নিজভূমে পরবাসী

দিগন্ত এর ছবি
লিখেছেন দিগন্ত (তারিখ: সোম, ১০/১২/২০০৭ - ৪:৩৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

auto
আজ বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। এবার এই দিন সোমবারে পড়েছে বলে এখানে মিছিল-মিটিং-ধিক্কারের সংখ্যা কম। তাও শুনলাম কাশ্মীরে আর কোলকাতায় কোনো কোনো জায়গায় কিছু বিচ্ছিন্ন সভা আয়োজন হচ্ছে। লোকে এখন আজকাল এতোটাই কেরিয়ার-সচেতন যে অফিস কামাই করে দুটো মিটিং-এ যোগ দেবার সদিচ্ছা কারো নেই - তাও যদি ইস্যুটা হয় "অন্যের মানবাধিকার"। সবাই নিজের নিজের ইস্যুতে সিদ্ধহস্ত, নিজের অধিকার সচেতন, কিন্তু অন্যের অধিকারের বিষয়ে গা নেই। স্বভাবতই এখানে মানবাধিকার দিবস অলিখিত হিসাবে সরে চলে এসেছে রবিবারে। তাই কাল ভাবলাম এদিকে ওদিকে একটু ঢুঁ মেরে দেখেই আসি কোথায় কি চলছে।

আমাদের সাথে কাজ করে রাহুল রাজদান বলে এক কাশ্মীরী (নামে কাশ্মীরী - নিজেকে ইউরোপিয়ান বলে দাবি জানিয়ে পার পেয়ে যেতে পারে যেকোনো জায়গায়)। যাহোক তিনি আমাদের আগেই আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তাদের মৌন মিছিলে যোগদান করার জন্য। অনেক খুঁজে পেতে গিয়ে হাজির হলাম তাদের সংস্থা রূটস ইন কাশ্মীরের (RIK) মিটিং-এ। একটা বড় রাস্তার পাশে ১০-১২ জন ছেলে-মেয়ে কিছু প্ল্যাকার্ড-ফেস্টুন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কপালে লাল ফেট্টি বাঁধা – লেখা “RIK”।auto রাহুল সহ আর কয়েকজন পাশে ল্যাপটপে পাওয়ার-পয়েন্ট প্রেসেন্টেশন দিয়ে চলেছে - কাশ্মীরে পণ্ডিতদের ওপর কিরকম কি অত্যাচার হয়েছে। একের পর এক স্তুপীকৃত লাশের বা ভাঙা দালানের ছবি আর পাশে স্থান-কাল। আমরা যেতে খুব খুশী হল আর অনেকবার ধরে ধন্যবাদ জানালো। সাথে দিল কয়েকটা প্যামফ্লেট - যাতে অসংখ্য রেফারেন্স দিয়ে বোঝানো আছে কি সমস্যা তাদের - কিভাবে সরকার আর জঙ্গীদের মাঝে "স্যান্ডুইচ" হয়ে তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ছে দিনে দিনে। প্রতিবছর এই কয়েকজন পণ্ডিত মিলে হায়দ্রাবাদে রোড শো করে আর মোমবাতি জ্বালিয়ে সবাইকে জানান দিয় যান - যে তারা হায়দ্রাবাদে থাকলেও তারা আসলে কাশ্মীরী।

কাশ্মীরে পণ্ডিতেরা হল আদি কাশ্মীরী - কয়েক হাজার বছর ধরে কাশ্মীর উপত্যকার স্থায়ী বাসিন্দা। আগে বেশ কয়েক দফায় এই সম্প্রদায়ের লোকজন কাশ্মীর থেকে পাতাতাড়ি গুটিয়ে ভারতে বিভিন্ন জায়গায় বাসা বেঁধেছে। এখন এরা তাই সংখ্যায় খুবই কম - মাত্র পাঁচ কি ছয় লাখ হবে। ভোটের দেশে চিরকালের মত এখানেও সংখ্যালঘুদের পাত্তা এমনিতেও কম – তার ওপর যদি জায়গাটা হয় কাশ্মীরের মত “Disputed”। ১৯৮৯ সালে যখন প্রথম কাশ্মীরে সংঘর্ষ শুরু হল, তখন প্রথম আক্রান্ত হয় এই পণ্ডিতেরাই। ভারত সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে এদের প্রক্সি দাঁড় করিয়ে শুরু হয় জঙ্গীদের অত্যাচার। মসজিদ থেকে মাইকে ঘোষণা শুরু হয় পণ্ডিতদের ঘরছাড়া করার আদেশ। শুরু হয় যাকে বলা হয় এথনিক ক্লিনসিং - বছরের পর বছর সংখ্যালঘুদের নিশ্চিহ্ন করে দেবার যে খেলা চলে এসেছে তারই আরো এক দফা। একের পর এক পণ্ডিতকে দলে দলে মারা শুরু হয় - কোথাও গলায় দড়ি দিয়ে, কোথাও গুলি করে, কখনো হাত-পা কেটে আর কখনও বা জ্যান্ত পুড়িয়ে। এসব লোমহর্ষক কাহিনী এখন আমাদের কাছে পুরোনো হয়ে গেছে - স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছে শুধু উদ্বাস্তু পণ্ডিতেরা যারা কোনোরকমে পালিয়ে বেঁচে আছে জম্মু আর দিল্লীর কিছু রিফিউজি ক্যাম্পে। সংখ্যার খাতিরে বলে রাখা ভাল - ১৯৮৯ সালের পরে কাশ্মীরে হামলায় মৃত ৭০ হাজার মানুষের মধ্যে প্রায় ১২ হাজার হলেন সম্প্রদায়ভুক্ত (অত্যাচার করে মারার ঘটনা প্রায় ১,১০০র মত) আর রিফিউজি-র সংখ্যা তিন থেকে পাঁচ লাখের মধ্যে (সরকারি ভাবে যদিও সংখ্যাটা এক-দেড় লাখের বেশী নয়)। আক্রান্ত প্রায় একশো মন্দিরের মধ্যে অনেকগুলোই এখন পরিত্যক্ত। জংগীদের ঠেলায় কাশ্মীর উপত্যকার শতকরা নব্বই থেকে পচানব্বই ভাগই এখন থাকেন জম্মু আর দিল্লীর ক্যাম্পে - ত্রিপলের তাঁবুতে।

আরো মজার কথা, যারা ছিলেন এই গণহত্যার দায়িত্বে, তাদের মধ্যে অনেকেই ব্যক্তিগত সাক্ষাতকারে স্বীকার করেছেন গণহত্যার কথা। যেমন ধরা যাক ইয়াসিন মালিক বা
"বিট্টা কারাটে"র (ফারুক আহমেদ দার) কথা। এরা গণহত্যার পরে এখন হিরো হয়ে বেঁচে আছেন। কাল "বিট্টা কারাটে"র ইন্টারভিউ দেখলাম ইউটিউবে। শান্ত গলায় সে দাবী জানাল সে বিশ জনকে মেরেছে - আর তার জন্য সে যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা ফাঁসির সাজা আশা করছে (২০০৬ সালে ছাড়া পেয়েছে ফারুক, এখনো কাশ্মীরে আছে)। বিবিসির সাথে ইন্টারভিউতে একইভাবে গণহত্যার কথা স্বীকার করেছেন ইয়াসিন মালিকও। কিন্তু এদের বিচারের ব্যবস্থা নেই - যেমন নেই গুজরাটে দাঙ্গাকারীদেরও।

কালরাতে বাড়ি ফিরে আরো একটু ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করে মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল। কাশ্মীরী পণ্ডিতেরা ভারতের - নিজভূমে পরবাসী’দের (Internally Displaced People) মাত্র অর্ধেক। বাকি অর্ধেকের মধ্যে আছে আসামের সাঁওতালরা - যাদের এককালে আসামে এনেছিল ব্রিটিশেরা - চা বাগানে কাজ করানোর জন্য। আছে গুজরাটি দাঙ্গাপীড়িতরা, মিজোরামের উপজাতিরা - যারা আশ্রয় নিয়েছে ত্রিপুরাতে আর মাওবাদী হামলায় ঘরছাড়া গ্রামবাসীরা। এর সাথে শুরু হচ্ছে কর্পোরেট ডিসপ্লেসমেন্ট - মানে শিল্পের জন্য জমি নিতে গিয়ে উচ্ছেদ। কম করেও ছয় লাখ লোক আছেন এই "নিজভূমে পরবাসী"দের দলে। দিন যাচ্ছে, কারোর দেশে ফেরার কোনও আশা দেখা যাচ্ছে না - সরকার পুনর্বাসনের জন্য “কথাবার্তা” চালাচ্ছে। মাঝে মাঝে মনে হয়, আদিম মানুষেরা নিজের জায়গায় থাকার অধিকারটা অন্তত নিশ্চিত করেছিল। আমরা অনেক এগিয়ে গিয়ে কি সেই পুরোনো অধিকারটাই হারিয়ে ফেলছি? তবে ওই - “অন্যের মানবাধিকার” নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কি লাভ? তাই আজ আমিও আবার পুরোপুরি কাজে ডুবে গেছি। স্বার্থপরতা জিন্দাবাদ!!

পুনশ্চ - অশোক পণ্ডিতের একটি তথ্যচিত্র ইউটিউবে দেখতে পারেন কাশ্মীরী পণ্ডিতদের নিয়ে - প্রথম খণ্ড, দ্বিতীয় খণ্ড

বিট্টা কারাটের ইন্টারভিউ ইউটিউব থেকে তুলে দিলাম।


মন্তব্য

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

চমতকার লাগলো। ভারত নিয়ে আজ বিশ্ব জুড়েই মানুষের কৌতুহল অনেক বেশী। কাজে যেমন প্রতিদিনই এমার্জিং মার্কেটস নিয়ে কিছু না কিছু শুনতে হয় বা পড়তে হয়। আর ভারত সেই এমার্জিং মার্কেটস-এর অগ্রভাগে। একদিকে করপোরেট মিডিয়ার 'ইন্ডিয়া শাইনিং'। আরেকদিকে সাইনাথ বা অরুন্ধুতি যেই ভঙ্গুর ইন্ডিয়া নিয়ে লেখেন, সেই ইন্ডিয়া। এইরকম আরো লেখার অপেক্ষায় থাকলাম।
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

খুব ভাল্লাগ্লো।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

হাসান মোরশেদ এর ছবি

কাশ্মীর নিয়ে আলোচনায়-মুসলিম জংগী কর্তৃক হিন্দু পন্ডিতদের নিধনের সত্যটা বেকবেঞ্চড হয়ে থাকে ।
দিগন্তকে ধন্যবাদ মুদ্রার অপরপিঠ মনে করিয়ে দেয়ার জন্য ।
তবে এই আলোচনায় ভারতীয় সেনাবাহিনী কর্তৃক কাশ্মীর উপত্যাকায় মুসলিম জংগী নিধনের নামে মুসলমান জনগোষ্ঠীকে হত্যা বিষয়টা ও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই ।
হিন্দু পন্ডিতদের হত্যা,নিজ বাসভূম থেকে তাদের উৎখাত অবশ্যই মানবাধিকারের চরম লংঘন- সেই সাথে এইসব ঘটনার শুরু এবং উস্কে দেয়ার জন্য দিল্লী ভিত্তিক ভারত শাসকদের ভুমিকা ও আলোচনা হওয়া দরকার ।

জেন্ডারসাইট ওয়াচের গবেষনায় এ বিষয়টি বেশ নির্মোহভাবে এসেছে । ভারতীয় সেনাবাহিনীর আতংকবাদী নির্মুলের নামে কাশ্মির উপত্যাকায় গনহত্যা চালানো আর তার অসুস্থ প্রতিক্রিয়া হিসাবে পাকিস্তান সমর্থিত জংগী গ্রুপগুলোর হিন্দু পন্ডিতদের নিধন ।

কাশ্মীর গনহত্যা

কাশ্মীরে পণ্ডিতেরা হল আদি কাশ্মীরী - কয়েক হাজার বছর ধরে কাশ্মীর উপত্যকার স্থায়ী বাসিন্দা।

এই মন্তব্যকে ঘিরে আরো আলোচনার সুযোগ আছে ।
আমি যতোদুর জানি আদি ভারতে যে আর্যরা এসেছিলেন তাদের প্রায় অবিমিশ্র বংশধর হলেন কাশ্মীরী পন্ডিতেরা ( পন্ডিত নেহেরু ও এই বংশধারার) । তাদের উন্নত নাসা, গৌরবর্ন,দীর্ঘদেহ -অনার্য্য ভারতীয়দের থেকে আলাদা দ্রষ্টব্য । আদি ভারতে আর্য্য আগ্রাসন/প্রবেশ/জয় কয়েক হাজার বছর আগের ঘটনা নিঃসন্দেহে । সে হিসাবে কাশ্মীরী পন্ডিতেরা কয়েক হাজার বছরের পুরনো অবশ্যই । জম্মু-কাশ্মীর উপত্যকা তাদের আদিবাস নিঃসন্দেহে । তবে কাশ্মিরের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান যাদের রাজা ছিলেন হিন্দু,দেশ বিভাগের সময় যারা স্বাধীন রাজ্যের মর্যাদা পেয়েছিল কিন্তু প্রথমে পাকিস্তানী আগ্রাসন ,পরে এই আগ্রাসন থেকে বাঁচতে গিয়ে ভারতীয় আগ্রাসনে বন্দী হওয়া-এই জনগোষ্ঠী কি বাইরে থেকে কাশ্মীরে যাওয়া? ধর্ম প্রচার ও রাজ্য জয়ে আরব পারস্যের মুসলমানরা ভারতে এসেছে । কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশের প্রায় সকল মুসলমান কিন্তু আরব-পারসিকদের বংশধর নয় । তারা এই মাটিরই সন্তান । নিম্নবর্নের হিন্দু থেকে ধর্মবদলে মুসলমান ।
বাংলা ,কাশ্মীর,সিন্ধুর মুসলমানরা কখনোই বাইরে থেকে মানুষ নয় ।

ধন্যবাদ দিগন্ত'কে আবারো ।
-----------------------------------------
মৃত্যুতে ও থামেনা উৎসব
জীবন এমনই প্রকান্ড প্রচুর ।।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

দিগন্ত এর ছবি

"এই জনগোষ্ঠী কি বাইরে থেকে কাশ্মীরে যাওয়া?"

- কোনোভাবেই নয় আর কেউ দাবীও জানায়নি। কাশ্মীরী পণ্ডিতদের কাশ্মীর থেকে উচ্ছেদ করার সময় যে স্লোগান চলত সেটা হল - "কাশ্মীর ফর কাশ্মীরীস"। মজার কথা কাশ্মীর যদি কাশ্মীরীদের হয় তবে কাশ্মীরী পণ্ডিতেরা কেন জায়গা পাবেনা সেখানে?
"জেন্ডারসাইট ওয়াচের গবেষনায় এ বিষয়টি বেশ নির্মোহভাবে এসেছে ... তার অসুস্থ প্রতিক্রিয়া হিসাবে পাকিস্তান সমর্থিত জংগী গ্রুপগুলোর হিন্দু পন্ডিতদের নিধন ।
"
- আমার মনে হয়না ব্যাপারটা ঠিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দিয়ে আবদ্ধ - সে ক্ষেত্রে কাশ্মীরী পণ্ডিতদের একাংশ আবার যুদ্ধে লিপ্ত হত। তবে জেন্ডারসাইডের লেখাটা অনবদ্য ও তার লিঙ্ক দিয়ে দিলাম। তবে আমার হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্টটাও খুব ভাল লেগেছে।

গোটা কাশ্মীরে মানবাধিকার নিয়ে ছেলেখেলা করেছে ভারত আর পাকিস্তান সরকার মিলে। হিসাব বের করতে শুরু করলে ঠগ বাঁচতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।