মেন্ডেল আর মরগ্যান একটা বৈজ্ঞানিক বিবাদের মীমাংসা করলেন। ডারউইনের তত্ত্বে যেটুকু ফাঁক ছিল - তাও আপাতত বন্ধ হয়ে গেল। বিজ্ঞানীদের কাছে একটা ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে দেখা দিল যে বংশবৃদ্ধির সময় ক্রোমোজমের ক্রসওভারের ফলে যে জিন-বিনিময় হয় তার ফলে একাধিক অপত্যের মধ্যে বিভিন্ন পার্থক্য দেখা দেয়। আর এই পার্থক্যের মধ্যে যে বৈশিষ্ট্যটি বেঁচে থাকার জন্য সবথেকে উপযোগী - সেটির অধিকারী জীব বেশী করে আরো বংশবৃদ্ধি করে। ফলে, সেই বৈশিষ্ট্যটি ধীরে ধীরে প্রজাতির মূল বৈশিষ্ট্যরূপে দেখা দেয়। তাহলে বিবর্তন হল প্রজাতির মধ্যে 'ভাল জিন' থাকা প্রাণীদের জন্য অন্য প্রাণীদের সরিয়ে জায়গা বানিয়ে নেবার গল্প - যাকে বলে যোগ্যতমের উদ্বর্তন। ডারউইন তার বই ওরিজিন অব স্পিসিস-এ সুচতুর ভাবে মানুষের বিবর্তনের বিষয়টা এড়িয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু বিজ্ঞানীরা বুঝেছিলেন এই প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব মানুষের ক্ষেত্রেও খাটে। ডারউইন তার নিজের শেষ বই "দ্য ডিসেন্ট অব ম্যান"-এ লেখেন -
"দুর্বলকে সাহায্য করা ভাল, কিন্তু এটাও মনে রাখা উচিত যে দুর্বল যদি বেঁচে থেকে বংশবৃদ্ধি করতে থাকে তাহলে সমাজে দুর্বলের সংখ্যা বেড়ে যায়। এর একটিই প্রতিরোধের উপায়। সমাজের শারীরিক বা মানসিকভাবে দুর্বলদের বিবাহ নিয়ন্ত্রণ করা অথবা তাদের একেবারেই বিবাহের অনুমতি না দেওয়া।"
বিজ্ঞান নিয়ে অনেকক্ষণ আলোচনা হল। এবার দেখে নেওয়া যাক সমাজের অবস্থা তখন কেমন ছিল - মানুষ জিন নিয়ে কি ভাবত, কি আশার আলো দেখতে পেত ভবিষ্যত নিয়ে। তার চেয়েও বড় কথা রাজনীতিবিদেরা এ নিয়ে কি ভাবতেন। জিন মানুষের গুণাবলী নিয়ন্ত্রণ করে - এই চিন্তা তাদের কি কি সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করেছিল। শিল্পায়নের পর থেকেই ইউরোপে সমাজে গরিব-বড়লোক বিভেদ স্পষ্ট হয়ে দেখা দিয়েছিল। এক শ্রেণীর মানুষ ছিল গরিব, বস্তিবাসী, অশিক্ষিত - যাদের মনে করা হত তারা রাষ্ট্রের কল্যাণে বেঁচে আছে। আরেকদল শিক্ষিত , ভদ্র, মিতভাষী আর নিজের উন্নতিতে সচেষ্ট। অথচ, সমাজে গরিবদেরই বেশী সন্তান-সন্ততি, ঠিক যেমন এখনো হয়। এবার ডারউইন-মেন্ডেলের তত্ত্ব একসাথে এই সমাজের ওপর প্রভাব চিন্তা করলে দেখা যায় এই অশিক্ষিতরা তাদের কুশিক্ষার কারণ তাদের 'খারাপ জিন', আর উল্টোদিকে নীতিবান উপরতলার লোকজনের 'ভাল জিন' তাদের ভাল করে। কিন্তু সন্তানদের মধ্যে যেহেতু পিতামাতার জিন আসে, তাই সমাজের নিচুতলায় বেশী করে সন্তান উৎপাদন হলে সমগ্র সমাজ আস্তে আস্তে 'খারাপ জিন'-ওয়ালা মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলবে। এভাবে চললে সমাজের অবনতি অনিবার্য। মেন্ডেল-ডারউইনের নীতির এই সামাজিক প্রয়োগের নাম 'সোসাল ডারউইনিসম' বা সামাজিক ডারউইনবিদ্যা। এই ধারণাটা যিনি প্রথম প্রস্তাব দেন তিনি হলেন হার্বার্ট স্পেন্সার - যার বিষয় ছিল বিবর্তনগত প্রগতি (Evolutionary Progressivism)। উনি বলেন যে প্রতি ব্যক্তিই প্রগতির একটি একক, আর এই প্রগতি আসে সমাজের মধ্যে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে।
এই সোসাল ডারউইনিজমের ধারণাকে আরো একধাপ আগে নিয়ে যান যিনি ছিলেন তিনি হলেন ডারউইনেরই এক নিকটাত্মীয় - ফ্রান্সিস গাল্টন। উনিও সামাজিক প্রগতির সাথে সোসাল ডারউইনিজমের সম্পর্ক বিশ্বাস করতেন। ১৮৬৯ সালে প্রকাশিত "হেরিডিটারি জিনিয়াস" বইতে তিনি লেখেন যে প্রতিভা বা ট্যালেন্ট হল উত্তরাধিকার সূত্রে পিতামাতার থেকে প্রাপ্ত একটি বৈশিষ্ট্য। তিনি এজন্য অনেক পরিবারের ঐতিহাসিক তথ্য সংগ্রহ করে দেখালেন এক পরিবারের লোকজন একই পেশায় ক্রমাগত সফল হচ্ছে। ১৮৭৪ সালে তার পরবর্তী বই "ইংলিশ মেন অব সায়েন্স - নেচার ভার্সাস নার্চার"-এ উনি ব্যবহারিক জিনতত্ত্বের সূচনা করেন আর সিদ্ধান্ত নেন যে যমজ বাচ্চাদের নিয়ে গবেষণা করেই জানা সম্ভব যে মানুষের বেড়ে ওঠার ওপর পরিবেশ আর জিনের প্রভাব কতটা। সবশেষে, ১৮৮৩ সালে, ডারউইনের মৃত্যুর পরে, গাল্টন সামাজিক ডারউইনবিদ্যাকে হাতিয়ার করে এক সামাজিক বিপ্লবের ডাক দেন। একটা নতুন টার্ম ব্যবহার করেন তিনি - ইউজেনিক্স (Eugenics)। যার মানে - "ক্ষণজন্মা" ("Good in birth")। গাল্টন ছিলেন এককথায় বহুমুখী প্রতিভা। জীববিদ্যার সাথে সাথে পরিসংখ্যানেও তার অসম্ভব দখল ছিল। সে কারণেই হয়ত সমসাময়িক বিজ্ঞানীদের মধ্যে তার গ্রহণযোগ্যতা খুব বেশী ছিল। ফলাফল - ইউজেনিক্স খুব দ্রুতই বিজ্ঞানীমহলের সমর্থন আদায় করে নেয়।
ইউজেনিক্স ছিল এক অর্থে গাল্টনের গবেষণার অনুসিদ্ধান্ত। প্রতিভা, ভাল বা খারাপ গুণ যদি পরিবার বা জিন-নির্ভর হয় তাহলে সমাজের প্রগতির একমাত্র উপায় হল প্রতিভাবানদের বেশী সন্তান উৎপাদনে উদ্বুদ্ধ করা, আর 'খারাপ'-দের নিরুৎসাহিত করা। এভাবেই সমাজ থেকে খারাপ জিন দূর করা সম্ভব - প্রগতিও আনা সম্ভব। খুব সহজেই বামপন্থীদের সমর্থন আদায়ে সমর্থ হয় এই তত্ত্ব। এর সমর্থকদের মধ্যে ছিলেন জর্জ বার্নার্ড শ, যিনি লেখেন - "এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে একমাত্র কোনো ইউজেনিক ধর্মই আমাদের সভ্যতাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে"।
ইউরোপে যে সময়ে গাল্টনের মত মেনে সবাই প্রতিভাবান বা উঁচুতলার মানুষদের বেশী করে সন্তান নিতে বলেছে, সেই একই সময়ে আমেরিকায় এই একই বিপ্লব উলটোপথে হেঁটে সমাজের নিচুতলার মানুষদের সন্তান উৎপাদন কমানোর দিকে নজর দেয়। ১৮৭৫ সালে রিচার্ড দুগডাল নিউ-ইয়র্কের একটি গোষ্ঠী নিয়ে আলোচনা করে জানান যে এই গোষ্ঠী প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এই একই ভাবে জোচ্চুরি, ছিনতাই আর রাহাজানি করে আসছে। কিন্তু এই ধারণাকে আরো একধাপ এগিয়ে নিয়ে যান চার্লস ড্যাভেনপোর্ট। ১৯১০ সালে লং আইল্যান্ডে বিখ্যাত কোল্ড স্প্রিং হার্বার ল্যাবরেটরির ডিরেক্টর হিসাবে উনি শুরু করেন প্রথম ইউজেনিক রেকর্ড অফিস। এই অফিসের কাজ ছিল জিন-নির্ভর বৈশিষ্ট্য (কুষ্টরোগ থেকে আরম্ভ করে অপরাধপ্রবণতা) সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা ও তাদের রেকর্ড লিপিবদ্ধ করে রাখা।
ড্যাভেনপোর্ট নিজেও একরকম ইউজেনিক চিন্তাধারায় বিশ্বাসী ছিলেন। উনি বিশ্বাস করতেন মেয়েদের পর্যবেক্ষণ আর সামাজিক বিদ্যা ছেলেদের চেয়ে ভাল - তাই উনি এই কাজে শুধু মেয়েদেরই নিযুক্ত করতেন। ১৯১১ সালে প্রকাশিত "হেরিডিটি ইন রিলেশন টু ইউজেনিক্স" বইতে তিনি দেখানোর চেষ্টা করেন যে সমস্ত দক্ষতাই পরিবার-ভিত্তিক - সেটা গানবাজনা থেকে শুরু করে বোট-বানানো পর্যন্ত যেকোনো দক্ষতার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। উনি এমনকি আরো একধাপ এগিয়ে পদবীর সাথে চেহারার সম্পর্কস্থাপনের প্রচেষ্টাও করেন। একটি বিশেষ পদবীধারী লোকজন যে "বলিষ্ঠ, চওড়া কাঁধ, মোটা ভুরু আর সঙ্গীতপ্রেম"-এর অধিকারী হয়, ওনার গবেষণার ফল তাই প্রমাণ করার চেষ্টা করে।
এদিকে ইউজেনিক্স কিন্তু আমেরিকায় ক্রমাগত জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। স্থানীয় ইউজেনিক সোহাইটি তৈরী হয় - যারা "উন্নত পরিবার"-দের পুরস্কৃত করত, উৎসাহ দিত আরো বেশী করে সন্তান উৎপাদনে। অপর পাশে ছিল "অনুন্নত"-দের জোর করে জন্ম-নিয়ন্ত্রণ। ১৯০৭ সালে ইন্ডিয়ানা স্টেটে প্রথম পাশ করা হয় বন্ধ্যাত্বকরণ আইন, যার ফলে অপরাধী, জড়বুদ্ধি, ধর্ষক বা চূড়ান্ত বোকাদের সমাজের স্বার্থে বন্ধ্যাত্বকরণ করানো বাধ্যতামূলক করা হল। এই আইনের বিরুদ্ধে কোর্টে কেসও উঠল, কিন্তু ১৯২৭ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ব্যাপারটা পাকা হয়ে যায় - "সমাজের যারা বোঝা, তাদের বাচ্চারাও সমাজের বোঝাই হবে। সুতরাং তাদের পৃথিবীতে না আসার ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের অন্যতম কর্তব্য"। ১৯৪১ সাল পর্যন্ত আমেরিকায় এরকম ষাট হাজার বন্ধ্যাত্বকরণ করানো হয়েছিল। এই ঢেউ গিয়ে লাগে নাৎসি জার্মানী ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলোতেও। সেখানেও চলে আইন করে নিচুতলার ওপর অত্যাচার - বলপূর্বক বন্ধ্যাত্বকরণ।
এরপরে ইউজেনিক্সের সাথে আরো একটি মাত্রা যোগ হয় - বিজ্ঞানসম্মত বর্ণবিদ্বেষ। আসলে, ইউজেনিক্সের মধ্যে বর্ণবিদ্বেষের সব উপাদানই ছিল আগে থেকেই। শুধু দরকার ছিল অগ্নিতে ঘৃতাহুতি। সেই কাজটাই করলেন আইনজীবি ম্যাডিসন গ্রান্ট। ১৯১৬ সালে প্রকাশিত "দ্য পাসিং অব গ্রেট রেস" বইতে তিনি দাবী জানালেন নর্ডিকরা (উত্তর-ইউরোপিয়ান - ম্যাপ দেখুন, নর্ডিকদের এলাকা লাল রঙে) জাতিগতভাবে শ্রেষ্ঠ, নিগ্রো, এশিয়ান, এমনকি বাকি ইউরোপিয়ানদের চেয়েও। উনি এর ভিত্তিতে নর্ডিক নয় যারা তাদের আমেরিকায় অভিবাসনের বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করলেন। এ জন্য উনি একটি সংস্থায় যোগ দেন - আমেরিকান ইমিগ্রেশন রেস্ট্রিকশন লীগ নামে। এর আগে উনি গ্লাটন সোসাইটিও প্রতিষ্ঠা করেন, ড্যাভেনপোর্টের সাথে মিলে। এই সময়েই আই-কিউ টেস্ট 'প্রমাণ' করে দিল যে আমেরিকায় অভিবাসীদের মধ্যে ৮০ শতাংশই সাধারণ আমেরিকানদের তুলনায় বুদ্ধিবিদ্যায় নিচুমানের। মজার কথা, এই আই-কিউ টেস্টগুলোতে অধিকাংশ প্রশ্নই হত জ্ঞানভিত্তিক, তাও প্রশ্ন হত ইংরেজীতে। আমেরিকা সংক্রান্ত জ্ঞান আমেরিকানদের বেশী থাকাই যে স্বাভাবিক - এই নিশ্চিত সত্যকে উপেক্ষা করেই প্রচার এগিয়ে চলল। এই কাজে গ্রান্টের সহযোগী ছিলেন হ্যারি লাফলিন নামক আরেক বর্ণবিদ্বেষী বৈজ্ঞানিক। গ্রান্ট নিজে রুজভেল্টের খুব নিকট বন্ধু ছিলেন।
যাহোক গ্রান্টের বই পাঠকমহলে খ্যাতি পেতে সময় নেয় নি। ১৯৩৭ সালের মধ্যে বইটির ১,৩৭,০০০ কপি বিক্রি হয়েছিল, যা তৎকালীন হিসাবে অকল্পনীয়। খ্যাতির সাথে সাথে বইয়ের জনপ্রিয়তাও বাড়তে থাকে। বই অনূদিত হতে থাকে বিভিন্ন ভাষায়। ১৯২৫ সালে জার্মান ভাষায় অনূদিত হয় বইটি আর এটা প্রভাবিত করে এক রাষ্ট্রনায়ককে - অ্যাডলফ হিটলার। হিটলার নিজে গ্রান্টকে ব্যক্তিগত চিঠিতে পরিষ্কার লেখেন - "এই বইই হল আমার বাইবেল"।
গাল্টন যে কাজ শুরু করে গিয়েছিলেন সেই কাজকেই অন্য মাত্রা এনে দিলেন গ্রান্ট। আর এই প্রথমবারের জন্য এই বর্ণবিদ্বেষী তত্ত্ব স্থান করে নিল এক একনায়কের মস্তিষ্কে। আর সাথে ছিল হিটলারের সহযোগী কিছু ভণ্ড বিজ্ঞানীও। শুরু হল ইউজেনিক্সের নাৎসী ভার্সান। ১৯৩৩ সালে ক্ষমতায় আসার পরেই হিটলার আমেরিকানদের অনুকরণে আইন প্রবর্তন করলেন "জিনগত ত্রুটি নির্মূল" করার জন্য। মাত্র তিন বছরের মধ্যেই ২,২৫,০০০ মানুষের বন্ধ্যাত্বকরণ করানো হল। এই বিষয়ে শুরু হল এক বিশেষ ধরণের কোর্ট - হেরিডিটি কোর্ট। এর সাথে ছিল সমাজের 'ভাল'দের আরো বেশী করে সন্তান নিতে উৎসাহী করে তোলা। ১৯৩৬ সালে আইন করে তাদের সন্তানসম্ভবা স্ত্রীদের জন্য ভাল থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হল। ইহুদীরা নর্ডিক ছিল না, তাই তাদের সাথে মুল জার্মানদের বৈবাহিক সম্পর্ক নিষিদ্ধ করা হল - যাতে জার্মান জিন ইহুদীদের সাথে মিশে অনুন্নত সন্তানের জন্ম না দিতে পারে। নাৎসীদের রাজত্বের শেষদিকে দেখা গেল মোট ৪ লক্ষ মানুষের বন্ধ্যাত্বকরণ করা হয়েছে আর স্থাপিত হয়েছে ২০০ হেরিডিটি কোর্ট।
দশকের শেষের দিকে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে দেখা গেল এভাবে একটা বড় দল তৈরী হয়ে গেছে যাদের বন্ধ্যাত্বকরণ করা হয়েছে অথচ তারা কারাগারে রাষ্ট্রের পয়সায় খেয়ে চলেছে। (ছবিতে - প্রচার চালানো হচ্ছে যে জিনগত রোগগ্রস্তদের বাঁচিয়ে রাখতে তার জীবনকালে রাষ্ট্রের ৬০০০০ মুদ্রা খরচ হয়) তাই নাৎসীরা বুঝে গেলেন বন্ধ্যাত্বকরণ হয়ত অনুন্নত অপত্যের হাত থেকে মুক্তি দেয়, কিন্তু এক প্রজন্মের কিছু 'অপদার্থ'-কে জন্ম দেয় যারা সরকারি পয়সায় জীবনযাপণ করে। তাই সরকারি হাসপাতালে প্রশ্নপত্র বিলি করা হল, এদের পরীক্ষা নেবার জন্য। পরীক্ষায় ৭৫,০০০ লোক পাশ করতে পারল না। তাদের চিহ্নিত করা হল "খাদ্য ধ্বংসকারী" বা "বেঁচে থাকার অনুপযুক্ত" বলে। কিছুদিনের মধ্যেই নাৎসী-বিজ্ঞানীরা এই সংজ্ঞার পরিধি বিস্তৃত করে সমস্ত ইহুদী আর জিপসীদের এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করলেন। আর এদের পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে তৈরী হল গ্যাস চেম্বার - গণহত্যার মারণাস্ত্র। এইভাবে, গ্রান্টের তত্ত্বের মধ্যে দিয়ে যে বর্ণবিদ্বেষ শুরু হয়েছিল, কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে গিয়ে তাই এক হত্যালীলার আকার ধারণ করল। জার্মান জাতিকে সর্বশ্রেষ্ঠ বানানোর জন্য দেশের মধ্যের 'অনুন্নত'-দের সরিয়ে দেবার এই মৃত্যুছকই ইউজেনিক্সের শেষ "অবদান"।
মন্তব্য
আগের পর্ব গুলো পড়িনি। চমৎকার লাগল! বাকিগুলো পড়ে জানাবো।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
থার্ড ওয়ার্ল্ডে বর্তমানে যে সকল জন্মনিবন্ধীকরণ পিল এবং ব্যবস্থা চালু
সেগুলো নাকি ধীর গদির বন্ধ্যাত্বকরণ প্রক্রিয়ারই অংশ
দুই জেনারেশন এই পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করলে তৃতীয় জেনারেশনের ফার্টিলিটি নাকি মাত্র ২০-২৫% এ গিয়ে পৌঁছায়
এটাও কি এক ধরনের ইউজেনিক্স?
আপনি বলছেন,
দুই জেনারেশন এই পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করলে তৃতীয় জেনারেশনের ফার্টিলিটি নাকি মাত্র ২০-২৫% এ গিয়ে পৌঁছায়।
না, এটা সম্ভব নয়। জন্মবিরতীকরণ পীলের প্রভাব জেনেটিক হতে হলে প্রথমত, একে জেনোমে মিউটেশন ঘটানোর ক্ষমতা রাখতে হবে, দ্বিতীয়ত ঐ মিউটেশন জার্মলাইন সেলে ঘটতে হবে কোন সোমেটিক সেলে হলে হবে না। জন্মবিরতীকরণ পীল কোন মিউটাজেন নয় এইচ আই ভি বা অন্য যে কোন রেট্রোভাইরাসের মত, বস্তুত ডিএনএ এর সাথে এর কার্যপ্রাণালীর কোন সম্পর্কই নেই।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
সরাসরি সূত্র এই মুহূর্তে আমার কাছে নেই
তবে এইসব বিষয় নিয়ে কাজ করে এমন অনেকের কাছেই শুনেছি অনেকবার
ঘটনাটা ঘটে নাকি মা থেকে মেয়ে হয়ে তার মেয়ে পর্যন্ত
কোনো মেয়ে পিল ব্যবহার করলে তার যে মেয়ে হয় তার উপরে এর প্রভাব নাকি থাকে। যদি সেও আবার পিল ব্যবহার করে এবং এর পরে তার মেয়ে হয় তাহলে তার প্রভাব গিয়ে তার উপর পড়ে
এখন তো আর ইউজেনিক্সকে দায়ী করা যাবে না। কারণ আদতে ইউজেনিক্স ই সত্য নয়। আসলেই যদি জন্মনিরোধের বিষয়টা সত্য হয় তাহলে এর কারণ জিনের মাধ্যমে পাওয়া সম্ভব। অবশ্য এটা সত্যি কি-না তা আগে জানা দরকার। বিষয়টা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ জন্মবিরতিকরণ আবশ্যক, আবার মানুষের প্রজনন ক্ষমতা বাঁচিয়ে রাখাও আবশ্যক।
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
ডারউইন থেকে ডাবল হেলিক্স সিরিজের এই পর্বটা সব থেকে ভাল লেগেছে। অসাধারণ। ইউজেনিক্স বিষয়ে তো কিছু জানতাম না। নতুন একটা নয়, প্রায় শ'খানেক চোখ গজালো।
হিটলারের বর্ণবিদ্বেষ মানব ইতিহাসের অন্যতম জঘণ্য অধ্যায়। এর মূলেও যে ইউজেনিক্স আছে তা জানতাম না। এবার ভাবতে পারছি, বিজ্ঞান সমাজকে কতোটা প্রভাবিত করে। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই বোধহয় বিজ্ঞান দ্বারা সরাসরি প্রভাবিত হতে শুরু করেছে সমাজ। কারণ অন্য সব প্রভাব ক্ষীণ হয়ে আসছে।
ম্যাডিসন গ্রান্টের নামটাও জানলাম। তার নাম আর ভোলা যাবে না। এভাবে সমাজকে বিপথে নিয়ে যেতে পারে বিজ্ঞানীরা। বিষয়টা আমাদের মনে রাখতে হবে সব সময়। সমাজকে বিজ্ঞান কিভাবে প্রভাবিত করবে তা সবার আগে ভাবতে হবে। এভাবে চূড়ান্ত সভ্য হতে পারে মানুষ।
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
কেন ইউজেনিক্স একটি বিফল ধারণা।
এটা ভুল ধারণা যে ইউজেনিক্স জেনেটিক ভুলগুলো দুর করতে পারে একটি পপুলেশন থেকে। কারণ, একটি ডিলিট্রিয়াস ট্রেইট এক্সপ্রেস হবে তখনই যখন কিনা ঐ লোসাইতে অর্গানিজম হোমোজাইগোট রিসেসিভ, ঠিক? কেননা ডমিনেন্ট হলে অর্গানিজম মরেই যেত বা প্রতিবন্ধী হতো। হার্ডি ভেইনবার্গ ল আমাদের বলছে একটি সিলেক্সন প্রেসার বহির্ভুত হাইপোথেটিকাল জিনের মাত্র দুটি অ্যালিলের ক্ষেত্রে হোমোজাইগোট ডমিনেন্ট জিনোটাইপ ফ্রিকোয়েন্সি p^2, হোমোজাইগোট রিসেসিভ জিনোটাইপ ফ্রিকোয়েন্সি q^2 এবং হেটেরোজাইগোট জিনোটাইপ ফ্রিকোয়েন্সি 2pq হবে. অর্থাৎ, ইউজেনিক্স যদিও সফল হয় একটি ডিলিট্রিয়াস অ্যালিলের হোমোজাইগোট রিসেসিভ q^2 জিনোটাইপ নির্মুল করতে, তারপরও 2pq বা হেটেরোজাইগোট জিনোটাইপে ঐ ডিলিট্রিয়াস অ্যালিল জিনপুলে ঠিকই থেকে যাবে। অর্থাৎ, মেন্ডেলিয়ান জেনেটিক্স অনুসারে তারপরও ভবিষ্যতে পপুলেশনে ডিলিট্রিয়াস রিসেসিভ অ্যালিল হোমোজাইগোট জিনোটাইপ রুপে দেখা যাবে। তাহলে কি আমরা ঐ 2pq হেটেরোজাইগোটদেরও ইউজেনিক্সের আওতায় আনবো? না, কেননা তাহলে আমাদের পুরো পপুলেশনই এর আওতায় পড়বে যেহেতু আমরা প্রত্যেকেই গড়ে ৫ টি ডিলিট্রিয়াস রিসেসিভ অ্যালিল বহন করছি, বলাই বাহুল্য এটা আমরা বহন করছি হেটেরোজাইগোট লোসাইতে, তা না হলে আমরা মারাই যেতাম বা প্রতিবন্ধী হতাম। ইউজেনিক্স যে সময়কার কথা তখন আমরা এতটা ভালো জেনেটিক্স জানতাম না, জেনেটিক্সে আমাদের জ্ঞান বাড়ার সাথে সাথেই তাই ইউজেনিক্স একটি ভ্রান্ত ধারণা রুপে আবির্ভুত হয়েছে। আমার বক্তব্য বেশী কঠিন মনে হলে অনুরোধ করবো উইকিপিডিয়াতে টার্মগুলো দেখে নিন। সব টার্মগুলো লিখতে গেলে এটা আরেকটি পোস্ট হয়ে যেত।
নতুন মন্তব্য করুন