আমার অরকুটপ্রীতি নিয়ে

দিগন্ত এর ছবি
লিখেছেন দিগন্ত (তারিখ: বিষ্যুদ, ১০/০১/২০০৮ - ২:৩৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সচলায়তনে অরকুটের কমিউনিটি ভোটের মত ভোটের ব্যবস্থার অভাব আমি খুব অনুভব করি। অবশ্য সেক্ষেত্রেও অনেকেই ভোটে বিরত থেকে ভোট বিফল করে দিতে পারেন, তাও। এমনকি খবরের কাগজগুলোর মত রোজকার বা এমনকি সাপ্তাহিক ভোটের ব্যবস্থা থাকলে আরো ভাল হত। আর ভোটের সাথে সাথে মন্তব্য করার ব্যবস্থা থাকলে তো সোনায় সোহাগা। ব্লগ তখন আর ব্লগ না থেকে পুরোদস্তুর সামাজিক মায়াজালে পরিণত হত।

যাহোক, অরকুট নিয়ে কথা শুরু করেছিলাম অরকুটেই ফিরে যাই। অরকুট করা শুরু করি আমি বছর দুয়েক আগে। সোসাল নেটওয়ার্কিং বলে বস্তুটা যে কি, তা বিশেষ একটা টের পাইনি তখনো। যাহোক, অরকুটের দৌলতে প্রথম দিকে আমি কলেজের পরিচিত, আর অল্প-পরিচিতদের সাথে পরিচিতিটা ঝালিয়ে নেবার জন্যই ব্যবহার করতাম। পরিচিতি শুধু বললে ভুল হবে, পরিচিতির সাথে সাথে কে কি করছে, কোথায় আছে – কেমন আছে, সবই টের পাওয়া যেত। বুঝলাম, ইন্টারনেট মানুষকে কাছে এনে দেবার যে উদ্যোগ নিয়েছে, সোসাল নেটওয়ার্কিং হল তার একটা অঙ্গ।

দিন গেছে, আমার অরকুটপ্রীতি বেড়েছে বই কমে নি কিছু। এখন মাঝে মাঝে লোকজনের স্ক্র্যাপ ঘেঁটে দেখি কে কি করছে। কি করছের মধ্যে অনেক কিছু আছে। কেউ চাকরি পরিবর্তন করলে সে খবর আসে অরকুট মারফত। কারো প্রেম ফাঁকি দিয়ে গেছে – অরকুট থেকেই বোঝা যাচ্ছে – কারণ বন্ধুতালিকায় প্রেমিকার অনুপস্থিতি। এমনকি, অ্যালবাম থেকে দেখা গেল, পুরোনো প্রেমিকার সাথে বিচ্ছেদের পরে আবার জোড়া লেগে বিয়ে – এ ঘটনাও অরকুটেই দেখলাম। লোকজনের সাথে আর যেচে আড্ডা মেরে জানতে হয় না কেমন আছে, অরকুটের পাতায় চোখ লাগলেই হয়। সবাই সবার অ্যালবাম দেখতে পায় আর স্ক্র্যাপ পড়তে পারে বলে পরনিন্দা-পরচর্চার একটা ভাল উতস হয়ে গেছে এটা। কয়েকজন বন্ধু মিলে বসলে দিব্যি কয়েকঘন্টা কেটে যাবে এর পেছনে।

আমার এই সামাজিক মায়াজালের সবথেকে বড় লাভ হল আমার ছোট্টবেলার স্কুলের বন্ধুদের সাথে আবার যোগাযোগ। সেটা ১৯৮৯ সালের কথা। আমি ক্লাস ফোর পাস করে কল্যাণী ছেড়ে চলে এলাম বর্ধমানে। তারপরে আর তাদের সাথে যোগাযোগ নেই। অরকুট পেতেই, আমার স্কুলের নাম দিয়ে কমিউনিটি দেখে তাতে যোগদান করেছি, কিছুদিন পরে দেখলাম তাতে সুদীপ বরণ দে বলে একটা ছেলে যোগ দিল। আমি মনে করলাম সেই আমার ছোটবেলার প্রিয় বন্ধু সুমিতের ভাই নয় তো? নামটা তো একই রকম - সুমিত বরণ দে আর সুদীপ বরণ দে। সটাসট স্ক্র্যাপ আর তার উত্তরও আসে জলদি। আমিই ঠিক, সুদীপ সুমিত বরণের ভাই। সেই সুমিত আর আমার মধ্যে বন্ধুত্বও ছিল যেমন তেমন ছিল ক্লাসে প্রতিযোগিতাও। তার সাথে ১৮ বছর পরে সাথে ফোনে যোগাযোগ। সে এখন কবি হয়ে গেছে, পুরোদস্তুর সাহিত্যিক। আমার সাথে এতদিন পরে যোগাযোগ পেয়ে সেই স্মৃতিতে একটা কবিতাই লিখে ফেলল। ভাবা যায়!! আমি কোথায় কর্পোরেট জীবনে কম্পিউটার টিপে জীবন চালাচ্ছি, সেই আমার কবি বন্ধু? আরো একে একে আমার বাকি বন্ধুদের সাথেও যোগাযোগ হল। আমার ছোটবেলার খেলার সাথীদের সাথে ভার্চুয়াল দেখা করতে যে কি ভাল লাগল ... ক’দিন আগেই এক বন্ধুর সাথে স্ক্র্যাপালোচনা হল, ১৯৮৬র বিশ্বকাপে আমি কেমন প্লাতিনির সমর্থক ছিলাম আর ও মারাদোনার। শেষ হাসি আমি হাসতে পারিনি বলে আমার কেমন দুঃখ ছিল ... ইত্যাদি।

আমার আরেকটা নিজের চোখে দেখা বিষয় হল প্রোপাগান্ডা। অরকূটে যথেচ্ছভাবে যে যার খুশীমত নিজের মত লিখে চলে আর দাবী করে সে-ই একমাত্র সত্যের পূজারী। সাথে থাকে কিছু সমগোত্রীয় নিউজপেপার রেফারেন্স, যেগুলো কিছু বিশেষ মতের লোকজন ছাড়া কেউ পড়েই না। প্রোপাগান্ডার মধ্যে ধর্মই দেখি প্রাধান্য পায় – একবিংশ শতাব্দীতে এসেও এরকম ধর্মকেন্দ্রিক ধারণা দেখে আমি যারপরনাই বিস্মিত। আর বুঝলাম মানুষের এখনো শিক্ষিত হতে আরো অনেক দেরি আছে – প্রোপাগান্ডা মোটামুটি সবাইকে কিছু না কিছু প্রভাবিত করে, এত নিউজ-সোর্স থাকা সত্ত্বেও। অনেক কাল ভারত-পাকিস্তান বন্ধুত্ব কমিউনিটির সদস্য হিসাবে বুঝেছিলাম যে কেউ কারোর মতাদর্শ থেকে একচুলও সরতে রাজী নয় – বন্ধুত্ব আসবে কি ভাবে? সবাই তো শত্রুতার ইতিহাস আলোচনাতেই ব্যস্ত।

অরকুটের পরে আসি লিঙ্কড-ইন, হাই-ফাইভ আর ফেসবুকে। প্রথমটা একটা অন্যধরনের লোকজনের জন্য, মানে যারা কর্পোরেট শুধু কর্পোরেটই থাকতে চায় – তাদের জন্য। পরের দুটো অরকুটের সমগোত্রীয়। তার মধ্যে ফেসবুকটাকে আমার খুব একটা পছন্দ হল না, সবকিছুইই বড় জটিল মনে হয়। সাধারণ মানুষ যে কিভাবে ব্যবহার করে এগুলো – বুঝে পেলাম না। এরপরে আমার তো মনে হয় একই জিনিস মোবাইলে চলে আসবে – খুব দ্রুত। এস-এম-এসের মাধ্যমে স্ক্র্যাপিং তো এখনই চলছে ...

আর কি দুনিয়া এগিয়ে চলেছে বনবন করে ঘুরতে ঘুরতে, আর আমরাও তার চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছি। নেট খুলে আজকাল আমি আনন্দবাজারের সম্পাদকীয়, টাইমস অব ইন্ডিয়া আর নিজের ই-মেল চেক করার মত অরকুটের পাতাতেও ঢুঁ দিয়ে যাই – যদি দেখা হয়ে যায় আমার পুরোনো কোনো বন্ধুর সাথে।


মন্তব্য

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

প্রোপাগান্ডার মধ্যে ধর্মই দেখি প্রাধান্য পায় – একবিংশ শতাব্দীতে এসেও এরকম ধর্মকেন্দ্রিক ধারণা দেখে আমি যারপরনাই বিস্মিত। আর বুঝলাম মানুষের এখনো শিক্ষিত হতে আরো অনেক দেরি আছে ...

আপনার এই মন্তব্যেই (বিপ্লব)

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

দিগন্ত এর ছবি

কি আর বলি বলেন, আমার আগে ধারণা ছিল প্রোপাগান্ডা বুঝি কোম্পানির মার্কেটিং আর কিছু পলিটিকাল আইডিয়া নিয়েই হয়। এসে দেখি এ হুজুগ আরেক। পৃথিবী আমার চোখে অনেক নেমে গেছে অরকুটে লোকজনের সাথে আলাপ হবের পরে।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

সবজান্তা এর ছবি

অর্কুটে প্রাইভেসি সমস্যাটা একটু প্রকট, বিশেষত মেয়েরা অনেকেই এমনটা বলে থাকেন ( পরিচিতারা অনেকেই সেই দিকেই তর্জনী তুলেছেন )।

ফেসবুক এদিক থেকে এগিয়ে থাকলেও, অজস্র আলতু ফালতু ফিচার, মূল ব্যাপারটিকেই নবাগতদের কাছে ঘোরতর কঠিণ করে ফেলছে।
------------------------------------------------------
অলমিতি বিস্তারেণ

দিগন্ত এর ছবি

প্রাইভেসি এখন মনে হয় আছে - মানে নিজের স্ক্র্যাপ আর অ্যালবাম লুকিয়ে রাখা যায়।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

অমিত আহমেদ এর ছবি

আমি ফেসবুকের ফ্যান।
বাকি গুলো কেমন জানি খেলো মনে হয়।


ওয়েবসাইট | ফেসবুক | ইমেইল

দিগন্ত এর ছবি

কেন বলেন তো? আচ্ছা, আপনি আমাকে ফেসবুকের ৩টে বৈশিষ্ট্য বলেন যা আপনাকে আকর্ষণ করে ...


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

অমিত আহমেদ এর ছবি

ফেসবুকের ইউজার ইন্টারফেসটা সবচেয়ে ফিজিবল। ট্রেনিং টাইম পেরিয়ে গেলে ইন্টারফেসের প্রেমে পরে যাবেন। সিকিউরিটিতেও ফেসবুক সেরা, লিমিটেড প্রোফাইল জিনিসটা ভাল... আর কনট্যাক্ট প্রতি সিকিউরিটি সেটিং এর ফিচারটা এলে গেলে তো কথাই নেই। ইচ্ছে মত অ্যাপ্লিকেশন এমবেড করা যায়, কিন্তু সেগুলো সবই ক্লিক এওয়ে। হাই ফাইভ কিংবা মাই স্পেসের মত হুট করে গান শুরু হয়ে যায় না।


ওয়েবসাইট | ফেসবুক | ইমেইল

অমিত আহমেদ এর ছবি

আর মাল্টিমিডিয়া কনটেন্ট শেয়ার করার জন্যও ফেসবুক সেরা। ছবি হোক, ভিডিও হোক, কিংবা অডিও হোক।


ওয়েবসাইট | ফেসবুক | ইমেইল

সবজান্তা এর ছবি

অমিত আহমেদ কে এই উত্তরের জন্য জাঝা
--------------------------------------------------------
অলমিতি বিস্তারেণ

সুমন চৌধুরী এর ছবি

আমি আছি ফেসবুকে এখনো। তবে ফান আর সুপার ওয়াল খুব বিরক্ত করে



ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

আমি FB এ আছি অনেকটা বন্ধুদের এটা সেটা দেখার আর জানার লোভে। নিজে তেমন কিছুই শেয়ার করি না, কোনও এপ্লিকেশনও ব্যবহার করি না। Flog-blog ছাড়া।
নির্জঞ্ঝাট জীবন যতোটা মেইনটেইন করা যায় আর কি!

গৌতম এর ছবি

ফেসবুকের কিছু কিছু ফিচারে আমি ইদানিং অসম্ভব বিরক্ত হচ্ছি। সারাদিনে কয়টি যে ফানওয়াল-সুপারওয়াল ইত্যাদি হাবিজাবি আসে! এডুকেশন সিস্টেম নিয়ে আমি একটি গ্রুপ খুলেছিলাম। পরিচিতজনদের বলেছিলাম সেখানে লিখতে। সবাই বরং এই দুই ওয়াল নিয়ে বেশি ব্যস্ত। তবে অনেক অ্যাপ্লিকেশনই চমৎকার। অরকুটের নাম আগে শুনেছিলাম, কিন্তু দেখা হয়নি।

..................................................
ছিদ্র খুঁজে বেড়াই, বন্ধ করার আশায়

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

অমিত আহমেদ এর ছবি

ফানওয়াল-সুপারওয়াল কিন্তু ফেসবুকের ফিচার নয়। এক্সটারনাল অ্যাপ্লিকেশন। ভাল না লাগলে আনইন্সটল করে ফেলেন না কেন?


ওয়েবসাইট | ফেসবুক | ইমেইল

নিঘাত তিথি এর ছবি

অর্কুটে আছি অনেক দিন ধরে। তবে রাগিব ভাই যেমন বললেন, বাংলাদেশে অর্কুট তেমন জনপ্রিয় হয়ে উঠার আগেই হাই ফাইভ, ফেসবুক এসে গেছে। ফেসবুকে আলগা-হাবিজাবি মার্কা প্রচুর এপ্লিকেশন আছে (অতি ত্যক্ত লাগে) যেগুলো সম্ভবত পোলাপানের খুব পছন্দ হয়েছে। এইগুলা দিয়ে টাইম-পাস করা যায় বোধহয় অনেক। ফেসবুকের আরেকটা সুবিধা, যেকোন আইডি দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করা যায় যেখানে অর্কুটে শুধুমাত্র জিমেইল আইডি-ই এপ্লিকেবল। আর বাংলাদেশে ফেসবুকটা খুব জনপ্রিয় হয়ে যাওয়াতে এখানে পুরনো বন্ধু-বান্ধব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে, এটা একটা বড় সুবিধা। শুধুমাত্র এই কারনে ফেসবুকে একাউন্ট খুলেছি।
ইদানিং অর্কুট, ফেসবুক কোনটাই তেমন ভাল্লাগে না, তবু ওই পরিচিতদের সাথে যোগাযোগের টানেই মাঝে মাঝে ঢুঁ মারি।
----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

বিপ্রতীপ এর ছবি

সোস্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলোতে এখন আর নিয়মিত যাই না। অর্কুট তেমন একটা খারাপ লাগে নাই। তবে ফেসবুক কেমন কেমন লাগে। খুলতে প্রচুর সময় নেয়...এক্কেবারে দাড়িঁ-গোঁফ পেকে যাবার মতো অবস্থা!
ফেসবুক নিয়া এতোটা মাতামাতির তেমন কোন কিছু চোখে পড়লো না। তবে অনেকের যাথে যোগাযোগ রাখার জন্য এসব সাইট বেশ ভালো। আমার স্কুলের বেশ কয়েকজন বন্ধুকে ঐদিন ফেসবুকে পেলাম।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
খুঁজে যাই শেকড়ের সন্ধান…

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।