সহিংসতা

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি
লিখেছেন ধ্রুব বর্ণন (তারিখ: বুধ, ২৬/১২/২০১২ - ১২:৩২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এই লেখায় রবিনসন ক্রুসো প্রথমবারের মতো আরেকজন মানুষের সান্নিধ্যে আসবে। ফলে এখানে প্রথমবারের মতো দেখা দিবে সমাজ গঠনের সুযোগ। ক্রুসো সহিংসতার মাধ্যমে কীভাবে সেই সুযোগ গ্রহণ কিংবা নষ্ট করতে পারে তার কয়েকটি দিক আমরা আলোচনা করবো।

সহিংসতা (ভাবানুবাদ)
মূল - মারি রথবার্ড (অস্ট্রিয়ান স্কুল অব ইকোনমিক্সের অর্থনীতিবিদ)
গ্রন্থ - মানুষ, অর্থনীতি, এবং রাষ্ট্র

বহুদিন একা কাটিয়ে অবেশেষে রবিনসন ক্রুসো দেখা পেলো জ্যাকসনের, যে কিনা এতোদিন দ্বীপটার অন্য প্রান্তে তার মতোই একা একা টিকে থাকার সংগ্রাম করেছে। মুখোমুখি হবার পর ক্রুসো আর জ্যাকসনের মধ্যে এখন যতোধরনের আদান প্রদান হতে পারে, তার মধ্যে এক প্রকার হলো সহিংস আদান প্রদান। ক্রুসো ও জ্যাকসনের সহিংস মিথস্ক্রিয়া অনেক প্রকারের হতে পারে। যেমন, ক্রুসো জ্যাকসনের প্রতি তীব্র বিরাগ পোষণ করে তার নির্মূল কামনা করতে পারে। এখানে তার লক্ষ্য হবে জ্যাকসনের মৃত্যু। আর সহিংসতা হবে সেই অভীষ্ট লক্ষ্য চরিতার্থ করার অবলম্বন।

কিংবা জ্যাকসনের প্রতি ক্রুসোর হয়তো কোনো বিরাগ নেই, কিন্তু জ্যাকসনের থাকার জায়গাটা আর জ্যাকসনের বানানো চামড়ার কোটগুলোর প্রতি তার লোভ রয়েছে। সেগুলো সে দখল করতে চায়। সেক্ষেত্রে জ্যাকসনকে হত্যা করে ক্রুসো সেই লক্ষ্য চরিতার্থ করতে পারে।

উভয়ক্ষেত্রে ক্রুসো তার অভীষ্ট লক্ষ্য চরিতার্থ করছে জ্যাকসনের জীবনের বিনিময়ে। জ্যাকসন যে এখানে অপূরণীয় এক ক্ষতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে সেটা বলাই বাহুল্য।

সরাসরি সহিংসতা ব্যবহার না করে সহিংসতার হুমকি ব্যবহার করাটাও সহিংসতার কাছাকাছি ধরনেরই একটা মিথস্ক্রিয়া। যেমন, ক্রুসো জ্যাকসনের গায়ে ছুরি ধরে হুমকির মুখে তার আহরিত সম্পদ লুট করতে পারে। ফলে জোরপূর্বক বলপ্রয়োগ বা তার হুমকি ব্যবহার - দুটোকেই আমরা সহিংসতা হিসেবে নির্ণয় করবো। উভয় ক্ষেত্রে একজনের অর্জন ঘটছে অন্যজনের শরীর বা সম্পদের বিয়োজনের মাধ্যমে।

কী কী কারণে ক্রুসো এখানে সহিংসতার পথ এড়াতে চাইতে পারে? নিচের যেকোনো এক বা একাধিক কারণকে আমলে নিলে সে সহিংসতার পথ এড়াতে চাইবে -

১) সে ভাবতে পারে যে সকল প্রকার সহিংসতাই অনৈতিক। সেক্ষেত্রে সহিংসতা থেকে নিবৃত্ত থাকাটা নিজেই একটা চূড়ান্ত লক্ষ্য। সহিংসতার মাধ্যমে অন্য যা কিছু সে অর্জন করতে পারতো, পুঁজি বা ভোগ্যদ্রব্য, সেই সবকিছুর চেয়ে সহিংসতা নিবারণ তার কাছে বেশি মূল্যবান।

২) বা সহিংসতা নিবারণ তার কোনো মৌলিক লক্ষ্য নয়, তবু সে ভাবতে পারে যে সহিংসতার ফলস্রুতি খুব সুখকর নাও হতে পারে। বরং সেটা অনাকাঙ্ক্ষিত ফলাফলও তৈরি করতে পারে। যেমন, যার উপর সে সহিংসতা ঘটাচ্ছে সেও এর প্রত্যুত্তরে সহিংস আচরণ ফেরত দিতে পারে। আর এর ফলাফল উল্টোটাও হতে পারে। অর্থাৎ আক্রমণকারী ক্রুসো নিজেই এখানে সহিংসতার দুর্বল পক্ষে পরিণত হতে পারে। বিভিন্ন ফলাফলের মধ্যে এটাও যেহেতু সম্ভাব্য, ক্রুসো অনাকাঙ্ক্ষিত ফলাফলের ঝুঁকি নেওয়ার বদলে অসহিংস থাকাটাই শ্রেয় হিসেবে বেছে নিতে পারে।

৩) ক্রুসো যদি ভাবেও যে তার সহিংসতার ফলাফলে তার নিজের বিজয় একদম নিশ্চিত, অন্য ফলাফলটা হবারই নয়, তারপরেও সে এই সিদ্ধান্তে আসতে পারে যে - তাকে তো অন্তত একটা লড়াই বা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। যুদ্ধকে আমরা সংজ্ঞায়িত করতে পারি একাধিক পক্ষের সহিংস মিথস্ক্রিয়া হিসেবে। ফলে ক্রুসো ভাবতে পারে যে সেই যুদ্ধের যে খরচ, যেমন অস্ত্র জোগাড়ে তার সময়ের আর শ্রমের যে বিনিয়োগ, এই সব খরচের তুলনায় যুদ্ধজয়ে তার যে লাভটা সেটা ক্ষুদ্র। এই বিচারে সে সহিংসতা থেকে নিবৃত্ত হতে পারে।

৪) ক্রুসো যদি এমনটাও ভাবে যে তার যুূদ্ধের যে খরচ তার তুলনায় যুদ্ধজয়ের প্রাপ্তিটাই বেশি, তারপরেও সে এই সিদ্ধান্তে আসতে পারে যে যুদ্ধজয়ে তার যে প্রাপ্তি সেটা সাময়িক। তার এই সাময়িক প্রাপ্তিটা অন্যান্য ভবিষ্যত দীর্ঘস্থায়ী প্রাপ্তির সুযোগকে নষ্ট করছে। সেই ভবিষ্যত প্রাপ্তিটা এই সাময়িক প্রাপ্তির চাইতে অনেক বেশি সুখকর হতে পারে তার কাছে। যেমন, তার এই সাময়িক প্রাপ্তি একসময় ফুরিয়ে যাবে, জ্যাকসনের বানানো বাসাটা কিংবা চামড়ার কোটগুলো ব্যবহারে ধীরে ধীরে জীর্ণ হবে, একসময় অব্যবহার্য হয়ে যাবে। ফলে সে ভাবতে পারে যে জ্যাকসনকে হত্যার ফলে সে জ্যাকসনের কাছ থেকে অবিরাম সেবা পাওয়ার সুযোগ হারাচ্ছে। সেটা হতে পারতো জ্যাকসনের সান্নিধ্য, কিংবা জ্যাকসনের তৈরি কিংবা জোগাড় করা অন্যান্য পুঁজি ও ভোগ্যদ্রব্য, যেটা জ্যাকসন বেঁচে থাকলে তাকে সরবরাহ করতে পারতো। জ্যাকসনকে না মেরে তার কাছ থেকে কীভাবে সেইসব সেবা আদায় করা যেতো সেটা আলাদা প্রশ্ন, কিন্তু মেরে ফেললে সেগুলোর সকলই যে অসম্ভব তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ফলে ক্রুসো হিসেব করে এই সিদ্ধান্তে আসতে পারে যে যুদ্ধজয়ের সাময়িক প্রাপ্তিটা জ্যাকসনের বেঁচে থাকার দীর্ঘস্থায়ী প্রাপ্তির কাছে তুচ্ছ। এই সিদ্ধান্তের কারণে সে সহিংসতা থেকে নিবৃত্ত হতে পারে। তবে এটাও সম্ভব যে ক্রুসোর কাছে বর্তমানের সময়ের অগ্রাধিকার ভবিষ্যতের সময়ের চেয়ে এতোটাই বেশি যে সে দীর্ঘস্থায়ী প্রাপ্তির সুযোগটা স্বীকার করলেও তুচ্ছ মনে করতে পারে।

এই সব ক্ষেত্রেই সুযোগ আছে যে ক্রুসো তার হিসেব নিকেশে ভুল করলো কিংবা যুদ্ধের খরচ বা ভবিষ্যত প্রাপ্তিটা আমলেই নিতে ভুলে গেলো। সেক্ষেত্রে ক্রুসো যদি তার লাভকে সর্বোচ্চ করার জন্যে সহিংসতা অবলম্বন করে, তাহলে সেটা তার পক্ষে ভুল সিদ্ধান্ত হতে পারে, কারণ সহিংসতা নিবৃত্ত করাটাই হয়তো তার পক্ষে আসলে অধিক লাভজনক।

আর এইসব কিছুকেই আমলে না নিয়ে ক্রুসো যদি জ্যাকসনকে হত্যা করে ফেলে, তাহলে সে তার সমাজ গঠনের সুযোগটাকে নিশ্চিতভাবেই নষ্ট করলো।

ধরা যাক ক্রুসো হিসেব করে দেখলো যে জ্যাকসনকে হত্যা না করাটা ভবিষ্যতের বিচারে বেশি লাভজনক। তখন তার সুযোগ থাকে জ্যাকসনের বিভিন্ন সেবা থেকে অবিরত লাভ অর্জনের। কিন্তু কীভাবে সে জ্যাকসনকে জীবিত রেখে তার সেবা থেকে লাভ পেতে পারে? এর বিভিন্ন সহিংস কিংবা অসহিংস উপায় থাকতে পারে। ক্রুসো হয়তো সহিংস উপায়টাই বেছে নিতে পারে। সে হয়তো জ্যাকসনকে হত্যা না করে তাকে আমৃত্যু শারীরিক আক্রমণের হুমকির মধ্যে রেখে তাকে শ্রম দিতে বাধ্য করতে পারে। একে আমরা বলবো দাসত্ব। এখানে দাসের মালিক দাসকে তার নিজের গবাদি পশু হিসেবে গণ্য করে। দাসকে মালিক তার নিজের চাহিদা পূরণের জন্যে উৎপাদনের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে। এর বিনিময়ে সে দাসের খাদ্য আর বাসস্থানের ব্যবস্থা করে, কিন্তু ঠিক অতোটুকুই করে যতোটুকু করলে দাস তার মালিকের প্রতি সেবা প্রদান অব্যাহত রাখতে পারে।

আমরা ভাবতে পারি যে দাস স্বেচ্ছায় এই চুক্তিতে রাজি হয়েছে। কিন্তু দাস এখানে মাত্র দুটো সম্ভাবনার মধ্যে একটা বাছাই করে নিয়েছে - মালিকের জন্যে কাজ করা অথবা শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। সহিংসতার হুমকির মুখে শ্রম আর সহিংসতার হুমকির অনুপস্থিতিতে শ্রম এই দুটো একেবারেই ভিন্ন গুণাবলীসম্পন্ন শ্রম। একটাকে বলা যায় বাধ্যতামূলক শ্রম, আরেকটা স্বেচ্ছাধীন বা স্বাধীন শ্রম।

জ্যাকসন যদি ক্রুসোর অধীনে দাসত্ব মেনে নেয়, তাতে এটা বলার সুযোগ নেই যে জ্যাকসন তার দাসত্বের একজন উৎসাহী সমর্থক। বরং এটা বলা যায় যে জ্যাকসন বিশ্বাস করে যে তার মালিকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তার অবস্থার উন্নতির কোনো সম্ভাবনা তার নেই। এই বিদ্রোহে তার যে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি সেটা সে বইতে পারবে না।

যারা মনে করে যে কোনো কোনো দাস হয়তো খাদ্য আর বাসস্থানের নিশ্চিত সরবরাহের কারণে দাসপ্রথাটাকে নিজ উৎসাহেই সমর্থন করতে পারে, তারা এটা বিচার করে না যে তাহলে মালিকের বলপ্রয়োগের বা হুমকির কেনো প্রয়োজন পড়লো। সেক্ষেত্রে জ্যাকসন তো নিজ ইচ্ছাতেই তার সেবা দান করার জন্যে ক্রুসোর কাছে হাজির হতে পারতো। আসলে সেটাকে আর তখন দাসত্ব বলার সুযোগ থাকতো না। ফলে এটা পরিষ্কার যে বলপ্রয়োগের হুমকির অনুপস্থিতিতে ব্যক্তি যে সম্ভাবনাটা বেছে নিতো, দাসত্ব সর্বদাই তার চাইতে অধিক অনাকাঙ্ক্ষিত ও মন্দ। দাসত্বে মালিক সর্বদাই দাসের ক্ষতির বিনিময়ে লাভ করে। এটা উভয়ের জন্যে লাভজনক মিথস্ক্রিয়া নয়।

দাসত্বের অধীনে দুটো ব্যক্তির মধ্যে যে মিথস্ক্রিয়া, সেটা হেজামোনিক (প্রভূত্বমূলক, কর্তৃত্বমূলক বা আধিপত্যমূলক?)। এখানে মিথস্ক্রিয়াটা নিয়ন্ত্রণ ও বাধ্যতার। মালিক তার দাসকে উৎপাদনের একটা উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে তার নিজের চাহিদা পূরণের নিমিত্তে। ফলে দাসত্ব বা হেজামোনি হলো একটা ব্যবস্থা যেখানে অন্যের হুকুমে ও বলপ্রয়োগের হুমকির মুখে বাধ্যতামূলক শ্রম প্রদান করতে হয়। হেজামোনিতে দাসের কেবল দুটো বিকল্প -

১) মালিক বা স্বৈরাচারের কাছে নিজেকে সমর্পণ করা; কিংবা
২) এই সহিংস ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নিজের সহিংসতা ব্যবহার করার মাধ্যমে কিংবা আজ্ঞা পালনে অবাধ্য হবার মাধ্যমে বিদ্রোহ করা।

সে যদি প্রথম বিকল্পটা বেছে নেয়, তাহলে সে হেজামোনিক শাসকের কাছে নিজেকে সমর্পণ করলো, এবং এরপর তার সকল সিদ্ধান্ত আর কর্মকাণ্ড নির্ধারিত হবে ওই শাসক দ্বারা। দাস এখানে মাত্র একটা বিকল্প বাছাইয়ের সুযোগ পায়, এবং এরপর সে বাধ্যতামূলক শ্রমে সমর্পিত হয়। এরপরের সকল স্বাধীন বাছাইয়ের সুযোগ থাকে কেবলমাত্র তার মালিকের। কিন্তু দাস যদি বরং অন্য বিকল্পটি বেছে নেয়, তাহলে লড়াই বা যুদ্ধের সূত্রপাত হবে। সেক্ষেত্রে নিচের ঘটনাগুলোর একটি ঘটতে পারে -

১) কোনো পক্ষই জিতলো না, যুদ্ধটা একটা লম্বা সময় ধরে চলতে থাকলো।
২) একজন অপরজনকে হত্যা করলো। এক্ষেত্রে আর কোনো ভবিষ্যত মিথস্ক্রিয়ার সুযোগ থাকলো না।
৩) একজন অপরজনকে লুট করে নিজের একাকী নিবাসে ফিরে গেলো। এক্ষেত্রে এই লুটের ঘটনা উভয়পক্ষ থেকে থেমে থেমে লম্বা সময় ধরে চলতে পারে।
৪) একজন অপরজনের উপরে বলপ্রয়োগের হুমকির মুখে একটা অবিরাম একচেটিয়া হেজামোনি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হলো।

এই চারপ্রকার ফলাফলের মধ্যে কেবল চার নম্বরটাতেই একটা দীর্ঘস্থায়ী মিথস্ক্রিয়াপূর্ণ সম্পর্কের সুযোগ তৈরি হয়। এই সম্পর্কটা বলপ্রয়োগমূলক। এখানে দাসকে খাদ্য ও বাসস্থানের বিনিময়ে মালিকের উৎপাদনের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। দাস নিজেকে উৎপাদনের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার হতে দেয়। মালিক তার খাদ্য ও বাসস্থানের সরঞ্জাম করে। এই বলপ্রয়োগমূলক সম্পর্কে এটাই মূল বিনিময়। যেকোনো মিথস্ক্রিয়াপূর্ণ সম্পর্ক যেখানে দীর্ঘস্থায়ী বিনিময় প্রতিষ্ঠিত হয় তাকে আমরা বলতে পারি সমাজ। এটা পরিষ্কার যে সহিংসতার অধীনে কেবল চার নম্বরটাতেই সমাজ গঠন সম্ভব। জ্যাকসনকে দাস বানানোর মাধ্যমে ক্রুসো যে সমাজ গঠন করলো, সেটা সার্বিকভাবে একটা হেজামোনিক সমাজ।

ফলে একাধিক মানুষের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী বিনিময়ের যে বিন্যাস বা আচরণ তৈরি হয়, সেটাকে আমরা সমাজ বলি। লক্ষণীয় যে সমাজ একটা বিন্যাসের নাম, সে তার নিজ বলে অস্তিত্বমান কোনো স্বাধীন সত্তা নয়। সমাজ পুরোপুরিই তার একক ব্যক্তিসত্তাদের আচরণের উপর নির্ভর করে। তাদের বাইরে সমাজের অতিরিক্ত কোনো অস্তিত্ব বা বাস্তবতা নেই।

এখানে আমরা ক্রুসো-জ্যাকসনের দ্বীপে সহিংসতার অধীনে টিকতে পারে এমন সম্ভবত একমাত্র সমাজ সম্পর্কে জানলাম। এখানে একটি হেজামোনিক সমাজ গঠিত হয়েছে। এটাকে শোষণমূলক সমাজও বলা চলে। এই সমাজে মালিক বা স্বৈরাচার তার অধীনস্থকে শোষণের বিনিময়ে নিজের লাভ করে।

(সমাপ্ত)

এর বাইরে ক্রুসো আর জ্যাকসনের মাঝে সহিংস বা অসহিংস আর কী কী ধরনের মিথস্ক্রিয়া হতে পারতো, সেটা বের করাটা আগ্রহজনক হতে পারে।


মন্তব্য

পথিক পরাণ এর ছবি

সরাসরি উভয়ের মধ্যে সহিংসতা না ঘটেও কিন্তু একজন আরেক জনের অধীনস্ত হইতে পারে। যেমনটা ফ্রাইডের ক্ষেত্রে ঘটেছিল। প্রাথমিক বশ্যতা শিকারের পর ক্রুসো দীর্ঘদিন ফ্রাইডেকে নানান ভীতির ভিতর দিয়া একটা হেজিমোনিক এটমস্ফিয়ারে দমাইয়া রাখার চেষ্টা বলবত রাখছে ঠিক (যার আদৌ কোন প্রয়োজন ছিল কিনা তা নিয়া প্রশ্ন তোলা যাইতে পারে), তথাপি নিজের জীবন রক্ষাকারীর প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তার নিঃশর্ত সমর্পন আমাকে নতুন ধরণের একটা সম্পর্কের সূচনার ইঙ্গিত দেয়।

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

এটা একটা ভালো উপায়। ভীতির পরিস্থিতি তৈরিকে সহিংসতা হিসেবে নির্ণয় করা যাবে না?

আরো কম সহিংস মিথস্ক্রিয়া কল্পনা করা যায় না?

পথিক পরাণ এর ছবি

সম্ভবত উত্তরটি 'না'।

আরও কম সহিংস অবস্থা হবার প্রধান শর্ত হচ্ছে সেখানে কেবল ক্রুসো অহিংস হলে হবে না। তার প্রতিপক্ষকেও সমান অসহিংস হতে হবে। অন্যথায় ক্রুসো যে যে কারণে সহিংস হতে পারে বলে কল্পনা করা হয়েছে, তার প্রতিপক্ষও একই কারণে সহিংস হয়ে উঠতে পারে।

ডিফো মিয়ার এই লেখাটার একটা অর্থনৈতিক ব্যাখ্যাও করা যায়।

ক্রুসোর জীবনচরিত, আমার বিচারে আদিম আর্থ-সমাজ গঠনের একটা উৎকৃষ্ট বয়ান। অ-মার্ক্সীয় বানিজ্যের তত্ত্বে সাধারণত একজন মৎস্যজীবী আর একজন শিকারির মধ্যে পরস্পরের উপার্জিত সম্পদ আর পন্য আদান প্রদানের মধ্যে দিয়ে একটা অর্থনৈতিক সম্পর্কের সূচনার কল্পনা করা হয়। এইধরণের পেশার মানুষদের ভিতর যে লেনদেন প্রক্রিয়া বিস্তার লাভ করে বলে ধারণা করা হয়, সেখানে বিনিময়ের শর্তগুলো থাকে শান্তিপুর্ণ, পরস্পরের স্বাধীনতাআশ্রয়ী এবং একটা সাম্যাবস্থা ধরে নেয়া হয়। কিন্তু বানিজ্য অনেক সময় একটা অসম আর কর্তৃত্বপূর্ণ পরিবেশেও বিকাশ লাভ করতে পারে। যেখানে একপক্ষ ক্ষমতাবান, অন্যপক্ষ কেবলই আজ্ঞাবহ (উপনিবেশগুলোর কথা ভাবুন)। স্বভাবতই এই ক্ষেত্রে একপক্ষ পুঁজি দিয়ে অন্য পক্ষর শ্রম কুক্ষিগত করে। এবং এখান থেকে উচ্চবৃত্তীয় এবং নিম্নবৃত্তীয় কর্মের বিভাজন সূচীত হয়। উচ্চ পক্ষ পরিকল্পনা করে তরমুজ (কিংবা নীল) ফলানোর। নিম্নপক্ষ তার শ্রম দিয়ে তা বাস্তবায়ন করে।

ক্রুসোর অভিজ্ঞতায় দেখুন, প্রথম জীবনে, ব্যবসা করে বেড়ানোর সময়, তার অর্থ বাজারে প্রবেশযোগ্যতা ছিল। তখন তার অর্থনৈতিক কর্মকান্ডর ছকটা ছিল – অর্থ- পণ্য- অর্থ। দ্বীপে নির্বাসিত হবার পর অর্থ বাজারে প্রবেশযোগ্যতা না থাকায় তার কর্মকান্ডর প্যাটার্নটা হল – পণ্য- শ্রম- পণ্য। শুরুর পনের বছর তার কাছে এমনকি স্বর্ণরও কোন মূল্য ছিল না। কেননা সে এই স্বর্ণ বিনিময় করার কোন উপায় দ্বীপের ভেতর পায়নি। এই সময় তার জীবন পুরোই শান্তিময়। দ্বীপে বন্দী অবস্থায় ১৫ বছর কাটাবার পর প্রথম যখন সে একটা অচেনা মানুষের খালি পায়ের ছাপ দেখতে পেল, সেদিন থেকে তার চিন্তা পালটে গেল। সে অজানা এক ভয়ে নিজের বাসস্থানের বাইরে বেরুতে ভয় পেতে লাগলো।

আরও দীর্ঘ সাত বছর পরে যখন সে সরাসরি সেভেজদের দেখা পেল, তখন তার ভেতর নতুন একটা ইচ্ছা জন্ম নিল। ক্রুসো ভাবল এদের ভেতর থেকে কাউকে যদি সে কোন উপায়ে বন্দী করে দাস বানাতে পারত! এই থেকে তার অর্থনৈতিক চিন্তা নতুন করে শুরু হল এবং সে শেষপর্যন্ত একজন দাসকে করায়ত্ব করে ফেলল, যে কিনা তার হয়ে শ্রম দিয়ে তার পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করবে।

কাজেই এখানে শুরু থেকেই প্রভু –দাস এমন একটি অবস্থা তৈরি হয়ে সমাজ অগ্রসর হয়েছে।

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

ঐতিহাসিকভাবে দেখলে সহিংস অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আর পারস্পরিক স্বাধীন বিনিময় ব্যবস্থা উভয়েরই উপাদান পাওয়া যায়। কোনোটা একতরফা ছিলো বলা যায় মনে হয় না। ফলে অ-মার্ক্সীয় বাণিজ্যের তত্ত্বকে সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে চিন্তা করা যাচ্ছে না। লক্ষ্য করুন, আপনার মন্তব্যেও আমরা দুটোরই অস্তিত্বের স্বীকৃত পাচ্ছি। যেমন - "কিন্তু বানিজ্য অনেক সময় একটা অসম আর কর্তৃত্বপূর্ণ পরিবেশেও বিকাশ লাভ করতে পারে" - এখানে অন্যান্য অনেক সময় পারস্পরিক স্বাধীন বিনিময়ের মাধ্যমেও যে অর্থনীতির বিকাশ লাভ করতে পারে তার স্বীকৃত আছে। ফলে আমি আপনার " সম্ভবত উত্তরটি 'না' " এর মাঝে "সম্ভবত উত্তরটি 'হ্যাঁ' " এর অস্তিত্বও দেখতে পাচ্ছি। হাসি

সম্ভাবনাটা নাকচ করা না করাটা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নিশ্চয়ই উপলব্ধি করছেন। মার্ক্সের বিশ্লেষণে এই নাকচের ফলে সিদ্ধান্তের যে অবধারিতার সেটা লক্ষণীয়।

এই লেখার পরের সেকশনটা সেই হিসেবে আগ্রোহদ্দীপক।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।