয় যাতে সমাজ অনাহারের খাদ্যাভাবে জর্জরিত থাকে। শাসক গোষ্ঠির চাপিয়ে দেয়া এই যুদ্ধটা ইউরেশিয়া বা পূর্বেশিয়ার বিরুদ্ধে নয়, বরং তার নিজের জনগণের বিরুদ্ধে, সমাজের কাঠামোটাকে অক্ষত রাখার নিমিত্তে।”
স্ক্রিনে ভেসে আসতে থাকে, এক বাগ্মী পার্টি নেতা পূর্বেশিয়ার যোদ্ধাদের বিষোদ্গার করছে। তাদের নিশ্চিহ্ণ করার শপথ নিতে বলছে। কিন্তু পূর্বেশিয়া না িচরবন্ধু ছিলো, ইউরেশিয়া ছিলো চিরশত্রু? হঠাৎ এই মুহূর্ত থেকে পূর্বেশিয়া হয়ে গিয়েছে চিরশত্রু! আর বলা হচ্ছে ইউরেশিয়া হচ্ছে ওশিয়ানিয়ার চিরবন্ধু রাষ্ট্র। চিরকালই তারা ওশিয়ানিয়ার বন্ধু ছিলো। হঠাৎ এতো বড় ইতিহাসটা সম্পূর্ণ পাল্টে গেলো। ইতিহাস প্রতি নিয়ত পুনর্লিখিত হচ্ছে। সত্যিকার ইতিহাস আসলে কোনটা, কার সাথে যুদ্ধ হচ্ছে, যুদ্ধ আদৌ হচ্ছে কিনা সেটাই বলা মুশকিল।
মুভিটা জর্জ অরওয়েলের একই শিরোনামের বিখ্যাত উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি। যদিও এই গল্পটা পুরোটা বলে দেওয়ার মাধ্যমে গল্পটিকে ফুরিয়ে দেওয়ার তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই, তবু এখানে থামছি। গল্পের ভয়াবহতম অংশটা পুরোটাই এখনো বাকি। তবে যা বলতে চেয়েছিলাম, তার পুরোটাই বলা হয়ে গেছে।
গুগলে কী কারণে মুভিটা আছে জানি না, তবে নিচের লিংক থেকে ছবিটা দেখা না দেখা আপনার ইচ্ছার বেশি কিছু মনে হয় না।
http://video.google.com/videoplay?docid=-5464625623984168940
শেষ করছি একজন পার্টি মেম্বারের সাথে স্মিথের একাট কথোপকথন দিয়ে -
মেম্বার: আমার হাতে কয়টা আঙুল, স্মিথ? (চারটা আঙুল বের করে)স্মিথ: চারটা। নাকি চাচ্ছো শুনতে পাঁচটা? পার্টি যদি পাঁচটা শুনতে চায়, তাহলে পাঁচটা। কিন্তু আমি কী করে ভুল বলবো, যখন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি চারটা? দুইয়ে দুইয়ে হয় চার!
মেম্বার: মাঝে মাঝে, স্মিথ, মাঝে মাঝে। সবসময় না। কখনো তারা পাঁচ হয়।
কখনো তারা হয় তিন। কখনো তারা একসাথে সবগুলোই।
অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত, এর কোনটাই তার নিজের অধিকারবলে বিরাজ করে না।
বাস্তবতা বিরাজ করে মানুষের মনে।
তবে ব্যক্তির মনে নয়।
ব্যক্তির মন ত্রুটিপূর্ণ, দুর্বল ও নশ্বর।
বাস্তবতা বিরাজ করে পার্টির মনে, যেটা গোষ্ঠিগত, বহু নির্মিত ও অবিনশ্বর!
ছবি কৃতজ্ঞতা: উইকিমিডিয়া
মন্তব্য
বেশ লিখেছেন, দেখতেই হবে। তবে বইটা এখনো শেষ করা হয় নি, কেবল সংগ্রহ করেছি।
মাঝে মাঝে ভেবে অবাক হয়, অরওয়েল যদিও সোভিয়েত সমাজব্যবস্থা মানে স্ত্যালিনিক কম্যুনিজম নিয়ে এই উপন্যাস লিখেছেন, কিন্তু আধুনিক বিশ্বে অনেক মুক্ত দেশেও যেন সেই বিগ ব্রাদার ফিরে এসেছে, যে খবরদারী করেই চলেছে আমাদের অজান্তে।
facebook
"অর্থনীতিকে চাঙা রাখার জন্যে যুদ্ধ করা ভালো" বুলিটার কথাই চিন্তা করেন। কতো দশক ধরে পশ্চিমের মানুষ বুঁদ হয়ে আছে এই মন্ত্রে। যুদ্ধ যুদ্ধ খেলে দেশের মনস্তত্ত্বকে ব্যস্ত রাখা হচ্ছে। নব্য গোষ্ঠিবাদীদের অন্যায্য মুনাফা নিশ্চিত করা হচ্ছে।
কী অসাধারন কনসেপ্ট।
দারুন।
দেখতেই হবে।
পোষ্টের জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ।
অরওয়েলের মূল বইটি পড়িনি আগে। 'এনিমেল ফার্ম' পড়েছিলাম। তবে রে ব্রাডবুরির 'ফারেনহাইট ৪৫১' র সাথে '১৯৮৪' র বেশ একটা মিল পাচ্ছি। হয়ত, দুটিই সরকারী সেন্সরশীপ আর dystopdystopiadystopiadystopiadystopiandystডিস্টোপিয়া নিয়ে লেখা বলে।
ম্যাপে ব্রিটিশ আইলস গুলো ইউরেশিয়ার অন্তর্গত না হয়ে ওশেনিয়ার অন্তর্গত দেখে মজা পেলাম।
ফারেনহাইট ৪৫১ ঘাঁটা লাগবে।
মুভিটা দেখিনি, দেখার ইচ্ছা রইল (ঢাকা থেকে ডাউনলোড করে পোষাবে না, দোকানে পাই কিনা দেখতে হবে)। ১৯৮৪ বইটাও পড়িনি। তবে এর (এবং অরওয়েলরই 'ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড'-এরও) কথিত প্রোটোটাইপ ও প্রিকার্সার, যে বই থেকে নাকি অরওয়েল অণুপ্রাণিত হয়েছিলেন, ইয়েভ্গেনি জামিয়াতিনের সেই "উই" বইটা পড়েছি। এটাও মুভি হয়েছে জার্মান ভাষায়। মজার ব্যাপার হল, এই বইটা রাশান ভাষাতেই লেখা। এছাড়া আর্থার কোয়েসলারের "ডার্কনেসস এট নুন"-ও ইউটোপিয়ান সর্বাত্নকবাদের বিরুদ্ধে এক অসাধারণ ক্রিটিক (যদিও তা অরওয়েল বা জামিয়াতিনের ডিস্টোপিয়ান ঘরাণার উপন্যাস না)। চাইলে পড়ে দেখতে পারেন।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ও কমিউনিজমের (বিশেষত স্ট্যালিনিস্ট, যদিও শেষ পর্যন্তই এর প্রভাব অনেকখানিই ক্রিয়াশীল ছিল) ) পতনের পর থেকে মতাদর্শগত বা রাজনৈতিক সর্বাত্নকবাদ এখন আর তার সেই সর্বগ্রাসী রূপে হয়তো অস্তিত্বশীল নেই বা মেইনস্ট্রীমে প্রোমোটিত নয় (ধর্মতন্ত্র বাদ দিলে), কিন্তু চারদিকে তাকালে মনে হয় এখন তা নানা ধরণের ইস্যুভিত্তিক সর্বাত্নকবাদে ছোট ছোট খণ্ডে বিবর্তিত হয়েছে! এধরণের মিনি সর্বাত্নকবাদ বা কর্তৃত্ববাদগুলি প্রায় সেই একই ধরণের আইদার-অর/ব্ল্যাক-এণ্ড-হোয়াইট/উইথ-অর-এগেইন্সট-আস কর্তৃত্ববাদ আর রেজিমেন্টশনের চর্চায় সচেষ্ট, কখনো প্রকাশ্যে বা স্পশটতই, আবার কখনও অতি সুকৌশলে এমনকি খোদ সর্বাত্নকবাদের (সেটা কোন দেশ, মতাদর্শসহ অনেককিছুই হতে পারে) বিরুদ্ধেই জিহাদ ঘোষণার নামে, অনেকসময় সর্বাত্নকবাদের উলটো অবস্থার একটা স্বঘোষিত দারুন চাকচিক্যময় ছদ্মাবরণে ।
বৃহৎ স্কেলে বুশিজম এর এক উদাহরণ, আধুনিক জাতীয়তাবাদে বহু ক্ষেত্রেই এই কর্তৃত্ববাদের প্রভাব রয়েই গেছে ২য় বিশ্বযুদ্ধপূর্ব চেহারায় না হলেও। অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র স্কেলে তো অনেক উদাহরণ।
বাঙালি/বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ আর আইডেন্টি-পলিটিক্স নিয়ে পড়তে গিয়ে অনেক আগে একটা চমৎকার উদ্ধৃতি পেয়েছিলাম, যা হয়তো এখানে পুরোপুরি অফটপিক হবে না -
(লেখকের নাম মনে নেই)
ব্যক্তির এই multi-dimensionality বা বহুমাত্রিকতা (?), বিভিন্ন চেহারার গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনে এর স্বীকৃতি ও অস্বীকৃতি এবং সেই স্বীকৃতির সীমা ও অস্বীকৃতির স্বরূপ প্রসঙ্গে আমার ব্যপক আগ্রহ রয়েছে। লিখবেন এনিয়ে?
****************************************
ডাইকোটোমি মানুষের চিন্তার উপায়ের যেন প্রধান শর্তের একটা। এভাবে ভাবতে মানুষের সুবিধা। যে জিনিসে অনেক মাত্রা আছে, সেটা বুঝতেও মানুষকে আগে এক্সট্রিম রূপ দুইটা বুঝে নেওয়া লাগে। তবে যেভাবে ভাবলে মানুষের সহজ হয়, সেই মতে বাস্তবে প্রয়োগ করলে যে লাভ হয় তা কিন্তু না। ফলে বাস্তবে মাত্রাভেদের অস্তিত্বকে স্বীকার করার প্রয়োজন পরে। আর এমন কি মাত্রাভেদও একমাত্রিক চিন্তা। সরলরেখা যেমন। সরল রেখার সীমিতকরণ হলো ডাইকোটোমি, হয় রেখার এই মাথা, না হলে রেখার অন্য মাথা। মাঝে যে আরো বিন্দু আছে, সেটা অস্বীকার করা। আবার সরলরেখা হলো তলের সীমিতকরণ। তল হলো ঘনবস্তুর সীমিতকরণ। মানে কেবল মাত্রাভেদই না, ডাইমেনশান ভেদও আছে। বহু বহু ডাইমেনশান আছে। প্রত্যেকটা ডাইমেনশানের আবার আছে মাত্রাভেদ।
যেমন মানুষ নাস্তিক আস্তিক আলাদা করে। কিন্তু এর যে মাত্রাভেদ, প্রকারভেদ, তা অস্বীকার করে। আবার নাস্তিক আস্তিকেও কিন্তু কাহিনী শেষ না। কিছু মানুষ অন্যের উপর জোর করে, কিছু মানুষ করে না। জোর করায় দেখবেন অনেক আস্তিক নাস্তিক ভাই ভাই। জোর করার বিষয় নিয়ে খালি তাদের মতপার্থক্য। এরকম আর কি।
তো, আপনি তাহলে আর লিখবেন না ঠিক করসেন?
চমৎকার বলসেন।
লিখব না - এমন কিছু তো ঠিক করি নাই, কিন্তু আমি তো নেহাতই আম পাব্লিক। এসব বিষয়ের উপর লেখার মত দখল নাই, যট্টুক বুঝি তা বেসিক কমন সেন্স দিয়ে বুঝি। তার থেকে খুব বেশি কিছু না। তাও কংক্রীট বাস্তব কনটেক্সটে/ইস্যুতে ক্ষুদ্র আকারে, যখন তা আমার বাস্তব জীবনকে স্পর্শ করে, বৃহৎ বা তাত্ত্বিক লেভেলে না। লেখার জন্য আরও পড়াশোনা লাগবে, সময় ও প্রস্তুতি লাগবে। আপনি হয়ত আমাকে দুয়েকটা বইপত্র রেকমেণ্ড করে সাহায্য করতে পারেন।
আমার আগ্রহের ফোকাসটা হচ্ছে, ব্যক্তিকে যেহেতু গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনেই বেঁচে থাকতে হয় বেঁচে থাকার মৌল প্রয়োজনে, সেক্ষেত্রে ব্যক্তিকতা আর গোষ্ঠীজীবনের ন্যূনতম এসেনশিয়াল সংযোগস্থলগুলি কোথায়, ব্যক্তিকে কোথায় ও কতটুকু গোষ্ঠীত্বের দায় বা দাম মেটাতে হবেই আর কোথায় তা না মেটালেও চলবে। গোষ্ঠী (বা গোষ্ঠীর নামে) ব্যক্তির ব্যক্তিকতার উপর কতটা এনক্রোচ করতে পারে গোষ্ঠীভূক্ত সব ব্যক্তির সমস্বার্থে বা ব্যক্তিকতার স্বার্থেই (কিম্বা অন্য কোন স্বার্থে), বা কতটুকু পারে না।
গ্রীনস্প্যানদের ঐ লেখার অন্যতম বক্তব্য হচ্ছে (আমি এখানে সরলীকরন করছি), একটা সুস্থ কার্যকরী সমাজবদ্ধ জীবনের জন্য সমাজের সব সদস্যদের মধ্যে বাস্তবতা এবং মানবতাবোধ সম্পর্কে একটা ন্যূনতম শেয়ার্ড উপলব্ধি থাকা প্রয়োজন। সেটা না থাকলে ঐ সমাজ ডিসফাংশনাল হয়ে পড়ে এবং শেষমেশ তা সমাজ তো বটেই - ব্যক্তি ও ব্যক্তিকতার জন্যও অনেক বড় বিপদ ডেকে আনে। এটা এখানে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই, আপনি ওদের মূল প্রবন্ধটা বা আরও ভাল হয় তাদের পূর্ণাঙ্গ বই - The First Idea (১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ) পড়ে দেখতে পারেন (এটা আমি পড়ি নাই অবশ্য, যদিও স্টুয়ার্ট শঙ্করের সাথে ইমেল বিনিময়ের সময় উনি আমাকে মনোগ্রাফটা পড়ার চেয়ে বইটা পড়ার জন্যই তাগিদ দিয়েছিলেন)।
কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে ঐ শেয়ারড কতটুকু হবে বা হওয়া প্রয়োজন এবং শেয়ারড ও আনশেয়ারড অংশের মধ্যে নেগোসিয়েশন হবে কিভাবে।
আপনি আস্তিক/নাস্তিকের উদাহরণ দিলেন। আমিও এখান থেকে একটা উদাহরণ দেই। ধর্মকারী আস্তিকের একদল সবসময় শুধু কোন ধর্মে আপনি বিশ্বাস করবেন শুধু তাই না, কিভাবে করবেন সেটা নিয়েও জোরাজুরি করেন। চর্চায় ও অন্তর্গত বিশ্বাসে প্রত্যেকটা মাইনিউট ডিটেলেই তাদের সাথে আপনাকে কনফর্ম করতে হবে। এখানে আপনার নিজস্ব কোন ইন্টারপ্রিটেশনের স্কোপ নেই, মন নেই, ইমাজিনেশন নেই, কল্পনা নেই, ব্যক্তিক চিন্তা বা ব্যক্তিগত কোন জগৎ বা মানসিক প্রাইভেট স্পেসটুকু পর্যন্ত নেই বা তার লেজিটিমেসির স্বীকৃতি দেয়া হয় না। এ যেন জামিয়াতিনের "We" উপন্যাসের কাঁচের শহরে বসবাসের মত বা ১৯৮৪-র 'থটক্রাইম'-এর মত। আবার নাস্তিকদের মধ্যেও একদল আছেন যারা ব্যক্তিকে এই ব্যক্তিক চিন্তা, ব্যক্তিগত জগৎ বা প্রাইভেট স্পেসটুকু এলাও করতে চান না। তাঁরা যেহেতু ইহলৌকিক জীবন নিয়ে কনসার্ন্ড এবং ধর্ম বা ঐ জাতীয় বিশ্বাসের লেশমাত্র যেহেতু ইহলৌকিক সমাজ জীবনের জন্য ক্ষতিকর, এবং ব্যক্তি যতই বলুক বা যতই চেশটা করা হোক সেকুলার আইনকানুন দিয়ে ঐ প্রাইভেট/পাব্লিক পৃথকীকরণের - ব্যক্তিক চিন্তা বা প্রাইভেট স্পেসের কোন না কোন প্রভাব পাব্লিক লাইফে পড়বেই পড়বে (তাদের মতে), এবং যেহেতু সেরকম কোন প্রভাবের লেশমাত্রও গ্রহনযোগ্য নয় - সেহেতু স্রেফ চার্চ-ও-স্টেট বা পাব্লিক/প্রাইভেট সেপারেশনমূলক সেকুলারিজম তাঁদের কাছে যথেষ্ট নয়, ব্যক্তির ব্যক্তিজগত বা প্রাইভেট স্পেসটাও তাদের কাছে ইনটলারেবল এবং আস্তিকের মতই সবরকম 'থটক্রাইম' ধোলাইপূর্বক কনফর্মিটি আনয়ন বা রেজিমেন্টেশনের জন্য নানাবিধ উপায়ে কোয়ের্শনের বৈধ ক্ষেত্র। আমি যা বুঝেছি তাই বললাম, ভুলও হতে পারে। তো এইটাও তো আমার কাছে একরকম ফ্যাসিস্টিক ডিস্টোপিয়া মনে হয়।
প্রশ্ন হচ্ছে, ধরুন, এই ক্ষেত্রে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীতে নেগোসিয়েশনটা কেমন হবে - বাস্তবতা এবং মানবতাবোধ সম্পর্কে কার্যকরী বা ফাংশনাল গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনের প্রয়োজনে একটা ইফেক্টিভ-এনাফ ন্যূনতম শেয়ার্ড উপলব্ধি বাদ না দিয়েই? কার পরিধি ও বিস্তৃতি কোনদিকে কতটুকু হবে, এবং সে সম্পর্কে ঐক্যমত্যও প্রতিষ্ঠা হবে কিভাবে?
এই প্রশ্নগুলি শুধু আস্তিক/নাস্তিক নিয়েই নয় - সংস্কৃতি, রাজনীতি, জাতীয়তাবাদ, দেশ, দেশপ্রেম - ইত্যাদি প্রসঙ্গেও এসে যায়।
পৃথিবীর সেরা সেরা মাথারা এইসব নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন ও লিখে কুল পাচ্ছেন না, আমার সেখানে কিছু লিখতে যাওয়াটা আমার কাছে ধৃষ্টতারই সামিল মনে হচ্ছে। তাও যদি ঐ সব মাথাদের কিছু প্রথমসারির বইপত্তর পড়া থাকত, তাহলেও নাহয় একটা কথা ছিল। কিন্তু তাঁদের বা তাঁদের লেখালেখির নামধামও আমি জানি না, আর জানলেও ঢাকায় বসে সেগুলি পাওয়ার সুযোগও খুব সীমিত। সময়-শক্তির ব্যাপারটা তো আছেই। তবে সময় ও ন্যূনতম প্রস্তুতিসাপেক্ষে লেখার ইচ্ছা থাকলই।
তবে না লিখলেও, আরেকটা একটু অন্যপ্রসঙ্গে যে বাস্তব কারনে (অনেকের কাছে হয়তো খুব তুচ্ছ মনে হবে) এই বিষয়গুলি নিয়ে ভাবনা এড়াতে পারি না আমজনতার একজন হিসেবে, তা হল - ঢাকায় থাকি এবং এখানকার উচ্চশ্রেণী ও শ্রমজীবী উভয়শ্রেণী মানুষের সাথে যৎসামান্য অন্তরঙ্গতা থাকার ফলে আমার মনে হয়েছে, এখানে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য সৃষ্টি হওয়ার পাশাপাশি (যা অর্থনীতিবিদেরা প্রায়ি আলোচনা করেন) বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে বাস্তবতা এবং মানবতা সম্পর্কে সবরকম শেয়ার্ড উপলব্ধি অতি দ্রুত উপে যাচ্ছে বা অনেক আগেই গেছে। এর কারন শুধুই অর্থনৈতিক নয়, যদিও অর্থনীতি ফেনোমেননটাকে অনেকদিন ধামাচাপা দিয়ে রাখতে পারে বা ড্রামাটিকালি সামনেও নিয়ে আসতে পারে। কিন্তু এই বাস্তবতা এবং মানবতা সম্পর্কে শেয়ার্ড উপলব্ধির অভাব বা এর মধ্যে ভাঙণের ফলাফলটা ভয়ঙ্কর। যার ছোট্ট একটা নমুনা, আমার ব্যক্তিগত ধারণা, আমরা বিডিয়ারের ঘটনায় দেখেছি। আপনি হয়তো অবাক হবেন (বা হবেন না) শুনে, এই ঘটনা নিয়ে আমি যে কয়জন শ্রমজীবি মানুষের সাথে সেসময় আলাপ করেছি - প্রায় সর্বক্ষেত্রেই লক্ষ্য করেছি এই পৈশাচিক ঘটনায় ভিক্টিমদের প্রতি মানবিক একাত্নতাবোধ ও এম্প্যাথির প্রবল অভাব, পারপেট্রেটরদের প্রতি কোন একটা লেভেলে উল্লেখযোগ্য একাত্নতাবোধ, বর্বরতা বা অমানবিকতার ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য রিয়্যাকশন বা অনুভূতি ও উপল্বধির ঘাটতি বা ডিসকানেক্ট এবং সর্বোপরি বাস্তবতা-বোধেও ডিসকানেক্ট। সেই সময় এই জিনিষটা আমাকে যথেষ্ট বিবমিষাগ্রস্ত করেছিল, কিন্তু এরপরে প্রতিটি পদেই এই ডিসকানেক্ট আমি অহরহ দেখছি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এগুলি প্রকাশ্যে, সঙ্ঘবদ্ধভাবে বা এলিট মেইনস্ট্রীমের রাডারে ধরা পড়ার মত জোরালো ভাবে এখনও হয়তো আর্টিকুলেটেড হয় না, কিন্তু জিনিষটা তো বাড়ছেই। এই রকম মানুষেরাই একসময় গোষ্ঠীবদ্ধতার নতুন কোন - এক বা একাধিক - সংগা খুঁজে নিতে পারে এবং নিচ্ছেও, যা আমাদের মেইনস্ট্রীম এলিট-আর্টিকুলেটেড গোষ্ঠীবদ্ধতার সংজ্ঞা, ক্যাচফ্রেইজ, স্লোগান বা পতাকাতলে একসময় আর বাঁধা পড়বে না (জঙ্গী মৌলবাদের ক্ষেত্রে সেটা পড়ছেও না)। এবং সেটা কারও জন্যই ভাল হবে না। আর এই মানবতা ও বাস্তবতার উপলব্ধিতে ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে, মানুষে মানুষে, শ্রেণীতে-শ্রেণীতে ডিসকানেক্ট "ব্যক্তিক চিন্তার" জগতকে অবধারিতভাবে ও ক্রমাগতভাবে সংকুচিত করতে থাকে, অন্তত তার লালন বা বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশটাকে প্রবলভাবে প্রতিকুল করে তুলে।
এইদিক থেকে চিন্তা করলে "গোষ্ঠিক চিন্তার"-ও হয়তো প্রয়োজন আছে, প্রয়োজন আছে কিছু মনস্তাত্ত্বিক ও আদর্শগত কনসেন্সাস। কিন্তু সেটা কিভাবে অর্জিত হবে? ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মধ্যে সেই সমঝোতাটা কিভাবে ও কেমন হবে? আমি প্রথমে যেই ব্যক্তিক চিন্তা, প্রাইভেট স্পেস, multi-dimensionality ও নেগোসিয়েশন দিয়ে শুরু করেছিলাম, এই শেষের ব্যক্তিক চিন্তা-স্পেস-নেগোসিয়েশনটা তার থেকে অনেক দুরবর্তী মনে হতে পারে হয়ত - কিন্তু আমার ধারণা তা হয়ত নয়। গ্রীন্সপ্যানরাও মনে হয় অনেকটা সে বিষয়েই আলোচনা করেছেন।
যাক, এই মুহুর্তে আমার আর আস্ত একটা পোস্ট লেখার কোন প্রয়োজন নেই মনে হয়। বিক্ষিপ্ত চিন্তা বা প্রশ্নগুলি নিয়ে এক কমেন্টেই আপাতত সব সেরে ফেললাম!
****************************************
পড়াশোনা তো লাগে। কিন্তু আবার লাগে’ই’ না কিন্তু।
অনেক কিছুই পড়বেন, কিন্তু চিন্তা করবেন তো নিজের মতো। যা আপনি করছেনও। সেটা বলাটাকেই তো লেখা বলে। লেখা কমনসেন্স থেকেই হওয়া উচিত। পড়াশোনা হয়তো সেই কমন সেন্সটাকে গঠন করছে। ফলে কমনসেন্সের উপর আস্থা হারায়েন না।
এটা আমার কাছে একটু ঘোলাটে মনে হলো। আমি আপনার লেখাটার ঠিক এখানেই আটকেছিলাম। এই উপলব্ধিটা ঠিক কতোটুকু গোষ্ঠির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য? একটা ক্ষুদ্র গোষ্ঠি? একটা গোটা গ্রামের মানুষ? গোটা শহর? গোটা দেশ? গোটা মানবতা? ক্ষুদ্র গোষ্ঠির জন্যে কথাটা মানা যায়, এবং ব্যাপারটা অলরেডি প্রযোজ্যও বলা যায়। যেকোনো ক্ষুদ্রগোষ্ঠির মধ্যে বাস্তবতা ও মানবতাবোধের একটা ন্যূনতম শেয়ার্ড উপলব্ধি আছেই দেখতে পাবেন। কিন্তু ঢাকা শহরের মধ্যবিত্ত আর শ্রমজীবী মানুষের বাস্তবতাবোধকে মিলাবেন কীভাবে? জরুরি কতোটুকু?
আর ভিন্ন বাস্তবতাবোধ তো চিন্তার জন্যে কাম্য বলেই মনে করি। চিন্তার অগ্রসরতার জন্যে বৈচিত্র্য আবশ্যক। এটা সত্যিকার অর্থে বহু কিছুর অগ্রসরতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলতে পারেন। সবার একটা মিনিমাম শেয়ার্ড উপলব্ধি আশা করাটা বরং আধিপত্যমূলক ভাবনা মনে হলো। কিংবা সম্পূর্ণটা বুঝি নি।
আরেকটা অল্টার্নেটিভের কথা চিন্তা করতে পারেন। Voluntary interaction। প্রতি দুটি মানুষের মধ্যকার যেকোনো বিনিময় হবে স্বেচ্ছায়। কোনো বিনিময় বা আদান প্রদানে বলপ্রয়োগ থাকবে না। হতে পারে এটাই সেই ন্যূনতম শেয়ার্ড উপলব্ধি যেটা থাকা প্রয়োজন। তবে সেটাও আপনি বলপ্রয়োগ করে সবার মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে পারেন না। ফলে সবাই এটা মানবে না। অনেকেই বল প্রয়োগ করতে পারে। কিন্তু অন্তত কিছু মানুষ যদি থাকে যারা এই প্রিন্সিপ্যালটাতে একমত হবে, তারা এই ধারণাটা ছড়াতে পারবে। এতে যেসব গোষ্ঠিতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদ রয়েছে, তাদের কর্তৃত্বে চিড় ধড়বে। কারণ তাদের যে মূলধন - তাদের কল্যাণ ও শুভকামিতায় মানুষের আস্থা - তাতে ঘাটতি পড়বে।
আপনি মনে হয় এই shared sense of humanity and reality বলতে অন্যকিছু বুঝেছেন। গ্রীন্সপ্যানরা এটা বলতে কোন মতামত বা মতবাদগত ঐক্য বোঝাননি। বরং বৈচিত্র্যকেই তারা উৎসাহিত করেছেন। "প্রতি দুটি মানুষের মধ্যকার যেকোনো বিনিময় হবে স্বেচ্ছায়। কোনো বিনিময় বা আদান প্রদানে বলপ্রয়োগ থাকবে না।" -এটা তাদেরও চিন্তার একদম মৌলিক একটা কেন্দ্রবিন্দু। ফলে এই বাক্যটা মনে হয় না কোন আধিপ্ত্যমূলক ভাবনা থেকে এসেছে। আপনি আমার ঐ পোস্টের একদম প্রথম ও শেষ অনেচ্ছেদ দুটি (১ ও ২২) পড়ে দেখতে পারেন। একটু হয়ত পরিষ্কার হবে (আসলে পুরো লেখাটা না পড়লে তারপরও কনফিউশন থাকতে পারে)। দৌড়ের উপ্রে আছি বলে এর বেশি এখন লিখতে পারয়াম না। হয়ত আলাদা কোন পোস্টে লিখব পরে।
****************************************
ব্রেভ নিউ ওয়ার্লডটা বোধহয় অ্যালডাস হাক্সলির লেখা। হাক্সলি একসময় অরওয়েলের শিক্ষক ছিলেন বলে পড়েছিলাম কোথাও। অরওয়েল ক্যামন করে জানি স্বৈরশাসক আর একনায়কদের চিন্তাভাবনার একেবারে গোড়ায় হাত দিতে পেরেছিলেন, ১৯৮৪ সে জন্য এখনও পুরনো হয়ে যায়নি, ভবিষ্যতে হবে সে সম্ভাবনাও কম। এরশাদ সাহেবের আমলে স্কুলের নিচু শ্রেনীর পাঠ্যবইতে "পাকিস্তানী সৈন্য" এর বদলে "হানাদার বাহিনী" শব্দযুগল থাকতো; আমার কাছে এটা নিউস্পিকের একটা উদাহরণ মনে হয়। আর যেভাবে পাঁচবছর পরপর জামাত+বিএনপি+জাপা বা আওয়ামীলিগ+জামাত+জাপা বা জামাত+জাপা+ইসলামীজোট ইত্যাদি পারম্যুটেশন আর কম্বিনেশন দেখতে পাই তাতে ওশেনিয়া ইউরেশিয়া আর ইস্টএশিয়ার কথাই মনে পড়ে যায়।
আমার খুব প্রিয় বই এবং লেখক। লেখাটার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।
হুমম, শব্দের দখল চলতেই থাকে।
আপনাকেও ধন্যবাদ।
দারুণ তো... দেখতে হবে
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
সিনেমাটা দেখেছি কিন্তু পার্টি বস্তুটাকে যেভাবে দেখানো হয়েছে সেটাকে আমার প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন বা বর্তমান চিনের সাথেই সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে হয়েছে।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
ডিস্টোপিয়া অঙ্কনে অরওয়েলের জুড়ি নেই। ১৯৮৪ বইটার আবহ এতই বিষন্নকারক ছিল যে পড়া শুরু করেও শেষ করতে পারি নাই, আবার ধরতে হবে। এনিমেল ফার্মের শেষের প্যারাগ্রাফটা এখনও কানে বাজে, চোখের সামনে এখনও যেন পরিস্কার দেখতে পাই।
নতুন মন্তব্য করুন