আইন্সটাইনের জন্মদিন উপলক্ষ্যে যে দুটো লেখা লিখেছিলাম এটা তার শেষটা। এটা ১৯৭৯ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী ওয়েইনবার্গের বক্তব্যের ভাবানুবাদ। শেষে আমি বক্তব্যের ইউটিউব ভিডিওটাও দিয়ে দিলাম, প্রথম আড়াই মিনিট বিজ্ঞান-আলোচনার পরে এই বিজ্ঞান-চিন্তার বিষয়ে উনি কথা বলেছেন।
বিগ ব্যাং বা অন্য মহাজাগতিক ঘটনাগুলোর জন্য প্রমাণ সংগ্রহ করার জন্য মানববিহীন স্পেসক্রাফটই যথেষ্ট ছিল। হাবল স্পেস টেলিস্কোপ বা কোবে স্যাটেলাইট - এদের কোনোটাতেই মানুষ ছিল না। আসলে বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণের জন্য যদি মহাকাশযান পাঠানো হয়, তাতে মহাকাশচারী লাগে না, বরং মহাকাশচারী থাকলে সমস্যা বাড়ে ছাড়া কমে না। দুঃখের বিষয় গত কয়েক বছরে রাশিয়া আর আমেরিকা মহাকাশ বা চাঁদে আবার মানুষ পাঠানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। এর খরচা ট্রিলিয়ন ডলারে পড়তে পারে। খরচা হলেও একেও আমরা মেনে নিতে পারি এই অর্থে যে আমরা খরচা করে ফুটবল খেলাও দেখি বা টিভিতে সিরিয়াল বা বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানও দেখি। কিন্তু এর সাথে বিজ্ঞানকে মিশিয়ে ফেলা উচিত নয়। প্রকৃত বিজ্ঞান শুধু পর্যবেক্ষণ নিয়েই মাথা ঘামায়, মানুষ মহাকাশে গেল কিনা তাতে কিছু যায় আসে না। সেই পর্যবেক্ষণগুলোকে এক সূত্রে গেঁথে ফেলাই হল বিজ্ঞানের কাজ। যে বিজ্ঞান চাঁদে মানুষকে নিয়ে গিয়ে গলফ খেলায়, সে বিজ্ঞানের ডিসনী ভার্সান, বিনোদনের জন্য তৈরী, জ্ঞানবৃদ্ধির জন্য নয়।
আমাদের যে বিষয়টা নিয়ে সবথেকে বেশী প্রভাবিত করে সেটা হল বিজ্ঞানমনস্কতা। আমরা কেউই হয়ত চাঁদে যাব না, কিন্তু চাঁদ সংক্রান্ত গবেষণা ও তার গতিপ্রকৃতি সবাই জানতে পারবে। আমরা আরো বেশী করে জানতে পারব আমাদের প্রকৃতি আর পরিবেশ নিয়ে। বিজ্ঞানের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় প্রকৃতির সূত্রগুলোর ধীরে ধীরে রহস্য উন্মোচন করে এসেছে। সেই কবে টাইকো ব্রাহে বলেছিলেন যে পৃথিবীও সূর্যের চারপাশে ঘোরা আর কয়েকটা গ্রহের মধ্যে একটা। তাকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। বিশ শতকের গোড়ায় হাবল সেই ধারণাকে প্রসারিত করে বললেন যে এমনকি আমাদের আশে পাশের দেখা তারাগুলো মিলে যে ছায়াপথ - এরকম অসংখ্য ছায়াপথ নিয়ে মহাবিশ্ব - আর একেকটি ছায়াপথে কোটি কোটি নক্ষত্রের সমাবেশ। আর এখন বলা হচ্ছে আমরা যে বিগ-ব্যাং এর ফসল, সেই বিগ-ব্যাংও হাজারে হাজারে বিগ ব্যাং-এর মধ্যে একটা। ঘটনাক্রমে এই বিগ-ব্যাং-এর ফলে সৃষ্ট মহাবিশ্বে কিছু মাত্রা এমনভাবে সম্পর্কিত, যে প্রানের উদ্ভব হওয়া সম্ভব হয়েছে।
বিজ্ঞান তো শুধু জ্ঞানবর্ধক নয়, বিজ্ঞান সত্য অনুসন্ধানের কাঠামোও বটে। আমরা বিজ্ঞানী হিসাবে কোনো সময়ে মনে করি না যে আমরা কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে নিশ্চিত। বিগ-ব্যাং এর মত কিছু তত্ত্ব হয়ত সর্বজনগৃহীত হয়ে যায় কিন্তু তাও আমরা স্বীকার করি যে এ বিষয়ে অনেককিছুই আমাদের এখনও অজানা। বিগ ব্যাং-এর শুরুর দিকে মহাস্ফীতি বা তারও আগে কোয়ান্টাম দশায় মহাবিশ্বের অবস্থা কেমন ছিল তা নিয়ে যখন আলোচনা হয় তখন আমরা স্বীকার করেই নি এর অনেক কিছুই আমাদের কল্পনা ও ব্যক্তিগত ব্যাখ্যা। কিন্তু, মতামত আলাদা বলে কাউকে পুড়িয়ে মারা হয় না - যদিও অনেকের মতামতই যথেষ্ট অদ্ভুত ধরণের।
আমাদের এই বিজ্ঞানলব্ধ জ্ঞান যুক্তি ও পর্যবেক্ষণ-নির্ভর। তার মানে এ নিজেই নিজেকে সংশোধন করে নিতে পারে। আর এটা মানব-সংস্কৃতির ওপর নির্ভর করে না। মহাকাশবিজ্ঞান আমাদের এখানে যে ভাবে পড়ানো হয় সেই একই ভাবেই জাপান বা ভারতেও পড়ানো হয়। মহাকাশবিজ্ঞানে আমার আর তাদের জন্য আলাদা সূত্র বা ব্যাখ্যার কোনো স্থান নেই। আমরা হয়ত ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছি, কিন্তু চেষ্টা করছি সবাই মিলে যাতে সঠিক ব্যাখ্যায় পৌঁছনো যায়। এটা আমাদের সংস্কৃতির কোনো উপবৃদ্ধি নয়।
সবশেষে বলি আমাদের বিজ্ঞানীমহলের একটা অভ্যাস সারা পৃথিবীর অনুকরণীয়। আমাদের বিজ্ঞানীজগতে অনেক 'হিরো' পাওয়া যায় - মহাকাশবিজ্ঞানে 'হিরো'দের কথা বলতে গেলে বলতে হয় আইন্সটাইন, হাবল, চন্দ্রশেখর, পেনরোজ বা হকিং এর নাম। কিন্তু তারা কেউই নবী বা প্রফেট নন। বিজ্ঞানে এমন কেউ নেই যার কথা গবেষণা করার সময় আমরা মনে রাখি। ঐতিহাসিক বিষয় উৎসাহ না থাকলে শুধু বৈজ্ঞানিক প্রয়োজনে কেউ আজকাল আর আইন্সটাইনের পেপার পড়ে না। যে কোনো বিশবিদ্যালয়ের ছাত্র আজ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব আইনস্টাইনের চেয়ে ভাল ছাড়া খারাপ বোঝে না - কারণ এই বিষয়ে জ্ঞান ক্রমবর্ধমান। আমরা আইন্সটাইনকে সম্মান করি কিন্তু শুধু তার বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করে কয়েকজন বিজ্ঞানীর তত্ত্বের মধ্যে বিবাদ-মীমাংসা করাই না। অন্যভাবে বললে, আমাদের জগতে 'হিরো' অনেক আছে, কিন্তু কোনো 'প্রফেট' নেই। আজকের দুনিয়ায় তাকালে দেখা যায় মানুষ কত সহজে হাজার বছর আগে কিছু বইয়ের ওপর শতভাগ ভরসা রেখে একে অপরকে খুন করতেও ভেবে দেখছে না। 'প্রফেট'-দের থেকে পৃথিবীর এইরকম লাভ হলে আমার মতে তাহলে বিজ্ঞানী-মহলের অভ্যাসটাই ভাল - 'প্রফেট' কম, কিন্তু 'হিরো' বেশী।
মন্তব্য
যতই পড়ছি ততই অবাক হচ্ছি। গতকাল আইনস্টাইনের অনুবাদটা পড়লাম, আজ ওয়াইনবার্গেরটা। অধিকাংশ বিজ্ঞানীরাই একেবারে ইতিবাচক ট্র্যাকে কথা বলেন। এসব যুক্তির বিরুদ্ধে বলাটাই যুক্তিহীন মনে হয়। লাস্টের কথাটাও গেঁথে গেলো অন্তরে:
তবে মনুষ্যবাহী নভোযানের বিষয়ে আমি কিছুটা দ্বিমত পোষণ করছি। ১৯৬৯ সাল থেকে মার্কিনীরা চাঁদে যে মানুষগুলো পাঠিয়েছিলো সেগুলোকে আমিও সমর্থন করি না। কারণ সেগুলো ছিল কেবল স্নায়ু যুদ্ধে এগিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু, এটা ঠিক, পৃথিবীতে ঘরে বসে বিজ্ঞান চর্চা করলেই শুধু হবে না। ছড়িয়ে পড়তে হবে নক্ষত্র থেকে নক্ষত্রান্তরে, ছায়াপথ থেকে ছায়াপথান্তরে। বিজ্ঞান চর্চা আর ঝুঁকিপূর্ণ জয়যাত্রা দুটোরই প্রয়োজন আছে।
এই কথাটার সাথেও পুরোপুরি একমত নই। সব বিজ্ঞানীই কিন্তু স্বপ্ন দেখেন যে মহাকাশে মানুষ ছড়িয়ে পড়বে। এই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়া তো অবশ্যম্ভাবী। এট ঠিক বিষয়টা প্রযুক্তি আর প্রকৌশলের, বিজ্ঞানের নয়। কিন্তু, মানুষের মহাবিশ্বের দূর দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ার বিজ্ঞানও কিন্তু এখন পর্যন্ত সম্পূর্ণ উন্মোচিত হয়নি। তাই এ বিষয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সমন্বয়ের প্রত্যাশী আমরা সবাই। মহাকাশে ছড়িয়ে পড়তেই হবে। আমার মনে হয় এটা মানবতার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি।
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
আমিও এ বিষয়ে আপনার সাথে একমত। আমি ওয়েনবার্গের যুক্তি ব্যবহার করেই বলতে পারি, মানবশরীরে কি কি পরিবর্তন ঘটে মহাশূন্যে থাকলে বা চাঁদে কম অভিকর্ষে কিছুদিন থাকলে শারীরবৃত্তীয় কি কি পরিবর্তন ঘটে তা পর্যবেক্ষণ করা মহাকাশে বা চাঁদে না গেলে সম্ভব নয়।
দ্বিতীয়ত, অন্য গ্রহে আস্তানা তৈরী করার এগুলো প্রথম পদক্ষেপ। কোনো কালে পৃথিবীতে রসদ ফুরিয়ে গেলে আমাদেরও এখান থেকে হাঁটা লাগাতে তো হবেই।
তৃতীয়ত, ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় লোকজনের বিনোদন যুগিয়ে টাকা নিয়ে তারপরে তা দিয়ে গবেষণার কাজ চালানো অনৈতিক নয়।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
এক্কেবারে খাঁটি কথা বলছেন।
ভবিষ্যতে মহাকাশ ভ্রমণ সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হতে পারে। এই ব্যবসাকে আমি ইতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখি। ব্যবসা থেকে যে লাভ হবে তা দিয়ে গবেষণা কাজ চালানো যায় সহজেই।
আমেরিকার অনেক প্রাইভেট সংস্থাই নাসাকে ব্যক্তি মালিকানায় ছেড়ে দিতে বলছে। আমার মতে, নাসাকে ব্যক্তি মালিকানায় না ছেড়ে নাসার একটা আলাদা বিভাগ খুলতে যার কাজ হবে মহাকাশ ব্যবসা। এই ব্যবসার টাকা দিয়ে নাসা অতি ব্যয়বহুল গবেষণাগুলো করতে পারবে। সরকারের উপর চাপও কমবে, রাজনীতিতে নাসার ব্যবহারও কমবে।
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
আর টাকা তো আসবে পৃথিবীর কিছু হোমরা-চোমরা বড়লোকদের কাছ থেকে। তাই গরিবের টাকা লুটে নেবার চিন্তাও নেই, মধ্যবিত্তের ট্যাক্সের টাকার বালাই নেই। তবে এরকম আরো পঞ্চাশ-একশো বছর চললে এটা না আবার মধ্যবিত্তের স্ট্যাটাস সিম্বলে না পরিণত হয়। আমার ভাবলেই অবাক লাগছে ...
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
ওয়াইনবার্গের "দ্য ফার্স্ট থ্রি মিনিট্স" বইটির বাংলা অনুবাদ বেরিয়েছে। অনেকেই হয়তো অনুবাদের বিষয়টা জানেন না। বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশন গত বছর বইটি প্রকাশ করেছে। ইংরেজি বইটি পড়িনি। বাংলাটিই পড়লাম। ভালো লেগেছে খুব। আ ব্রিফ হিস্টরি অফ টাইমে টেকনিক্যাল বিষয় খুব একটা আলোচিত হয়নি। কিন্তু এই বইতে মহা বিস্ফোরণের পর প্রথম তিন মিনিটের ঘটনাগুলো টেকনিক্যাল বিষয় সহই আলোচিত হয়েছে। একটা অতি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বলা যায় একে।
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
বাঃ, ভাল তথ্য দিলেন।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
জ্ঞানীদের ভীড়ের মধ্যে আইসা তো ফাঁইসা গেলাম...
সব কথা-বার্তা এন্টেনার উপর দিয়ে যাইতেছে
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
ঠিকমত টিউনিং কর। তাইলেই তো হয়। ঠিকমত টিউনিং করলে ধরা যায় না এমন কোন সিগনাল মহাবিশ্বে আছে না-কি।
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
আমি তো গীটার টিউনিং করতে জানি...
গীটার টিউনিং করলে হইব নাকি '' শাওন রাতে যদি...''
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
নতুন মন্তব্য করুন