শুধুমাত্র আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে থাকিলেই বিবর্তনে সুবিধা পাওয়া যায় - এই ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে আগের পর্বে লিখেছিলাম। আগ্রাসী জীবেদের নিজেদের মধ্যে মারামারি করার প্রবণতা তাদের বিবর্তনগত ভারসাম্যে পৌঁছতে বাধা দেয়, যার ফলে সেই “আগ্রাসী জিন” স্থায়ী হতে পারে না। এবারে লিখছি দলবদ্ধ জীবদের নিয়ে। প্রকৃতিতে এইরকম দলবদ্ধ জীবের সংখ্যাই বেশী। পাখিরা জোট বেঁধে ওড়ে, মাছ দলে দলে সাঁতার কাটে, পোকামাকড় দলবেঁধে বাসা বানায় বা হায়েনারা দল বেঁধে শিকার করে। এখানে আলোচ্য মূল প্রশ্ন হল - এই দলবদ্ধ থাকার সহজাত প্রবণতা কিভাবে স্বার্থপর জিন তত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে? প্রতিটি জীব স্বার্থপর হলে কি তাদের দল গঠিত হতে পারে না? আরো বড় কথা সেই দল বা পরিবারের জন্য সহজাত আত্মত্যাগের কি ব্যাখ্যা হতে পারে? আর একই তত্ত্ব দিয়ে জীব কিভাবে উপকারীর উপকার করতে শেখে তা নিয়েও আলোচনা করছি।
প্রথমেই নজর দেওয়া যায় দলবদ্ধ ভাবে থাকার স্বাভাবিক কিছু সুবিধার দিকে। একসাথে শিকার করায় হায়েনাদের শিকার পাবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। পেঙ্গুইনেরা নিজেদের মধ্যে জড়াজড়ি করে হাঁটে, যাতে এদের ঠান্ডা কম লাগে। একসাথে সাঁতার কাটলে সামনের মাছের তৈরী প্রবাহের মধ্যে শরীর ভাসিয়ে সাঁতার কাটাও সহজ হয়। আর V-আকৃতির জোট করে পাখিরা দূর-দূরান্তে পাড়ি দেয় একই প্রবাহ-জনিত সুবিধার কারণে। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে হ্যামিল্টনের স্বার্থপর জোটের মডেলে কথা। ভুল বোঝার অবকাশ না রাখার জন্য বলে রাখা ভাল, এখানে স্বার্থপর জোট বলতে স্বার্থপর জীবের জোট বোঝানো হচ্ছে।
ডিসকভারি বা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে আমরা অনেকবারই দেখেছি বাঘের হরিণ শিকার করার দৃশ্য। মোটামুটি একটা সংক্ষিপ্ত জায়গার মধ্যে হরিণ দলবেঁধে চরে বেড়ায়। বাঘ যখন আক্রমণ করে, কাছাকাছি একটা হরিণকে বেছে নিয়ে তাড়া করে ধরে ফেলে। খুব স্বাভাবিকভাবেই বাঘের নজর থাকে দলের প্রান্তবর্তী হরিণগুলোর দিকে, যাদের ধরতে পারলে বাঘের শক্তিক্ষয় কম হবে। আর একই কারণে, হরিণদের দল গঠনের সময়ে সব হরিণই চাইবে যত পারা যায় দলে মাঝখানে থাকতে যাতে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা কমে যায়। ঘাস খাবার সময়ে হয়ত কিছুটা বিচ্ছিন্ন হবার দরকার পড়ে, কারণ মাঝের অংশে ঘাস দ্রুত কমে যায়। কিন্তু সাধারণভাবে চলাচল করার সময় হরিণেরা (ভাল দেখা যায় ভেড়াদের মধ্যে) যথাসম্ভব গা ঘেঁষাঘেঁষি করে চলতে থাকে। দূর থেকে দেখে এরা দলবদ্ধ বলে মনে হলেও এর পেছনে আছে প্রত্যেকের নিজ-নিজ স্বার্থপর উদ্দেশ্য - বিপদ-এলাকা কম করা আর প্রান্ত ছেড়ে মাঝের দিকে আসার প্রবণতা। এই ধরণের জোটকেই বলা যায় স্বার্থপর জোট - যেখানে সবাই নিজের স্বার্থের জন্যই জোট বেঁধে থাকে।
তবে, প্রকৃতিতে জোট-গঠন ছাড়াও সহমর্মিতার আরো অনেক উদাহরণ আছে যা এই মডেল দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। সবথেকে বড় সমস্যা হয় যেখানে জীব নিজের বিপদ এনেও দলকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। আপাতত সেরকম কয়েকটা উদাহরণ নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। ছোটো অনেক পাখি আছে যারা বাজ বা ঈগলের মত শিকারী পাখি দেখলেই কিচিরমিচির শব্দ করে দলের বাকি পাখিদের সতর্ক করে দেয়। এর ফলে ওই পাখিটার বিপদ কিছুটা বেড়ে যায়, কারণ শিকারী তাকে সহজেই খুঁজে পেতে পারে। সে কিন্তু ইচ্ছা করলেই বিপদ বুঝে সটকে পড়তে পারে, কিন্তু সে তা না করে নিজেকে শিকারীর নিশানায় এনেও দলকে সাহায্য করছে - এই আত্মত্যাগের ব্যাখ্যা কি হতে পারে? এই ঘটনার তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের আগে একটা ব্যাপার বলে রাখা ভাল। পাখিদের এই এল্যার্ম কল নিয়ে বিশদ গবেষণা করে শব্দবিজ্ঞানী মার্লার দেখিয়েছেন এই ডাকগুলো এমনভাবে ডাকা হয় যাতে শিকারীরা কিছুতেই ডাক কোথা থেকে আসছে বুঝতে না পারে। স্বাভাবিকভাবে, কোনো এক সময়ে এই এল্যার্ম কল ঠিকঠাক না আসায় অনেক পাখি শিকার হয়েছে। তাই যাদের এল্যার্ম কল ঠিকঠাক, তারা বেঁচে থেকে বেশী বংশবৃদ্ধি করেছে। এল্যার্ম কল দেওয়ায় সুপটু করে তোলার জিনও প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে স্বার্থপরের মত পাখিদের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে।
এবার আসা যাক আত্মত্যাগের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে। সাধারণভাবে দেখা যায় যে একই গোষ্ঠীতে জীবের "কিন" বা আত্মীয় থাকার সম্ভাবনা বেশী। আর আত্মীয়দের মধ্যে একই ধরনের জিন থাকার সম্ভাবনাও বেশী। তাই "কিন সিলেকশন" তত্ত্ব অনুসারে জীব নিজের স্বার্থপর জিনের "কপি" বাঁচানোর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। দুটো ভিন্ন প্রেক্ষাপটে দেখা যাক এল্যার্ম কলের গুরুত্ব।
একধরনের পাখি আছে যারা মাটিতে চরে বেড়ায়। শিকারী আক্রমণ করলে তাদের আত্মরক্ষার সহজ উপায় হল আশেপাশের ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে পড়া। ধরা যাক এরকমই একটি পাখির দলে একটি পাখি এক শিকারীকে আগেভাগে দেখে ফেলেছে। যেকোন মুহূর্তে এরপরে শিকারী আঘাত হানবে। এখন তার কাছে দুটো পথ খোলা আছে - প্রথমটি হল নিজের মত চুপচাপ ঝোপে লুকিয়ে পড়া, আরেকটা হল সবাইকে সতর্ক করে দেওয়া। এখানে ভেবে দেখলে বোঝা যায়, পাখিটা যদি একা একা ঝোপে লুকিয়েও পড়ে, শিকারী আক্রমণ করলে গোটা দলই বিপদে পড়বে। শিকারী যদি দলবেঁধে আসে, তাহলে তো কথাই নেই। অন্যদিকে, শিকারী আঘাত হানার আগেই যদি সবাই মিলে লুকিয়ে পড়া যায়, তাহলেই বেঁচে যাওয়া যাবে। এধরনের পাখিরা তাই হিস-হিস শব্দে বাকিদের সতর্ক করে দেয়।
আরেক ধরনের পাখির কথা আসে, যারা আক্রান্ত হলে দলবেঁধে উড়ে পালিয়ে যায়। আগেরবারের মতই ভাবা যাক যে কোনো এক শ্যেনদৃষ্টি পাখি শিকারীকে আগে থেকেই দেখে ফেলেছে। এখন সে একা উড়ে যেতে পারে। কিন্তু শ্বাপদসংকুল পৃথিবীতে একা উড়ে গেলে তার বিপদের সম্ভাবনা বেড়ে যাওয়া ছাড়া কমে না। শিকারী পাখিরা সাধারণত এরকম একা-হয়ে-যাওয়া পাখিদেরই আক্রমণ করে সহজ শিকার বানিয়ে ফেলে। পড়ে যদি তার আবার দলে ফিরে আসার সম্ভাবনাও থাকে তাও সাময়িকভাবে তাকে একা হয়ে যেতে হবে। তাই এই অবস্থানে সবথেকে ভাল নীতি হল নিজেও উড়ে পালানো, আর সাথে আর সবাই যাতে পালায় সেজন্য কিচিরমিচির শব্দে তাদেরও সতর্ক করে তোলা। হ্যামিলটনের এই তত্ত্ব ঠিক হোক বা না হোক, পাখিদের মধ্যে এই আচরণ বারে বারে একই রকম ভাবে দেখা যায়।
বেঁচে থাকার পথে এই কৌশল খুবই দক্ষ। এই এল্যার্ম কল নিখুঁত না হবার কারণে যেমন অনেক পাখি শিকারে পরিণত হয়েছে, তেমনই এল্যার্ম কল না দেওয়ার কারণে অনেক দলও বিপদ্গ্রস্ত হয়েছে। সবে মিলে এল্যার্ম কল যারা ঠিকঠাক দিতে পেরেছে, সময়ের সাথে সাথে তাদের স্বার্থপর জিন বেশী হারে ছড়িয়ে পড়েছে। জীব নিজে স্বার্থপরের মত এল্যার্ম কল দিতে শিখেছে আর তা দেখে আমরা তাদের আত্মত্যাগের কথা ভেবে বিমোহিত হয়েছি।
(চলবে)
মন্তব্য
দিগন্ত, চমৎকার ঝরঝরে লেখা। এটাতো মনে হয় ভাবানুবাদ, সরাসরি অনুবাদ নয়? অনেক আগে পড়েছিলাম সেলফিশ জিন বইটা, অনেক কিছুই মনে নেই এখন। কতগুলো চ্যাপ্টার করার কথা ভাবছো?
বন্যা
আমি আপাতত তিনটে চ্যাপ্টারের কথা ভাবছি। ওগুলো শেষ হলে আবার দেখব।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
দিগন্ত, আপনি বোধয় Survival এর বাংলা "বিবর্তন" করেছেন। অন্তত টেক্সট পড়ে আমার সেটা মনে হল। যদি আসলেই তাই হয়, তাহলে Survival এর সঠিক বাংলাটি হবে "উদ্বর্তন"।
..............................................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!
না তো, আমি সজ্ঞানে এটা করিনি। যাই হোক উদ্বর্তন শব্দটা নিয়ে ব্লগারদের অনেক আপত্তি পড়েছি, তাই ওই শব্দটায় আমার একটা ফোবিয়া আছে।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
"উদ্বর্তন" নিয়া ব্লগারদের আপত্তির কারণটা কি? ইংরেজি শব্দটা যদি Survival ই হয় তাইলে বাংলা মানে "বিবর্তন" করলে সেটা ভুল হবে, তা বিজ্ঞ ব্লগাররা যতই আপত্তি করুন, বা আপনার যতই ফোবিয়া থাকুক। বিবর্তন মানে হল Evolution। Evolution একটা প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে কিছু প্রাণ Survive করে, কিছু করে না। আশা করি পার্থক্যটা স্পষ্ট করতে পেরেছি।
..............................................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!
যাহোক, আপনি ঠিক কোথায় কোথায় শব্দটা ব্যবহার করলে ভাল হয় বলে মনে করছেন জানান। আমি তারপরে দেখছি কিভাবে ম্যানেজ করা যায়।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
Survival এর বাংলা "বিবর্তন" করলে সেটা ভুল বাংলা হবে, আমার বলার বিষয় এটুকুই। এটা এখন আপনি কিভাবে "ম্যানেজ" করবেন সেটা আপনার বিষয়। টা টা।
..............................................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!
নতুন মন্তব্য করুন