মোহাম্মদ জবুথবু হয়ে ল্যাবের সোফায় বসে আছে। ঝিমুচ্ছে। কানাডা সরকার ইরানের দূতাবাসকে তাড়িয়ে দিয়েছে। এমন দুঃসময়ে বেচারার ইরানী পাসপোর্ট হারিয়েছে, আরো হারিয়েছে কানাডার স্টাডি পারমিট। বাস্তবতার কড়াঘাতে সে মূহ্য।
আমি একটা ফোনের জন্যে অপেক্ষা করছি। এই ঘনঘোর দুঃসময়ে মোহাম্মদ নিশ্চয়ই আগের মতো বিনা নোটিশে দার্শনিকতা কপচানো শুরু করবে না। এই ভরসায় সোফার অন্য প্রান্তে গিয়ে বসলাম। মোহাম্মদের ক্লান্ত বন্ধ চোখটা মুহূর্তে খুলে গেলো। ধীরে ধীরে ঘাড়টা ঘুরালো আমার দিকে। আমি মুখে হাসি নিয়ে ভয়ে ভয়ে তাকালাম।
“তোমার কাছে আমার খুব গভীর কিছু প্রশ্ন ছিলো। তুমি যুক্তি দিয়ে কথা বলো, গভীরে চিন্তা করতে পারো। তাই তোমার সাথে আমার কথা বলা দরকার।” মোহাম্মদ ধীরে ধীরে বলে ফেললো।
আমি মনে মনে বললাম, হোলি ফাক!
শঙ্কিত চোখে বললাম, “কী হয়েছে মোহাম্মদ?”
“আমি ভীষণ ডিস্টার্ব্ড। মাঝে মাঝে সুইসাইড করতে ইচ্ছে করে।” মোহাম্মদ বলে।
কারো সুইসাইড করতে ইচ্ছা করলে আমার পলিসি হচ্ছে মোটেও পাত্তা না দেওয়া। বরং পারলে সুইসাইড করতে চাওয়ার জন্য আনন্দ উদ্যাপন করা। সেলিব্রেট করা। বলা, হুররে মোহাম্মদ, ইউ মেইড এ গ্রেইট ডিসিশন!
কিন্তু এর সব পণ্ড করে দিলো লিয়া। পরদিন তার মাস্টার্স ডিফেন্স। কষে প্রেজেন্টেশন তৈরি করছে। এর মধ্যে মরার উপর খাড়ার ঘা। ইরান-আগত এক মোহাম্মদ সুইসাইডের হুমকি দিচ্ছে! হয়তো ভাবছে, ধুম করে যদি এখন একটা বোমা ফাটে আর আগামীকাল যদি আর না আসে? জাস্ট কিডিং।
লিয়া তরাক করে চেয়ার থেকে উঠে বললো, “কেনো, মোহাম্মদ? কী হয়েছে?”
মোহাম্মদ একটু নড়ে চড়ে বসলো এবার। আসর জমছে। জবুথবু হয়েই ধীরে ধীরে বলতে থাকলো, “আমি জীবনের মূলনীতিটাকে খুঁজছি। যতোই খুঁজছি, ততোই সবকয়টা প্রচলিত নীতির অর্থহীনতা দেখে অবাক হচ্ছি। হতাশ হচ্ছি।”
লিয়া কিছুক্ষণ মাথা নাড়লো। আমি ঠিক ঠিক বলতে পারি যে সে হিসাব করে দেখার চেষ্টা করছিলো যে পরের দিন তার মাস্টার্স ডিফেন্স হবার সম্ভাবনা এখনও কতোটুকু বাকি আছে। স্টিল কিডিং!
“তোমার এই খোঁজাখুঁজিতে তাহলে গুডলাক, মোহাম্মদ।” বলে লিয়া আবার ফেরত গেলো। হয়তো সে নিরাপদ আছে বুঝতে পেরেছে। হু নোজ?
যা হোক। এবার মোহাম্মদের শিকার আমি একলা।
মোহাম্মদ বলতে থাকলো - “যেমন, এই যে মহানবীর ভিডিও নিয়ে যা ঘটছে। একদিক দিয়ে ভাবলে, এর জন্যে প্রতিবাদ করার কী আছে? মানুষের কি যা খুশি বলার অধিকার নেই? আবার মুসলমানদের দিক থেকে চিন্তা করলে, তাদের অনুভূতিতে আঘাত করলে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার অধিকার কি তাদের নেই?”
“তার জন্যে মানুষ খুন করে ফেলা যায় কি?” আমি জিগ্গাসিলাম।
“হুম। কিন্তু এটা কোন মূলনীতি থেকে আসলো যে অন্যকে খুন করা যাবে না?”
বিপদে পড়েছি। আমি লিয়ার দিকে তাকালাম। ওর কানে হেডফোন। ভাগ্গিশ!
বললাম, “এটাকে বলতে পারো নন-অ্যাগ্রেশন প্রিন্সিপল, অনাক্রমণের নীতি।”
“কিন্তু কে বললো অনাক্রমণের নীতি ভালো?”
বললাম - “এটা একটা অ্যাক্সিআম (axiom) বলতে পারো। প্রতিজ্ঞা বা স্বতঃসিদ্ধ। ফলে যেকোনো স্বতঃসিদ্ধের মতোই এটা আর্বিট্রারি বটে।”
এবার তার মুখে একটু সন্তুষ্টির হাসি ফুটলো। সকল স্বতঃসিদ্ধ আর্বিট্রারি বলছি। তার কালচারাল রিলেটিভিজম তুষ্ট হচ্ছে।
বললাম - “সকল স্বতঃসিদ্ধ যেহেতু আর্বিট্রারি, ফলে এর একমাত্র জাজ তুমি, তোমার ইন্সটিংক্ট। নিজের একেবারে ভেতরে যাও। সে কি নিজেকে আঘাত করতে চায়? ইন্সটিংক্টিভলি চায় না। খুব রেয়ার কেইস ছাড়া। যদিও গাণিতিক কিংবা বৈজ্ঞানিকভাবে বেঁচে থাকা আর মরে যাবার মধ্যে কোনো অ্যাবসল্যুট ভ্যালু জাজমেন্ট করা সম্ভব নয়, তথাপি আমাদের সেল্ফটা ইন্সটিংক্টিভলি বেঁচে থাকতে চায়। এটা নিয়ে তেমন সন্দেহ নেই। এটা প্রায় ট্রিভিয়ালি ট্রু। আর একই ভাবনাটা যদি অন্যদের উপর আরোপ করো, জেনারালাইজ করো, তাহলে সম্ভবত অনাক্রমণের নীতিতে আসা সম্ভব।”
“আর নীতিটা যেনো ঠিক কী বলে?” মোহাম্মদ জানতে চায়।
বললাম, “কোনো মানুষ বা তার গোষ্ঠি অন্যের শরীর বা সম্পদে আক্রমণ করতে পারবে না।”
“এটা কোনো টেকসই সমাজ হতে পারে কিনা আমার সন্দেহ আছে।” মোহাম্মদ সন্দেহ নিয়ে বলে।
“চলো তাহলে ঠিক উল্টো নীতিটার কথা চিন্তা করি। যেটা বলে যে - কোনো মানুষ বা তার গোষ্ঠি অন্য মানুষের শরীর বা সম্পদে আঘাত করতে পারে। এটা কি টেকসই? অবশ্যই সবাই এটা মানে না। সেটা আমাদের ভাগ্যই বলা যায়। কিন্তু সবাই যদি মানতো, তাহলে সমাজটা কীভাবে টিকতো? বরং বলা চলে অনেকে এটা মানে না বলেই সমাজ ধ্বংস হয় নি। অন্য দিকে ইতিহাস বলে যে - বড় বড় সমাজ সভ্যতা ধ্বংস হয়েছে অন্যের উপর আক্রমণের কারণে। সবাই আক্রমণ করে না। এটা সত্য। সবাই অনাক্রমণের নীতি মানে না, সেটাও সত্য। কিন্তু যখন চিন্তা ভাবনা করে নীতি বাছাই করতে যাবো, তখন তো সেটাই বেছে নেবো, যেটার অন্তত ন্যূনতম টেকসইত্ব আছে, যেখানে অন্যটার বিন্দুমাত্র সেটা নেই?” আমি বললাম।
মোহাম্মদের চোখ ছটছট করে নড়ছে। বললো, “অনাক্রমণের নীতি নিয়ে আমি সন্তুষ্ট হতে পারছি না। এটা অনেকটা বলতে চাচ্ছে যে সকল মানুষের অধিকার আছে আক্রমণ না করে যা খুশি করার। সব কিছু করা যাবে, যতক্ষণ অন্যের শরীর কিংবা সম্পদে আঘাত হচ্ছে না। তার মানে অন্যে আক্রমণ না করে যা খুশিই করছে, আমাকে তা মানতে হবে। তার অধিকারকে স্বীকার করতে হবে। এখন বলা হচ্ছে মতপ্রকাশের অধিকার আছে মানুষের। এর মানে কী? মহানবীকে গালাগাল করা কি মতপ্রকাশের অধিকার? মত প্রকাশের অধিকারকে মানতে হলে কি অন্যের গালাগাল করাকেও এখন আমাকে সেলিব্রেট করতে হবে?”
অনেকগুলো ব্যাপার একসাথে গুলিয়ে যাচ্ছে তার কথায়। সাবধানে বোঝার চেষ্টা করছি। অন্যের অধিকার স্বীকার করা বলতে সে কী বোঝাচ্ছে? মুখে স্বীকার করতে হবে? মুখে তো সে চাইলে অস্বীকারও করতে পারে। সেটাও তার বাক স্বাধীনতা। এবং অনাক্রমণের নীতি অনুযায়ী ব্যাপারটা সঙ্গতই আছে, যতোক্ষণ সে অন্যের শরীর বা সম্পদে আঘাত না করছে। তবে তাকে আরেকটু বলতে দিলাম।
সে একটু থেমে বললো, “আমার মনে হয় অন্যে কী বললো না বললো, সেটার অধিকারকে সেলিব্রেট করার কিছু নেই। অবস্থানটা এটা হওয়া উচিত নয় যে গালাগাল করাটা সঠিক। অবস্থানটা এটা হওয়া উচিত যে এর বিপরীতে অন্যকে আঘাত করাটা অনুচিত।”
“মানে শারীরিক আঘাতের কথা বলতে চাচ্ছো?” আমি জানতে চাইলাম।
“হ্যাঁ।” সে বলে।
এটাই তো অনাক্রমণের নীতি রে চান্দু!
তবে তার কথায় একটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট আছে উপলব্ধি করলাম। কোনটা ঠিক সেই তর্কের চেয়ে কোনটা বেঠিক সেই তর্ক সহজ এবং দরকারি।
বললাম, “তুমি একটা ভালো পয়েন্ট তুলেছো, মোহাম্মদ। আমরা যদি মানুষের মুক্তি চাই, তাহলে তার বৈধ কাজের পরিধিকে আমরা সসীম ও সীমিত করে তুলতে পারি না। কিন্তু যখন আমরা অধিকারের কথা বলি, যদিও আমাদের উদ্দেশ্য থাকে মানুষকে মুক্ত করা, তথাপি আমরা অধিকারকে এক অর্থে সীমিতই করি। আমরা বলি আমাদের অমুক জিনিস করার অধিকার আছে। আমাদের তমুক জিনিস করার অধিকার আছে। কিন্তু মানুষের কর্মকাণ্ডের পরিধি অগুণিত। আমরা সবকিছুর কথা তো বলতে পারবো না। একসময় থামতে হবে। এতে শেষে গিয়ে যা দাঁড়ায়, আমরা সসীম ও সীমিত সংখ্যক কিছু অধিকারকে সংজ্ঞায়িত করতে পারি, এবং বাদ বাকি আর যা কিছু আমাদের পক্ষে করা সম্ভব, যার সংখ্যা অসীম, তা কিন্তু নিষিদ্ধের তালিকায় চলে যায়। আমরা যদি মানুষের মুক্তি চাই, আমাদের উচিত নিষিদ্ধের একটা সসীম তালিকা করা। কী কী করা অনুচিত। তাহলে বাদ বাকী অঢেল অসীম সংখ্যক কর্মকাণ্ড মানুষ করতে পারে কিনা সে প্রশ্ন আর থাকে না। অনাক্রমণের নীতি কিন্তু তারই একটি রূপ। এটি বলছে অন্যের শরীর ও সম্পদে আক্রমণ করা যাবে না। বাদ বাকি কাজ নিয়ে উচিত অনুচিতের প্রশ্ন অবান্তর। মহানবীকে গালাগাল করাকে অধিকার মানার ব্যাপার নেই। তবে এর জন্যে কেউ যখন অন্যের শরীর বা সম্পদে আঘাত করে, তখন সেটাকে না মানার ব্যাপার আছে। মহানবীকে গালাগাল করাকে আমি ঘৃণা করতে পারি। প্রতিবাদ করতে পারি। অসন্তোষ প্রকাশ করতে পারি। কারণ এতে কারো শরীর বা সম্পদে আঘাত হয় না। কেউ আমাকে তা না করতে বাধ্য করতে পারে না। কিন্তু এ কারণে যখন আমি ধ্বংসে নামবো, সেটাকে ঠেকানোর তখন ভিত্তি থাকে।”
মোহাম্মদ বলে - “কিন্তু মহানবীকে গালাগালে আহত হয়ে যারা হত্যাকাণ্ড ঘটাতে চায়, তাদেরকে বাক স্বাধীনতার ঝাণ্ডা সমুন্নত রাখার নামে যখন ঠেকানো হয়, তখন ব্যাপারটা ঘোলাটে হয়ে যায়। হত্যা করা ঠিক নয়, কিন্তু মহানবীকে গালাগাল করা ঠিক তা-ও বা কে বললো? একদল গালাগালকারীদের হত্যা করতে চায়, আরেক দল গালাগালকারীদের অধিকার রক্ষার পক্ষে হত্যাকারীদের ঠেকাতে চায়। কোনোটাই তো সুবিধার পক্ষ না।”
“কিন্তু হত্যাকারীকে ঠেকাতে গালাগালকারীদের পক্ষ নিতে হবে কেনো?” আমি বললাম - “ তোমার কথা অনুযায়ীই কিন্তু কোনটা অধিকার সেটা নিয়ে আমাদের মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই। কোনটা করা ঠিক নয়, কেবল সেটা নিয়ে আমরা চিন্তিত থাকবো। হত্যাকারীকে ঠেকানোর জন্যে হত্যাকারী যে অন্যের শরীরে আক্রমণ করার নিষিদ্ধতাকে অতিক্রম করছে, সেটা জানা-ই যথেষ্ট। সে কী উদ্দেশ্যে সেটা করছে তা জানার প্রয়োজন হয় না। আর বাদবাকি যতো কাজ, যেখানে অন্যের শরীর ও সম্পদের ক্ষতি হয় না, সেগুলো বাকযুদ্ধের জন্যে উন্মুক্ত।”
মোহাম্মদ মাথা নাড়ছে। মোহাম্মদ মাথা নাড়ছে! এক বছর আগের নৈতিক জিঘাংসার সংহত গাণিতিক সিস্টেম বের করা মোহাম্মদ আজকে অন্যের শরীরের উপর যে-কো-নো কা-র-ণে আক্রমণ করার অন্যায্যতার ব্যাপারে একমত হয়ে মাথা নাড়ছে!
মোহাম্মদ বলতে থাকে - “তুমি ঠিকই বলেছো। আমাদের সসীম সংখ্যক অনুচিত জিনিসগুলোকে বের করা উচিত। তাহলে অসীম সংখ্যক জিনিস করার সুযোগ খোলা থাকে। কিন্তু ব্যাপারটা কী জানো? আমাদের সভ্যতা একটা অথোরিটারিয়ান শাসন ব্যবস্থা থেকে এসেছে, সেখানে সেটাই করার সুযোগ ছিলো যাতে রাজার সায় ছিলো। সে জায়গায় আমরা মুক্তির পথে এগুচ্ছি ধীরে ধীরে, এজন্যে আমরা গুনে গুনে অধিকারের তালিকা তৈরি করছি।”
“এবং এই তালিকা বাড়ছে।” আমি বললাম - “কিন্তু যেহেতু শূন্য অধিকার ও অসীম নিষিদ্ধের শাসন থেকে শুরু করেছি, একবারে আমরা অসীম অধিকার ও সসীম নিষিদ্ধের শাসনে যেতে পারি নি। ফলে আমরা যখন মুক্তির কথা বলি, তখন আমরা কোনটা নিষিদ্ধ কেবল সেটাকে বের না করে অধিকারগুলোকে ফোকাস করি। অধিকারকে প্রমোট করার জন্যে সবাইকে সেই অধিকারগুলোকে সেলিব্রেট করতে হবে তেমন ক্লেইম করে বসি। আবার সকল মতকে সেলিব্রেট করাটাও একটা নন-সেন্সে পরিণত হয়। মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সমুন্নত রাখার খাতিরে যা খুশি বলার অধিকারকেও অস্বীকার করা যায় না। এটা একটা অনর্থক তর্কযুদ্ধ তৈরি করে। বলতে হয়, আমি আপনার গালাগাল করার অধিকারকে সম্মান করি, কিন্তু আপনার গালগালটার প্রতিবাদ করি। কথাটায় ভুল নেই, কিন্তু এটা একটা দুর্বল বাক্যে পরিণত হয়। অধিকারের পক্ষেও সে দুর্বল, প্রতিবাদের পক্ষেও সে দুর্বল। প্রতিবার এমন ব্যালেন্স করে কথা বলাটা অনর্থকও। কথাটা এতোটা প্যাঁচানো যে - না প্রতিবাদটা যুতমতো হয়, না মত-প্রকাশের অধিকার যারা মানে না তাদেরকে একটু কনভিন্স করা যায়। কিন্তু আমরা যদি আগেই এই ব্যাপারে সবাই স্পষ্ট হয়ে নিতাম যে, হোয়াট সো এভার, কেউ কারো শরীর বা সম্পদে আক্রমণ করতে যাবো না, তাহলে আর তর্কের মাঠে কোনটা অধিকার কোনটা নয়, মত প্রকাশের কিংবা গালাগালের অধিকারকে সম্মান করতে হবে কি হবে না, সেসব নিয়ে প্যাঁচিয়ে যাবার আর প্রয়োজন পড়তো না। কারো কথা পছন্দ না হলে উপযুক্ত প্ল্যাটফর্মে মন মতো প্রতিবাদ অবশ্যই করা যায়।”
“হুমম। আমাদেরকে সঠিক অবস্থানটা বাছাই করতে হবে। অবস্থানটা মত প্রকাশ করার অধিকার নিয়ে করার বদলে করা উচিত, হোয়াট সো এভার, অন্যের উপর আক্রমণ করা যায় কিনা সেই ব্যাপারে। কিন্তু সরকার যখন একটা ওয়েবসাইটকে বন্ধ করে, সেটাকে কিন্তু অনাক্রমণ নীতি অ্যাড্রেস করতে পারে না, মত-প্রকাশের অধিকারের অবস্থানটা পারে।” মোহাম্মদ বলে।
খুব ভালো পয়েন্ট!
“না। অনাক্রমণের নীতিও পারে একে অ্যাড্রেস করতে। ইরানের যে কোনো ব্যক্তি অন্য কারো শরীর বা সম্পদে আঘাত না করে অন্যের কাছে সম্পূর্ণ মুক্ত ইন্টারনেট সার্ভিস সরবরাহ করতে পারে।” বললাম।
“কিন্তু সরকার তো সেই অনুমতিই দিতে চায় না।” মোহাম্মদ বলে।
“কারণ সরকার অনাক্রমণের নীতি মানে না। সে মনে করে মাঝে মাঝে অন্যের শরীর ও সম্পদে আক্রমণ করা সমাজের জন্য ভালো।”
“আর সে যদি কাউকে অনুমতি দেয়ও, তাদেরকে বাধ্য করে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ব্লক করতে।” মোহাম্মদ আবার বলে।
“এতে সরকার ‘মানুষের একটা গোষ্ঠি’ হিসেবে অন্যের সম্পদে মানে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারের সম্পদে আক্রমণ করে। বাধ্য করে। সেটা না মানলে সে তখন তার শরীরে আক্রমণ করবে। সরকার বা ক্ষমতার মনোপলি ব্যবস্থা অনাক্রমণ নীতির সম্পূর্ণ বিপরীতে অবস্থান করে। কিন্তু এটাই আমাদের সভ্যতার বাস্তবতা। সহসাই এটা গায়েব হয়ে যাবে না। ফলে সহসাই অধিকারের সীমিত তালিকা নিয়ে তর্ক বাদ দিয়ে অনাক্রমণের নীতিতে একমত হওয়া আমাদের হয়তো হবে না। তাই সরকার ব্যবস্থার মধ্যে থেকেই প্রতিনিয়ত তার কাছে গুনে গুনে প্রাপ্য অধিকারগুলো আমাদেরকে চেয়ে যেতে হয়। এটাই সরকারের সাথে নাগরিকের সম্পর্কের ইতিহাস। এটাকে অনাক্রমণ নীতির ধীর বাস্তবায়নও বলা যেতে পারে। যার ভবিষ্যত হয়তো সুদূর পরাহত, কিন্তু স্পষ্ট।” বললাম।
আমার ফোন বাজা শুরু হলো। মোহাম্মদ বুঝে গেলো আমাকে যেতে হবে।
“অনেক ধন্যবাদ, ধ্রুব, বিষয়টা পরিষ্কার করার জন্য।” মোহাম্মদ বললো।
“ধন্যবাদ তোমাকে, মোহাম্মদ, বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করার জন্য।” আমি বললাম।
আমার ভালো লাগলো। এক বছর আগে সে অন্য একটি নীতির উপর ভিত্তি করে রীতিমত গাণিতিকভাবে, গোডেলের ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণকে ভর করে, এগুচ্ছিলো। নীতিটা ছিলো - অবজেক্টিভ মোরালিটি বা নৈর্ব্যক্তিক নৈতিকতার নিশ্চয়ই অস্তিত্ব আছে, এবং সেই ভালোর সাপেক্ষে বাকি সব জিনিসের ভালো খারাপ নির্ধারণ সম্ভব। আর ঈশ্বরের সংজ্ঞা হলো - কেবল সকল ভালো কিছুতে বা সকল নৈতিক কিছুতে যে সমন্বিত। তার সিস্টেমে এই প্রিন্সিপলকে যারা মানে, তাদেরকে সে নৈতিক মনে করে। যারা মানে না, তারা অনৈতিক। আর অনৈতিকদের নাই করে দিতে চাওয়াটা ফলত নৈতিক। অর্থাৎ জিঘাংসার নৈতিক বৈধতা ছিলো তার কাছে।
এরপর এক বছরের উপর চলে গেছে। হয়েছে বহু তর্ক। এর মাঝে কতোবার সে একবার জায়নামাজ ধরেছে আরেকবার বিয়ার ধরেছে। অজ্ঞেয়বাদী নাস্তিক থেকে আবার সে অজ্ঞেয়বাদী আস্তিক হয়েছে। আজ সে - যে কোনো কারণেই যে অন্যের শরীর ও সম্পদে আক্রমণ করা উচিত নয় - এ নিয়ে একমত হচ্ছে।
এটা আমার চোখে একধরনের উত্থান, উত্তরণ। ইরানের সরকারি কূটনীতিকের বিভ্রান্ত সন্তান, যে তার পথ খুঁজে ফিরছে, কিন্তু অন্যের শরীরে আক্রমণের ভালো মন্দ নিয়েও যে নিশ্চিত ছিলো না, সে অনাক্রমণের নীতিতে মাথা নাড়ছে। সেটার উপর ভিত্তি করে আরও নতুন সিদ্ধান্ত তৈরি করতে পারছে। এর শুরু কীভাবে হয় জানি না। অনাক্রমণের নীতি নিতান্তই মানুষের চিন্তার একটা অবস্থা। কিন্তু সেটাতে যে একমত হয়, তার কাছে এটা অমূল্য।
আমার কাছে মনে হলো, চৌদ্দশ বছর আগের কোনো এক মোহাম্মদ, তার সংজ্ঞায় যে অনৈতিক তার উপর শারীরিক আঘাত করার বদলে, যেকোনো শারীরিক আঘাতকেই অনৈতিক বলে উপলব্ধি করতে পারছেন। হয়তো তিনি সত্যি সেরকমই উপলব্ধি করেছিলেন। কে তা জানে? তবে এক অর্থে এতে কিছুই যায় আসে না। চৌদ্দশ বছর আগের মোহাম্মদ যদি উপলব্ধি করেই এই সিদ্ধান্তে আসেন, আজকের মোহাম্মদকেও সেই উপলব্ধির মধ্যে দিয়েই যেতে হবে।
আজকের মোহাম্মদকে তাই চিন্তা করতে দেখে আমি আশান্বিত হই। চিন্তা তাকে নৈতিক জিঘাংসা থেকে তুলে এনেছে। অন্ধ আনুগত্যের মধ্যে সেটা সম্ভব হতো না। এটাই উত্তরণের একমাত্র পথ। আমি বিশ্বাস করতে থাকি যে - মোহাম্মদরা নিজের উপলব্ধির উপর নির্ভর করতে শিখছে এবং আমি দেখতে পাচ্ছি যে তারা চিন্তা করছে। আমি দেখতে পাচ্ছি, তাদের উত্থান ঘটছে মুক্তির পথে।
পরদিন মোহাম্মদকে দেখলাম, সে অ্যাডামকে বোঝাচ্ছে যে - মুসলমানদের এইসব ধ্বংসাত্মক আক্রমণ আসলে তাদের স্বাধীনতা, মুক্তিকামিতা এবং নব্যসাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদেরও এক ধরনের প্রকাশ।
ফলে আমার আশার বাণীটাকে একটু সীমিতও করতে হচ্ছে। হয়তো এই মুক্তি রাতারাতিই ঘটছে না। হয়তো চিন্তা ও আত্মউপলব্ধি এতোটা শক্তিশালী নয়। তবে অন্যকিছুও তো নেই, যা এর চেয়ে বেশি শক্তিশালী!
মন্তব্য
আপনার লেখা সবসময়ই অনেক ভাল লাগে । বিশেষ করে আপনার যুক্তিগুলো; যেগুলো আপনি আপনার লেখায় দেন । যে অনাক্রমণের নীতিতে আমি বিশ্বাস করি তার পেছনের যুক্তিগুলো (রেফারেন্স সহ) আপনার লেখা থেকে পেলাম। (Y
খুব ভাল লাগল কথাটা। আপনার লেখা সবসময়ই মনোযোগ দিয়ে পড়ি। যুক্তির উপস্থাপন চমৎকার।
আত্মজীবনি, চিন্তাভাবনা আর অণুগল্প - ট্যাগের এই তিনটা অপশন থেকে যে কোন একটা অপশনকে বাছুন। আমার পরামর্শ থাকবে অণুগল্পের অপশনটা নেয়া। সেক্ষেত্রে পটভূমিটা আরেকটু ব্যাখ্যার দরকার পড়বে, তবে তাতে ভবিষ্যতের পাঠক তার তৎকালীন পরিস্থিতির সাথে গল্পটা সহজে মিলিয়ে নিতে পারবেন।
এক ব্যক্তির চিন্তা ও কর্মের স্বাধীনতার ফলে অন্য ব্যক্তির স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়া ঠেকানোর কথা বলে প্রতিষ্ঠান ব্যক্তির ওপর যে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে বা করতে চায় তার সীমারেখাটা কী হওয়া উচিত সেটা নিয়েই মূল দ্বন্দ্বটা হয়। প্রতিষ্ঠানের বাইরে ব্যক্তির অস্তিত্ত্ব অনুল্লেখযোগ্য, অর্থাৎ ভৌতভাবে বা চিন্তাগতভাবে কোনপ্রকার কোন প্রতিষ্ঠানের আওতাভূক্ত নয় এমন ব্যক্তি ধর্তব্য নয়। প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি অনিবার্য বলে তার বিধি-বিধানও অনস্বীকার্য। এক্ষেত্রে ব্যক্তির চিন্তার বাস্তবায়নে প্রতিষ্ঠানের চোখরাঙানীটা থেকেই যাচ্ছে। যারা প্রতিষ্ঠানের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে তারা গাইডেড মিসাইলের মতো বিপদজনক। যারা তা করে না তাদেরকে প্রায়ই এই চোখরাঙানীটা দেখতে হয়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
চমৎকার বলেছেন।
প্রতিষ্ঠানের মূল অস্তিত্ব মানুষের মনে, মানুষের কল্পনায়। মানুষের গোষ্ঠিবদ্ধতা, প্রাতিষ্ঠানিকতা তো সাধারণত চমৎকার ব্যাপার। একসাথে হয়ে মানুষ কতো অসাধ্য সাধন করে। তবে একচেটিয়া ক্ষমতাধারী ও বলপ্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের চমতকারিতা ধীরে ধীরে মানুষের কাছে কমে আসছে। অতীতে মানুষ জন্ম থেকে যে কয়টি প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত থেকে বেড়ে উঠতো, তার অল্পই তার ছাড়ার এখতিয়ার থাকতো। অল্প কয়টি নতুন প্রতিষ্ঠানেই তার যুক্ত হবার সুযোগ থাকতো। সদস্যতা ছিলো বাধ্যতামূলক, দাসত্বমূলক। আজ দেখুন, আমরা কতো কতো প্রথাসিদ্ধ প্রতিষ্ঠানের সদস্যতা ত্যাগ করতে পারছি। তবে কিছু প্রতিষ্ঠান এখনো রয়ে গেছে, যারা এখনো বদ্ধ। তারা সদস্য বিনিময় করে খুবই অল্প। গণ্ডির ভেতরে তার থাকে ক্ষমতার একচেটিয়া। প্রতিষ্ঠানটি অকাজের তা নয়, কিন্তু বাধ্যতামূলকতা দিয়ে সে নিজেকে জড়াগ্রস্ত করে, করছে। সকল প্রতিষ্ঠানের সদস্যতা ত্যাগের সুযোগ মানুষের থাকা উচিত। তাহলে প্রতিষ্ঠানের সাথে মানুষের আদান প্রদান আরো ন্যায্য হয়।
হয়তো চিন্তা ও আত্মউপলব্ধি এতোটা শক্তিশালী নয়। তবে অন্যকিছুও তো নেই, যা এর চেয়ে বেশি শক্তিশালী
বিল বোঝাই কচুরিপানায়। আপনি এগুবেন, কচুরিপানা সরিয়ে সরিয়ে। পরিস্কার পানিতে নীলাকাশ আর সাদা মেঘ আপনাকে আশা দেখাবে। পেছন ফিরে দেখবেন আপনার বানানো পথ ফিরে গেছে কচুরীপানার দখলে।
অনেকে বলে, "নতুন করে চাকা আবিষ্কারের দরকার নেই"। আমি দেখি সংসারে মানুষ হরহামেশা চাকা আবিষ্কার করার জন্য গলদঘর্ম হচ্ছে। আসলেই ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না - এটাই ইতিহাসের শিক্ষা।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
আপনার যুক্তি কিছুতেই ফেলে দিতে পারছি না।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
যারা ভাবেন নব্যসাম্রাজ্যবাদ না থাকলে ধর্মানুভূতিজাত আক্রমণ নীতিও থাকতো না, তাদের জন্যে চিন্তার খোরাক।
রামুতে বৌদ্ধ মন্দিরসহ বাড়ি-বাড়ি আগুন, ভাঙচুর, হরিলুট
নতুন মন্তব্য করুন