বাতাসে বদলের গন্ধ। 'ঘর হইতে দুই পা ফেলিয়া' পথে নেমে হাতের বাঁ দিকে তাকাতেই মন কেমন করে ওঠে। একটা গোরস্থান, তারপর কী সব গাছের সারি। মাঝখানটা একটা হাঁটাপথ। হলদে-লালচে 'সেঞ্চুরি' পাতায় ছেঁয়ে আছে পথটা। গাছগুলোর দিকে তাকালে মনেহয় এরা একেকজন মানুষ, অগুরুত্বপূর্ণ অথবা কিছুটা ব্যর্থ। পুরোটা সময় প্রবল উৎসাহে ধরে রাখা স্বপ্নগুলো শীতের আগমনী বার্তায় টপাটপ ঝরে পড়ছে। ঝরাস্বপ্ন। সৈয়দ মুজতবা আলী যদি এখন বনে থাকতেন, তাহলে বলতাম আমার ঘরে এসে একটু ব্লগিয়ে যেতে। অনেক্ষণ ব্লগরব্লগর করে যখন এই রাস্তাটা ধরে এগোতেন তখন কী নাম দিতেন তিনি রাস্তাটার, ভাবি। স্বপ্নঝরা লেইন, রোড বা এভিনিউ! আমি এগিয়ে যাই। পায়ের নিচে পচপচ শব্দে দলিত হতে থাকে ঝরে যাওয়া স্বপ্নগুলো। একটু পর থেমে নুয়ে পড়ে একটা স্বপ্ন হাতে তুলে নেই। সন্তর্পণে তাকে কবরস্থানের উঁচু দেয়ালে রাখি। ঝুলানো এক হাতের কব্জি আরেক হাতের মুষ্ঠিতে চেপে ধরার নীরব মুহূর্তে হয়তো একটু মন খারাপ হয় কিংবা আদৌ হয়না হয়তো। তারপর, আবার এগিয়ে যাই আমি স্বপ্ন মাড়িয়ে, আগের মতো।
সন্ধ্যার পর শান্ত হয়ে যাওয়া শহরের অলিগলি ঘুরে ফিরি। এক সময় নিজেকে আবিষ্কার করি মুজতবা আলীর ফ্ল্যাটের সামনের গলিতে। গ্রীবা উঁচু করে তাকাই সামনের দালানের একটা জানালার দিকে। ঠিক এখানটাতে দাঁড়িয়ে রতন'দা বলেছিলেন, 'আমি যদি না-ও থাকি কখনো, তুমি কিন্তু চলে যেও না।' সৈয়দ মুজতবা আলীকে নিয়ে গবেষণারত রতন'দা চলে গেছেন ক'বছর যেনো! হঠাৎই। তাঁর মোবাইল নাম্বারটা এখনো মোছা হয়নি আমার মোবাইল থেকে। জানি কোনোদিন ঐ নাম্বারটা থেকে আর ফোন আসবে না আমার কাছে, তাও রেখে দিয়েছি। কেনো কে জানে!
ঘুরতে গিয়ে উল্টোদিকের এরোটিক শপের লালরঙা দেয়ালে চোখ পড়ে যায়। হ্যালোজেন লাইটের কর্কশ আলোয় দেখি কালো রঙা বিকিনি পরে আবেদনময় ভঙিতে পৌনে শোয়া এক মডেল। মৃদু হাসি পায় কেনো যেনো! আমি উল্টোদিকে হাঁটা দিই।
গ্যালারিয়ার এক কোণে সবুজ রঙের বিশাল ব্যানার ঝুলছে। সেবার ১৩০ বছর পূর্তির। তাদের সেবার ধরণটা একটু ভিন্ন। খুব ছোট্ট একটা ডি বীয়ার্সের আংটির সেবা তারা দেয় মাত্র ৪৯৯ ইউরোতে। গ্যালারিয়ার আটকানো কাঁচের দরোজা পেরিয়ে সামনে এগিয়ে বেথোফেনের কাছে যাই। শীত-গ্রীষ্মে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি, এখানেই মলিন আলখাল্লায় সজ্জিত হয়ে। তাঁকে ঘিরে ঘুরে এসে বাঁধানো বেদীর একটা জায়গায় বসি। ঠিক এখানে বসে একবার চন্দ্রোদয় দেখেছিলাম। সিন লেফার্সের ওপর দিয়ে আস্তে আস্তে একটা ধুসর রঙা চাঁদ বড় হতে হতে বিরাটকায় রূপোর থালার আকার ধরেছিলো, আমারই চোখের সামনে। আমি চন্দ্রস্নাত হয়েছিলাম। কানের কাছে বাজছিলো 'ইফ টুমরো নেভার কামস...'।
আজকে চাঁদ ছিলো না সেখানটায়, কানের কাছে সেদিনের মতো করে গানটা বাজেনি। দিনগুলো বড্ড বদলে গেছে, কিংবা এই আমিই বড্ড বেশি বদলে গেছি, অথবা বদলে গেছে গানটা, অযাচিত ভাবে।
জেনারেল আনসাইগারের কাঁচের দেয়ালে সাঁটানো এলসিডি টিভিতে কি একটা ডকুমেন্টারি দেখাচ্ছে। আমি তাকাই না। 'মারি জো লঁজারি'র ম্যানিকুইনগুলোর পরনের রঙবেরঙা জিনিষের দিকেও না। পাশের ফটো শ্মিডের দেয়ালে ঝুলানো ছবি গুলোর দিকে চোখ যায়। একটা বাচ্চা হাসছে। নিষ্কলুশ হাসি। তার সদ্যগজানো পাঁচটা দাঁত বেরিয়ে পড়েছে সেই হাসিতে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, বাচ্চাটার চোখ দুটোও হাসছে তার সাথে। অসম্ভব ভালো লাগলো ছবিটা দেখে। পাশে আরও বেশ কয়েকটা ছবি আছে। কোনো এক স্বর্ণকেশীর পাশ থেকে তোলা ছবি, আড়াআড়ি ডোরাকাটা পোলো টিশার্ট পরা কোনো এক যুবকের ছবি। তাদের পাশেই এক বয়ষ্ক যুগল, মনে হলো পুরোটা পথ পাড়ি দেয়ার পর একসঙ্গে কাটানোর সর্বশেষ মুহূর্ত। এই ছবিটার ডানদিকেই সদ্যবিবাহিত এক যুগলের ছবি। হাতে সাদাফুলের তোড়া নিয়ে দাঁড়ানো বউটার পাশে চুলে জেল দেয়া কালো স্যুটের বর। তার নেকটাইটায় একদমই মানায়নি তাকে। আমি আবারো পঞ্চদন্তবিকশিত বাচ্চাটির দিকে তাকাই। তার সাথে সাথে আমিও হাসি। সামনের আয়নায় সেই হাসির প্রতিফলন দেখা যায়। আমি সরাসরি চোখের প্রতিবিম্বের দিকে তাকাই। বাচ্চাটার হাস্যরত চোখের সাথে কোথায় যেনো মিলে যায়!
সামনে ফ্রিডেনপ্লাৎসে না গিয়ে ডানে ঘুরে এগুতে থাকি। এই রাস্তাটায় ঢুকলেই নাকে আসে একটা হাইব্রিড সুগন্ধি ঘ্রাণ। অনেকটা সিডনীর কিউভি বিল্ডিং-এর আর্কেডিয়ার মতো। গন্ধটা প্রায় একই রকম। কিংবা একই রকম না। আমার মস্তিষ্ক হয়তো একই রকম করে শোঁকাচ্ছে। সিরামিক ইটের পথ ধরে একসময় এসে পড়ি জনহীন বিশাল চত্বরে। পুরাতন সিটি হলের সামনে একটা পাথরের ভাস্কর্য। এই চত্বরের ১৯২০ সালের তৈলচিত্রেও দেখেছি ভাস্কর্যটা আছে। তখন এই জায়গায় চলতো ঘোড়ায় টানা ট্রাম। আন্দাজমতো তেমনি একটা ট্র্যামলাইনের ওপর দাঁড়িয়ে মাথাটা উঁচু করে তাকাই। দালানগুলোর সূচালোভাগ অনেক উঁচু হয়ে আকাশের পেটে ঢুকে গেছে যেনো! কিংবা আকাশটাই অনেক নিচে নেমে গেছে আজ। হঠাৎ মনে হলো সবকিছু খুব দ্রুত ঘটছে, খুব। আলোয় ভরে উঠলো মার্কটপ্লাৎসের সুবিশাল চত্বর। দেখতে দেখতে অনেক মানুষের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠলো। আমার চারপাশে গমগম করতে থাকলো মানুষ, অনেক মানুষ। কিন্তু কেউ-ই যেনো আমাকে দেখছে না। ফিরে আবারও আকাশের দিকে তাকাই... এখনও নিচেই মনে হচ্ছে... হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারবো বুঝি... সবকিছু অনবরত ঘুরতে থাকে আমার চারপাশে... হঠাৎ অবাক হয়ে শুনতে পাই আমার কানের কাছেই কোথাও বাজছে, 'ইফ টুমরো নেভার কামস...'
মন্তব্য
ভীষণ ভালো লাগলো নিঃসঙ্গ পথচারীর এই ব্লগর ব্লগর! দৃশ্যগুলো দেখার লোভ হচ্ছে খুব।
গুরু, আছেন কেমন?
২০৬ খানা হাড্ডি ঠিকঠাক আছে? আর মন?
এইসব বিকিনির বিকিকিনি বাদ্দিয়া ঘরে আরো দুইশো ছয়খানা হাড্ডি সর্বস্ব মন নিয়া আসেন গুরু। অনেক দিন বিয়ার দাওয়াত খাওয়া হয়না
---------------------------------
তবে যে ভারি ল্যাজ উঁচিয়ে পুটুস্ পাটুস্ চাও?!
---------------------------------
বাঁইচ্যা আছি
ধূগোদা আছেন কেমন? আপনার লেখায় মুজতবা আলীর নাম পড়ার পর পন্ব্ঞতন্ত্রের উনার স্মৃতি কাহিনী মনে পড়ল। আচ্ছা জার্মানীতে কি এখনও ছুটির রাতে ছাত্র বনাম পুলিশের চোর-পুলিশ খেলা হয় ?
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
মন খাবাপ?
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
ধুরো, ধুগোর লেখা কঠিন হয়ে গ্যালো ক্যান?
ভাই রাশি মাষ্টারদের মতো একখানা বাণী দেই,
আপনার রাশির জাতক জাতিকারা কষ্ট গায়ে মাখতে পারে একেবারে তেলের মতো সহজ করে।
আপনার জন্য শুভ অক্ষর হচ্ছে ক ষ ট ।
আমি আপনার মতো করে লিখার স্বপ্ন দেখি।
মন খারাপ?রাস্তায় রাস্তায় এতো ঘোরাঘুরি কেনো?
কেনো যেনো ঠিক কখনওই আপনার হাসিতামাশায় আমি আপনাকে খুঁজে পাই না সেভাবে, যতোটা পাই এই ধরনের বিষাদমাখা (দুঃখিত, এভাবে ক্যাটেগরাইজ করতে চাই না। কিন্তু অন্যভাবেও বোঝাতে পারলাম না) লেখাগুলোতে। আর এ কথা কে-ই না বা জানে, বাইরের হাসির আবরণের মাঝেই লুকিয়ে থাকে চেনা-অচেনা যতো কষ্ট। তাই আপনার এই অংশটাই বেশি বাস্তব লাগে আমার কাছে। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের হাসি-আনন্দগুলো ভীষণরকম এক হলেও, এই কষ্ট বা বিষাদটুকুই আলাদা করে দেয় আমাদের, বাকি সবার থেকে। এই লেখায় তাই আপনাকেই খুঁজে পেলাম, আপন সেই ধুগো'দাকে।
আরও অনেক কিছু বলার ইচ্ছা ছিলো, এখানে নাই-বা বলি। শুধু এইটুকুই জানাই, বড়োই ছুঁয়ে গেলো লেখাটা। চমৎকার লাগলো।
"ফায়ার, ওয়াক উইথ মি "
- টুইন পিক্স।
চমৎকার দিনপঞ্জী।
এই লুক! এই দুষ্ট লুক! এই লুঙ্গী-বিড়ি-শুকনা মরিচের সওদাগর! আপ্নে ক্যান দুঃখের লেখা দিবেন? ক্যান? ক্যান?? ক্যান??? দুনিয়াতে কি দুঃখু কম পড়ছে যে আপ্নেরেও এর বিলিব্যবস্থায় যোগ দিতে হবে? ধ্যাত!
----------------------------
ইহাসনে শুষ্যতু মে শরীরং
ত্বগস্থিমাংসং প্রলয়ঞ্চ যাতু।
অপ্রাপ্য বোধিং বহুকল্পদুর্লভাং
নৈবাসনাৎ কায়মেতৎ চলিষ্যতি।।
- ললিতবিস্তর
**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।
মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।
ধুরো, কখনো কী ভাবসিলাম- ধুগোর মন খারাপ করানো লেখা পড়েও লগিন কর্তে হবে ??
...
মন ভালো করেন।
______________________________________________________
মধ্যরাতের কী-বোর্ড চালক
গুরু, খুব ভালো লাগলো লেখাটা ... ভালো থাকবেন ...
................................................................................................
খাদে নামতে আজ ভয় করে, নেই যে কেউ আর হাতটাকে ধরা ...
কি খাইয়া নিছিলা লেখার আগে?
আমার তো এমন লেখা জীবনেও বের হবে না!
কি রে ব্যাটা কেমন আছিস? তুই কেন মন খারাপ করা লেখা লিখিস?
ভাল আছি, ভাল থেকো।
ভাল আছি, ভাল থেকো।
তোমার এই লেখাটা অন্য লেখাগুলো আলাদা, এক ধরনের বিষন্নতা মাখানো। পড়তে ভালো লেগেছে।
**************************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
চমৎকার ভাই, অতি চমৎকার।
ধূ গো,
আফনেও আইজকাইল এত জটিল লেখা লিখেন!
আবার আমারে কন সোজা কইরা লিখতে!
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
খুব ভালো লাগলো...
"Life happens while we are busy planning it"
এক্কেরে মাইরা লাইছেরে!
ধূগো খুব ভাল লেগল লেখা।
**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
বিষাদবৃক্ষে অটাম সেল দিচ্ছে নাকি? সচলে প্রায় সবাই দেখি বিষণ্ণ বিষণ্ণ লিখছেন৷
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
- সবাইকে প্রাণবন্ত ধন্যবাদ। লেখাটা কি কিঞ্চিৎ বিষণ্ণ সুরের হয়ে গেলো! ওভাবে লিখতে চাইনি যদিও। অনেকদিন থেকে লেখা হচ্ছে না, তাই ভাবলাম একটা আবঝাব লিখে খরাটা তো কাটাই। সবার মন্তব্যের জবাবে ধন্যবাদ বাবদ এক সঙ্গে কয়েকটা লাইন লিখে রাখছি বলে এবেলা ক্ষমা প্রার্থী হলাম। কী করবো, অলসতায় পেয়ে বসেছে যে!
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
নতুন মন্তব্য করুন