সুস্বাগতম কসোভো

দিগন্ত এর ছবি
লিখেছেন দিগন্ত (তারিখ: সোম, ১৮/০২/২০০৮ - ৬:৪৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সুস্বাগতম কসোভো!! নতুন আরেকটি দেশ পথচলা শুরু করল গতকাল। সংবাদটা পাবার পর থেকে বেশ ভাল লাগল, অবশেষে কিছু একটা পজিটিভ বেরিয়ে এলো মীমাংসা হিসাবে। অনেকদিন ধরেই আমি নজর রেখে চলেছি এই ছোট্ট ভূখন্ডের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ওপর। যুগোশ্লাভিয়ার স্বৈরাচারী শাসক, তারপরে আলবেনিয়ানদের বিতাড়িত করা, শেষে ন্যাটো আর কসোভো লিবারেশন আর্মির হাত ধরে উলটো কসোভোর সার্বদের ওপর প্রতি-আক্রমণ এবং সব শেষে প্রেসেডিন্ট নির্বাচন ও স্বাধীনতা ঘোষণা।

অনেকদিন ধরেই সবাই যুগোশ্লাভিয়ার সোসালিস্ট রিপাবলিকের কথা জানেন। সোভিয়েত সোসালিস্ট রিপাবলিকের মত এটিও অনেকগুলো রিপাবলিক নিয়ে তৈরী ছিল। তার মধ্যে প্রধান ছিল আজকের সার্বিয়া। এছাড়া ছিল মন্টিনিগ্রো, ক্রোয়েশিয়া, ম্যাসিডোনিয়া, বসনিয়া আর স্লোভেনিয়া। সার্বিয়ার মধ্যে হলেও কসোভো ছিল স্বশাসিত। এর মধ্যে অধিকাংশই ছিল আলবেনিয়ান আর বাকি সার্বিয়ান। তবে ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে দেখা যায় ষোড়শ শতকে এখানে সার্বরাই মূল অধিবাসী ছিল, ধীরে ধীরে আলবেনিয়ান মাইগ্রেশনের আর সংখ্যাবৃদ্ধির ফলে জায়গার অধিকাংশ অধিবাসী আলবেনিয়ান হয়ে যায় বিংশ শতকের গোড়া থেকেই।

তা সমস্যা সৃষ্টি হল ১৯৮০ সালে যুগোস্লাভিয়ার অধিপতি জেনারেল টিটোর মৃত্যুর পর থেকেই। সোভিয়েত সোসালিস্ট রিপাবলিকে যেমন ছিল রুশদের আধিপত্য, তেমনই সার্বদের সংখ্যাধিক্যের কারণে যুগোস্লাভ রিপাবলিকে ছিল সার্বদের দাপট। কিন্তু যুগোস্লাভ রিপাবলিকের মূল কমিটিতে আটটির মধ্যে ছটি রিপাবলিক নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে ভোটাভুটি করে দমিয়ে রাখত সার্বদের। টিটোর মৃত্যুর পরে, মিলোসেভিচের নতুন সরকার ঠিক করল রিপাবলিকদের স্বশাসন তুলে নেওয়া হবে সংবিধান সংশোধন করে। ফলে ব্যাপক অস্থিরতা শুরু হল ক্রোয়েশিয়া, স্লোভেনিয়া আর কসোভোতে। তারা মনে করল এটা মিলোসেভিচ সার্বদের চাপিয়ে দিতে চাইছেন যুগোস্লাভিয়ার ওপর। মিলোসেভিচের উদ্দেশ্যও ছিল তাই। যদি একবার সার্বিয়ার বাইরে বসবাসরত সার্বদের সমর্থন পাওয়া যায় তাহলে সব যুগোশ্লাভিয়া সার্বদের দাপট কেউ ঠেকাতে পারবে না।
এই ঘটনাই হল কসোভোর স্বাধীনতার শুরু। এর পরে নব্বইয়ের দশলে কসোভোতে আলবেনিয়ানরা হরতাল করা শুরু করল - সমর্থন মিলল ক্রোয়েশিয়া আর স্লোভেনিয়া থেকে। কিছুদিনের মধ্যেই যুগোস্লাভ রিপাবলিক ভেঙে গেল। আর উতখাত হয়ে দলে দলে সার্বিয়ায় এসে ভিড় করা সার্বদের জায়গা দেবার জন্য শুরু হল কসোভোতে পাঠানো। এর বিরুদ্ধে আলবেনিয়ানরা গঠন করল কসোভো লিবারেশন আর্মি - গরিলা বাহিনী। আক্রমণ শুরু হল সার্ব সিভিলিয়ান আর যুগোস্লাভ আর্মির বিরুদ্ধে। যুগোস্লাভ আর্মি শুরু করল আলবেনিয়ান জেনোসাইড। র‌্যাচাকের গণহত্যার পরে ন্যাটোও নড়চড়ে বসে। ১৯৯৯ সালে ন্যাটোর বোমারু বিমান পাঠিয়ে যুগোস্লাভ আর্মির বিরুদ্ধে বোমাবর্ষণ শুরু করে কিন্তু একের পর এক গণহত্যা চলতেই থাকে। উল্টদিকে আলবেনিয়ানরা একের পর এক সার্বিয়ান চার্চ আর মনাস্ট্রি ধ্বংস করে ফেলে।

যুদ্ধশেষে, ২০০২ সালে ন্যাটো জাতিসংঘের হাতে তুলে দেয় কসোভোর শাসনক্ষমতা। সাথে সাথেই শুরু হয়ে যায় প্রতি-আক্রমণের পালা। লাখখানেক সার্বসহ অন্যান্য নন-আলবেনিয়ান মাইনরিটিদের দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়। ২০০৪ এ একটা সাধারণ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবার সার্ব-আলবেনিয়ান দাঙ্গা বাধে - অনেক সার্ব বাড়িঘর ও চার্চ পুড়িয়ে দেওয়া হয়। কসোভো তখন ডি-ফ্যাক্টো স্বাধীন দেশ।

২০০৬ থেকেই বিভিন্ন টানাপোড়েন চলছিল কসোভোর স্বাধীনতা নিয়ে। জাতিসংঘ কিছুতেই মীমাংসায় পৌঁছতে পারছিল না চিন ও রাশিয়ার বিরোধিতার কারণে। এর মাঝেই ফেব্রুয়ারিতে হল প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ডেমোক্রাটিক পার্টির হয়ে ভোটে জিতলেন লিবারেশন আর্মির পুরোনো কম্যান্ডার হাসিম থাচি। উল্টোদিকে চাপ আসছিল সার্বিয়া থেকেও। তারাও স্বাধীন কসোভোকে কোনোভাবেই মেনে নেবেনা বলে দাবী জানিয়েছিল অনেকদিন ধরেই।

এরকম জটিল প্রেক্ষাপটে গতকাল ঘোষণা হয়েই গেল কসোভোর স্বাধীনতা। কিন্তু সাথে সাথেই টানাপোড়েন শুরু হয়ে গেল আন্তর্জাতিক মহলে - কে কে কসোভোকে স্বীকৃতি দেবে আর কে কে দেবে না - তা নিয়ে। মূলত আমেরিকা, ব্রিটেন আর ফ্রান্স স্বীকৃতি দিতে রাজি, আর অরাজী চিন ও রাশিয়া। এ ছাড়া যারা স্বীকৃতি দিতে পারে তাদের মধ্যে আছে সৌদি, পাকিস্তান, ইটালী, জাপান, আলবেনিয়া, জার্মানী, টার্কি ও সুইজারল্যান্ড। আর দেবে না বলে মনে করা হচ্ছে বসনিয়া, সাইপ্রাস, গ্রিস, রোমানিয়া, চেক রিপাবলিক, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, স্পেন, শ্রীলঙ্কা, জর্জিয়া ইত্যাদি অধিকাংশ দেশ। ভারত সরকারও ধীরে চল নীতি অবলম্বন করছে - তবে শেষে চিন, রাশিয়া আর শ্রীলঙ্কার পথই অবলম্বন করবে বলে মনে করা হচ্ছে। মজার কথা পাশাপাশি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ বসনিয়া স্বীকৃতি দিতে পারছে না নিজের বড়সড় সার্ব জনসংখ্যার জন্য - অথচ তারা ক্রোয়েশিয়ার মতই ছিল "ফেলো স্ট্রাগলার"।

সার্বিয়ার প্রস্তাবিত পতাকাটা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পতাকার সাথে মেলে - ম্যাপ আঁকা আছে পতাকায়।

কসোভোতে সংখ্যালঘু সার্বদের কি হবে সে নিয়ে অবশ্য সবারই মাথাব্যাথা চলছে। আসলে সারা যুগোস্লাভিয়াতেই বিভিন্ন জাতির লোকজনে পকেট-টেরিটরিতে বসবাস করে - অনেকটা স্বাধীনতা পূর্ববর্তী ভারতীয় উপমহাদেশের মত। তাদের মধ্যে জাতিগত দাঙ্গার ঘটনাও কম নয়। তাই এরকম একটা পার্টিশনের ফলে উদ্বাস্তুর সংখ্যা বাড়বে ছাড়া কমবে বলে মনে হয় না। সার্বরা আগেই উতখাত হয়েছে বসনিয়া আর ক্রোয়েশিয়া থেকে, এবার বাকিরা ফিরবে কসোভো থেকেও। তবে কোনো অবস্থাতেই স্বাধীন কসোভো থেকে ফিরে যাওয়া আর সম্ভব নয় বলেই মনে করা হচ্ছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সার্বরা এবার আবার ঘরে ফেরার জন্য বাক্স গূটোতে শুরু করে দিয়েছে। আর আলবেনিয়ানদের মার খাবার দিন শেষ - এখন তারা আনন্দের সাথে নতুন দেশ গড়ার কাজে জেগে উঠবে।
auto


মন্তব্য

রাতুল এর ছবি

আল জাজিরাতে যা দেখলাম তাতে মনে হলো কসভোতে আমেরিকার পতাকাই বেশী উড়ছে।
আমরিকার ক্ষেপনাস্র নীতির সফল করার পথে বিশাল পদক্ষেপ।

হিমু এর ছবি

গতকাল শহরের কেন্দ্রীয় চত্বর কোয়নিগসপ্লাৎসে দেখলাম ঢাক পিটিয়ে বাজনার তালে তালে নাচছে কাসেলে কসোভো থেকে আগত মানুষেরা। কসোভোর পতাকা তো দেখে মনে হলো লাল জমিনের ওপর কালো কোন পাখি (ঈগল বা এই গোছের কিছু)।

যারা নাচতে এসেছিলেন তাদের হাতে কসোভোর পতাকা ছাড়াও জার্মানী আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা ছিলো। ট্রাম মোড় ঘোরার পর দেখি গাড়ির ওপর কসোভোর পতাকা টাঙিয়ে তীব্র বেগে কোয়নিগসপ্লাৎসের দিকে যাচ্ছে বেশ বড়সড় এক কনভয়, আর সমানে ভেঁপু বাজাচ্ছে।


হাঁটুপানির জলদস্যু

দিগন্ত এর ছবি

আপনি যেটা দেখেছেন সেটা হল কসোভো লিবারেশন আর্মির পতাকা। তার মাঝে ওদের লোগোও আছে লাগানো। auto


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

হিমু এর ছবি

ঠিক। কসোভোর পতাকা কারো হাতেই চোখে পড়েনি তাহলে!


হাঁটুপানির জলদস্যু

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

যেসব দেশে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন আছে বা তার সম্ভাবনা আছে (রাশিয়া, স্পেন যেমন), সেই দেশগুলো স্বীকৃতি সহজে দেবে বলে মনে হয় না।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

দিগন্ত এর ছবি

রাশিয়া বিপক্ষে কারণ চেচনিয়া, স্পেন বিপক্ষে কারণ কাতালোনিয়া, চিন বিপক্ষে কারণ তিব্বত আর শিঞ্জিয়াং, ভারত বিপক্ষে কারণ কাশ্মীর, শ্রীলঙ্কা বিপক্ষে কারণ উত্তরের তামিলরা। এই তো হালত ...


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- কসোভো কিংবা মন্টিনিগরোর ললনাদের চাইতে সার্ব ললনারা অনেক সুন্দরী। গড়ন, বলন, চলন, চাহন সবকিছুতে। আমার একবার ক্র্যাশ হয়েছিলো একজনের ওপর। তার মা'র আবার আমাতে অগাধ বিশ্বাস। পরিচিত আরকি! একবার নিরালায় সুযোগ পেয়ে মেয়েটিকে খাঁটি বাংলাদেশী স্টাইলে প্রেম নিবেদন করে বসি। কন্ডিশন দিয়েছি, দরকার হলে ছাড়িব জর্মন দেশ, করিব বাস সার্বিয়াতে বেশ, যদি ছড়ানো থাকে আমার মুখেতে- ও সুন্দরী তোমারি ঐ কালো কেশ!

অমায়িক ললনাটি বলে, আমি কখনোই তোমাকে ঐভাবে ভাবিনি! মন খারাপ
আর তার মা বলে, আমি ডিজএ্যাপয়েন্টেড!!
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।